জীবনের অন্যরঙ পর্ব-৭

0
336

#জীবনের অন্যরঙ [৭ম পর্ব]
#আজিজুর রহমান

প্রিয়া-রূপ ধরে এতদিনে এলে আমার কবিতা তুমি,
আঁখির পলকে মরুভূমি যেন হয়ে গেল বনভূমি!
জুড়াল গো তার শত জনমের রৌদ্রদগ্ধ-কায়া–
এতদিনে পেল তার স্বপনের স্নিগ্ধ মেঘের ছায়া!
চেয়ে দেখো প্রিয়া, তোমার পরশ পেয়ে
গোলাপ দ্রাক্ষাকুঞ্জে মরুর বক্ষ গিয়াছে ছেয়ে!

সকাল সকাল স্নান খাওয়া দাওয়া করে অনিমান বেরোবার জন্য প্রস্তুত।
–তুমি এখানে? সারা বাড়ী খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি।
অনিমানকে দেখে বললেন,এদিকে আয়।
অনিমান কাছে গিয়ে ভাবির কাছে দোয়া চাইলো। উঠে দাঁড়িয়ে দেখল ভাবির হাতে একজোড়া সোনার বালা,মুখে দুষ্টু হাসি।
— এই বালা জোড়া তোর বউয়ের জন্য রেখেছি। তোর মা আমাকে দিয়ে গিয়েছিল। ভাবি বললেন।
–গাছে কাঠাল গোফে তেল। লাজুক হেসে বলল অনিমান ।
–আমি আসছি?

অনিমান রাস্তায় নেমে বড়রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করে। আজ রেজাল্ট বেরোবার কথা। মা আগে থেকে ছেলের বউয়ের জন্য বালা রেখে গিয়েছিল। সব মায়েদের মনে ছেলের বউকে নিয়ে সংসার করার স্বপ্ন থাকে। অবাক লাগে পরীক্ষার আগে ভাবি ‘পড়-পড়’ করে অতিষ্ঠ করে তুলতো অথচ রেজাল্ট বেরোবে শুনেও এখন কেমন নির্বিকার গা-ছাড়া ভাব? নজরে পড়ল রুবিকে নিয়ে আণ্টি হন হন করে চলে যাচ্ছেন।

অনিমান কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,ভাল আছেন?
আন্টি একবার মেয়ের দিকে তাকালেন। রুবি এমনভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে যেন অনিকে দেখতেই পায়নি। আন্টি বললেন,তুই কেমন আছিস?
–ঐ একরকম।
–ওকি কথা? একা থাকিস বলে কি নিজের খেয়াল রাখবি না?

অনিমানের চোখ ভিজে যায়। আন্টি বললেন,দেখ মেয়ের রেজাল্ট বেরোবে আর এই শরীর নিয়ে মেয়ের সঙ্গে যেতে হচ্ছে।
–বললাম তোমাকে যেতে হবেনা তুমিই তো জোর করে এলে। রুবি অনুযোগ করে।
–থামো,আমি না গেলে তোমার খুব সুবিধে?
–তাহলে আবার এসব বলছো কেন? রুবি নাকি সুরে বলল।
–দেখলি অনি দেখলি?কেমন মুখে মুখে কথা?
–আচ্ছা বাবা আমি আর একটি কথা যদি বলি। রুবি বলল।
–আণ্টি তোমার ভালর জন্যই বলছেন। অনিমান বলল।

রুবি কটমট করে তাকায় কিছু বলেনা। আন্টি বললেন,মা তো ওর শত্রু,কত সব হিতৈষী জুটেছে এখন।
রুবি আড়চোখে অনিকে দেখে চোখাচুখি হতে জিভ ভ্যাংচায়। রাস্তার মোড়ে এসে বাক নিলেন আন্টি।মেয়েদের কলেজ ঐদিকে।

