জীবনের অন্যরঙ পর্ব-৮

0
342

#জীবনের অন্যরঙ [৮ম পর্ব]
#আজিজুর রহমান

পেনশন বন্ধ,হাতে টাকা যা ছিল কলেজে ভর্তি হতেই সব প্রায় শেষ হয়ে এসেছে । যেন অকুল পাথারে পড়েছে অনিমান। অসীম শূণ্যতার মাঝে দাঁড়িয়ে অনিমান উপলব্ধি করল,মা তার জীবনে কতখানি জায়গা জুড়ে ছিল। করিম ভাইয়ের দোকানে আড্ডা নিয়মিত কলেজ যাওয়া আসা।

এক দিন কলেজ থেকে বাসায় ফিরে খা-খা ঘরের দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। নীচে দুটো দোকান ছিল দেখল তারা অন্যত্র চলে যাচ্ছে।তখনও মনে হয়নি দেখার আরও বাকী ছিল।আরেকদিন কলেজ থেকে সকাল সকাল ফিরে দেখল বাড়ীর ছাদ নেই। কয়েকজন মজুর বাড়ী ভাঙ্গছে। সেকি তার মালপত্তর? রাজু ভাই তখন অফিসে কি করবে সে?পাড়ায় কেউ নেই। কি করবে ভেবে পায়না। চোখে জল এসে গেল। মুন্না এসে বলল,ভাইয়া কই ফিকর নেহি। আপকা সামান জায়গা মত আছে।

–জায়গামত মানে?আমার বই-পত্তর অনেক জরুরী কাগজ–।
–সব আছে আপনি উঠেন। মুন্না বাইকে উঠতে বলল।

অনিমান দেখল আশেপাশে কেউ নেই। অসহায় চোখে বাইকের পিছনে চেপে বসে। তার সার্টিফিকেট কাগজ পত্র কোথায় নিয়ে গেছে এরা?বাইক ছুটে চলেছে দ্রুত গতিতে। পাড়া ছাড়িয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা পর একটা নির্মীয়মান চারতলা ফ্লাটের নীচে বাইক থামল। মিস্ত্রি মজুররা কাজ করছে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখল, দোতলায় একটা ঘরের দরজায় তালা ঝোলানো। তালা খুলে ঘরে ঢুকে দেখল অসম্পুর্ন মেঝতে পড়ে আছে তার টিনের স্যুটকেস।ঘরের এক কোনে গাদা দেওয়া তার বিছানা।
–খাট আলমারী?
–ঘর পরসন্দ হইসে?মুন্না জিজ্ঞেস করল।
কি বলবে অনিমান?খাট আলমারি কিছুই নেই।জানলায় পাল্লা নেই,বাথরুমই বা কোথায়?
মুন্না আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,যতদিন ঐ ফ্লাট শেষ না হবে আপনি নিশ্চিন্তে এখানে থাকবেন। ঘরের একদিকে দরজা খুলে বলল,এইটা বাথরুম আছে। একেবারে এটাচ আছে।
–খাট আলমারি?
— আপনার কাকার কাছে আছে। ইখানে অত জায়গা নেই।

চাবি হাতে দিয়ে মুন্না চলে গেল। অনিমান দরজা বন্ধ করে স্যুটকেস খুলে বসে। বালাজোড়া ঠিক জায়গায় আছে। তার লেখার ডায়েরী জিনিস পত্র গোছাতে গিয়ে একটা কার্ড হাতে পেল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে মনে পড়ল চিত্রাদের বাসায় যাবার পথে একজন ব্যক্তি কার্ডটা দিয়েছিল।

দুটো ক্লাস করা হল না বাসভাড়া গেল মনটা এমনিতেই খারাপ। খুব ক্ষিধে পেয়ে গেছে। চোখে জল চলে এল। মায়ের কথা মনে পড়ে। যখন থাকবো না কি হবে তোর?বউয়ের জন্য একজোড়া বালা রেখে গেছে। বউয়ের আশা করেনা,মায়ের দেওয়া স্মৃতি বিক্রির কথা চিন্তা করতে মনের সায় পায়না।

