#জীবনের অন্যরঙ [৯ম পর্ব]
#আজিজুর রহমান
হে পবিত্র! আজিও সুন্দর ধরা, আজিও অম্লান
সদ্য-ফোটা পুষ্পসম, তোমাতে করিয়ানিতি স্নান!
জগতের যত পাপ গ্লানি
হে দরদী, নিঃশেষে মুছিয়া লয় তবস্নেহ-পাণি!
হাতে সময় অঢেল,হেঁটে যাওয়াই ভাল। পকেটের স্বাস্থ্য ভাল নয়। টিফিনের সময় কলেজ হতে বেরিয়ে পড়বে। অটো স্ট্যাণ্ডে এসে হোটেলে বেঞ্চে বসতেই এক থালা ভাত দিয়ে গেল। চেনা হয়ে গেছে এখন আর চাইতে হয়না। খাওয়া শেষ হলে দাম মিটিয়ে কলেজের পথ ধরে। আজ আর পাড়ায় যাবার সময় হবেনা।
বেলা ভাবির সঙ্গে অনেক গল্প হল। নিজের স্বামীর কথা বাইরে বলার পিছনে আত্মম্ভরিতা প্রকাশ পায়।উকিলী পেশায় রোজগার বাড়াতে এরকম তঞ্চকতা করতে হয়। বেলা ভাবির কথা শুনে অনিমান বিস্মিত হয়নি। শুনেছে ফ্লাট হলে তাকে পিছন দিকে একতলায় ঘর দেবে। থাকার জন্য ঘর দরকার সামনে হল না পিছনে তাতে কিছু যায় আসে না।
পরপর তিনটে ক্লাসের পর শুনল স্যার আসেনি, ফোর্থ পিরিয়ডে ক্লাস হবে না। কলেজ থেকে বেরিয়ে পড়ল।এত তাড়াতাড়ি বাসে ওঠা ঠিক হবে কিনা ভাবছে। আর কিছু চিন্তা না করে ভদ্রলোকের কার্ডের উপর লিখা ঠিকানা মতো বাসে উঠে পড়লো। গন্তব্যে পৌছে অনিমান নেমে পড়ল।
অনিমান সামনে তাকিয়ে দেখলো চারতলা বিল্ডিং। অনিমান হেঁটে অফিসের দোতলায় উঠে দেখল ভদ্রলোক বসে আছেন চেয়ারে। ভদ্রলোকের কার্ডটি দেখানোর ফলে সহজে ঢুকতে পারলো।
ভদ্রলোক আমাকে দেখে হেসে বললেন,কেমন আছো?
–আপনার দোয়ায় ভাল আছি আঙ্কেল।
অনিমানকে বসতে বলে নিজেও বসলেন।
–হাউ ইজ দা স্টাডি গোইং?
–ভাল।
–স্টাডি উইথ ইয়োর মাইণ্ড,মানির জন্য ফিকার করবেনা।
অনিমান মাথা চুলকায়। কিছু বলার আগেই অনিমানের সমস্যা ভদ্রলোক বুঝতে পেরেছেন।
–শোন আজ থেকে তুমি নিজের কাজে জয়েন করো। অফিসের কাজ তোমার মতো বুদ্ধিমানের জন্য সহজ হবে। পারবে না তুমি?
–পারব আঙ্কেল।
–তোমার আমার সম্পর্কের কথা কাউকে বলবে না।আঙ্কেল হাসলেন। আর একটা কথা ভাল করে খাওয়া দাওয়া করবে। টাকা পয়সা জরুরত হলে শরম করবে না। তুমি আমাকে আঙ্কেল ডেকেছো। তাই আমি তোমাকে নিজের ছেলের মতো দেখি।
— যাও এখন ডিউটিতে জয়েন কর। কলেজের পাশাপাশি কাজ করে যাবে।
অনিমান অফিসের অনেক বিষয় বুঝলো। আঙ্কেলর পরার্মশে জামাল ভাই তাকে অফিসের বিভিন্ন জিনিস বুঝালো। অনিমান মনে করেছিল অফিসের কাজ অনেক কঠিন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অনেকটা সহজ।
অনিমান রাস্তায় এসে দাড়ায়। আঙ্কেল তাকে বলেছে তুমি অনেক বড় হবে। নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকায়। এই জীবনে বড় হবার সুযোগ কোথায়?চাকরি করে করে অনেক অর্থ উপার্জন হয়তো সম্ভব কিন্তু খ্যাতি?বাস আসতে উঠে পড়ল। স্বপ্ন ছিল একদিন লেখক হবে। কয়েকটা গল্প এখানে ওখানে ছাপা হয়েছে। কিন্তু কজন তাকে জানে লেখক হিসেবে?