কলেজে ভীড় দেখে বুঝতে পারে খবরটা মিথ্যে নয়।ঐতো দেওয়ালে লটকে দিয়েছে। অফিস ঘরে লম্বা লাইন। অনিমান ভীড় ঠেলে এগোতে গেলে সুবীর বলল,আছে নাম আছে।
খুঁজে খুঁজে নামটা দেখে মন খারাপ হয়ে যায়,সেকেণ্ড ক্লাস। ভীড় ছেড়ে বাইরে আসতে সুবীর বলল,একটা খারাপ খবর আছে।
খারাপ খবর?তনিমার কিছু হল নাকি?চোখ তুলে তাকাতে সুবীর বলল,বাশার এক সাবজেক্ট ব্যাক।
–কোথায় বাশার?
–ঐ ওদিকে বসে আছে।
দুজনে ভীড় সরিয়ে বাশারের কাছে গিয়ে বলল,তুই এখানে?চল ক্যাণ্টিনে গিয়ে বসি।
তিনজনে ক্যাণ্টিনে গিয়ে চা নিয়ে বসল।
–তোরা ভাবছিস আমার মন খুব খারাপ?বাশার হেসে জিজ্ঞেস করে।
অনিমান খুশি হয় বাশারের এই মনোভাবে। বাশার বলল,বাড়ীতে মামাটা একটু খিচখিচ করবে। একটা সাবজেক্ট আবার দেবো কি আছে?
বাবা মারা যাবার পর বাশার মামার আশ্রয়ে থাকে। চা খাওয়া হলে ওরা লাইনে দাড়ালো মার্কশীট নেবার জন্য। লাইন ক্রমশ বড় হচ্ছে। মার্কশীট নিয়ে অনিমান জিজ্ঞেস করে,বাড়ী যাবি তো?
সুবীর হেসে বলল,একজন আসবে তুই যা। সন্ধ্যেবেলা করিম ভাইয়ের দোকানে দেখা হবে।
–বাশার?
–আমিও পরে যাবো। বাশার বলল।

অনিমানের মন খারাপ। সামান্য নম্বরের জন্য ফার্স্ট ক্লাস ফসকে গেছে। পার্ট-টুতে যদি মেক আপ করা যায়। ভাবির কথা মনে পড়ল বিয়ে দেবার ইচ্ছে। সবাই প্রায় প্রেম করেছে। তার যদি কোনো প্রেমিকা থাকতো তাহলে ভাবির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিত। একটা কথা মনে হতে হাসি পেয়ে গেল। সেটা না হয় অজানায় থাক।

–একা একা হাসছো কি ব্যাপার?

চমকে তাকিয়ে দেখল মিলি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছে খেয়াল করেনি। টেনে চুল বাঁধা, চোখে মোটা করে কাজল দিয়েছে। বোধ হয় সিনেমা-টিনামা যাচ্ছে।কৌতুক করে বলল,দোকা পাবো কোথায়?
–আহা,সামনে তাকিয়ে দেখেছো কখনো?তুমি তো আকাশের দিকে তাকিয়ে চলো।
–তোমার উলটো।
–তার মানে?
–আমার বাস্তবের মাটিতে পা আর উন্নত দৃষ্টি। তুমি উর্ধপদ হেটমুণ্ড।
–তার মানে তুমি বলছো আমার নজর নীচু?অভিমানী গলায় বলল মিলি।
–তুমি ফ্যাণ্টাসির জগতে বাস করছো। যেদিন বাস্তবের কর্কশ কাকড়ে পা পড়বে বুঝতে পারবে। বাদ দাও বাজে কথা, আজ কলেজ যাওনি?
–আজ পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট বেরিয়েছে,ক্লাস হবেনা। ও তুমি পরীক্ষা দিয়েছিলে না?
–পাস করেছি।
–শুভর খবর কি জানো?
–ওর অন্য কলেজ দেখা হয়নি।
–অনি তোমাকে একটা কথা বলবো,রাগ করবে না?
–তুমি কি বলবে আমি জানি। তবু বলো,আমি কারো উপর রাগ করিনা।
–বাবা ডাক্তার ভাবে কিই না কি?

অনিমান হেসে ফেলল। শুভ্রতার কথা বলতে চাইছে,ওর প্রতি লক্ষ্য করেছে অনেকের রাগ। ওকে কখনো কাউকে নিয়ে বলতে শোনেনি। মিলি বলল,হাসির কি হল?
–তুমি কি সিনামা যাচ্ছো?দেরী হয়ে যাচ্ছে না?
–তুমি যাবে?আড়চোখে তাকায় মিলি।
–আমার পকেট খালি।
–আমি তোমাকে একটা সিনেমা দেখাতে পারবো না?চলো একা একা ভাল লাগে না।
–বাড়ীতে ভাবি অপেক্ষা করছে। কিছু মনে কোর না, আসি?