ময়নারা রান্না শুরু করে দিয়েছে। সন্তর্পনে উপরে উঠে গেল। পোশাক বদলে লুঙ্গি পরল। বোতল নিয়ে ঢক ঢক করে জল খেয়ে শুয়ে পড়ে। চোখ ছাপিয়ে জল এসে পড়ে।

খোলা জানলার ধারে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে মনে হচ্ছে সব দুঃখ গ্লানি যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে।ময়নার কথায় মন আচ্ছন্ন। এদের কত সরল জীবন যাত্রা, আপনাতে আপনি বিভোর কারো সাতে পাচে থাকেনা। গতরে খেটে জীবিকা নির্বাহ করে। রাস্তাঘাটে কখনো সাওতালকে ভিক্ষে করতে দেখেছে মনে করতে পারেনা। তথাকথিত ভদ্রলোকেরা কেন যে এদের শান্ত জীবনে হামলা করে ভেবে পায়না। সকালের দিকে কাজের মেয়ে ময়নাকে মারধর করতে এসেছিল কিন্তু আমি থাকায় কিছু করতে পারে নি। আমিও ঝগড়া, মারধর খুব ভয় পাই। কিন্তু কোনো ক্রমে কাউকে অন্যায়ভাবে মারধর করলে বসে থেকে দেখতে পাই না। এখানে এসে ময়নার সাথেই প্রথম কথা হয়েছে।

এখন রাত তবে ময়নার মনে যে কষ্ট রয়েছে অনিমান বুঝতে পেরেছে। নারী জীবন খুব কষ্টের যা সবাই বুঝতে পারে না। অনিমান উপন্যাসটা নিয়ে বসল।লিখতে লিখতে রাত বাড়তে থাকে। কোনো দিকে খেয়াল নেই। ময়না পাশে এসে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে,কোনো শব্দ করেনা পাছে লেখায় বিঘ্ন ঘটে। অনিমান মুখ তুলতে ময়নাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,কখন এসেছো?তোমার খাওয়া হয়েছে?
–তুকে দিয়ে খাবো।
অনিমান জিজ্ঞেস করল,তুমি আমার জন্য এত করছো কেন?আমাকে তো ভাল করে চেনোই না?
–একটা মানুষ না খাই থাকলে খাওয়া যায়?তুই পারবি?
ময়না চলে গেল,সারা ঘরে ছড়িয়ে দিয়ে গেল একরাশ ভাললাগা। তৃপ্তি করে খেয়ে বাথরুমে গিয়ে থালা ধুয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল।

করিম ভাইয়ের দোকানে আড্ডা চলছে। অনির কথা কারো মনেই নেই। করিম ভাই একসময় জিজ্ঞেস করে, অনির কি হল?ওকে দেখিনা।
শুভ বলল, অনি এখন বড়লোক। বাবুয়া ওকে ফ্লাট দিয়েছে।
–ফালতু কথা বলিস কেন?তুই দেখেছিস?বাশার প্রতিবাদ করে।

করিম ভাই গালে হাত দিয়ে বসে ভাবে জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। একদিন তাকেও ভুলে যাবে যখন থাকবেনা। রাজু একটু খোজ খবর নিত। সেও চ্যারিটি নিয়ে মেতে আছে এখন। দোকানে কমই আসে,আসলেও বেশিক্ষন থাকেনা।