ভেবেছিল উপন্যাস লিখে ছাপা হলে হয়তো কিছু হতে পারে,সেইভেবে একটা উপন্যাস লিখেওছে। লেখার পর মাস খানেক ফেলে রেখে আবার চোখ বুলিয়ে ত্রূটি-বিচ্যুতি সংশোধন করতে হয়। ইচ্ছে আছে পরীক্ষার পর আবার লেখাটা নিয়ে বসবে।
চলার পথে ডাক্তার উকিল অধ্যাপক ইঞ্জনীয়ার কত রকমের লোক দেখা যায়। কারও ব্যবহার ভাল কারো ব্যবহার খারাপ তাছাড়াও তাদের ভিতর আরেকটা মন আছে যার খবর কজনই বা জানে। বাইরে থেকে দেখে হয়তো মনে হবে সুখী পরিবার। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ নেই কলহ নেই। দুজনে একসঙ্গে সিনামা যায় ছুটিতে বেড়াতে যায় কিন্তু একজন আরেকজনের কাছে যা যা প্রত্যাশা করেছিল সবই কি পেয়েছে?অন্য কোনো নারী বা পুরুষ দেখে কখনো মনে হয় নাকি এই মহিলা আমার স্ত্রী হলে বা এই লোকটি তার স্বামী হলে আরও ভাল হতো?
রাত বেশি হয়নি বাস থেকে নেমে অনিমান পাড়ার দিকে হাটতে লাগল। বেলা ভাবির কথা মনে পড়ল।
অনিমান বেলা ভাবি ও বিজয় ভাইয়ের সম্পর্কের কথা চিন্তা করলো। বেলা ভাবি অনিমানের কাছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ব্যাপারে কিছু একটা জানতে চেয়েছিল।
অনিমান বুঝতে পারেনি বেলা ভাবি কি সময় চাইছেন বিজয় ভাইয়ের কাছে। স্বামী স্ত্রী সারাদিন নিজেদের মধ্যে রোমান্টিকতা করে কাটাতে পারে না। দুই জীবন এক হলেও সেখানে দুইটা জগত থাকে। দুইটা জগত কখনো এক হতে পারে না। দুজন দুইভাবে বেড়ে উঠেন দুই সমাজে। তারা হুট করে নিজেদের জগতকে একটা জগত বানিয়ে ফেলবেন সেটা কি করে সম্ভব! বানানোর দরকারটাই বা কি। এসব অনিমানের ব্যাক্তিগত ভাবনা। তার ভাবনার সাথে বেলা ভাবির ভাবনা মিলতে নাও পারে। তবু অনিমান ভাবিকে বলেছে- ভাবি বিজয় ভাইয়ের একটা ভিন্ন জগত আছে। ভাইয়ের অর্থ বিত্তের পিছনে সেই জগতের ভূমিকা অনেক। তিনি সেই জগত থেকে সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে আপনার জগতে ঢুকে যাবেন তেমন আশা করা ঠিক হবে না। আবার আপনিও আপনার জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাইয়ের জগতে ঢুকে পরবেন সেটা সম্ভব নয়। আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি স্বামীর উচিৎ নয় স্ত্রীর নিজস্ব জগতে প্রবেশ করে তাকে ডিষ্টার্ব করা তেমনি স্ত্রীরও উচিৎ নয় স্বামীর জগতের খোঁজখবর নিয়ে তাকে বিব্রত করা। কারন প্রত্যেকটা জগতেরই কিছু অন্ধকার দিক থাকে যেগুলো সে আলোতে আনতে চায় না। অন্ধকার দিক না থাকলে সেটা কোন নিজস্ব জগতই হত না। এটুকু বলতেই অনিমান দেখলো বেলা ভাবি যেনো কেমন আতঙ্কিত হয়ে গেলেন। তবে তিনি নিজেকে সামলে নিলেন সাথে সাথেই। বললেন-তুমি দেখছি খুব কম বয়েসে অনেক কিছু জেনে গেছো অনি। কি করে জানলে অতসব? তিনি যেনো বেশ সিরিয়াস হয়েই প্রশ্ন করলেন কোন সিরিয়াস উত্তর পেতে। অনি