অনিমান চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মিলি ভাবে,আজ্ঞাবহ ব্যক্তি। বেশি পাত্তা দেওয়াই ঠিক হয়নি। শুভ্রতা লাথ মেরেছে ঠিক করেছে।

মিলি গত বছর পার্ট ওয়ান পাস করেছে। ওর বাবা বেসরকারী একটা ব্যাঙ্কে আছেন। শুভর সঙ্গে কি নিয়ে গোলমাল জানি না। মনে হল ভালই হয়েছে।শুভদের বাড়ীর অবস্থা বেশ ভালই। ওর দাদা ব্যাঙ্কে কাজ করে। শুভ ভালভাবে পাস করে একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারলে মনে হয়না আণ্টির আপত্তি হবে না। আণ্টি বেশি বাইরে বেরোয় না,মিতা এদিক দিয়ে স্বাধীন। ওর ক্ষেপচুরিয়াস কাকাটাই পিছনে লেগে আছে। এই মুহূর্তে কেন জানি চিত্রার কথা মনে পড়ছে। আর হয়তো দেখা হবেনা। পাস করেছে শুনলে খুব খুসি হত। মনে কোন মালিন্য ছিলনা। অত্যন্ত সহজভাবে বলেছিল,না তুমি আসবে। তার বাবা নিষেধ করেছেন চিত্রা কি জানে?না জানলেও রোববারের পর নিশ্চয়ই জানতে পারবে অনি আর যাবে না।

দরজা হাট করে খুলে ঘরে ঢুকলো। ভাবি দেখে দু-কাপ চা আর একবাটি মুড়ী নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, রবিটার মধ্যে এই মানুষটা ছিল ভাবতেও পারিনি।
–ঐসব ভেবে মন খারাপ কোরোনা।

অনিমানের ভাবি কয়েক পলক দেখে বললেন,তুই হয়েছিস তোর বাবার মত। বোকা-বোকা ভাব সব বুঝতে পারত কিন্তু মুখে কিছু বলত না।
–ভাবি বাবার কথা বলো। অনিমান আবদার করে।
–শুধু তোর বাবাকে বোঝার জন্য একটা ঘটনার কথা বলছি। গ্রাম থেকে একদিন এসে বলল,অমুক তুই তো গ্রামে যাবিনা। তোর বাবা বলল,চাকরি ছেড়ে কি করে যাবো? তোর কাকা বললেন,তা ঠিক তাছাড়া গ্রামে আছেই বা কি?তুই এই কাগজটায় সই করে দে।জমিজমার বেদখল ঠেকাতে মাঝে মধ্যে আদালতে যেতে হয়। তোর পক্ষে কাজ কর্ম ছেড়ে ত বারবার যাওয়া সম্ভব নয়। তোর বাবা সই করে দিল। তোর মা রাগারাগি করছিল,যা বলল তুমি বিশ্বাস করে নিলে?তোর বাবার সেদিনের কথাটা কোনোদিন ভুলব না। তোর মা আচল দিয়ে চোখ মুছল। তোর বাবা বলেছিল বউ যে ঠকে অপরাধ তার নয়, অপরাধ যে ঠকায়। ভাই ঐসব বানিয়ে বানিয়ে না বললেও আমি সই করে দিতাম।

অনিমান অবাক হয়ে ভাবি কে দেখে। এসব কথা কোন বইতে লেখা আছে?কিন্তু মার মনে সে কথা গাঁথা ছিল।

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। অনিমান বেরিয়ে পড়ে। করিম ভাইয়ের দোকানে সবার আসার কথা। বিজয় কোর্ট থেকে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে চেম্বারে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছে। বেলা ভাবি তাকিয়ে স্বামীকে লক্ষ্য করছেন।
–কি কিছু বলবে?
–তুমি তো এমন ছিলেনা।
বিজয় ভাই বিরক্তি নিয়ে বললেন,কি বলতে চাও?
–রবি এসেছিল কেন?
–কি মুস্কিল উকিলের কাছে মক্কেল আসবে না?
–অনির কথা একটু ভাববে না?
–কি মুস্কিল সবার কথা ভাবতে গেলে আমাকে উকিলি-পেশাই ছেড়ে দিতে হয়। ধরো যদি ফ্লাট হয় অনিও কি সেই সুবিধে পাবে না?তোমায় একটা কথা বলি,নিজের কাজ মন দিয়ে করো। সব ব্যাপারে মাথা ঘামালে কোনো কাজই সুষ্ঠূভাবে হবেনা।

