জীবনের অন্যরঙ [১ম পর্ব]

0
2100

#জীবনের অন্যরঙ [১ম পর্ব]
#আজিজুর রহমান

আজকের গল্পটা আমাকে নিয়ে। চিরাচরিত জীবনে অনেক রঙ দেখা হয়েছে। সে রঙ হতে আজকে একটি গল্প বলব।
আমাদের পাড়ায় মধ্যবিত্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের বাস। কয়েকঘর হিন্দু এবং কয়েকঘর শিখ ছাড়া সবাই বাঙালি মানে সবাই মুসলিম। আমি অনিমান চৌধুরী। আমার নাম শুনে কেউ বুঝতে পারবে না আমি আসলে হিন্দু নাকি মুসলিম। আসলে চৌধুরী বাদ দিলে সহজে কেউ বুঝতে পারবে না। যাই হোক আমি কি তা পরে জানা যাবে।

মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হল। পাশ করলেও নতুন সমস্যা, পড়াশুনায় ইতি টানতে হবে এখানেই। বাবার পৈতৃক বাড়ি থাকায় মাথার উপরে ছাদের কোনো সমস্যা ছিল না। পাড়ার এক বড় ভাই রাজু টিউশনির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। টিউশনির যে মাইনে তা দিয়ে মাধ্যমিক পড়া হয়ে গেলেও কলেজে পড়া অনেক কষ্টকর হয়ে যাবে। তবে আমার স্বপ্ন আমি অনেক বড় কিছু হব। মা-বাবা মারা গিয়েছে। আমার বন্ধু-বান্ধব সবাই উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে আমিই একমাত্র কলা বিভাগে ভর্তি হলাম। ওদের ধারণা শুভ্রতা এর কারণ।যারা যেমন তারা তেমনই ভাববে।

শুভ্রতা আমাদের পাড়ার ডাক্তার কাকুর মেয়ে। শুভ্রতাকে আমার ভাল লাগতো কিন্তু ও আমাকে পাত্তাই দিতনা। সে জন্য মনে আমার কোনো খেদ ছিল না। সাধারণ কেরাণীর ছেলে আমি,ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা শোভা পায় না। এখন অবস্থা আরও করুণ। তবু রাস্তা ঘাটে শুভ্রতাকে দেখলে মনে অদ্ভুত একটা অনুভুতির সঞ্চার হতো মানে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। পাশ কাটিয়ে চলে যাবার পর আকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম পিছন ফিরে একবার দেখে কিনা?আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেত একবারও ঘুরে দেখতো না।
অবশ্য ছোটো বেলা থেকে একটা স্বপ্ন মনের অগোচরে বাসা বেঁধেছিল–লেখক হবো। এই স্বপ্নটা আমার কাছে অলীক কল্পনা বটেই। তবে সবাই আমার অগোচরে অনেক হাসি-তামাশা করে থাকে এই ব্যাপারে। অনেকে বোকা,বুদ্ধু আরো অনেক কিছুই বলে থাকে।

দারিদ্রের মধ্য থেকে উঠে এসেছে অনেক প্রতিষ্টিত লেখক এরকম অনেক কাহিনী আমাকে প্রেরণা দেয়।একদিন একটা গল্প লিখে বন্ধুদের পড়ে শোনালাম। অবুঝ প্রেমের গল্প। নায়িকার নাম শুভা । কোনো কিছু ভেবে এই নাম দিইনি কিন্তু বন্ধুরা গল্প কেমন হয়েছে তার ধারে কাছে না গিয়ে জিজ্ঞেস করল,এ্যাই শুভা কে রে?

