জীবনের অন্যরঙ পর্ব-৩

0
315

#জীবনের অন্যরঙ [৩য় পর্ব]
#আজিজুর রহমান

চলতে থাকো হে মানুষ, চলতে থাকো। দেখছো না- পৃথিবী বনবন করে ঘুরছে, বাতাস শনশন করে বইছে, নদী কলকল করে গাইছে ? বলো- তারা চির চলমান কেন ?

প্রথমদিন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে রাজু। ঘেমো জামা খুলে চোখে মুখে জল দিয়ে বসতেই মুন্নী চা নিয়ে ঢুকলো। রাজু হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিতে মুন্নী জিজ্ঞেস করে, ভাই কেমন লাগল অফিস?
রাজু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এক মুহূর্ত ভেবে বলল,ভাবি আগে ভাবতাম খুব বুঝি খাটতে হবে।
–কদিন যাক,নেশা ধরে যাবে। দেখছো না তোমার ভাইকে?পাঁচটায় ছুটি বাড়ী ফিরতে ফিরতে আটটা-নটা বেজে যায়। এ্যাই জানো আজ অনির সঙ্গে দেখা হল।
–কি বলল?
–কি বলবে?আমিই মজা করে বললাম,কারো সঙ্গে প্রেম-টেম করছিস নাতো?একেবারে ঘেমে নেয়ে একসা। খিল খিল করে হেসে ওঠে মুন্নী।
–ও খুব লাজুক আর ইমোশনাল। সামান্য কিছু হলেই চোখে জল চলে আসে।
–ইমোশন থাকা ভাল আবার–।
–আবার মানে?রাজু জিজ্ঞেস করে।
–এক একসময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
–কেউ একটু দরদ দেখালে একেবারে কেলিয়ে পড়ে। রাজুর মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে যায়।
–এসব কি কথা? ভাই ভাষা সংযত করো।তোমার ভাতিজা বড় হচ্ছে।
–স্যরি স্যরি মানে গদ্গদ হয়ে পড়ে।
–ছেলেটা খুব সংবেদনশীল। মেয়েরা এরকম খুব পছন্দ করে। হাসতে হাসতে বলল মুন্নী।
–অর্নিতা ওকে খুব ভালবাসত।
–অর্নিতা কে?
–ঐযে পাঞ্জাবী মেয়েটা–ওরা চলে গেছে।
মুন্নী ওকে চেনে বেশ লম্বা বয়সে অনির বড়ই হবে।মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের সঙ্গেই ওর বেশী মেলামেশা।
চা টিফিন খেয়ে বেরিয়ে পড়ল রাজু।
করিম ভাইয়ের দোকানে এসে দেখল আড্ডা জমজমাট। সবাই অনিকে নিয়ে পড়েছে। শুভ বলল, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? কিরে অনি ডুবে ডুবে প্রেম করছিস নাকি?
অনিমান চমকে ওঠে,শুভ কেন একথা বলল?সামলে নিয়ে অনিমান বলে,এখানে বসেই সব বুঝে গেলি?
–গায়ের গন্ধে বোঝা যায় বস।
— সবাইকে তোর মত ভাবিস নাকি? অনিমান সকলকে এড়িয়ে নিজের জামার গন্ধ শোকে।ঘামের গন্ধ ছাড়া আর কোনো গন্ধ পায়না।
বরুণ মাঝখানে নাক গলায়,লেখকদের এত মাথা গরম করলে চলে?
শুভ বলল,রাগ করছিস কেন?বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে ঠাট্টা ইয়ার্কি করা যাবেনা?সবাই রুহিকে নিয়ে আমাকে যখন বলে আমি কিছু বলেছি? করিম ভাই লেখককে একটা চা দাও।
–আমি কি বাদ? রাজু দোকানে ঢুকে বলল।
–আরে তুমি? করিম ভাই দুটো চা করো। বলো অফিস কেমন লাগল?
–তোরা খাবি না?
–আমাদের এক প্রস্থ হয়ে গেছে। আবার পরে খাবো।
অনিমানের কোনো কথা কানে যায় না সে ভাবে প্রেম ভালোবাসা কি তা বুঝি না। তবে অর্নি আপু চলে যাবার পর হতে কিছু একটা হারাবার কষ্ট অনুভব হয়। এটা কি ভালোবাসা বলা যায় তা নয়তো কি।
রাজু মাছি তাড়ানোর মত বলল,ছাড়তো অফিস।শোন এবার কাজের কথা বলছি। তোদের মেনু করার দরকার নেই?
সিরাজ বলল,তুমি কিন্তু কথা দিয়েছো।
–আজ বুধবার। আগামী রবিবার দুপুরবেলা আমাদের বাসায় সকলের দাওয়াত।
–তোমার বাসায়? ভাইয়া থাকবেনা?
–থাকলে থাকবে। ভাবি তোদের যেতে বলেছে,ব্যাস। রাজু বলল।
–ভাবি আমাকে কিছু বলল নাতো? অনিমান বলল।
–তুমি কে সত্যবাদী সন্ন্যাসী ?তোমাকে আলাদা করে বলতে হবে?বরুণ টিপ্পনী কাটে।
রাজু বিরক্তি প্রকাশ করে,কি আরম্ভ করলি তোরা?কলেজ কবে খুলছে?
–সোমবার।
–ব্যাস। তাহলে রবিবার?কিরে অনি অসুবিধে নেই তো?
–অসুবিধের কি আছে? রাজু ভাই আমি আসছি,অনেক সকালে বেরিয়েছি।
অনিমান দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামে। রাজু ভাই পাশে এসে জিজ্ঞেস করে, তোকে কেমন অন্যরকম লাগছে,কিছু হয়েছে?
ফ্যাকাশে হেসে বলল অনিমান,কি আবার হবে?তোমায় কেউ কিছু বলেছে?
–ভাবি বলছিল,লেখকরা খুব আবেগ প্রবণ।
–মুন্নী ভাবিকে আমার খুব ভাল লাগে।
–আবেগে মানুষ অঘটনও ঘটাতে পারে।
–মানে?
–ভাবি একটা সুন্দর কথা বলেছে।
–কি কথা?
–এক সময় সতীদাহ প্রথা ছিল। অনেক ভীরু রমণী আবেগের বশে স্বামীর চিতায় আত্মবিসর্জন দিত অবলীলায়।
–ধর্মীয় আবেগ।
–যাইহোক আবেগ। রবিবার,মনে আছে তো?
রাজু ভাই চলে গেল পঞ্চাদার দোকানে। মুন্নী ভাবির সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে। রাজু ভাই ভাগ্যবান অমন ভাবি পেয়েছে। চোখের সামনে দাউ-দাউ চিতার ছবি ভেসে ওঠে,লক লক করছে লেলিহান শিখা। সবাইকে আগুনের শিখার মত লাগে। নজরে পড়ল রাস্তার একধার দিয়ে রুহি হাঁটতে হাঁটতে তাকে আড়চোখে দেখছে। সম্ভবত শুভর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। নটা বেজে গেছে এতরাতে বেরিয়েছে কিসের টানে? প্রেম হলে কি এমন হয়? আমারও অর্নি আপুকে দেখার ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে। অনিমান ক্লান্ত পায়ে বাড়ীর দিকে হাঁটতে থাকে।