সকালে কলেজে উপস্থিত হলো অনিমান। অনার্স ক্লাস হচ্ছে একের পর এক। সব ক্লাসই করে অনিমান। কিন্তু কোনো কথা কানে যায়না। এলোমেলো চিন্তা মাথায় বিজবিজ করে। খালি পেটে ক্লাস করতে কার ভাল লাগে?রাতের খাবার ময়না দেয় কিন্তু ও নিজেই নিজের পেটের জন্য সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটছে। কতদিন তাকে যোগাবে?টিফিনে বেরিয়ে রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকানে বসল। এককাপ চা আর কোয়ারটার পাউণ্ড রুটি নিয়ে লাঞ্চ সারল। কলেজ ছুটির পর পুরানো পাড়ায় যাবার কথা মনে হল। রাজু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে কিছু একটা করবে হয়তো। কথায় বলে আউট অফ সাইট আউট অফ মাইণ্ড। সকলেরই ব্যক্তিগত কাজ থাকে। ছুটির পর হাঁটতে শুরু করল। একটা দুশ্চিন্তা কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। কলেজ করছে ঠিকই কিন্তু সেকি শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দিতে পারবে?ময়নাকে কিছু টাকা অন্তত দেওয়া উচিত কিন্তু কিভাবে দেবে? মোবাইল বাজতে কানে লাগাতে শুনতে পেল,হ্যালো অনি?
চিত্রা এতদিন পর,কি ব্যাপার?আবার পড়াতে বলবে নাকি?উৎসাহিত হয়ে বলল,বলো?
–তুমি কোথায়?
–এই তো কলেজ ছুটি হোল।
–তুমি না বললেও আমি জানি বাপি তোমাকে নিষেধ করেছে। আম আই রাইট?
অনিমান কি বলবে?আর এতদিন পর এসব কথায় কি লাভ?
–ম্যান প্রপোজেস গড দিজপ্রোপজেস। উই আর হেল্পলেস। অনিমান বলল।

অনিমানের ভাল লাগেনা এসব কথা বলল, চিত্রা আমি রাস্তায়,পরে কথা বলব?ফোন কেটে দিল। রাজু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়না অনেকদিন। ভাবছে একদিন পুরানো পাড়া যাবে, রাজু ভাইকে বলবে টিউশনির কথা নাকি চাকরির কথা বলবে। অনিমান জানে তার হাত থেকে বাড়ির জায়গা চলে গেছে। কাকা শুধু সমাজের চোখে নিজেকে ভালো রাখতে আমাকে এখন থাকতে দিয়েছে। কিন্তু একদিন তো তাকে বের হয়ে যেতে হবে। তখন সে কোথায় থাকবে? কি করবে সেটা সে জানে না। অর্নিতা আপু থাকলে আমার জন্য অবশ্যই কিছু করত। আমি জানি তিনি আমাকে অন্যরকম ভাবে ভালোবাসেন। সে ভালোবাসা কি আমি আজও বুঝতে পারি নি। তবে তার সাথে কথা বললে আমার দুঃখ ঘুচে যেত। একাকীত্বের জীবনে অর্নিতা আপু যেন আমার একমাত্র সাথী ছিল।

সকাল আটটা মানে এখান থেকে সাড়ে-ছটার মধ্যে বেরোতেই হবে। ক্লান্তিতে চোখের পাতা লেগে আসে।
অনিদের বাড়ীটা মাঠ হয়ে গেছে। রাজু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। কোথায় উধাও হল ছেলেটা খুব মনে পড়ে। বেলা ভাবি জিজ্ঞেস করছিল বলতে পারেনি।চ্যারিটি ফাউণ্ডেশনের ব্যাপারটা অনির মাথায় প্রথম এসেছিল। রবি কাকা কে একদিন দেখেছিল, জিজ্ঞেস করবে ভেবেও জিজ্ঞেস করার প্রবৃত্তি হয়নি। বাবুয়া মস্তানের সঙ্গে খুব ভাব। একবার মনে হয়েছিল রবি কাকার কাছে থাকে নাতো?কিন্তু বেলা ভাবি বলল,না থাকেনা। বিজয় ভাইয়ের বন্ধু রবি কাকা, সব খবরই বেলা ভাবি পায়।

বাসায় ফিরে রাজু দেখল ভাবি তার অপেক্ষায় বসে আছে। রাজু হাত মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসে। মুন্নী দেওরকে খেতে দিয়ে নিজেও বসে গেল।
–অনিদের বাড়ীটার কোনো চিহ্ন নেই। খেতে খেতে বলল রাজু।
–অনির কোনো খবর পেলেনা?ছেলেটা রাতারাতি উবে গেল?কেমন বন্ধু তোমরা?মুন্নীর গলায় ক্ষোভ।