বুঝতে পারলাম চামারকে দিয়ে কামারের কাজ হয়না।ওরা ধরে নিল শুভ্রতার কথা ভেবেই নায়িকার নাম দিয়েছি শুভা। সেদিন থেকে ওরা আমার সঙ্গে শুভ্রতার নাম জড়িয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি শুরু করল। শুভ্রতার কানে এসব কথা গেলে লজ্জার শেষ থাকবে না। সত্যি কথা বলতে কি ওদের জন্যই শুভ্রতা আমার মনে জায়গা করে নিল।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নাছির ভাইয়ের যোগা ক্লাস। বাসায় ফিরে স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে কলেজ। শনি রবিবার দুপুরে টিউশনি। সন্ধ্যে বেলা এদিক-ওদিক ঘুরে পড়তে বসা এই ছিল অনিমানের সারাদিনের রুটিন। অন্য সময় সারা পাড়া টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো।

নাছির ভাইয়ের যোগ ব্যায়ামের ক্লাস থেকে বেরিয়ে অনিমান দেখল রেহানা আন্টি আসছে্ন।একহাতে বাজারের থলে অন্য হাতে লাঠি।মাধ্যমিক পাস করার পর নাছির ভাইয়ের যোগ ব্যায়াম ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল,এবার উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। অর্নি আপু ছেড়ে দিয়েছে ভাবছে সেও এবার ছেড়ে দেবে। নাছির ভাই কেমন মেয়েলি ধরণের, পাড়ার অনেকের কাছে শোনা অনেকের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক আছে। আমি অতশত সম্পর্কের ব্যাপারে বুঝি না। রেহানা আণ্টি কাছে এসে বলেন,এখানে দাঁড়িয়ে?
–তোমাকে দেখে দাড়ালাম। তুমি বাজারে গেছিলে?
–আমি না গেলে কে যাবে?
অনিমান হাত থেকে থলি নিয়ে বলল,চলো তোমাকে পৌঁছে দিই।

বছর দুই হল সোহাগ কাকু মারা গেছেন। ফ্লাটে তারপর থেকে একাই থাকে রেহানা আণ্টি। অনিমানের মায়ের বয়সী কি কয়েক বছরের ছোট হবে। সোহাগ কাকু একটা বাণিজ্যিক সংস্থায় বড় চাকরিতে ছিলেন। গাড়ি ছিল,নিজে ড্রাইভ করে অফিস যেতেন। পাড়ায় কারো সঙ্গে মিশতেন না,একটু উন্নাসিক প্রকৃতির। সেই সোহাগ কাকুর বউ রেহানা আন্টির কি অবস্থা আজ। বা-পাটা ভাল করে ফেলতে পারেনা,রাস্তায় বেরোলে লাঠি থাকে সঙ্গে।
–স্বার্থপরটা আমাকে একা ফেলে চলে গেল।আণ্টির দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
রেহানা আণ্টির উপর মায়া হয়। দুই মেয়ে কোনো ছেলে নেই। মেয়েরা দুজনেই বিদেশে থাকে। ছেলে থাকলে নাতি বউমা নিয়ে সংসার করত। বাজারে যেতে হত না।
–আণ্টি কাকু নেই তো কি হয়েছে। তোমার কোনো অসুবিধে হলে আমাকে বলবে।

প্রসঙ্গ বদলাতে জিজ্ঞেস করে,তুমি লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারো না?
–পারবো না কেন।আসলে ভারী শরীর বা-পাটায় চাপ পড়লে হাটুতে টন টন করে। হাতে লাঠি থাকলে একটু ভরসা হয়।

–আণ্টি হাটতে তোমার কষ্ট হয়?
আণ্টি ঘুরে দাঁড়িয়ে মায়া জড়ানো চোখ তুলে আমাকে দেখেন। তারপর কি ভেবে বললেন,কষ্ট আর কি?ভালই আছি,বা-পাটা ভাজ করতে পারি না। মাঝে মাঝে হাটুটা ব্যথা করে। এই বয়সে কি যে রোগ হল।
ফ্লাটের নীচে এসে গেছি,থলিটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,না মানে এই বাজার-টাজার।আসি আণ্টি?
–এতদুর এলি আয় এককাপ চা খেয়ে যা।
–আবার তুমি চা করবে? আজ নয় অন্য কোনো দিন।