রাজু ভাবে অনিকে একটা ট্যুইশনি জোগাড় করে দেওয়া দরকার। আজকাল সবাই চায় স্কুল টিচার।স্কুল টিচার হলেই ভাল পড়াবেন?স্কুলে পড়াতেন সাজ্জাদ স্যার। রাজুর মনে পড়ল। অঙ্ক শেখাতেন।পটপট করে বোর্ডে অঙ্ক করে দিতেন কিন্তু কিভাবে করছেন কিছুই বুঝতে পারত না রাজু। শুভ হেলান দিয়ে বসে মাঝে মাঝে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে রাস্তার দিকে। বরুণের নজর এড়ায় না।
জিজ্ঞেস করে,কি বস কথা আছে?
–নিজের চরকায় তেল দে।
বরুণ চুপ করে যায়। রাজু অনি আর বরুণ ছাড়া সকলেরই কেউ একজন আছে। বয়সে বড় রাজু কিছু বলেনা অনির অন্যের ব্যাপারে তেমন কৌতুহল নেই। বরুণটার সব ব্যাপারে কৌতুহল।শুভ ঝট করে দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ল। বরুণ লক্ষ্য করে,দূরে রুহি হেঁটে চলেছে। আগেরটা কেটে যাবার পর শুভ রুহিকে ধরেছে। মিলি শুভকে ভাগিয়ে দিয়েছে,শুভ বলে সেই নাকি মিলিকে ভাগিয়েছে। দলের মধ্যে অনিটাই সব থেকে লাল্টু দেখতে অথচ ওর কিছু হলনা কেন কে জানে? অনিটা একটু ক্যালানে টাইপ।

