জীবনের অন্যরঙ পর্ব-২

0
379

#জীবনের অন্যরঙ [২য় পর্ব]
#আজিজুর রহমান

অনিমান ঘরে ঢুকে জামা কাপড় বদলে টেবিলের উপর দেখল ব্রাউন খামে মোড়া মোটামত কি যেন।হাতে তুলে বুঝতে পারে বই।খাম ছিড়ে বইটা বের করতেই একটা কাগজ পড়ল ,তুলে দেখল লেখা,প্রিয় বন্ধু আপনার প্রেরিত গল্পটি এই সংখ্যায় ছাপা হয়েছে। সঙ্গে বইয়ের এককপি পাঠানো হল।
অনেক দিন আগে পাঠিয়েছিল লেখাটা খেয়ালই ছিল না। বইটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখতে দেখতে মনে পড়ল অর্নি আপুর কথা। অর্নি আপু বলছিল বাংলা পড়তে শিখছে চাই।

স্নান খাওয়া সেরে অনিমান ম্যাগাজিনটা নিয়ে বসল। পাতা উলটে নিজের গল্পটা বের করে চোখ বোলায় “হঠাৎ বৃষ্টি।” পাশের বাড়ি ভাবি এসে বলল।
–আজ পড়ানো আছে তো? ভাবি জিজ্ঞেস করে।
–হ্যা যাবো।
–ছাতা নিয়ে বেরোবি,বৃষ্টি হতে পারে। পিয়ন কি দিয়ে গেল রে?
অনিমান বইটা ভাবির চোখের সামনে মেলে ধরে।ভাবি পড়ালেখা করে নি, তবে আমার রান্নাবান্না তিনিই করে দেন। ভাবি দেখে বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে,লিখলে টাকা দেয়না?
–টাকাটাই কি সব? যদি তোমার নাম ‘সাবরিনা সুমি’ ছাপার অক্ষরে বের হয় তোমার ভাল লাগবে না?
ভাবি উদাস চোখ মেলে অনিমানকে দেখে কয়েক মুহূর্ত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার আবার ভাল লাগা। তোর জন্য আমার যত চিন্তা,কি যে করবি তুই–। কথা শেষ না করে চলে গেল।
অনিমান আধশোয়া হয়ে গল্পটা পড়তে থাকে।আকাশে মেঘের খেলা। একপাল মেষ সারি দিয়ে চলেছে অনির্দেশ লক্ষ্যপথে। কখনো ভাল্লুকের দল ধীর পদে একরাশ ভাবনা মাথায় নিয়ে এগিয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে যেন নতুন গল্প পড়ছে। ভাল্লুক কি ভাবনা-চিন্তা করে?প্রশ্নটা মনে হতে পড়ায় ছেদ পড়ে। অনিমান ভাবে নিজেকে আড়ালে রেখে শিকারকে অনুসরণ করা কি চিন্তাছাড়া সম্ভব?

করিম ভাইয়ের চায়ের দোকানে আড্ডা চলছে। আড্ডার বিষয় অনির গল্প “হঠাৎ বৃষ্টি।” রাজু জিজ্ঞেস করে,আচ্ছা তোর গল্পে মিল থাকে না কেন?
–আমি মিল-অমিল ভেবে লিখিনা। যেখানে যেমন স্বাভাবিক সেই মত লিখি।

বন্ধুবান্ধবরা সবাই গল্প নিয়ে মজা করে। এদের আর গল্প পড়াবে না। এরা তার গল্পের মর্যাদা বুঝবে না। রাজু ভাই চুপচাপ বসে আছে।
–কি গো রাজু ভাই তুমি একেবারে চুপ মেরে গেলে?সুজন জিজ্ঞেস করে।
–একটা খবর তোরা জানিস না।
–পাড়ার কোনো খবর?
–বদরুল মির্জা দেশে চলে যাচ্ছে।
–ফ্লাট কি হবে?
–বিক্রী হয়ে গেছে।
অনিমান উঠে পড়ল। সুজন জিজ্ঞেস করে,চললি?
–একটু কাজ আছে।
অনিমানের মন খারাপ। বদরুল মির্জা চলে যাবেন মানে অর্নি আপুও চলে যাবে? চলে যাবার কথা অনেকদিন আগেই শুনেছিল কিন্তু সত্যিই চলে যাবে মেনে নিতে খারাপ লাগছে। অনির পিছনে পিছনে সিরাজও বেরিয়ে এল।
–অনি দাড়া আমিও যাবো।
দুজনে পাশাপাশি চলতে থাকে। অনি আপন মনে বলে,অর্নি আপু চলে গেলে পাড়াটা ফাঁকা ফাঁকা লাগবে।
–ঠিকই পাঞ্জাবী হলেও বেশ জমিয়ে রেখেছিল।সিরাজ বলল।
–অবশ্য একদিন আমাদের সবাইকে যেতে হবে।দার্শনিকের মত বলে অনি।