অপলক দৃষ্টিতে অনিমানকে দেখতে থাকেন।কলেজে পড়ে কিন্তু একেবারে ছেলে মানুষ।
–তুই নাকি গল্প লিখিস? রেহানা আচমকা জিজ্ঞেস করেন।
অনিমানের পা থেমে গেল। মাথা নীচু করে লাজুক হাসে।
–কোথাও ছাপা হয়েছে?
–একটা প্রতিযোগিতায় দিয়েছিলাম। প্রথম হয়েছে,ওদের পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।
–তোর অনেক গুণ।
–আজ আসি অন্য কোনো দিন কথা হবে।

রেহানা ভাবতে থাকে পাড়ার মধ্যে অনিমানের মতো ভালো ছেলে কখনো দেখে নি। ছেলেটাকে দেখলে খুব মায়া হয়। মা-বাবা মারা গেছে তাতেও ছেলেটির কোনো দুঃখ নেই। বাবার পৈতৃক বাড়িতে একা থেকে টিউশনি করে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা খুবই সরল সোজা। সবাইকে অল্প সময়ে আপন করে নেই।

স্কুলের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে,শীতের শুরু।
তাই অনিমান সকাল সকাল হাঁটতে বের হয়েছে। পাড়ার অনেকে শীতের সকালে নিজের শরীরকে গরম রাখার জন্য খেলাধুলো করে। আগের মতো আর কাঠ,লাকড়ি, পাতা দিয়ে আগুণ পুড়ানো হয় না। দিনদিন সব বদলে যাচ্ছে। ওরা কি খেলছে দেখার জন্য এগোতে থাকে। নজরে পড়ল একটা গাছের ছায়ায় অর্নিতা বসে উদাসভাবে। অর্নি আপু কে এভাবে একলা বসে থাকতে দেখে অবাক হয়। কলকাতার মেয়েরা উচ্ছ্বল খুব খোলামেলা,অর্নি আপু কে অনিমানের খুব ভাল লাগে। অর্নি আপুর পরিবার কলকাতা ছেড়ে আমাদের দেশে চলে আসে। এই দেশে এসে আপুরা আমাদের পাড়াতে আসে। অর্নি আপুর দিকে এগিয়ে গেল। চোখাচুখি হতে হাসি বিনিময় করে।
–এখানে বসে কি ভাবছো?
অর্নি আপু চমকে তাকায় হেসে বলল,তোর কথা ভাবছিলাম।

অনিমান লজ্জা পেয়ে বলল,খালি ইয়ার্কি।
–দাঁড়িয়ে কেন বোস।
অনিমান দুরত্ব বাচিয়ে বসল। অনিমান জিজ্ঞেস করল, তুই যোগা ক্লাসে যাস না কেন?
কেন যায়না সে কথা অর্নি আপুকে বলা যায় না,কিছুতো বলতে হবে ভেবে অনিমান বলল, নাছির ভাই খুব অসভ্য।
ঝর্ণার মত ঝরঝরিয়ে হেসে ওঠে অর্নি আপু। অর্নি আপু হাসলে বেশ লাগে। অর্নি আপুর বাবা বদিউল মির্জা আই পি এস অফিসার পাড়ায় কারো সঙ্গে তেমন মেলামেশা নেই অথচ অর্নি আপু কত সহজভাবে মেশে সবার সঙ্গে। হাসি থামলে অর্নি আপু বলল,লোকটা হোমো আছে। হাবুর সঙ্গে রিলেশন আছে,আমিও ছেড়ে দিব।
যে কথা বলতে সঙ্কোচ হচ্ছিল অর্নি আপু কত সহজভাবে বলে দিল। মনে ময়লা না থাকলে তারা সহজভাবে বলতে পারে। অনিমান মনে মনে ভাবে সে কেন বলতে পারেনি?
–তুই স্টোরি লিখছিস তো?
–তুমি ত বাংলা পড়তে পারো না।
–একদম পারিনা সেটা ঠিক না। এখুন বাংলা শিখছি,তুই আমাকে শেখাবি?
অনিমান বুঝতে পারেনা অর্নি আপু কি মজা করছে?অর্নিতা জিজ্ঞেস করে,কিছু বললি নাতো?
–ছাত্রী বড় শিক্ষক ছোটো।হি-হি-হি। অনিমান মজা পায়।
অর্নিতার ভ্রু কুচকে যায় বলে,বোকার মত হাসিস নাতো। তুই আমার চেয়ে তিন বছর ছোটো হবি?ইটস ট্রেডিশন্যাল থিঙ্কিং। মেয়েরা হাজব্যাণ্ডের চেয়ে ছোট হতে হবে?আচ্ছা বলতো অনি সমস্যা কি আছে?
মেয়ে হাজব্যাণ্ড কেন আসছে। অনিমান বুঝতে পারেনা ইতস্তত করে।
–অনি মিনস আশ্রয়স্থল। অর্নিতা বলল।
–ধ্যেৎ আমার নাম ত অনি নয় অনিমান। যার নিজের কিছু নেই।
–তোর মধ্যে একটা এট্রাকশন আছে মেয়েরা খুব লাইক করে। খুব সাবধান মেয়ে থেকে দূরে থাকবি।