বেলা ভাবি আহত হল। বিজয় আগে তার সঙ্গে এভাবে কথা বলত না। অরি বলছিল সব কিছু বদলায়,সম্পর্ক চিরকাল এক জায়গায় থেমে থাকেনা। ছেলেটার জন্য মায়া হয়। কেউ যদি রেগে তিরস্কার করে তাতেও মনে করে কিছু শেখা হল। মানুষ রেগে গেলে তার ভাষা কেমন বদলে যায়। বিজয় ইদানীং কথা বলে অন্যদিকে তাকিয়ে,তাতেই বোঝা যায় ওর মধ্যে চাতুরি আছে। উকিল হলে কি মানবধর্ম ত্যাগ করতে হবে?ন্যায়ের জন্য লড়াই করা উকিলের কাজ কিন্তু বিজয় যা করছে তাতো অন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা। রূপ দেহের আকর্ষণ চিরকাল থাকেনা। একটা সন্তান থাকলে নিজেকে এমন অসহায় মনে হতো না।

করিম ভাইয়ের দোকানে শুরু হয়ে গেছে গুলতানি।সবাই পাস করেছে শুনে করিম ভাইও খুশি। ফুরফুর হাওয়া দিচ্ছে। বাশার আজ বেশি কথা বলছেনা। অনিমান ঝুকে টেবিলে হাত রেখে হাতের উপর চিবুকের ভর দিয়ে ভাবছে। নতুন করে ভর্তি হতে হবে, রাজু ভাই দু-শো টাকা কাজে লাগবে। চিত্রার বাবা পাচশো টাকা পাঠীয়েছিলেন।

শুভর নজর পড়তে জিজ্ঞেস করে,কিরে অনি ওখানে বসে কি ভাবছিস?
মুখ তুলে হাসল অনিমান। শুভর দিকে তাকিয়ে মনে পড়ল মিলির কথা। শুভকে বলল, আজ কলেজ থেকে ফেরার পথে মিলির সঙ্গে দেখা হল।
–এ্যাই থামতো তোর কাছে শুনতে চেয়েছি?মাছি তাড়াবার ভঙ্গী করে শুভ বলল।
এক সময় যাকে দেখার জন্য ছটফট করত এখন তার কথা এখন শুনতেও বিরক্তি। হিমেশ জিজ্ঞেস করল,কিছু বলছিল?বাশার সঙ্গে দেখনা যদি কিছু ব্যবস্থা হয়।
–এবার বেশি করছিস বলে দিচ্ছি। বাশার বলল।
সবাই হো-হো করে হেসে উঠল। সবাই খুশি এতক্ষন পর বাশার কথা বলেছে। যে বেশি কথা বলে তাকে চুপ করে থাকতে দেখলে খারাপ লাগে।
–আমাকে বলছিল তুমি সামনে তাকিয়ে দেখনা তাই তোমার কেউ জোটেনি। অনি বলল।
–অনি সাবধান,তোর দিকে নজর পড়েছে। সুবীর কোন থেকে বলল।

রাত বাড়তে থাকে,লোক চলাচল কমতে থাকে রাস্তায়। অনিমানের মনটা খারাপ হয়ে উঠলো।

–আমি যাইরে। দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ল অরিমান। কিছুটা হাঁটার পর মনে হল চ্যারিটি অফিসটা ঢূ মেরে আসি। কয়েকজন বয়স্ক লোক কথাবার্তা বলছেন বাইরে থেকে দেখে আর ঢুকল না।বারান্দায় বেলা ভাবি বসে আছে মনে হল। লাইট জ্বালেনি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। কাছে গিয়ে মৃদু স্বরে ডাকল, ভাবি?