–তোর একা থাকতে অসুবিধে হয় নাতো?
–আমার মা বলতো ” দ্যাখ অনি,সংসার থাকলে দুঃখ-কষ্টও থাকবে তোরে সব সময় মানায়ে চলতে হবে।তাহলি কিছু টের পাবি না। টের পালিই কষ্ট।”
–কি ভাবে মানিয়ে চলিস?
–নিজেরে জলের মত মনে করবি। যেই পাত্রে রাখবে সেই আকার ধরবি,মা বলতো।
ব্যাটা একেবারে বোকা না,সিরাজ ভাবে। ওর সঙ্গে কথা বলতে ভালই লাগে।
–আচ্ছা অনি, তোরে যদি কেউ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ,তুই কি করবি?
–আমি ওনার কাছে তুচ্ছ হয়ে থাকবো। মা বলতো,স্রোতের শ্যাওলা এই জীবন ভাসতে ভাসতে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কে বলতে পারে?
অনির প্রতি মায়া অনুভব করে সিরাজ। একা কিভাবে জীবনটাকে চালিয়ে যাচ্ছে না দেখলে বুঝা যায় না। সবসময় মুখে হাসি লেগেই থাকবে। সবার মনকে খুব কাছ হতে বুঝে ফেলে। অনির এমন দার্শনিক কথাবার্তা আমাকে সবসময় ভাবায়। সিরাজ বাড়ির গলির পথ ধরে। সামনে একটু দূরে মিতা চলেছে।কোচিং থেকে ফিরছে।

–কি রে তুই আমাকে দেখিস নি?
মিতার গলা পেয়ে অনি বলল,তুই আমাকে দেখিস নি?
–দেখব না কেন?সিরাজের সঙ্গে কথা বলছিলি তাই।
–তোকে একটা কথা বলি?
মিতা মুখ টিপে হাসে। অনি বলল,তোদের কোচিং থেকে সাজেশন দিলে আমাকে দিবি?
–তোর আর আমার সাব্জেক্ট কি এক?তোর কি নিউট্রিশন আছে?
–যে সাবজেক্ট গুলো কমন যেমন ইংরেজি বাংলা–।
–বুঝেছি কিন্তু একটা শর্তে। তুই অন্য কাউকে দিবিনা।
–আমি কেন অন্যকে দিতে যাবো?
–ঠিক আছে,তোকেই শুধু দেবো। সাজেশন নিয়ে কি করবি?সারাদিন দেখি করিম ভাইয়ের দোকানে আড্ডা মারছিস।
মিতার গলায় শাসনের সুর। অনি ভাল করে লক্ষ্য করে। মেয়েদের আচরণ নিয়ে অনির বেশ কৌতুহল বেড়েছে। তাদের আচার-আচরণ যেন হঠাৎ করে পরিবর্তন হয়ে যায়। তাদের সৌন্দর্য কি করে বেড়ে চলে এটা রহস্য রয়ে গেল। মেয়েদের নিয়ে অনির কৌতুহল শুধু বেড়েছে।
–মিতা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি করছিস?
–কাকু অনি কথা বলছিল তাই–। থতমত খেয়ে মিতা বলল।
–যাও বাড়ী যাও।
মিতা চলে যেতে কাকু অনিকে বলল,ফের যদি দেখি রাস্তায় ওকে ডাকাডাকি করেছিস চাবকে সোজা করে দেবো।
অনিমানের মুখে কথা যোগায় না। বুঝতে পারেনা কি অপরাধ তার। মুখ কালো করে বাড়ীর পথ ধরে।আণ্টি তো এমন নয়। ওর কাকাটাই অনিকে সহ্য করতে পারেনা। ভাবির মুখে এককথা, সারাদিন কোথায় থাকিস?বাড়ী এসে লোকে ফিরে যায়।
–কেউ এসেছিল নাকি?
–একটু আগে ঐ পাঞ্জাবী মেয়েটা কি যেন নাম–তোর সঙ্গে কি নাকি জরুরী দরকার ছিল।
অর্নি আপু এসেছিল?অর্নি আপু তো বাড়িতে আসেনা। কি দরকার পড়ল? ইস মিতার সঙ্গে বকবক না করলে ওর কাকার ধমক খেতে হতনা,অর্নি আপুর সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। এখনই যাবে?এতবেলায় না বরং বিকেলে যাবে। অনিমান স্নানে ঢুকলো।
ভাবি গজগজ করে চলেছে। পড়াশোনা নেই সারাদিন টো-টো করে বেড়ানো। আমি না থাকলে তুই কি করে বাঁচবি। সেই কথা ভেবে ভেবে শান্তিতে মরতেও পারছিনা। ভাবি আমাকে খুব ভালোবাসে নিজের ছেলের মতো। ভাবির কোনো সন্তান না থাকায় আমাকে নিজের ছেলের আদর করে। এতে আমিও অনাথের ছায়া থেকে দূরে আছি বলে মনে হয়।
ভাবি মাঝে মাঝেই মরার হুমকি দেয়। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে।
রাজু ভাই আরেকটা টিউশনির খবর দিয়েছে।মেয়েটি নাইনে পড়ে,ইংরেজিটা ভাল করে শেখাতে হবে। বাবা ব্যাঙ্কে চাকরি বেতন ভালই দেবে।একান্নবর্তী পরিবার ভদ্র। বিকেলে বেরিয়ে অর্নি আপুর খবর নেবে,কেন এসেছিল?কি এমন জরুরী দরকার?দেখা না হওয়া অবধি চিন্তাটা খচখচ করতে থাকবে। সন্ধ্যের দিকে ট্যুইশনির ব্যাপারটাও সেরে নেবে।