অনিমান ভাবে শুভ্রতা তাকে পাত্তা দেয়না। অর্নি আপু বলছে মেয়েরা লাইক করে। সীমা হাপাতে হাপাতে হাজির হয়।
–কিরে গেম আপ?কে জিতলো?অর্নিতা জিজ্ঞেস করে।

অনিমান এই সুযোগে সেখান থেকে সরে পড়ে।এতক্ষন একান্তে কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বললে,অনেকে অনেক রকম অর্থ করে। অনিমান লক্ষ্য করেছে অর্নি আপু একমাত্র ব্যতীক্রম। অর্নি আপুর সঙ্গে প্রেম করার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেনা। মেয়েদের ব্যাপারটা সম্পর্কে অনিমানের মনে অনেক প্রশ্ন।কেন তারা এরকম হয়?লেখকদের সব কিছু জানতে হয়। কিন্তু সে কিছুই জানে না।

সকালটা কেমন উদাস লাগে অনিমানের,চারদিকে তাকিয়ে দেখে আম জাম কাঁঠাল কত রকমের গাছ সারি সারি। একটা কাঁঠাল গাছের নীচে ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে।
কেবল বাইরে থেকে দেখলে হবেনা,লেখকদের মনের গভীরে ডুব দিতে হবে। ছেলেরা দেখতে একরকম আর মেয়েরা অন্য রকম আচ্ছা তাদের মনও কি আলাদা?বয়সের সঙ্গে মনও কি বদলায়?কিম্বা একজন বাঙালি এবং অবাঙালির ভাবনা-চিন্তা কি স্বতন্ত্র?নানা প্রশ্ন অনিমানের মনকে কুরে কুরে খায়। একটা তন্দ্রার ভাব হয়তো এসে থাকবে হঠাৎ মনে হল মুখের উপর বুঝি একটা পোকা হেটে বেড়াচ্ছে। ধড়ফড়িয়ে চোখ মেলতে দেখল অর্নি আপু। গাছের পাতা দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
জিন্সের প্যাণ্ট শার্টে বেশ দেখতে লাগছে অর্নি আপুকে। অর্নি আপু জিজ্ঞেস করে,কিরে ঘুমোচ্ছিলি?
উঠে বসে বলল,না এমনি শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম।
–রাইটাররা খুব ভাবে। তুই আমাকে নিয়ে একটা পোয়েম বলতো।
–ধুস এভাবে হয় নাকি?
–দু-এক লাইন বল।
অর্নি আপু তাকে নিয়ে মজা করতে ভালবাসে তবু অনিমানের ভাল লাগে অর্নি আপুকে। অর্নি আপু তাগাদা দেয়,কিরে বল।
একটু ভেবে নিয়ে অনিমান বলে, বিশালাক্ষী প্রেমের ফুল ছড়িয়েছে তার সুভা / তৃষ্ণাত্ব ভ্রুমর পেয়েছে তার প্রেমের আভা –।
ঝরণার মত হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে অর্নি আপু। হাসি সামলে অর্নি আপু বলল,আমি কি বিশালাক্ষী ?তুই একটা বুদধু আছিস।
অনিমান বলল,অর্নি আপু তুমি খুব ভাল তুমি অনন্য /তোমার স্পর্শে ঘুচে যায় মনের যত মালিন্য।
অর্নি আপু দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে,দৃষ্টিতে উদাস ভাব। তারপর অনির দিকে ঘন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,আমার স্পর্শে সব মালিন্য দূর হয়ে যায়?
অনিমানের গা ছমছম করে,কি বলবে বুঝতে পারেনা। অর্নি আপু জিজ্ঞেস করল, অনি সত্যি করে বলতো,বাঙালী বিহারী পাঞ্জাবী নেপালী–তোর কাকে বেশি ভাল লাগে?
–সত্যি করে বলব?জানো অর্নি আপু বাঙালী বিহারী পাঞ্জাবী মানুষের খোলস। আমার ভিতরের মানুষটাই আমার কাছে গুরুত্বপুর্ণ।
অর্নিতা মিটমিট করে হাসতে থাকে। বলল,চল বাড়ির দিকে যাওয়া যাক। অনেকটা সকাল হয়েছে।