রাজু দোকানে ফিরে শুভকে না দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে,শুভ চলে গেছে?
বরুণ অদ্ভুত ভঙ্গী করে বলল,শুভ এখন গোলাপের গন্ধ নিচ্ছে।
রাজু বুঝতে পারেনা,সিরাজ বলল,সব ব্যাপারে চ্যাংড়ামি। রুহির সঙ্গে গেছে,এখুনি এসে পড়বে।
অনিমান বাসায় ঢুকে হাত মুখে জল দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। আর ভেবে চলছে গভীরভাবে।
প্রেম ভালবাসা গল্প উপন্যাসের অন্যতম উপাদান।সে গল্প লেখে অথচ প্রেম ভালবাসা সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। প্রেম নাকি অন্ধ হিসেব করে চলেনা। জাত ধর্ম বয়স ধনী গরীব তার কাছে কোনো বাধা নয়। তাই কি? সকলের কাছ থেকে শেখার আছে। আবার মনে হয় প্রেম বিয়ের সোপান মাত্র।

অনিমান ঘুমায়নি। খাওয়া দাওয়ার পর তার ডায়েরী লেখা অভ্যেস। সামনে ডায়েরী খোলা,গভীর চিন্তায় ডুবে আছে।
বিবাহে দেওয়া-নেওয়া প্রেমে কেবল দেওয়া। কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে। মনের মধ্যে একটা আকুলতা আছে তার মানেই সেটা প্রেম?মেয়ে পটিয়ে কি প্রেম হয়?শুভর সঙ্গে মিলির একসময় প্রেম ছিল। তারপর কি করে যেন মিলি ওর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে। একে কি প্রেম বলা যায়?
নিজে প্রেমের গল্প লিখেছে অথচ প্রেম নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই ভেবে অনিমান অবাক হয়। প্রেম কি দয়া দিয়ে চলে? নাকি তার কোনো আলাদা চালক আছে? অনিমান মনে মনে হাসে,সে নিজেই আজ দয়া মায়ার পাত্র। সব কিছুকে আমরা ভাল মন্দ ইতিবাচক নেতি-বাচক দিয়ে বিচার করি কিন্তু ভাল মন্দ মিশিয়েই মানুষ।

অর্নি আপু চলে যাবার বেশ কিছুদিন আগের কথা মনে পড়ে গেল। অর্নি আপুর সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলাম। হঠাৎ করে অর্নি আপু একটা কথা বলে বসলো।