হাতে মুখ গুজে বসেছিল তাই খেয়াল করেনি। চমকে তাকিয়ে অনিকে দেখে বলল,আয় ভিতরে আয়।
অনিমান ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল,তুমি কাঁদছিলে?
বেলা চোখ মুছে বলল,কেন আমার কাঁদা কি বারণ?
–না তা নয়। কাঁদলে মনের ময়লা বেরিয়ে যায়। তবে কি তোমার মত শক্ত মনের মানুষকে কাঁদতে দেখলে ভাল লাগেনা।
–তোর ভাল লাগল কি লাগল না তাতে আমার কি?
অনিমান বুঝতে পারে কোনো কারণে ভাবির মন অশান্ত। কথাটা গাঁয়ে মাখে না। একা থাকুক,অনিমান উঠে দাঁড়াল। বেলা ভাবি জিজ্ঞেস করে,যাচ্ছিস?
–হ্যা যাই। তুমি শান্তিতে কাঁদো।
–শোন অনি সাবধানে থাকিস। তোর সামনে বিপদ।
যেভাবে জ্যোতিষীরা বলে কথাটা তেমনি শুনতে লাগল। অনিমান হেসে বলল,সামনে হোক কি পিছনে বিপদ বিপদই।

বাড়িতে ঢুকে ভাবি কে কেমন অস্থির-অস্থির লাগে। অনি দেখে জিজ্ঞেস করেন, রবির সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
–না কেন?
–একটু আগে এসেছিল,সঙ্গে একটা লোক মুন্না না কি নাম।
অনিমান ভ্রু কুচকে যায়। মুন্না মানে বাবুয়ার শাকরেদ?কি বলছিল?
–একটা কাগজ দিয়ে গেছে। বলেছে সই করে রাখতে। ভাবি কাগজ এগিয়ে দিতে অনিমান বলল,পরে দেখব। এখন ভাল লাগছেনা।
আলমারি খুলে একজোড়া বালা এনে অনির হাতে দিয়ে বলল,তোর কাছে রাখ।
ভাবির আচরণে অবাক হয়। অনিমান বলল,আমার কাছে কেন,যেখানে ছিল সেখানেই থাকুক না।
–তোকে বলছি,তুই রাখ। কড়া গলায় বললেন ভাবি।
অনিমান বালাজোড়া নিয়ে নিজের ঘরে গেল। বেলা ভাবি বলল বিপদের কথা। ভাবি কি সেরকম কিছু আশঙ্কা করছে?কি বিপদ হতে পারে?হুড়মুড়িয়ে মাথার উপর ছাদ ভেঙ্গে পড়বে?নাকি বাড়ীতে ডাকাত পড়বে?ডাকাতরা খবর নিয়ে আসে। একজোড়া বালার জন্য নিশ্চয় এত পরিশ্রম করবে না। তাহলে কি কাকা জোর করে বাড়ী লিখিয়ে নেবে? কাকা যদি করতে পারে সেইবা কেন পারবেনা মেনে নিতে? বালাজোড়া চোখের সামনে ধরে ম্লান হাসে অনিমান।তার বউয়ের জন্য যত্ন করে রেখে দিয়েছে মা।
রাত নিঝুম,আজ আর ডায়েরী লিখতে ইচ্ছে করছেনা। বালাজোড়া টিনের স্যুটকেসে ঢুকিয়ে রেখে শুয়ে পড়ল অনিমান। কাকা কি কাগজে সই করাতে এসেছিল,কাল দেখবে।

করিম ভাই দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে গেছে।রাস্তায় কয়েকটা নেড়ি কুত্তা ছাড়া আর কেউ নেই।বেপাড়ার লোক ঢুকলে ঘেউ ঘেউ করবে। কুকুর বেড়াল ঘুমালেও মৃদু শব্দে জেগে ওঠে। মানুষ ঘুমালে একেবারে কাদা। পকেট হাতড়ে সব নিয়ে গেলেও টের পায়না। ভাবি কে ভীষণ উত্তেজিত মনে হল। কি কথা হয়েছে কাকার সঙ্গে ভেঙ্গে বলেনি ।

সরদার পাড়ায় বাবুয়ার ফ্লাট প্রায় শেষ হতে চলল।সরদার পাড়া এ পাড়া থেকে মাইল খানেক দূর হবে। কিছুটা পথ গেলে মেট্রোরেল। জমির দাম হু-হু করে বাড়ছে। ঢাকা থেকে বাবুয়া মিস্ত্রি মজুর নিয়ে আসে।তাদের মজুরি ছাড়াও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর এদিক-সেদিকে শুয়ে পড়েছে সবাই।