মেয়েদের দল ছেড়ে অর্নি আপু অনিমানের পাশে হেঁটে চলছে। বিপরীত দিকে মেয়েরা হাঁটতে বের হয়েছে।
–তুমি আমার সাথে হাঁটছো যে?
–তোকে খুব ইন্টারেশটিং লাগে। আমার খুব পছন্দ, অর্নি আপু বলল।
অনিমান এদিক-ওদিক তাকায়,অর্নি আপুর কথা কেউ শোনেনি তো। অর্নি আপু তাকে নিয়ে মজা করছে। মেয়েদের মধ্যে শুভ্রতাকেও দেখা যাচ্ছে। কি জানি কি ভাবছে শুভ্রতা।

বাড়ির কাছাকাছি আসতে কাউকে দেখতে পেলাম। মনে হচ্ছে বাবার কোনো দেনাদার?আরে এটা তো রবি কাকু এসেছে?

রবি কাকু বলল, শোন অনি আমি তোর বাবা আমার থেকে অনেক টাকা নিয়েছে, যার ঋণ এখনো তুই শোধ করতে পারিস নি। আমারো ব্যবসায় লোকসান দেখা দিয়েছে। তাই আমি চাচ্ছি টাকার বদলে তোদের এই বাড়িটাকে বিক্রি করে আমার টাকা পরিশোধ কর, নাহয় এই বাড়িটা আমাকে দিয়ে দে।

অনি বলল, কাকু এই বাড়ি না থাকলে আমি কোথায় দাঁড়াবো আর কোথায় থাকবো? আমাকে কিছু দিনের সময় দিন ভাবার।

অনি বুজতে পেরেছে রবি কাকু কেন আজ এসেছে। ঋণের নাম করে এই বাড়িটাও হাতিয়ে নিতে চাই। রবি কাকু তা হলে এই মতলবে এসেছে?বাড়ীটা প্রোমোটারের হাতে তুলে দিতে চায়। বাবা-মা অকালে মারা গিয়েছে। বাবা কেরানী চাকরি করত। ভালো করে সংসারও চলতো না। তাই অনেক দেনা হয়ে গিয়েছিল বাবার। আজ এই দেনার কারণে পৈতৃক বাড়িটাও হারাতে হবে মনে হচ্ছে।