রাজু লজ্জিত হয়।
–ঐ কি নাম বাবুয়াকে জিজ্ঞেস করতে পারতে?শুনেছি দোকানদারদের অন্য জায়গায় ঘর ঠিক করে দিয়েছে?মুন্নী বলল।

অনির মুখটা মনে পড়ল। কেমন মায়া জড়ানো মুখ।নিজের সমস্ত দুঃখ কষ্টকে সরিয়ে রেখে কেবল অন্যের কথা ভাবতো।
–ভাবছি কারো খপ্পরে–।
মুন্নী হাত তুলে দেওরকে বিরত করে। অনিকে যতদুর জানে জ্ঞানত কোন পাপে জড়াবার ছেলে ও নয়।কোথায় আছে কি খাচ্ছে কে জানে।
কথাটা রাজু বলতে চায়নি,লজ্জিত বোধ করে। ভাবি ঠিকই বলেছে অনি ওরকম নয়।

পরেরদিন বিকালে অনিমান নিজের এলাকায় আসলো। প্রায় সবার সাথে দেখা হলো। বেলা ভাবি বারান্দায় অন্ধকারে বসে আছেন। রাজু ভাই অন্যান্যরা চ্যারিটি অফিসে ঢুকে গেল, অনি বারান্দায় কলাপসিবল গেটের কাছে দাঁড়াতে বেলা ভাবি ঠেলে গেট খুলে দিল। বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসল অনি। বেলা ভাবি জিজ্ঞেস করল,চা খাবি তো?
অনি হাসল। বেলা চা আনতে গেল। অনি বুঝতে পেরেছে রাজু ভাই তার কথায় সন্তুষ্ট হয়নি। কিন্তু রাজু ভাইকে সন্তুষ্ট করতে বলার মত কি আছে? তাই নিজের সম্পর্কে জানাতে চাই নি অনিমান। রাজু ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ার পর নানান ধরণের প্রশ্ন করেছে। কোথায় থাকি? কি করি? লেখাপড়া চলছে কি? এসব প্রশ্ন করলো কিন্তু আমি যে উত্তর দিলাম তাতে রাজু ভাই সন্তুষ্ট হয় নি বেশ বুঝতে পেরেছি বেলা ভাবি কে দেখে।