অনিমান সিঁড়িঁ বেয়ে তিন তলায় উঠে গেল। অবাক হয়ে দেখল দরজায় তালা ঝুলছে। চার তলা থেকে একজন নামছিল,তাকে দেখে বলল,মির্জা সাহেব চলে গেছে।
–চলে গেছে?কবে গেছে?
–আজ দুপুর বেলা চলে গেল। ঘণ্টা খানেক আগে আসলে দেখা হতো।
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা অনিমান। ভাবি বলার সঙ্গে সঙ্গে এলে হয়তো দেখা হতো।যাবার আগে মনে হয় অর্নি আপু বিদায় নিতে এসেছিল। আর হয়তো কোনোদিন দেখা হবেনা।নীচে নেমে এল। বেলা আরেকটু পড়ুক তারপর না হয় সিমান্ত খাঁ বাড়ী যাওয়া যাবে। চোখে জল চলে আসায় হাসে অনিমান। বুঝতে পারে অর্নি আপুকে সত্যিই খুব ভাল বাসতো।
হঠাৎ খেয়াল হল রেহানা আণ্টির ফ্লাটের নীচে এসে পড়েছে। উপর দিকে তাকাতে ব্যালকণিতে বসে থাকা আণ্টির সঙ্গে চোখাচুখি হল। কিছু বলার আগেই অনিমান বলল,কাল আসব।
–খাওয়া-দাওয়ার পর দুপুরে আসিস। রেহানা বললেন।
অনিমান ভাবে কাল আসবে বলল যদি সিমান্ত সাহেব কাল থেকেই পড়াতে বলেন?বড় রাস্তার ধারে চার তলায় সিমান্ত সাহেব থাকেন। সন্ধ্যে নেমেছে এখন নিশ্চয়ই বাড়িতে ফিরে এসেছেন।কি বলবে মনে মনে ভেবে নিল। সপ্তাহে তিনদিনের বেশি পড়াতে রাজি হবেনা। চারতলায় উঠে কলিং বেল টিপতে একটি মেয়ে দরজা খুলে দিল। এই মনে হয় ছাত্রী। অনিমান বলল, রাজু ভাই পাঠিয়েছে।
মেয়েটি ভিতরে ডেকে বৈঠক খানা ঘরে বসতে বলে চলে গেল। কিছুক্ষন পর সিমান্ত সাহেব এবং একজন মহিলা ঢুকলেন। মহিলা সম্ভবত সিমান্ত সাহেবের স্ত্রী।
–তুমি কি পড়ো?
— বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ছি।
–ইংরেজিতে পাওনি?
–সেজন্য নয় বাংলা আমার পছন্দ।
কথাটা কি মহিলার পছন্দ হয়নি? মহিলা উঠে চলে গেলেন। সেদিকে তাকিয়ে সিমান্ত সাহেবও উঠে চলে গেলেন। ঘরে অনিমান একা। অন্য একজন মহিলা চা নিয়ে ঢুকলেন। চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন,নেও চা খাও। সামনে বসলেন মহিলা।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে কানে এল,বাইরে ফিস ফিস কথা চলছে। দেখেছো কেমন রাঙামুলোর মত চেহারা?একা একা মেয়ে ওর কাছে পড়বে?সামনে বসা মহিলা বুঝতে পেরে উঠে সামলাতে গেলেন।হ্যা ভাই ঠিকই বলেছে আপু। ঘি আগুন একসঙ্গে থাকলে বিপদ কখন ঘটে তার ঠিক আছে? অনিমান বুঝতে পারে কপালে কি আছে তার। সিমান্ত সাহেব গলা খাকারি দিয়ে ঢুকে বললেন,ঠিক আছে আপনি আসুন। রাজু কে সব বলে দেবো।
–আজ তাহলে আমি আসি?
সিঁড়িঁ দিয়ে নামতে নামতে অনিমান ভাবে,অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়।
এখানে টিউশনি হবেনা। কিন্তু তার একটা টিউশনি খুব দরকার ছিল,রোজ পড়াতে বললেও সে রাজি।ঘাড় ঘুরিয়ে সিমান্ত খাঁ এর এ্যাপার্টমেণ্টের দিকে তাকালো। সত্যি বাইরে থেকে মানুষকে কতটুকু চেনা যায়। একটা অভিজ্ঞতা হল। অর্নি মির্জা এখন হয়তো ট্রেনে। পাড়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার নতুন পরিবেশে মিশে যাবে। তার অভিভাবিকার মত ছিল। কোনোদিন আর দেখা হবেনা হয়তো। শেষবারের মত দেখা করতে এসেছিল,দেখা হল না।