— দ্যাখ তো আমাকে কেমন দেখতে লাগছে। অনিমান সরাসরি তাকাতে পারে না,আড়চোখে দেখে। অর্নি জিজ্ঞেস করে,কিরে বল আমাকে কেমন দেখতে লাগছে?
–তোমাকে না তোমাকে কি বলবো একেবারে স্বর্গে থেকে আসা কোনো হুর পরীর মত দেখতে লাগছে।
অর্নি অস্বস্তি বোধ করে,পাগলটার কাছে তাকে হুর পরীর মত লাগে? কিছুক্ষণ নীরবতার পর জিজ্ঞেস করে, কার যে কাকে কেন ভাল লাগে বুঝিনা বাপু?
–হ্যা তুমি ঠিক বলেছো।
–কি করে বুঝলি?
–তুমি রাগ করবে নাতো?
–না রাগ করবো কেন?তোর কথা তুই বলবি তাতে কে রাগ করলো কি না করলো বয়ে গেল।
—তোমাকে দেখতে এসে পছন্দ করলো জিমিকে। আমার খুব খারাপ লেগেছে।
‘খারাপ লেগেছে’ কথাটা শুনে অনিমানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে অর্নি,কিছু বলে না। কি ভেবে অনিমান জিজ্ঞেস করে, অর্নি আপু তুমি বিয়ে করবে না?
–তোর কোনো পাত্র জানা আছে?
–বাঃ আমার কেন থাকবে?আমি কি জানি তোমার কেমন পছন্দ?
–যদি বলি তোকে আমার পছন্দ।
–যাঃ তুমি ভারী অসভ্য, সব কথায় ইয়ার্কি।
–কেন অসভ্য কেন? অসভ্যতার কি হল?জিমিকে বিয়ে করল বলে তোর খারাপ লেগেছে বললি।
–তুমি কি যে বল না?কোথায় তুমি আর কোথায় আমি? সেই কি একটা কথা আছে চাঁদের সঙ্গে…।কথাটা শেষ করে না অনিমান।
অর্নিতা অবাক হয়ে দেখে গা-ঘেষে হেঁটে চলছে সেজন্য মনে কোনো চঞ্চলতা নেই। খুব সরল মনে কোনো মালিন্য নেই। বেচাল দেখলে ঠাস করে এক চড় কষাতো।
–ভেবে দ্যাখ আমাকে বিয়ে করতে হলে তোকে পড়াশুনা করতে হবে।
ম্লান হয়ে যায় অনিমানের মুখ। গভীরভাবে ভেবে বলে,আমার পড়াশুনা হবে না। পড়াশুনা করতে টাকা লাগে।
–তূই নাইটে পড়ছিলি না?
–সেই জন্যই তো বললাম একটা চাকরি যোগাড় করে দাও। প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবো। মাথার উপর একজন না থাকলে কেমন দিশাহারা বোধ হয়।
–আছা এখন যা চাকরির খবর পেলে তোকে বলবো। আমার একটু কাজ আছে।
–অর্নি আপু মিথ্যে কথা কি বলছিলে?
অর্নিতা কিছুক্ষন ভেবে বলল,সত্যি বললে যদি কেউ আহত হয় মিথ্যে বলে তাকে একটু আনন্দ দেওয়া দোষের কি?এখন যা।

অনিমান সব সময় আত্মনিমগ্ন নিজেতে নিজে ডুবে আছে। সেদিনের অর্নি আপুর বলা কথাগুলো আমাকে বেশ ভাবায়। জানি যে এখানে আমার আর থাকা হবে না। তবে অর্নি আপুর মতো কাউকে দেখি নি। তিনি একেবারে অন্যরকম। আমার সাথে সবসময় ইয়ার্কি করতো। আমার বেশ ভালো লাগতো। ভালোবাসা মনে হয় এমনই হয়। জানি না কেন মানুষ ভালোবাসতে চাই অচেনা একজন কে? কি করে অচেনা মানুষের সাথে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়? প্রেম, ভালোবাসাকে খুব কাছ থেকে অনুভব না করলে কখনো রোমান্টিক ভালো লেখক হয়ে উঠা যাবে না। অনেকের মনে আমার গল্প নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে কি করে এত সুন্দর প্রেমের গল্প লিখি। তবে সত্যি বলতে সব গল্পই আমাদের চারপাশের চরিত্র দ্বারাই আমি লিখে থাকি।