মা আমাকে অনেক ভালোবাসত। আজ মাও নেই। আজ অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এই একলা জীবনে কি হতে চলেছে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। কে তাকে রবি কাকুর হাত থেকে বাঁচাবে? অর্নি আপুর কথা মনে পড়ল। সব বলতে হবে অর্নি আপুকে। অর্নি আপুর খুব সাহস,কাউকে ভয় পায়না। অর্নি আপুর ড্যাড পুলিশের উচ্চপদে আছে। অনিমান আশ্বস্থ বোধ করে। অনিমান নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ল বাহিরে।

দূর থেকে দেখল মিতা বাড়ীর সামনে দাড়িয়ে।ওদের বাড়ীর কাছে আসতে মিতার গলা পেল,এই যে লেখক কি ভাবছিস, আশপাশ কিছু দেখতে পাচ্ছিস না?
চোখ তুলে দেখল মুচকি হাসছে মিতা। অনি বলল,তুই এখানে দাঁড়িয়ে?
–কোচিং যাবো বলে বেরিয়েছি,তোকে দেখলাম তাই–।
–আমাকে দেখলে কোচিং যাওয়া যায়না?
–আচ্ছা সবাই তোকে বুদধু বলে কেন?মিতার ঠোটে হাসি।
–আমি বোকা তাই।
–আমি কি তোকে তাই বলেছি?
–মানুষ যা ভাবে সব কথা কি মুখে বলে?
–তুই যা ভাবিস না বললে অন্যে বুঝবে কি করে?
–কি ব্যাপার বলতো?আমি কি লোক ডেকে ডেকে বলব,এইযে শুনুন আমি এই-এই ভাবছি?
খিল খিল করে হেসে উঠল মিতা। মানুষ হাসলে অনিমানের দেখতে খুব ভাল লাগে। বিশেষ করে মেয়েরা।
–আচ্ছা বলতো রুহিকে তোর কেমন মনে হয়?
–মন্দ কি,ভালই মনে হয়।
–সবাই তোর কাছে ভাল। কতটুকু জানিস ওকে?
অনিমান বিরক্ত হয়।গম্ভীরভাবে বলল,মিতা তোর কি কোনো কাজ নেই?অন্যকে নিয়ে ভাবার এত সময় পাস কোথায়?
— অন্যকে নিয়ে ভাবতে বয়ে গেছে। চোখে পড়েছে তাই বলেছি।
–কি চোখে পড়েছে?
–সাধে কি তোকে বুদ্ধু বলে? কিছুদিন আগে কি কাণ্ড ঘটিয়েছে জানিস? রুহি ও শুভ উমমম….না.. না… রুহিকে প্রমিজ করেছি আমি।
–আমি শুনতে চাইনা। তোর কোচিং এসে গেছে তুই যা।

মিতা চলে যেতে অনিমান ভাবে,ওদের কোচিং থেকে যে সাজেশন দেবে মিতার কাছে চাইবে কিনা? রুহি আর শুভ কি করেছে? আন্টি সারাক্ষণ মেয়েকে চোখে চোখে রাখে তার মধ্যেই এতকাণ্ড?প্রেমের জোয়ার কি বাঁধ দিয়ে আটকানো যায়?

বাইরে থেকে মানুষকে যেভাবে দেখা যায় তাছাড়াও প্রত্যেক মানুষের একটা গভীর গোপন জগত আছে তার খবর সবাই রাখেনা।