হেসে দিলো ফান করার ভঙ্গিতে। বলল – ভাবি আমি ছোট মানুষ, বড়দের কথা কপি করে পেষ্ট করে দেয়ার মানসিকতা থেকে বের হতে পারিনি। কপিপেষ্ট শুনে আপনার মনে হচ্ছে আমি অনেক কিছু জেনে ফেলেছি। বেলা ভাবি সিরিয়াস ভঙ্গি থেকে বের হলেন না। তিনি যেনো গোপন কথা বলছেন তেমনি অনির দিকে বললেন- সত্যি অরি! তুমি তোমার বোধ থেকে বলোনি এসব? কারো কথাকে হবহু বলে দিয়েছো? তিনি সিরিয়াস ভঙ্গিতে অনিমানের কাছে উত্তর খুঁজছেন। অনি ফান মোড থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে সিরিয়াস হল। বলল-দেখুন ভাবি আমি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। আমাকে একা হাঁটতে হয় জীবন চলতে। বাবা মা আশা করেন কোন এক অলৌকিক উপায়ে আমি হুট করে বড় হয়ে যাবো। প্রতিপত্তি নাম যশ দিয়ে তাদের ধন্য করব। কিন্তু সত্যি এটাই যে হুট করে কিছু হয় না মানুষ। কিছু হতে হলে প্রচন্ড শ্রম দরকার হয়। সেই শ্রম দিতে নিজেকে শিখে নিতে হয়। নিজেই নিজের শিক্ষক হতে হয়। যখুনি নিজের শিক্ষক হবেন কেউ তখুনি তার বোধ জাগ্রত হবে। বোধ তখন আপনা আপনি অনেক কিছু বলে দেবে। আমার বোধ আমাকে অনেক কিছু বলে দেয়। সেগুলো মিথ্যা বা অসৎ কি না আমি জানিনা। কিন্তু এগুলি নিশ্চয় আমার ভেতরের কথা। এই কথাগুলো আমি অমান্য করতে পারি না। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন বেলা ভাবি অনির কথাগুলো। তারপর সুন্দর একটা হাসি দিলেন তিনি।
বিজয় ভাইয়ের চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক ভাল ছিল। অথচ বিজয় ভাইয়ের মন পাওয়ার জন্য কি বিচলিত মন ভাবির।
রাস্তায় বাতিস্তম্ভে টিমটিম আলো জ্বলছে। মাঝে মাঝে দু-একটা অটো হুউ-শ করে চলে যাচ্ছে। অনিমান নানা ভাবনা চিন্তার বোঝা নিয়ে রাস্তার ধার ঘেষে চলেছে। হঠাৎ কে একটা তার পাশ দিয়ে হনহন করে তাকে অতিক্রম করে। মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগে সায়ন্তা না?
–এই সায়ন্তা।
মেয়েটি চমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। অনিমান এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,তুমি আমাকে দেখোনি?
–না মানে দেখেছি,ভাবলাম তুমি যদি বিরক্ত হও?সায়ন্তা ঢোক গিলে বলল।
সায়ন্তা বারবার পিছন দিকে দেখছে,ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে অনিমান পিছন ফিরতে মনে হল কে যেন গলিতে ঢুকে গেল। সায়ন্তাকে জিজ্ঞেস করে,কে?
সায়নী লাজুক হেসে বলল,তোমার বন্ধু।
–হিমেশ?কোথায় গেছিলে?
–অনি তুমি এখন কোথায় থাকো? করিম ভাইয়ের দোকানে দেখিনা। ধরা পড়ে গেছে বুঝতে পেরে সায়ন্তা কাছে এসে জিজ্ঞেস করল।
-সরদার পাড়া। বললে নাতো কোথায় গেছিলে?
–সিনেমা। আর বোলো না ওর পাল্লায় পড়ে যেতে হল। খালি মারধোর ঘুষোঘুষি তুমি বলো ভাল লাগে?