নয়ন প্রায় ঘুমিয়ে গেছে। মুন্নী বাথরুমে গিয়ে ধুয়ে এসে সবে শুয়েছে,হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল,সাড়ে-বারোটা। এত রাতে কে হতে পারে?বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,কে-এ?
বাইরে থেকে আওয়াজ এল,রাজু ভাই–রাজু ভাই।
কপালে ভাজ পড়ে,মুন্নী এদিক ওদিক দেখে দরজা খুলে চমকে ওঠে,সুজয় আলুথালু চুল। মুন্নী বলল,কি হয়েছে?তুমি অমন করছো কেন?
–ভাবি মার অবস্থা ভাল নয়,একটু রাজু ভাই কে ডেকে দেবে?
–ভিতরে এসে বোস। আমি ডাকছি–।
ইতিমধ্যে রাজু ঘুম থেকে উঠে এসেছে,কি ব্যাপার রে সুজয়?
–মা কাটা পাঠার মত ছটফট করছে,কি করবো বুঝতে পারছিনা।
–তুই বোস। ভাবি কিছু টাকা দাওতো?
গায়ে জামা গলিয়ে সুজয়কে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।রাজু চলে যাবার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মুন্নী। অথচ ওর ভাইয়ের মধ্যে অন্যের জন্য কোনো ফিলিংস নেই।

ডা.বারিক শাহের বাড়ীতে তখনো আলো জ্বলছে।এত রাতে ঘুমাননি নাকি?বেল বাজাতে বেরিয়ে এলেন ডা.শাহ,দরজার আড়ালে শুভ্রতা। ডা.শাহ বললেন,ও তোমরা?কি ব্যাপার?
–ওর মার পেটে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে ডাক্তার সাহেব।রাজু বলল।
–হসপিটালে নিয়ে যাও। ডাক্তার শাহ বললেন।
আড়াল থেকে শুভ্রতা বেরিয়ে এসে বলল,বাপি কি হয়েছে না জেনে হাসপাতালে চলে যাবে?
ডা.শাহ চিন্তিতভাবে বললেন,তুই কি বলছিস একবার দেখে আসব?
–অবশ্যই। নাহলে কি করে বুঝবে?
–আচ্ছা চলো।
–রাজু ভাই তুমি একটু দাঁড়াও। শুভ্রতা ভিতর থেকে একটা এ্যাটাচি ব্যাগ এনে রাজুর হাতে দিয়ে বলল,বাপি কিছুক্ষন আগে চেম্বার থেকে ফিরেছে।
ডাক্তার শাহ এ্যাটাচি খুলে প্রেশার নিলেন,স্টেথো দিয়ে পরীক্ষা করে বললেন,এত রাতে ওষূধ কোথায় পাবে?
–আপনি লিখে দিন ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কি হয়েছে ডাক্তার সাহেব?
–কত কি হতে পারে। ইউএসজিটা করাও দেখি কি ব্যাপার। আলসার হতে পারে আবার–।
–আবার কি ডাক্তার সাহেব?
–কাল সকালে টেস্টটা করাও।
ডা. শাহ বাসায় ফিরতে শুভ্রতা হাত থেকে এ্যাটাচিটা নিল। ড.শাহ পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট বের করে মেয়ের হাতে দিল। শুভ্রতা নোটদুটো দেখে বুঝল ফিজ নিয়েছে। জিজ্ঞেস করে,কি হয়েছে বাপি?
–আলসার আবার ম্যালিগ্ন্যাণ্টও হতে পারে। দেখা যাক টেষ্ট করে কি বেরোয়।
ম্যালিগন্যাণ্ট? শুভ্রতার চোখ ছল ছল করে উঠল।সুজয়ের মা অনেকদিন ধরে ভুগছে। ক্যান্সার হলে বেচারি কি যে করবে?
দোকান খুলিয়ে ওষুধ এনে খাইয়ে দিতে যন্ত্রণা কিছুটা উপশম হল। সুজয় বলল, রাজু ভাই তুমি যাও। কাল তোমার আবার অফিস আছে। ও তোমার টাকাটা–।
–ঠিক আছে পরে দিবি। সকালে সোনোগ্রাফিটা করাবি।