বেলা চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকে দু-কাপ নামিয়ে রেখে বলল,ট্রে-টা অফিসে দিয়ে আয়।
অনিমান অফিসে চা দিয়ে ফিরে আসতে বেলা ভাবি জিজ্ঞেস করে,মুন্নীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল,তোর খোঁজ করছিল?
–রাজু ভাই তো কিছু বলেনি। কি ব্যাপারে তুমি জানো?
–ওর ছেলের ট্যুইশনির জন্য। চায়ে চুমুক দিয়ে বলল বেলা।
একটু আগে রাজু ভাইকে মিথ্যে বলেছে ভেবে,চোখের পাতা ভিজে যায়। বেলা ভাবিকে বানিয়ে বলল,সরদার পাড়ায় কটা ট্যুইশনি করছি,তাছাড়া এতদুরে এসে পড়ানো সম্ভব নয়। তুমি কেন ডেকেছো বললে না তো?
–এমনি। অনেকদিন তোকে দেখিনা,তোর সঙ্গে কথা বলতে বেশ লাগে।
অনি লজ্জা পায়। বেলা জিজ্ঞেস করল,যে বইটা দিয়েছিলাম,পড়েছিস?
–মোটামুটি।
বেলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনিমানের মনে হয় ভাবি মনে কিছু একটা বিষয় আন্দোলিত হচ্ছে। ভাবছে বলবে কি বলবে না। অনির চা খাওয়া হয়ে গেলে হাত থেকে কাপটা নিয়ে পাশে সরিয়ে রেখে বেলা ভাবি বলল,একটা ব্যাপারে খুব খারাপ লাগছে।
অনিমান সজাগ হয় কি বলতে চায় ভাবি। বেলা বলল,তোদের বাড়ীর ব্যাপারে তোর কাকাকে পিছন থেকে কে পরামর্শ দিয়েছিল জানিস?তোদের বিজয় ভাই–আমার স্বামী।
অনিমান হাসল। বেলা অবাক হয়ে বলল,তুই হাসছিস?তোর খারাপ লাগছে না?
–ভাবি একজন নিরক্ষর আদিবাসী মেয়ে একটা সুন্দর কথা বলেছিল,কারো ভাগের জিনিস কেউ নিতে পারেনা। তুমি একটা বই পড়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিলে,তোমাকে বলি। একটা কুট তর্ক আছে ডিম আগে না মুরগী আগে?তার উত্তর আমার জানা নেই।কিন্তু এটা জানি তত্ত্ব অনুযায়ী ঘটনা ঘটেনা,ঘটনা থেকে তত্ত্বের সৃষ্টি। চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে অনেক শিক্ষার আছে।
–তুই বলছিস আমার সঙ্গে যা ঘটছে সব আমার ভাগ্যে ছিল?
–তুমি বিদুষী তোমাকে বলা আমার শোভা পায়না।মানুষ চিরকাল এক জিনিস নিয়ে থাকতে পারেনা,বদল চায়। বিয়ে হয় তারপর সন্তান হয়–এইভাবে বদল হয়।
–আমার সন্তান নেই তার জন্য দায় কি আমার একার?বেলা বাষ্পরুদ্ধ গলায় বলল।
অনিমান দম নেবার জন্য থামল। তারপর আবার শুরু করল,কিছু মনে কোর না আমার ভুল হতে পারে।একটা সিনেমা দেখেছিলাম “গল্প হলেও সত্যি।”সেখানে এক বাড়ীতে ভাইয়ে ভাইয়ে মিল ছিলনা,সবাই সবাইকে সন্দেহ করত। বাড়ির পাচক একভাইকে বানিয়ে বলত,অন্যভাই তার খুব সুখ্যাতি করছে। এইভাবে সব ভাইকে বলে বলে সংসারে আবার শান্তি ফিরিয়ে আনল।
বেলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,তার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক?
অনিমান হেসে বলল,সম্পর্ক কিছু নেই। বিজয় ভাইয়ের মনে ব্যক্তিগত কিছু হতাশা আছে। যা হতে চেয়েছিল হতে পারেনি। এই সময় তোমার সহায়তার খুব প্রয়োজন ছিল। সত্যি করে ভেবে বলতো তুমি বিজয় ভাইয়ের কাজকে কখনো এ্যাপ্রিসিয়েট করেছো?বরং নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য পাঁচজনের কাছে হেয় করেছ।

বেলা উদাসভাবে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। একসময় উঠে গ্রিলের কাছে গিয়ে দাড়ায়। অনিমান উঠে বেলা ভাবির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,তুমি আমার উপর রাগ করলে?

বেলা চোখ তুলে অনিকে কিছুক্ষন দেখল তারপর চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বলল, এইজন্য তোকে খুঁজছিলাম। অনি তোকে খুব ভাল লাগে। তুই আমার চোখ খুলে দিলি।

রাজু ভাই বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করল,তুই কি যাবি নাকি দেরী হবে?
অনি বলল,আসি ভাবি?
অনি বেরিয়ে রাজু ভাই আর বাশারের সঙ্গে যোগ দিল। রাজু জিজ্ঞেস করে,কেন ডেকেছিল ভাবি?
–ঐ কেমন আছিস কোথায় থাকিস? এলাকায় দেখিনা আজকাল–এইসব।
হাঁটতে হাঁটতে বাশার বলল, ভাবির সঙ্গে বিজয় ভাইয়ের সম্পর্কটা ভাল যাচ্ছেনা।
–তুই কি করে বুঝলি?অনি জিজ্ঞেস করে।
–আমাদের সামনেই কি ঝগড়া। বিজয় বলল নিজেকে খুব পণ্ডিত মনে করো?তারপর–।
রাজু বাধা দেয়,এইজন্য সবাই তোকে পছন্দ করেনা।সব কথায় তোর দরকার কি?
–যা সত্যি তাই বললাম। কে কি বলল কিছু যায় আসেনা।