তাহলে সঙ্গে হিমেশ ছিল? হিমেশ হিন্দী সিনেমার ভক্ত। সায়ন্তার কথা শুনে ভাল লাগল। আজকাল বাংলা সিনেমাগুলো হিন্দি সিনেমার অনুকরন কোনো চিন্তার খোরাক যোগায় না।
–মিতা তোমার খোঁজ করছিল, বলছিল কি সাজেশন দেবে তোমাকে। সায়ন্তা বলল।
মিতা ওর সহপাঠী,এক কলেজে পড়ে। হঠাৎ দুপুরের কথা মনে পড়ল।
–ও হ্যা তোমাদের আপুমণি সিল্ককের শাড়ি পরে লম্বাটে মুখ শ্যামলা রঙ ঘাড় অবধি ছাটা চুল–।
–কেকে?কৃষ্ণকলি –অনি উনি তোমার চেয়ে বয়সে বড়। সায়ন্তা মজা করে বলল।
–ঝাঃ তুমি ভীষণ ফাজিল হয়ে গেছো। অনিমান লাজুক গলায় বলল।
–দেখতে পারো ফাকা আছে।
–মানে?
–এখনো সিঙ্গেল আছে।
–খুব ইয়ার্কি হচ্ছে?
–হি-হি-হি।এমনি বললাম।
অনিমান ভাবে কৃষ্ণকলি বেশ সুন্দর নাম। মনে পড়ল সেই গানটা–“কালো হরিণ চোখ” “ময়না পাড়ার মাঠে চুলগুলি তার পিঠের পরে লোটে।” কৃষ্ণকলির চুল অবশ্য কাধ পর্যন্ত।
কথা বলতে বলতে করিম ভাইয়ের দোকানের কাছে চলে এল। অনিমান “আসি” বলে করিম ভাইয়ের দোকানে ঢুকে গেল। অন্য দিকে তাকিয়ে সায়ন্তা দোকান পার হয়ে গেল। হিমেশ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুভর সঙ্গে কথা বলছে। অনিমান গুনে দেখল দোকানে তাকে নিয়ে পাঁচজন।
সবাইকে লক্ষ্য করে অনি বলল,কে কে চা খাবি?
শুভ অবাক হয়ে তাকায়। হিমেশ অবাক হয়ে বলল,তুই কখন আসলি?
–কখন আসলাম বলব?
–থাক থাক বলতে হবেনা,তুই চা বল। হিমেশ কথাটা ঘোরাবার চেষ্টা করে।
–বেশ আমদানী হচ্ছে মনে হয়?বাশার মজা করে বলে।
অনি হাসে,ইতিমধ্যে করিম ভাই টেবিলে চা রেখে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে অনি জিজ্ঞেস করে, রাজু ভাই আসেনি?
–তুই শালা রাজু ভাইকে যা নেশা ধরিয়ে দিয়েছিস,সারাক্ষণ ওই নিয়ে পড়ে আছে।
রাজু ভাই চ্যারিটি ব্যাপারটাকে বেশ সিরিয়াসলি নিয়েছে দেখে অনির ভাল লাগে। বাজে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করার চেয়ে কিছু একটা করা ভাল।
সারাদিন ঘ্যাচর-ঘ্যাচর খট-খটাং শব্দে চলছে কাঠের কাজ। ঘরে ঘরে দরজা জানলা বসছে। তার মধ্যে চলছে অনিমানের পড়াশুনা। এখন কলেজ যেতে হয়না,হোটেলে খেতে যাওয়া ছাড়া অনিমান বাইরে বের হয়না। পাড়ার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। আম্মু বলেছিল যখন কোন সমস্যা হবে আম্মুর মুখ স্মরণ করতে। সমস্যা ছাড়াই নিবিড় নিশীথে মনে পড়ে আম্মুর মুখ। বিশেষ করে উজ্জ্বল একজোড়া চোখ যেন নির্নিমেষ তাকে দেখছে। পরীক্ষার কটাদিন কলেজ পর্যন্ত টানা অটোতে গেছে,আসার সময় অবশ্য কিছুটা হেটে এসে অটোতে উঠেছে। পরীক্ষার শেষদিন কলেজ থেকে বাইরে বেরোতে এক ঝলক শীতল বাতাস যেন সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিল।মায়ের কথা মনে পড়ল। তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ ছিলনা মায়ের। রেজাল্ট বেরোলে পাস করবে তাতে সংশয় নেই কিন্তু একটাই আক্ষেপ দেখে যেতে পারল না মা। রুমাল বের করে চোখ মুছল। কোথায় যাবে এখন,কাছাকাছি যাবার কোনো জায়গা নেই। আজ আর পাড়ায় যাবেনা বরং সরদার পাড়ায় গিয়ে একটা ঘুম দেওয়া যেতে পারে। মনে হয় কতকাল ভাল করে ঘুমোতে পারেনি। শেষ যেদিন পাড়ায় গেছিল দেখছিল, তিনতলা অবধি পিলার করে ঢালাই হয়ে গেছে। বেশ দ্রুত হচ্ছে বাড়ীটা। সায়ন্তা বলছিল মিতা নাকি সাজেশন দেবার জন্য তার খোঁজ করছিল।