সুজয় রাতে ঘুমায় না। বাবা আর টিনাকে অনেক বলে ঘুমোতে পাঠিয়েছে। মায়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কত কথা মনে পড়ে। দেখতে দেখতে জানলা দিয়ে ভোরের আলো এসে পড়ে ঘরের মেঝেতে। বীণা বেগম চোখ মেলে দেখলেন,ছেলে বসে বসে ঝিমোচ্ছে।
সুজয় মাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে,ঘুম হয়েছিল?
বীনা বেগম হাসলেন। সুজয় জিজ্ঞেস করে,হাসছো কেন?
–আমি ঘুমোই নি,চোখ বুজে ছিলাম। শিয়রে ছেলে জেগে থাকলে কোন মা ঘুমোতে পারে?
সুজয় ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে।

ঘুম থেকে উঠে চোখে মুখে জল দিয়ে চা খেয়ে অনিমান ভাবল,যাই একটু ঘুরে আসি। কদিন পর কলেজ খুলে গেলে সকালে বেরনো বন্ধ। নীচে নেমে চমকে ওঠে। ভূত দেখছে নাতো?বাড়ীর নীচে রাস্তার ধারে শুভ্রতা দাঁড়িয়ে কেন?কাছে যেতে মৃদু হেসে শুভ্রতা জিজ্ঞেস করে,ভাল আছো?
–হ্যা তুমি এখানে?কি ব্যাপার?
–ব্যাপার কিছুই নয়। ওকে বাসে তুলতে যাচ্ছিলাম। সিগারেট কিনতে গেছে তাই–।
অরিমান দেখল উল্টো দিকের দোকানে একটি সুপুরুষ যুবক, নাকের উপর চশমা। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছে। অনিমান জিজ্ঞেস করল,রিলেটিভ?
–না না,বাপির বন্ধুর ছেলে। কাল রাতে আমাদের বাড়িতে ছিল।
অনিমানের মন খারাপ হয়। যুবকটি এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে রাস্তা পেরিয়ে এদিকে আসছে। যুবকটি কাছে এলে শুভ্রতা বলল,সাগর পরিচয় করিয়ে দিই। অনিমান,আমরা এক স্কুলে পড়তাম।সাগর সওদাগর হবু ডাক্তার–ন্যাশনালে ইণ্টারণশিপ করছে।
যুবকটি হেসে করমর্দন করে বলল,শুভার কাছে আপনার কথা শুনেছি।
–জানো অনি একজন লেখক।
সাগর বলল,তাই?আমি অবশ্য একেবারে বেরসিক। স্কুলে যা একটু গল্প কবিতা পড়েছি।
–ও হ্যা শুনেছো,সুজয়ের মা খুব অসুস্থ। রাজু ভাই কাল রাতে বাপিকে ডাকতে এসেছিল। আসি আবার পরে কথা হবে?
ওরা বাস রাস্তার দিকে চলে গেল। বেকুবের মত হা-করে তাকিয়ে থাকে অনিমান। বাপির বন্ধুর ছেলে,ডাক্তারি পড়ে। কয়েক বছর পর হয়তো অন্য পরিচয় হবে। বাপির নয় বলবে আমার–। বেশ মানাবে দুটিতে। মনে মনে বলল,শুভ্রতা তোমরা সুখী হও।