এতরাত হয়ে গেল সেই অটোতে উঠতেই হবে। অটো স্ট্যাণ্ডে গিয়ে হোটেলে ঢুকে ভাত খেয়ে নিল। নীচে কাঠমিস্ত্রীরা তাস খেলছে। অনিমান হ্যারিকেন জ্বেলে পড়তে বসল।

অনিমান চলে যাবার পর বেলা চৌধুরি ওর কথাগুলো নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করতে থাকে। জীবন যাপনে বৈচিত্র্য এনে একঘেয়েমী কাটিয়ে উঠতে হবে। এমন কি সংসার জীবনেও নতুনত্ব আনা প্রয়োজন। আত্মস্বীকৃতি সবাই চায়। শ্বশুর মশায়ের মত বিজুরও হয়তো ইচ্ছে ছিল জজ ম্যাজিস্ট্রেট বা তেমন কিছু হবে। অনেকে না-হতে পারাটা নিজের সন্তানের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে পূরণ করার চেষ্টা করে। কেউ পারে আবার কেউ না-পেরে নানা জটিলতা সৃষ্টি করে। এই সময়ে স্ত্রী হিসেবে তার কর্তব্য স্বামীর পাশে দাঁড়ানো। বয়স অনুপাতে অনি অনেক পরিণত। ওর মধ্যে লক্ষ্য করেছে অনুসন্ধিৎসা।
রাত দশটা নাগাদ বিজয় চৌধুরি চেম্বার থেকে ফিরল।বাসায় ফেরার জন্য সবার একটা টান থাকে। কতক্ষণ পরে তার প্রিয় মুখগুলোর সঙ্গে দেখা হবে,উষ্ণতায় ভরিয়ে দেবে মন। ক্লান্ত মানুষটিকে এগিয়ে দেবে শরবত কিম্বা জল। কৌতুহলী মন নিয়ে জানতে চাইবে সারাদিনের অভিজ্ঞতা। কিন্তু বিজয় চৌধুরী সেই টান অনুভব করেনা,বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতেই তার ভাল লাগে। বারান্দায় স্ত্রীকে দেখেই মনটা ব্যাজার হয়।বেলা দরজা খুলে দিল। অন্য দিন নিজেই দরজা খুলে ঢোকে। ঘরে ঢুকে পোশাক বদলে লুঙ্গি পরে সবে পাখার নীচে বসেছে সামনে তাকিয়ে দেখল গ্লূকোনে-ডি গোলা পানীয় হাতে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী। হাত বাড়িয়ে না-নিয়ে বিরক্তি মেশানো গলায় বলল,এখানে রেখে দাও।

বেলা গেলাসটি পাশের টেবিলে নামিয়ে রেখে চলে গেল। বিজয় গেলাসটি দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে।কি ব্যাপার কিছু মিশিয়ে দিল নাতো?গেলাসটি তুলে সামান্য একচুমুক খেয়ে বুঝতে চেষ্টা করে। বেশ তেষ্টা পেয়েছে দেরী না করে একচুমুকে গেলাসটা নিঃশেষ করে তৃপ্তির শ্বাস ফেলল। কিছুক্ষন পর খারাপ লাগে মিথ্যেই বেলাকে সন্দেহ করেছিল।