সাজেশন ছাড়াই ভাল পরীক্ষা হয়েছে। মিতা তাকে মনে রেখেছে ভেবে ভাল লাগে। মিতা অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে তার মতো একটা ছেলেকে মনে রাখা কিশোরী মনের উচ্ছ্বাস। একদিন মিতাই হয়তো হাসবে নিজের বোকামীর জন্য।
সিঁড়িঁ বেয়ে উপরে উঠে অবাক,যে ঘরে সে থাকতো সেই ঘরের দরজা বদলে নতুন দরজা, জানলায় পাল্লা লাগিয়েছে। পরক্ষনে অন্য একটা চিন্তা মাথায় উঁকি দিল। মিস্ত্রীরা তার ঘরে ঢুকেছিল?ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বাক্স খুলে দেখতে লাগল। জামা কাপড়ের নীচে মায়ের দেওয়া বালা জোড়া দেখে স্বস্তি। সব ঠিক আছে মিছেই শঙ্কিত হয়েছিল। এইবার মনে হচ্ছে ঘর।শুয়ে পড়ল মেঝেতে পাতা বিছানায়। আজ কি তাস খেলা হচ্ছেনা?নীচে কোনো সাড়াশব্দ নেই। পরমুহূর্তে ভুল ভাঙ্গে খেলা হচ্ছে কিন্তু হল্লাবাজির আওয়াজ কম। ঘরে দরজা জানলা ভেদ করে ঢুকতে পারছে না।এবার একটা প্রাইভেসি হয়েছে।
তাকে নিয়ে সবাই মজা করে, অনিমানের রাগ হয়না সেও মজা পায়। একসময় শুভ্রতাকে নিয়ে তাকে ক্ষ্যাপাতো,সেদিন সায়ন্তা ওদের কলেজের আপুকে নিয়ে ঠাট্টা করল। কি যেন নাম বলেছিল,বেশ নতুন ধরণের নাম। মনে পড়েছে, কৃষ্ণকলি। সায়ন্তা বলল,উনি এখনো সিঙ্গেল। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।
কাঠ চেরাইয়ের শব্দে অনিমানের ঘুম ভেঙ্গে গেল।জানলা দিয়ে ঘরে আলো এসে পড়েছে। অনেক বেলা হয়ে গেছে। বিছানায় উঠে বসে খেয়াল হয় কাল রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। অবশ্য এক-আধবেলা না খেলে তার কিছু যায় আসেনা। হাতে কোনো কাজ নেই তাও সকাল সকাল স্নান সেরে নিল। বাক্স থেকে তালা চাবি বের করে দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে।অটোস্ট্যাণ্ডে নেমে হোটেলে ভাত খেয়ে নিল। এবার কি করবে? পাড়ায় গিয়ে লাভ নেই,কাউকে সন্ধ্যের আগে পাওয়া যাবেনা। এলোমেলো ভাবতে ভাবতে বাস রাস্তায় চলে এল। একটা বাস আসছে সল্ট লেকে যাবে। কোনো কিছু না ভেবেই উঠে পড়ল।
পথিক পথ চলে,চলাই তার ধর্ম। খানা খন্দ চড়াই উৎরাই ভেঙ্গে চলতে থাকে। অন্তরালে এক বাজিকর সুতো ধরে বসে থাকে কখনো ডাইনে কখনো বায়ে সুতোর টানে গতি নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। এক সময় দু-বেলা খাওয়া জুটতো না নিয়মিত সেই অনিমানের হাতে এখন অনেক টাকা। সপ্তাহে অন্তত দু-দিন অফিসে কাজ করে থাকে। আঙ্কেল বলেছে সময় করে যেন তার অফিসে কাজ করি। সত্যিই আঙ্কেল অনিকে নিজের ছেলের মতো মনে করে। কাজের শেষে অনেকটা টাকাও দিল। আড়চোখে দেখে বুঝেছে রাজু ভাইয়ের ঠোঁটে কিছু প্রশ্ন চুলবুল করছে । অনিমান তার আগেই বলল,আমি জানি তোরা ভাবছিস এত টাকা কোথায় পেল?নানা প্রশ্নে জেরবার করে অনিকে অপমান করার জন্য জিভ চুলকাচ্ছে,তাই না?