কোনোকিছুই এক জায়গায় স্থির থাকে না।আজকের যৌবন কালকে পৌঢ়। এই দুনিয়ায় সতত চলছে নিত্য নাটের খেলা। এক শিল্পি এক শিশুর পবিত্র মুখের ছবি আঁকেন। সেই শিল্পী দীর্ঘকাল পরে এক নৃশংস পাপীর ছবি আঁকেন।জানা গেল অনেক কাল আগে আঁকা সেই পবিত্র শিশুই পরবর্তীকালের নৃশংস পাপী। জন্মের সময় কাদার তাল। তারপর সেই কাদা দিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে মাটির প্রতিমা।

অর্নি আপুর সঙ্গে দেখা হলনা,টিউশনিটাও হলনা। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে করিম ভাইয়ের দোকানে আসতে দেখল আড্ডা জমে উঠেছে। রাজু ভাই ছাড়া সবাই হাজির। অনিমান দোকানের এককোনে বসল। সবাই আড়চোখে তাকে দেখছে।পলাশ বলল,কিরে চা খাবি তো?অনি তাকিয়ে হাসে।পলাশ বলল, করিম ভাই পাঁচটাকে সাতটা।একটু পরেই রাজু ভাই এসে জিজ্ঞেস করে,অনি আসেনি?কোণে অনিকে দেখে পাশে বসতে বসতে বলল,এই আরেকটা চা বল। অনিকে জিজ্ঞেস করে,গেছিলি?কি বলল?
–তোমাকে বলবে বলল।
–আমাকে বলার কি আছে?একী মেয়ে দেখতে গেছিলি নাকি?
–এদের পছন্দ নয়।
–পছন্দ-অপছন্দের কথা আসছে কেন?
–আমি নাকি রাঙামুলোর মত দেখতে। মেয়ে আমার কাছে পড়লে কিছু ঘটে যেতে পারে।
সবাই হো-হো করে হেসে উঠল। বরুণ বলল,বোকা চেহারাখানা বানিয়েছে জব্বর। মেয়ে পটানো চেহারা।
–চুপ করতো। রাজু ভাই ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,তোকে এসব বলেছে?
–আমাকে বলবে কেন?আড়ালে আলোচনা হচ্ছিল শুনলাম।
–ভেবেছিলাম তোদের একটা গুড নিউজ দেবো–শালা মেজাজটাই খারাপ করে দিল। রাজু ভাই দুঃখ করে বলল।
–মেজাজ খারাপের কি আছে। ভাগ্যে থাকলে হবে। গুড নিউজটা কি?অনি বলল।
–বেকার জীবন ঘুচল। কাল থেকে অফিসে যাবো। শুভ কি একটা বলতে যাচ্ছিল থামিয়ে দিয়ে রাজু বলল,হবে–সব হবে। তোরা মেনু ঠিক করে ফেল।
সিরাজ হঠাৎ উঠে গেল। রাস্তার ওপারে বুকের কাছে বইয়ের গোছা তনিমা দাঁড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে। সিরাজ বেরিয়ে যেতে বস্তির দিকে হাঁটতে থাকে। ব্যাপারটা বুঝতে কারো অসুবিধে হয়না। বরুণ বলল,ঠিক নজরে পড়েছে।
–তোর এত বুক ফাঁটছে কেন?শুভ বলল।
তনিমা ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। গলির দিকে বাক নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সিরাজ আসতে জিজ্ঞেস করে,কি নিয়ে আড্ডা চলছিল?