অনিমান সিঁড়িঁ বেয়ে উপরে এসে নিজের ঘরে শুয়ে পড়ে। অনিমানের অতীতের কথা মনে পড়ে গেল। এমন অসময়ে শুয়ে পড়লে মা তাকে নিয়ে কথা চিন্তা না করতো। অনিমানকে বলতো, এই অবেলায় শুয়ে পড়লি?শরীর খারাপ লাগছে?
–না।
কপালে হাত দিয়ে বললেন,না কপাল তো ঠাণ্ডা।তাহলে কি মন খারাপ?
অনিমান মায়ের হাত চেপে ধরে উঠে বসতো। মা বললেন,রান্না হয়ে গেছে,স্নান করে খেয়ে নে।
–মা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
–তোর কি হয়েছে বলতো?
–তুমি বাবাকে খুব ভালবাসতে?
–এ আবার কি কথা?
–বাবাকে তোমার মাঝে মাঝে মনে পড়েনা?
মা গম্ভীরভাবে বললেত,না।
–একদম ভুলে গেছো?
–না। যে মনে আছে তাকে মাঝে মাঝে কেন মনে পড়বে?
মা দ্রুত উঠে চলে যেতে যেতে বললেন,স্নান করে নে। আড়ালে গিয়ে আঁচলে চোখ মুছলেন।
অনিমান খেতে বসে কেমন অন্যমনস্কভাবে ভাত নাড়াচাড়া করে।

বাবা নেই কত বছর হয়ে গেল। মা এখনো সেই স্মৃতি আকড়ে বসে আছে। এই সম্পর্ক কি প্রেম?মা জীবদ্দশায় বাবার স্মৃতিকে ধরে বেঁচে ছিল। মায়ের নিশব্দ ভালোবাসা বাবার প্রতি আমাকে বেশি চিন্তায় ফেলে দিত। শুভ্রতা কে নিয়ে বন্ধুরা করত কিছুই না বলেছে। যদি সত্যিকারের ভালোবাসা হতো তাহলে কি এমন হতো।

সঞ্জয়ের বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিতে টিনা বেরিয়ে এসে বলল,ও অনি ভাইয়া? ভাইয়া তো বাড়ী নেই।
–আন্টি কেমন আছে?
–মাকে নিয়ে ভাইয়া আল্ট্রাসোনগ্রাফী করাতে গেছে।
–কোথায় মিশনারিতে?
–হ্যা আসার সময় হয়ে এল,তুমি বসবে?
–না আমি এগিয়ে দেখি।
মিশনারি হাসপাতাল বাস রাস্তার ওদিকে,এ অঞ্চলে সবাই ওখানেই যায়। মিশনারিতে পৌঁছে দেখল সুজয় মাথা নীচু করে বসে আছে। তাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল,এইমাত্র ঢোকালো।বাবাকে জোর করে কাজে পাঠিয়েছি। কাল রাতে যা ধকল গেল কি বলব। কথা বলতে বলতে দেখল একটা ছোট দরজা দিয়ে আন্টিকে ধরে একটি লোক বাইরে চেয়ারে বসিয়ে দিল। সুজয় বলল,অনি তুই দাড়া আমি একটা রিক্সা নিয়ে আসি। সুজয় রিক্সা নিয়ে আসতে আন্টিকে ধরে রিক্সায় তুলে দিল। সুজয় অস্বস্তি বোধ করে। অনিমান বলল,ঠিক আছে তুই যা। আমি হেঁটেই চলে যাবো।

অনিমান হাঁটতে থাকে। শুভ্রতা আর সাগর দুজনের নামে মিল আছে। ওরা পরস্পরকে পছন্দ করে। একে নিশ্চয়ই প্রেম বলা যায় না। বিয়ে হলে সুখী সংসার হবে। একজন আরেকজনের কথা ভাববে। অনিমান বুঝতে পারেনা শুভ্রতার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিলনা তবু কেন তার খারাপ লাগছে?তার অবচেতনে কি কোন প্রত্যাশা বাসা বেধেঁছিল? আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে খেয়াল হয় নিজের বাড়ীর কাছে চলে এলো।