–ফালতু কথা বলছিস কেন?তোকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেছে?বাশার ঝাঝের সঙ্গে বলল।
রাজু ভাই প্রশ্ন করার ভরসা পায়না। অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,তুই কি লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছিস?
চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে বিষম খায়,চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে। কেউ বুঝতে পারল না চোখে কেন জল এল। হেসে বলল,তুমি কিযে বলো,না-লিখলে আমি বাঁচব?
আবার মিথ্যে কথা বলল। গত তিনমাস এক লাইন লেখেনি শুধু অফিসের কাজ নিয়ে পড়েছিল। নানা ভাষা নানা ধর্ম নানা বয়সের মানুষকে সামলাতে হয়েছে–কোন বাছ বিচার করেনি। অনিমানের কাজ হলো কাস্টমারকে অফিসের পোডাক্টের প্রতি ভরশা সৃষ্টি করা। কাজ করতে করতে রোবটের মত হয়ে গেছে। চেহারায় জেল্লা এসেছে,পকেটে টাকা থাকলে শরীর মন ভাল থাকে। টাকার মাঝে এখন আর সুখ পায়না। অনিমান উপলব্ধি করেছে যেখানে ভালবাসা নেই সেখানে টাকা নিরস নিষ্প্রাণ।
তাদের বাড়ীটা চারতলা অবধি ঢালাই হয়ে গেছে। ব্রিক ওয়ার্ক শুরু হয়েছে। আলপনা ভাবি নাকি মাঝে মাঝে আসে। বাশারের কাছে শুনেছে,সুবীর নাকি তনিমার সঙ্গে প্রেম কেটে যাবার পর মিতার পিছনে ঘুর ঘুর করছিল। একদিন বাস থেকে নেমে বাসায় ফিরছিল মিতা। সুবীর জিজ্ঞেস করল,কোথায় গেছিল? মিতা বলল,জানা কি খুব জরুরী? সুবীর বলল,তুমি খুব বিরক্ত হয়েছো মনে হচ্ছে? মিতা বলল,বুঝেছো তাহলে? সুবীর ক্ষেপে গিয়ে বলল, অনির সঙ্গে কথা বললে তো বিরক্তি হও না? মিতা দাঁড়িয়ে পড়ে পিছন ফিরে হাসল বলল, অনির কথা কেন? তুলনা হয় সমানে সমানে। বাশারের কাছে এই গল্প শুনে গ্লানিতে ভরে যায় মন। মিতা জানে না যে অনিকে ও চিনতো সেই অনি আর নেই। এই গোলোক ধাঁধাঁ থেকে কোনোদিন বেরোতে পারবে অনিমান ভাবে না। অফিসের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে গেছে অনিমানের জীবন। আঙ্কেলের হাতে তার জীয়ন কাঠি। তার নড়াচড়া সব আঙ্কেলের নখ দর্পণে। বেরিয়ে আসার সামান্যতম ছিদ্র তার নজরে পড়েনা।অফিসে যে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে তাতে অনিমান একেবারে জড়িয়ে গেছে। অভাব মানুষকে খারাপ দিকে বেশি ধাবিত করে। আজ সে অন্ধকার জগতের গলিতে অনবরত হেঁটে চলেছে। কোথাও কোনো আলোর জ্বলক দেখা যায় না। কিভাবে অবিশ্বাস্য বাক নিল অনিমানের জীবন মুহূর্তাকাল আগেও কল্পনা করতে পারেনি।
পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। বন্ধু-বান্ধব সবাই পাস করেছে। সুবীর একটা বিষয়ে ব্যাক। বাশারও পাস করেছে। এত ঝামেলার পর অনার্স বজায় রেখেছে অনিমান,সবাই বলাবলি করছে।