রাজন অফিস বেরিয়ে গেল। রাজু ভাতিজাকে আনতে স্কুলে গেছে। মুন্নী এতক্ষনে নিঃশ্বাস ফেলে।ছেলে ফিরলে তাকে স্নান করিয়ে খাইয়ে তবে শান্তি। দেওর কে কথাটা বলব-বলব করেও বলা হয়নি পাছে ভুল বোঝে। চারটি প্রাণীর সুখের সংসার। কোনো আচড় পড়ুক মুন্নী চায়না।
ওরা ফিরলে ছেলেকে খাইয়ে দেওর ভাবি খেতে বসেছে। রাজু মুখ বুজে খেতে থাকে। রান্না ভালমন্দ তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। যা পায় তৃপ্তি করে খায়। মুন্নী বলল,আচ্ছা ভাই সারাদিন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ালে চলবে?
রাজু মুখ তুলে তাকায় জিজ্ঞেস করে, ভাইয়া কিছু বলেছে?
–ভাই বলবে কেন?আমিই বলছি।
রাজু স্বস্তির শ্বাস ফেলে আবার খেতে থাকে। মুন্নী বলল,আমি বললে পাত্তা দেবার দরকার নেই?
–আচ্ছা বলো।
–নিজের কথা একটু ভাববে না?তুমি কি বিয়ে-টিয়ে কিছু করবে না?সারাজীবন ভাইয়ের সংসারে ফাই-ফরমাস খাটবে?
–তুমি কি কোনো মেয়ের সন্ধান পেয়েছো?
–বেকার ছেলেকে বিয়ে করবে কার এত দায় পড়েছে?
রাজুর মা নেই,অবাক হয়ে ভাবিকে দেখে।একেবারে মায়ের মত কথা বলছে। রাজু বলল,ভাবি একটা কথা জিজ্ঞেস করব,রাগ করবেনা?
–রাগের কথা হলে রাগ করব।
–এই যে তোমার সংসারে একজন অকম্মা দেওর বসে বসে খায় তোমার খুব খারাপ লাগে তাইনা?
–ঠিক আছে আর কখনো যদি তোমায় কিছু বলি–।
রাজু উঠে পড়ে বলল,এইতো রাগ করলে?
–রাগ করব না?তুমি একথা কেন বললে?
–অন্যায় হয়ে গেছে,লক্ষী ভাবি এবারের মত মাপ করে দাও। কথা দিচ্ছি আমি এবার চাকরির চেষ্টা করব।
মুন্নীর ঠোঁটের কোলে হাসির ঝিলিক,তুমি ওর ভাই,আমি তোমাকে দেওর বলি বটে কিন্তু তোমাকে নিজের ভাইয়ের মত মনে করি।

অনিমান ফেরার পথে আবার মিতার সঙ্গে দেখা।সামনা সামনি হতে জিজ্ঞেস করে, কোচিং শেষ হল?
–আবার তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মিতা হেসে বলল।
–চরণ রেখা যায়না দেখা চলে গেলে অনেক দূরে..।
মিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,মানে?
–একটা কবিতার লাইন। একদিন কে কোথায় চলে যাবো,শেষ হবে দেখাদেখির পালা।
মিতা উদাস কণ্ঠে বলে,তোকে জানতে পারলাম না,তুই অন্য রকম।
–আগে নিজেকে জানো।
–তুই কি বলছিস,নিজেকে জানিনা আমি?
–তোর সম্পূর্ণ নাম পারমিতা। এর অর্থ কি জানিস?
মিতা একটু ইতস্তত করে বলল,একজন বিদুষীর নাম।
–পারমিতা মানে পরিপুর্ণতা। সম্পুর্ণরূপে জানা–প্রজ্ঞা পারমিতা।
–তুই খুব পড়াশুনা করিস। আচ্ছা সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়াস পড়িস কখন?
–শুধু বই পড়েই কি শেখা যায়?
মিতার মনে দুষ্টু বুদ্ধি খেলা করে,জিজ্ঞেস করে,একটা কথা জিজ্ঞেস করব?রাগ করবি নাতো?
অনিমান দাঁড়িয়ে পড়ে ঘুরে তাকায়। মিতা জিজ্ঞেস করে তুই কি শুভ্রতাকে ভালবাসিস?
আচমকা শুভ্রতার কথা জিজ্ঞেস করবে অনিমান ভাবেনি। অনেকেই ওকে জড়িয়ে তাকে নিয়ে কথা বলে।অনিমান কখনো ভাবেনি ডাক্তার কাকুর মেয়ের সঙ্গে প্রেম প্রণয়ের কথা।
–কি হল কি ভাবছিস?ভাবছিস সত্যিটা বলবি কিনা?
অনিমান হাসল তারপর এদিক ওদিক দেখে সুর করে নীচু গলায় গান ধরে ,তােমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালােবাসা ভালােবাসা’—সখী, ভালােবাসা কারে কয়!
মিতা খিল খিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে বলল খুব চালু হয়েছিস?বললেই পারতিস বলবি না।
–জানি না।
–তার মানে?ভালবাসিস কিনা জানিস না?
–মানুষ নিজেকে সম্পুর্ণভাবে কতটুকু জানে?কিছু পৃষ্ঠা আছে দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা। কখনো তার অর্থোদ্ধার হয় আবার কখনো তা অজানাই থেকে যায়।
–তোর কথা কিছুই বুঝলাম না।
অনিমান ভাল করে লক্ষ্য করে মিতাকে।বুকের উপর বই চেপে ধরা। মেয়েদের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে।
–আচ্ছা মিতা তুই কাউকে ভালবাসিস না?অনিমান জিজ্ঞেস করে।
মিতার মুখে লাল ছোপ পড়ে বলে,জানিনা।
–দেখলি অনেক সময় আমরা কি চাই নিজেরাই বুঝতে পারিনা। তোর বাড়ি এসে গেছে।
মিতা মাথা নীচু করে একটু এগিয়ে গেটের কাছে গিয়ে পিছন ফিরে অদ্ভুত চোখে অনিকে দেখে।
অনি হাত নেড়ে এগিয়ে চলে। মিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। চরণ রেখা যায়না দেখা চলে গেলে অনেক দূরে,লাইনটা কানে অনুরণিত হয়। মা-বাবা ছাড়া অনাথ ছেলেটি কি করে যে একা থাকে আল্লাহ ভালো জানেন। কেমন মায়া হয় অনিটার জন্য।