–রাজু ভাই চাকরি পেয়েছে। একদিন সবাইকে খাওয়াবে বলেছে।
দুজনে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। তনিমা জিজ্ঞেস করে,তুমি কবে চাকরি করবে?
–দাঁড়াও আগে গ্রাজুয়েশনটা শেষ করি।
–ঐভাবে গ্যাজালে হবে?পড়াশুনা করতে হবেনা?
–বাড়ীতে দু’বেলা শুনেছি,তুমি আর জ্ঞান দিওনা তো।
ব্যাজার মুখ করে হাঁটতে থাকে সিরাজ। তনিমা বলল,আমি কিন্তু আর দশ মিনিট থাকবো।
–তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।
–ফালতু কথা বলবেনা,ওসবে তনিমা কে ভোলানো যাবেনা।
–কি ব্যাপার বলতো?কথা বললেই খচে যাচ্ছো?
–ফালতু কথা ভাল লাগেনা।
যা বলছে সব ফালতু?তাহলে কি বলবে,চুপচাপ হাঁটবে?সিরাজের মনে অনির কথাটা এল।
–জানো আজ একটা মজা হয়েছে।
–আবার ফালতু কথা?
–না শুনেই বলে দিলে।জানো অনিকে কি বলেছে?
তনিমা মুখ ঘুরিয়ে সিরাজের দিকে তাকালো,অনিকে নিয়ে আবার কোনো গল্প বানাবে নাতো?স্কুলে তনিমার সঙ্গে পড়ত অনিমান।ওর অদ্ভুত নাম নিয়ে মেয়েরা হাসাহাসি করত। ও গাঁয়ে মাখত না।
–রাজু ভাই ওকে এক বাড়ীতে ট্যুইশনি করতে পাঠিয়েছিল,ভাগিয়ে দিয়েছে।
–এর মধ্যে মজা কি হল?
সিরাজ হাসতে হাসতে বলল,ওরা রাঙামুলোর মত চেহারা কাউকে রাখবেনা।
–তোমার বন্ধু সত্যিই লালটু দেখতে।
–লালটু?
–ফালতূ কথা রাখো।কেন ডেকেছো বলো।
–দেখতে ইচ্ছে হয়না?তুমি ফোন ধরোনা কেন?
–কোচিং-এ থাকলে তুমি ফোন করবেনা।
–বাড়ীতে থাকলে করবনা কলেজে থাকলে করব না,তাহলে কখন করব?
–দেখা হচ্ছে ফোন করার দরকার কি?
–দেখা হলে সব কথা বলতে পারিনা।
–শোনো ফোনে উল্টোপাল্টা কিছু বলবেনা। এখন যাও আমার পাড়া এসে গেছে। কে দেখবে বাবাকে লাগাবে।
সিরাজ দাঁড়িয়ে পড়ে। তনিমা একবার পিছন ফিরে দেখে চলতে থাকে। পিকনিকে দেখেছিল অনিমান অর্নি আপুর সঙ্গে গাছ তলায় বসে গল্প করছিল। অর্নি আপুর সঙ্গে খুব ভাব।

সিরাজের মনে হল তনিমা বদলে যাচ্ছে। সব কিছুতেই ওভার রিএ্যাক্ট করছে। অন্য কারো দিকে নজর পড়েছে নাকি?
অনিমান কি করবে এখন?ভেবে দিশাহারা বোধ করে। তার এই চেহারা সেকি নিজে করেছে?চেহারার জন্য ট্যুইশনিটা হলনা,ভাবতে খারাপ লাগছে। সে ওখানে প্রেম করতে গেছিল?তাকে দেখে কি সেরকম মনে হয়?পরক্ষণে মনে হল,এমন হতে পারে নিজেদের মেয়ের প্রতিই বিশ্বাস নেই।