একদিন করিম ভাইয়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে এমন সময় সবাইকে অবাক করে মিতা রাস্তা থেকে তাকে ইশারা করে ডাকল। অনিমান উঠে কাছে যেতে বলল,অনি আমি খুশি হয়েছি। অনিমানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এক মুহূর্ত না দাড়িয়ে হনহন করে চলে গেল। বিমর্ষ মুখে দোকানে ফিরে আসতে লক্ষ্য করল সবাই রুদ্ধশ্বাসে তাকে দেখছে কিন্তু কেউ কোনো প্রশ্ন করল না। অনিমান এক কোনে বসে তর্জনী দিয়ে টেবিলে আঁক কাটতে কাটতে ভাবতে থাকে নিজেই নিজের জীবনটাকে নষ্ট করে ফেললাম।নুনের পুতুলের মত সাগরের জল মাপতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে গেলাম সাগরে।
বাশার সান্ত্বনা দিল, অনি কি ভাবছিস ফালতু,ওর কথায় কিছু মনে করিস না মেয়েটা খুব ফাটুশ। ওর কথা ছাড়তো, সুবীরকেও একদিন যা-তা বলেছিল।
অনিমান ম্লান হাসে। ওরা জানেনা মিতা কি বলেছে আর কেনই বা তার মন খারাপ? কালকেই অফিসে কোনো বড় কাস্টমার আসবে। মিতা এমন কর্মকাণ্ডে আমার জড়িত হওয়া জানতে পারলে মুখটা কেমন হবে ভেবে শিউরে ওঠে।
রাজু ভাই চ্যারিটি থেকে মুখ ব্যাজার করে ফিরল।বেলা ভাবি প্রস্তাব দিয়েছিল,কৃতি ছাত্রদের সম্বর্ধনা দেওয়া হোক চ্যারিটির পক্ষ থেকে। শাকিল খাজা আপত্তি করলেন। বিষয়টা চ্যারিটির সঙ্গে মিলছে না।
শুভ জিজ্ঞেস করল,ডাক্তারবাবু এসেছিলেন?
–কোথায় কলে গেছিলেন,যাবার পথে ঘণ্টা খানেক কাটিয়ে গেলেন।
–উনি একা বললেই ত হবেনা। হিমেশ বলল।
–সকলে ডাক্তারবাবুর কথায় তাল দিল। বলল শুধু কৃতি নয় দুস্থ এবং কৃতি হতে হবে। রাজু ভাই কথাটা বলে বলল,ছাড় ওসব। সবাইকে অভিনন্দন, চা বল।সুবীরকে দেখছি না।
–রেজাল্ট বেরোবার পর থেকেই দোকানে আসছেনা।
–তাহলে আমাদেরই একদিন ওর বাসায় যেতে হয়। রাজু ভাই বলল। এত ভেঙ্গে পড়ার মত কি হল?
মোবাইল বাজতে অনিমান দেখল স্ক্রিনে অফিস লেখা। মোবাইল কানে লাগিয়ে বাইরে বেরিয়ে বলল,হ্যালো?
–অনিমান চৌধুরি?
–বলছি বলুন।
–কাল চারটি ক্লায়েন্ট হলে অসুবিধে হবে?
–সময়ে কুলোলে পাঁচটি-সাতটি আমার অসুবিধে নেই।
ওপাশ থেকে হাসি শোনা গেল। সহকারী ম্যানেজার শিরিন। আর কিছু বলবেন?
–খুব ব্যস্ত নাকি?
–না না বলুন।
–ক্লায়েন্টের সঙ্গে নিজের কথাও ভাবুন। স্যার কে আবার এসব বলবেন না–।
–ঠিক আছে রাখছি?
–আমার সঙ্গে কথা বলতে বিরক্ত হচ্ছেন?
–না তা নয়,আমি এখন রাস্তায়।
–তাহলে পরে ফোন করবো?
–কেন কিছু বলার আছে?
–আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে। অনিমান ফোন কেটে দিল।
ফোন রেখে দোকানে ঢুকতে বাশার জিজ্ঞেস করে,কে রে?