মোবাইলে শব্দে ঘুম ভাঙ্গে,হাতড়ে বালিশের পাশ থেকে মোবাইল নিয়ে কানে লাগিয়ে বলল,হ্যালো?
–কংগ্রাটস অনি।
ধড়ফড়িয়ে উঠে অসে অনিমান। চিত্রা কি তার রেজাল্টের খবর পেয়েছে?কিন্তু কে দেবে খবর?জিজ্ঞেস করে,কংগ্রাটস?
–বেঙ্গলিতে আমি ক্লাসে টপ। ক্রেডিট গোশ টু ইউ অনি।হি-হি-হি। স্কুলের টাইম হয়ে গেছে। দেখা হলে আরো কথা হবে। রাখছি?
স্কুলের টাইম হয়ে গেছে?ঘাড় বেকিয়ে ঘড়ি দেখল,সাড়ে-আটটা বাজে। অনির আজ মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন সকাল ছিল। মা সকাল সকাল আমার জন্য চা নিয়ে আসতো। কিন্তু সেদিন চা নিয়ে না আসায় মনে হলো শরীর খারাপ নাকি?খাট থেকে নেমে মার ঘরে গিয়ে দেখল শুয়ে আছে।
–তোমার শরীর খারাপ?গায়ে হাত দিয়ে দেখে ঠাণ্ডা।তাহলে?এক ঝটকায় ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামে।ঐ অবস্থায় ডা.কাকুর বাড়ীতে গিয়ে, শুভা শুভা বলে চিৎকার করতে লাগল। শুভ্রতা বেরিয়ে চমকে ওঠে,কি হল অনি?
–শিগগীর এসো আমার মা–।কেঁদে ফেলে অনিমান।
শুভা বলল,তুমি যাও আমি এখুনি আসছি।
অনিমান বাসায় ফিরে বিছানায় শায়িত মায়ের দিকে বোবা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। মা কি নেই?সবাই আছে এই পৃথিবীতে শুধু তার মা নেই?কিছুক্ষণের মধ্যে শুভা তার বাবাকে নিয়ে উপস্থিত হয়। ডা.কাকু নাড়ী পরীক্ষা করেন। কাঁধে হাত রাখে শুভা। ডা.কাকু ব্যাগ হাতে বেরিয়ে যান। শুভা বলল,কি হল বাপি?অনি আমি এক্ষুনি আসছি । শুভা বাবার সঙ্গে চলে গেল।

দুঃসংবাদ বাতাসের আগে ছোটে। রাজু ভাই এলো আরও অনেকে এসে দেখে গেল। রবি কাকু এসেই ভাতিজাকে চোটপাট করতে থাকে,একটা খবর দিতে কি হয়?বিজয় না বললে জানতেই পারতাম না। অনির মনে হল কাকা যদি রোজ এসে হম্বিতম্বি না করত তাহলে মা এত তাড়াতাড়ি চলে যেত না। আমার বাবার ছোট একটি বাড়ির জায়গার উপর কাকার লোভ গেল না। বাবার মারা যাবার পর থেকেই আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে।

আলপনা মা-গো বলে আছড়ে পড়ে মার উপর। শুভা এক ফাঁকে এসে অনিমানের হাতে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে বলল,পরে আসব।
বেলা ভাবিও এসেছিল। মা কি আগেই সব টের পেয়েছিল?
মৃত্যুর আগে কি মানুষ বুঝতে পারে?
পাড়ার অনেকেই এসেছিল। নানাভাবে সান্তনা দিচ্ছিল,কিছুই ভাল লাগছিল না। পৃথিবীতে নিজেকে বড় একা মনে হয়। সারাদিন টো-টো করে বেড়াতাম মা একা বাড়ীতে থাকতো। কতক্ষনই বা মায়ের সঙ্গে থাকতাম। এখন বুঝতে পারছি মা না থাকা কি?
এখনও আগের কথা মনে করলে চোখে অশ্রু চলে আসে। একটি কবিতার কয়েকটি উক্তির কথা মনে পড়ে গেল।

সর্বসহা কন্যা মোর! সর্বহারা মাতা!
শূন্য নাহি রহে কভু মাতা ও বিধাতা।
হারা-বুকে আজ তব ফিরিয়াছে যারা-
হয়ত তাদেরি স্মৃতি এই ‘সর্বহারা’!

.
.
চলবে…!

[গল্পটির অনেক চরিত্রের নাম পরিবর্তন হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন না লিখার ফলে অনেক চরিত্রের নাম ভুলে গেছি। তবে আশাকরি নতুন নামে গল্পটা বুঝতে সমস্যা হবে না।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here