রাজন অফিস থেকে ফিরেছে রাত হল রাজুর দেখা নেই। মুন্নী চিন্তিত,দেওরের জন্য তাকেই গঞ্জনা শুনতে হয়। মনে হচ্ছে দরজার কাছে খসখস শব্দ হচ্ছে। রাজু কলিং বেল বাজায় না। মুন্নী দরজা খুলে দেখল যা ভেবেছে তাই মক্কেল দাঁড়িয়ে আছে। রাজু ঢুকতে আলতো করে দরজা বন্ধ করে দিল। দেওরের দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করে,কোথায় ছিলে সারাদিন?
রাজু মুখ টিপে হাসে। মুন্নী ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,কি ব্যাপার বলতো?মনে হচ্ছে কিছু ব্যবস্থা হয়েছে?
রাজু অবাক। ভাবি কি করে বুঝল?
–ঠিক ধরেছো। আচ্ছা ভাবি তুমি কি করে বুঝলে?
–ভালবাসলে বোঝা যায়।
–তুমি আমাকে ভাইয়ার থেকে বেশি ভালবাসো?
–এবার ঠাস করে এক চড় মারব।
রাজু গাল পেতে দিল। মুন্নী আলতো করে গাল চাপড়ে দিয়ে বলল,আমরা তিন বোন। কোনো ভাই নেই। ভাইয়ের জন্য আক্ষেপ ছিল বিয়ের পর আর আক্ষেপ নেই।
অন্য ঘর থেকে রাজন হাক পাড়ে,মুন্নী।
–যাই ওদিক সামলে আসি।
মুন্নী ঢুকতে রাজন বলল,তুমি কি ভাবছো আমি কিছু বুঝতে পারিনি?
–বোঝাবুঝির কি আছে? রাজু এল দরজা খুলে দিলাম।
–আর কতদিন ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাবে?
–এ কি কথার ছিরি?ও তোমার ঘাড়ে বসে খাচ্ছে না।
–মানে?তুমি খাওয়াচ্ছো?
–নিজেই নিজের ব্যবস্থা করেছে।
রাজন হা-করে চেয়ে থাকে। মুন্নী পাশে বসে বলল,তোমার ভাই চাকরি পেয়েছে।
রাজন কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল,আমার কথা কিছু শোনেনি তো?
–না শুনলেও আমি গিয়ে বলব। মুন্নী বলল।
–তবে রে। রাজন বউকে জরিয়ে ধরে ঠোঁটজোড়া মুখে চেপে ধরে।
–উম–উম–কি হচ্ছে। সাহস দিন দিন বাড়ছে দেখছি।
মুন্নী উঠে এ ঘরে এসে দেখল,নয়ন পড়া ছেড়ে চাচুর সঙ্গে গল্প করছে। বিরক্ত হয়ে বলল,কি ব্যাপার তুমি পড়া ছেড়ে উঠে এলে?
–আম্মু চাচু চাকরি পেয়েছে। কে আমাকে স্কুলে নিয়ে যাবে?
রাজু বলল,ভাবি আমি দিয়ে আসব। তুমি শুধু নিয়ে আসবে।
মুন্নী এদিকটা ভাবেনি। দেওর ছিল নয়নকে স্কুল যাওয়া নিয়ে ভাবতে হয়নি। রাজু জিজ্ঞেস করে,ভাবি পাঁচশো টাকা হবে?