–ফালতু ফোন,কে জানে কোথায় নম্বর পেল।
–অতক্ষন কথা বললি কেন? গালি দিয়ে ছেড়ে দিবি তো।
— রাজু ভাই আজ আসি,একটু লেখালিখি করার আছে।
বাস রাস্তায় এসে একটা ভাল হোটেলে ঢুকল।ফুটপাথের হোটেলে এখন খায়না। রুটী কসা মাংসের ফরমাস করে। হঠাৎ নজরে পড়ল কাউণ্টারের কাছে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকলি আপু। অনিমানের বুঝতে অসুবিধে হয়না আপু এখান থেকে খাবার নিয়ে যান। একা মানুষ বাসা বাড়ীতে রান্নার পাট রাখেননি। টেবিলে খাবার দিতে খাওয়ায় মন দিল অনিমান। আপু সম্ভবত তাকে দেখেনি। না দেখাই ভাল, অফিসেতে যোগ দেবার পর থেকেই একটা স্বাতন্ত্র রক্ষা করে। বেশি লোকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় এড়িয়ে চলে। খাওয়া শেষ হতে দেখল আপু কাউণ্টারে নেই। মুখ ধুয়ে দাত খুচুনি নিয়ে কাউণ্টারে পয়সা মিটিয়ে অটো ধরার জন্য রাস্তায় এসে দাড়াল।
–তোমাকে কোথায় দেখেছি বলতো?
চমকে তাকিয়ে দেখল কৃষ্ণকলি আপু। কোথায় দেখেছি,ন্যাকামী হচ্ছে?বাইরে তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। অনিমান চিন্তিতভাবে বলল,ঠিক মনে করতে পারছি না।
–তুমি ওই দিকের অফিসে কাজ করো?
পথে এসো। ধীরে ধীরে খোলস খুলছে। অনিমানের হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেছে এমনভাবে বলল,ও হ্যা আপনি ওখানে নিজের অনৈতিক কাজের সমাধান করতে যান,তাই না?
–একদিন এসো না আমার কোয়ার্টারে,আলাপ করা যাবে।
–আমার অটো এসে গেছে। আসি?
অনিমান অটোয় চেপে বসল। মুখ বাড়িয়ে পিছনে দেখল কৃষ্ণকলি তাকিয়ে আছেন। অনিমান হাত নাড়ল। কৃষ্ণকলির মুখে হাসি ফোটে,তিনিও হাত নাড়তে লাগলেন।
অটো ছুটে চলেছে সর্দারপাড়ার দিকে। তিন চার মাস আগে যখন খাওয়া জুটতোনা তখন বাড়ী যেতে বললে অনিমান মুহূর্ত বিলম্ব করতো না। এখন সে আর আগের মত নেই,তার এখন অফিসে অনেক খাতির।
ফ্লাটের সামনে আসতে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল।ছুতোর মিস্ত্রীরা যথারীতি বিড়ী টানতে টানতে তাস খেলায় মগ্ন। অনিমান দোতলায় উঠে এল। তালা খুলে ঘরে ঢুকে হ্যারিকেন জ্বালল। কাল চারটি ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেল করার কথা বলল,কিন্তু রিপোর্টিং সময় কি সেই একই?এই ব্যাপারে তো কিছু বলেনি। সুইচ টিপে মোবাইলে সময় দেখল,সাড়ে-দশটা। উপন্যাস লেখা খাতাটা নিয়ে চোখ বোলাতে লাগল। রাজু ভাই বলছিল লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছে কিনা?নতুন করে লেখা শুরু করবে ভাবছে। এবারের গল্পের নায়িকা কৃষ্ণকলি। আপুর মনে অনেক বেদনা জমে আছে মনে হল। আপু অধ্যাপিকা, বিদুষী মনের যন্ত্রণা দুঃখ অনেক বেশি। কেবল চারপাশের সমস্যা সমাধান করেই মনে শান্তি আসেনা। চাহিদা থাকলেই বেদনা জমে। ময়নারা এদিক দিয়ে অনেক খুশি। তারা দিন কাজ করে দিনে খায়। এত টাকার পাহাড় জমিয়ে নিজের শান্তির ঘুম নষ্ট করে না।
রেখেছে সান্ত্রী পাহারা দোরে
আঁধার-কক্ষে জামাই-আদরে
বেঁধেছ শিকল-প্রণয়-ডোরে।
তুমি ধন্য ধন্য হে॥
.
.
.
চলবে….!
[পর্বটি কেমন হয়েছে নিজেদের মতামত জানাবেন।]