অনিমান বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে মাটিতে পানি ঢেলে যে আকার দেওয়া হোক না কেন তাই হবে। মাটি দিয়ে অনেক প্রতিমা তৈরি হয়। আবার একই মাটি দিয়ে আল্লাহ আমাদের তৈরি করেছেন। যাই ভাবি না কেন প্রত্যেক ধর্মের একটা পরিচয় আমরা সবাই মানুষ। একই রক্ত বয়ে চলছে আমাদের শীরায়। তবুও কেন যে মানুষ এত ঈর্ষা করে একে অপরের প্রতি আজও বুঝতে পারি নি। আমার এটা না বুঝায় ভালো। সব বুঝে গেলে দুঃখের ছোঁয়ায় আমি শেষ হয়ে যেতে পারি।
মা বলেছে, “খোকা, যেভাবেই থাকিস না কেন কখনো নিজেকে জানার চেয়ে বেশি জানতে চাস নে। মানুষ যাই করুক না কেন যা ভালো তাই শিখে নিবি আর খারাপকে শুধু চিনে রাখবি।” আজও মায়ের কথা মনে আছে আমার। বাবার পেনশনের টাকা না পেলে আমি কখনো টিউশনি করে নিজের জীবন চালাতে পারতাম না। মায়ের স্বপ্ন ছিল আমি লেখাপড়া যেন শেষ করি। তাই এখনো পড়ালেখাকে কষ্ট করে চালিয়ে যাচ্ছি। সামনে কি হবে আল্লাহ ভালো জানেন।
.
.

চলবে…!

[আমার প্রথম সামাজিক লেখা গল্প। কেমন হয়েছে কমেন্ট করে জানাবেন। গল্পের চরিত্র সব কাল্পনিক হলেও সব চরিত্রের কথোপকথন বাস্তব থেকে নেওয়া। যদি ভুলক্রমে কারো সাথে মিলে যায় তাহলে ক্ষমা করবেন। ফ্যান্টাসি গল্পের সাথে এই গল্পটি চলমান থাকবে। একদিন পর পর করে দুটি গল্প চলবে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here