–টাকা দিয়ে কি করবে?
–সবাইকে বলেছি খাওয়াবো।
–খাওয়াবে,মাইনে পাও।
–আমি কথা দিয়েছি–।
–ঠিক আছে। আচ্ছা যদি সবাইকে বাড়ীতে ডেকে রান্না করে খাওয়াই?
–বাড়ীতে?চমকে ওঠে রাজু। ভাইয়া যদি–।
–সে তোমাকে ভাবতে হবেনা।
–তাহলে দারুণ হবে। রাজু খুব খুশি হয়।
–কজন হবে?
–কজন আর শুভ বরুণ অনি সিরাজ–দশজনের মত হবে। জানো একটা মজা হয়েছে। রাজু অনির ব্যাপারটা ভাবিকে বিস্তারিত বলল। অনিমানকে চেনে মুন্নী,কয়েকবার এসেছে। মনে মনে ভাবে সত্যিই ছেলেটাকে দেখলে সব মেয়েই মজবে।জিজ্ঞেস করল,ও তো শুনেছি নাকি লেখালিখি করে?
–ঐ আর কি। কয়েক জায়গায় ছাপা হয়েছে।কদিন আগেই একটা গল্প ছাপা হয়েছে, “হঠাৎ বৃষ্টি।”
–বাঃ নামটা তো বেশ কাব্যিক। দিও তো বইটা পড়বো। মুন্নী বলল।
–অনির জন্য খুব খারাপ লাগে। লেখাপড়ায় খারাপ না কিন্তু ওর অবস্থা খুব ভাল না।
দেওরের এই জিনিসটা মুন্নীর ভাল লাগে। মনটা ওর খুব নরম।
–ওতো বাবার পেনশন পাই?শুনেছি ভালোই।
–বাড়ীটা প্রোমোটারকে দেবার জন্য চাপ দিচ্ছে অনিকে। বাবার ঋণ ছিল যার জন্য এসব হচ্ছে।
মুন্নী ভাবে রাজন মুখে যাই বলুক ভাইকে খুব ভালবাসে। স্বামীর প্রচ্ছন্ন সায় না থাকলে সেকি রাজুকে এত প্রশ্রয় দিতে পারতো? সবাই সমান হয়না। নারীকে যারা অস্বীকার করে তারা ভাল হতে পারেনা। স্বামী হিসেবে রাজনকে পেয়ে মুন্নী খুশী।
–সিমান্ত সাহেবের বাড়িতে ট্যুইশনিটা পেলে উপকৃত হত। দেখতে রাঙামুলো–এটা কি কোন যুক্তি হল?
মুন্নী হেসে বলল,দেখো ওদের মেয়ের হয়তো ছোকছোকানি আছে,তাই ভয় পাচ্ছে। এবার চেঞ্জ করে খেতে এসো।
অনিমান শুয়ে শুয়ে ভাবে, রাজু ভাই চাকরি পেয়ে গেল। ভাল খবর খুশি হয়েছে সে। ভাই-ভাবি এত ভাল রাজু ভাই চাকরি না পেলেও ক্ষতি হত না। রাজু ভাই তাকে খুব ভালবাসে। ব্যাঙ্কে কাজ করে ভদ্রলোকের বাড়ীতে রাজু ভাই পাঠিয়েছিল। সেও কি পড়াশুনা ছেড়ে চাকরির চেষ্টা করবে নাকি?উচ্চ-মাধ্যমিক পাস কে চাকরি দেবে?কলেজের পড়াটা যদি টেনেটুনে চালাতে পারত তাহলে নিশ্চিত পাস করবে সে বিশ্বাস আছে।