সকালের বাসি কাগজ টেনে নিয়ে চোখ বোলাতে লাগল। বেলা ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসল। বিজয় আড়চোখে দেখে আবার কাগজ পড়ায় মন দিল।
–জানো আজ অনি এসেছিল।
বিজয় শুনেও না শোনার ভান করে।
–বেচারি এখন সরদার পাড়ায় থাকে।
বিজয় অনুমান করার চেষ্টা করে কোন প্রসঙ্গে যেতে চাইছে। জিজ্ঞেস করল, তুমি বলেছো কিভাবে বিজয় চৌধুরী চক্রান্ত করে–।
বেলা কথা শেষ করতে না দিয়ে হেসে বলল,কি করে বলব তার আগেই অনি যা শুরু করল,–।
–আর তুমি ঘরে বসিয়ে উপভোগ করলে?
–করব না?স্বামীর প্রশংসা কোন মেয়ের না ভাল লাগে বলো?
বিজয় ধন্দ্বে পড়ে যায়,কাগজ পাশে সরিয়ে রেখে বলল,কি বলছিল অনি?
–পুরানো বাড়ী এমনি খসে খসে পড়ছিল। কাকার কোনো মাথা ব্যথা নেই। কোনদিন ভেঙ্গে চাপা পড়েই মরতে হত। বিজয় ভাই ছিল বলেই একটা গতি হল।
বিজয় আড়চোখে বউকে দেখল,নতুন কোন কৌশল নয়তো?তারপর আপন মনে বলল, অনি ছেলেটা ভাল।
–এতদিনে বুঝলে?
–আমি না তুমি বোঝ। তোমার ধারণা পয়সার জন্য আমি রবির সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছি।
–আচ্ছা বাবা,আমি তো ভুল স্বীকার করছি। রাত হল এবার খেতে এসো।
বেলা টেবিলে খাবার সাজাতে সাজাতে ভাবে,অনির পরামর্শে এত দ্রুত কাজ হবে ভাবেনি। বাকীটা ধীরে গতিতে প্রয়োগ করতে হবে।
বিজয়ের খারাপ লাগে। বাবুলালকে বলে রবিকে অতিরিক্ত পাঁচ লাখের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।এগ্রিমেণ্টে সেসব কথা লেখা নেই। বেলি জানলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। কেন করতে গেল?উকিলের কাছে টাকাটাই কি সব?ন্যায়-অন্যায় ধর্মাধর্মের কোনো মূল্য নেই?

ডাইনিং টেবিলে এসে বসতে বেলা দেখল বিজয় মুখ ভার। এতক্ষন বেশ তো ছিল হঠাৎ কি হল?চেয়ারের পাশে গিয়ে বিজয়ের মাথা বুকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল,কি হয়েছে তোমার আমাকে বলো? নিজের মধ্যে চেপে রেখে কেন মিথ্যে কষ্ট পাচ্ছো?
বিজয় ধ্বন্দ্বে পড়ে যায়। সব কথা খুলে বলে সুন্দর রাতটাকে নষ্ট করতে ইচ্ছে হল না। ম্লান হেসে বিজয় বলল,কিছু হলে তো বলব?দাও খেতে দাও।
বেলা ভাত বেড়ে দেয়। বিজয় কিছু একটা চেপে যাচ্ছে,চাপাচাপি করলে শান্ত পরিবেশ যদি নষ্ট হয়ে যায় এই আশঙ্কায় আর তাগাদা দিল না।
পড়তে পড়তে চোখ লেগে গেছিল সম্ভবত হঠাৎ হল্লাবাজীতে অনিমান সজাগ হয়। নীচে তাসখেলা এখনো চলছে মনে হয়। কতরাত অবধি চলবে? এখান থেকে চলে যাওয়া প্রয়োজন। কাল ভদ্রলোকের কার্ড নিয়ে যাব। কিছু কাজ যদি পাওয়া যায় তাহলে মায়ের স্বপ্ন লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে পারব। অন্যথায় স্বপ্নকে কাঁদা চাপা দিয়ে নতুন জীবন সংগ্রামে পা বাড়াতে হবে।
.
.
চলবে….!

[গল্পটি কেমন হচ্ছে সবাই নিজের মতামত জানাবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here