ঘুম হতে সকালবেলা উঠে অনিমান স্নান সেরে বাথরুম হতে বেরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বিন্যস্ত করছে। ভাবি চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন,কোথায় যাবি?
–কোথায় যাবো,চুল আচড়াবো না?
–এইযে বললি কোথায় যাবি?
মিথ্যে বলার এই দোষ।একটা মিথ্যেকে চাপা দিতে হাজার মিথ্যে বলতে হয়। অনিমান বলল,এখনই নাকি? খেয়ে-দেয়ে বেরবো।
–পড়াশোনা নেই,কোথায় বেরোবি?
–সেইজন্যই যাচ্ছি। ট্যুইশনির জন্য রাজু ভাই একজনের সঙ্গে দেখা করতে বলেছে।

রাজু অনেককাল পর ভাইয়ের সঙ্গে খেতে বসেছে।আগে ভাবির সঙ্গে খেতো। মুন্নী জিজ্ঞেস করে, রাজু নয়ন কে স্কুলে দিয়ে আসতে তোমার অসুবিধে হচ্ছে নাতো?
–অসুবিধে কিসের,মর্নিং স্কুল। ওর অফিস দশটায়। রাজন বলল।
–তাহলে তুমিই দিয়ে আসতে পারো। মুন্নী বলল।
রাজন বিরক্ত হয়। মাথা নীচু করে বলল,ও না পারলে আমিই দিয়ে আসব।
মুন্নী মুখ টিপে হাসে,রাজু অস্বস্তি বোধ করে। দুই ভাইয়ের বয়সের ব্যবধান বছর ছ-সাত। বাবা-মা থাকতেই রাজন ভাইয়ের গার্জিয়ানগিরি করে আসছে। তাদের মধ্যে হৃদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি। এখনও দুই ভাইয়ের মধ্যে মুন্নীই সেতু।
ওরা অফিস বেরিয়ে যাবার পর মুন্নী নিজেকে প্রস্তুত করে ছেলেকে আনতে যাবে। বড় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কখন স্কুল বাস আসে।তালাচাবি দিয়ে বেরোতে হবে। অন্যদিন দেওর আনতে যেত তালাচাবি দেবার দরকার হতনা।দুজনেই অফিসে মুন্নী কে তালাচাবি দিয়ে বেরোতে হয়।
এখন করিম ভাইয়ের দোকানে কেউ থাকবেনা।সকালে একটা মিথ্যে বলার জন্য এই দুপুরে বেরোতে হল। ছুটি শেষ হলে কলেজ খুললে বাঁচা যায়। ভর দুপুরে কোথায় যাবে ভেবে পায়না। দূরে দাঁড়িয়ে আছে মুন্নী ভাবি। কি ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছে কেন?ভাবি সাধারণত বের হয়না। অনিমান কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,ভাবি তুমি এখানে?
–তোকে দেখে দাড়ালাম। তুই বড়রাস্তার দিকে যাচ্ছিস তো?
তাল দিয়ে অনিমান বলল,হ্যা-হ্যা তুমি কোথায় যাবে?
–রাজু নেই। নয়ন কে আনতে হবে আমাকে।
অনিমান বুঝতে পারে রাজু ভাই অফিস গেছে। মুন্নীর সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে।
–তুই কেমন আছিস?
–এই তো ভালো।
–এখন তো কলেজ ছুটি। টো-টো করে ঘুরে বেড়িয়ে বাড়ী বসে লেখালিখি করলে পারিস।
অনিমানের ভাল লাগে। ভাবির কথায় লেখক হিসেবে একটা স্বীকৃতি অন্তত পাওয়া গেল। সবাই তাকে লেখক ভাবতে শুরু করেছে। সত্যিই যদি লেখক হতে না পারে সে
বড় লজ্জার হবে। একদিক দিয়ে ভাল নিজের মধ্যে একটা চাপ বোধ করবে।
–হুম.. ভাবছি এবার একটা উপন্যাস শুরু করব।
–কারো সঙ্গে প্রেম-টেম করিস নাতো?বাজে ব্যামো।
অনিমান লজ্জা পায়,কিছু বলেনা। মুন্নী জিজ্ঞেস করে,কিছু বলছিস না যে?
–কি বলব,আমাকে কে প্রেম করবে বলো?
–এমন মেয়ে পটানো চেহারা,বলছিস কে প্রেম করবে?
আবার সেই চেহারা। অনিমানের চোখে জল আসার জোগাড়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,প্রেম করলে রাজু ভাই ঠিক জানতে পারত।
খিল খিল করে হাসে মুন্নী। ছেলেটা খুব সরল,মুখ ফুটে নিজের কথাটাও বলতে পারেনা। মুন্নী বলল,বোকা ছেলে তোর সঙ্গে মজা করলাম।
বোকা বিশেষণ শুনে শুনে গা-সওয়া হয়ে গেছে।চালাক হতে গেলে কি করতে হবে?লোককে ঠকাতে পারলেই কি সে চালাক? অনিমান কোনো কথা বলেনা দেখে মুন্নী জিজ্ঞেস করল, তুই কি আমার উপর রাগ করেছিস?
–ঝাঃ,রাগ করব কেন? ভাবি তোমার পারফিউমটায় বেশ সুন্দর গন্ধ।
মুন্নী হাসি সামলাতে পারেনা,খিলখিল হেসে ফেলে।অনিমান অপ্রস্তুত হয় সে কি এমন কথা বলল?
–তুই বেশ কথা বলিস। ছুটির দিন দেখে একদিন আয়।

তেরাস্তার মোড়ে গাড়ী আসার কথা। মুন্নী ছায়া আশ্রয় করে দাঁড়িয়ে পড়ে। অনিমান ভাবছে কি করবে সে? মুন্নী বলল,তুই কোথায় যাচ্ছিলি যা।
অনিমান ম্লান হেসে বিদায় নেয়। মুন্নী ভাবির চোখের থেকে আড়াল হতে হবে। যোগাস্কুলের কাছে এসে ডান দিকে বাক নিল। ভাবিকে আর দেখা যাচ্ছেনা। এই রাস্তা দিয়ে যোগা ক্লাসে আসতো। এমনি এদিকটা আসা হয়না। কোথায় যাবে এখন? সন্ধ্যে হতে এখনো চার-পাঁচ ঘণ্টা। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সিমান্ত সাহেবের বাড়ীর পাশ দিয়ে গেলে কেমন হয়?ওরা মত বদল করতেও পারে। রাজু ভাইকে দিয়ে খবর দেবে বলেছিল।
.
.
.
চলবে…!

[গল্পটি কেমন হচ্ছে কমেন্ট করে জানান। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্য আমাকে গল্পটিকে আরো সুন্দর করে লেখার প্রেরণা দিবে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here