বাড়ি ফিরে মনে হল ভাবি তার জন্য অপেক্ষা করছিল। রবি কাকু এসেছিল সঙ্গে একজন ছিল, সে নাকি গুণ্ডা। নাম বলেছিল ভাবি মনে করতে পারল না। নীচে দোকানদারদের সঙ্গে কি সব নাকি কথাবার্তা বলে গেছে। অনিমান ভাবির কাছে সব শুনে অসহায় বোধ করে। অর্নি আপু থাকলে চিন্তা ছিল না। ঐ সব গুণ্ডাফুণ্ডা ভয় করে না। বুঝা গেল আর এ বাড়িতে থাকা হবে। বাড়ির সব কাগজপত্র রবি কাকুর কাছে। তিনি চাইলে যেকোনো সময় আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারেন। আটটা নাগাদ বাড়ি হতে বের হল। করিম ভাইয়ের দোকানে যেতেই শুনল রাজু ভাই নাকি তার খোঁজ করছিল। একটু আগে সুজয়কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে। শুভকে খুব চিন্তিত মনে হল। বরুণ ফিসফিস করে বলল,রুহির উপর বাড়ীতে খুব ঝামেলা হচ্ছে। ঝামেলা করছে মানে ওর মা মানে আন্টি আণ্টি। বাড়ির গার্ডিয়ান আণ্টি। কাকুও বউকে ভয় পায়।
অনিমানের হাসি পেল। সুজয় আর রাজু ভাই এল।রাজু ভাই বলল,তুই বাড়ি যা। তোর বাবা অপেক্ষা করছে। টাকার জন্য চিন্তা করবি না। সুজয় চলে গেল। রাজু ভাই অনিকে দেখল কিছু বলল না।এমনি খোঁজ করছিল হয়তো।
–শালা একের পর এক ঝামেলা। রাজু ভাই বলল। সিরাজ বলল,চা বলি?
–বললে বল। কোনদিন কেউ বলেছে চা খাবো না? বরুণের কথায় সবাই হেসে ফেলল।
শুভ হাসতে হাসতে বলল,এই শালা ড্যাবা হারামী।
–হারামী বুঝলাম কিন্তু ড্যাবাটা কি? বরুণ জিজ্ঞেস করে।
অনিমান ড্যাবা কথাটা আগেও শুনেছে কিন্তু তার অর্থ নিয়ে কখনো প্রশ্ন জাগেনি। গরুকে খেতে দেওয়া হয় যে বড় গামলায় তাকে ডাবা বলে কিন্তু ড্যাবা কি তার থেকে এসেছে। তা হলে অর্থ দাঁড়ায় গামলার মত হারামী।
সিরাজের কথায় করিম ভাই চা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাজু ভাই কি বলে শোনার জন্য। দোকানদার হলেও করিম ভাই ওদের সুখ দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে রাজু ভাই শুরু করে,ইউএসজি রিপোর্টে কিছু পাওয়া যায়নি।ড.শাহ বললেন,স্ক্যান করাতে।
–শালা খালি টাকা খ্যাচার ধান্দা।
–তুই বেশি বুঝে গেছিস? শরীফ বলল।
–বরুণকে সাপোর্ট করছিনা কিন্তু ভেবে দেখ এসব তো আগে ছিলনা। তখন কি চিকিৎসা হতনা?শুভ বলল।
–হবেনা কেন?টেষ্ট ফেষ্ট না করে ব্রঙ্কাইটীশ হয়েছে টিবির চিকিৎসা করেছে। সিরাজ বলল।
–একটা ব্যতিক্রমকে সাধারণী করণ করা ঠিক হবেনা। একটা মেয়ে খারাপ মানে সমগ্র নারীজাতি খারাপ এই সিদ্ধান্ত করা যায়না।
–যাঃ শালা এর মধ্যে মেয়ে এল কোথা থেকে?সিরাজ ভাবে অনি কি তনিমার ইঙ্গিত করল?
–কিরে অনি কেউ কি দাগা দিয়েছে?শুভ হেসে বলল।

অনিমান বুঝতে পারে তার এভাবে বলা ঠিক হয়নি।সকালে শুভ্রতার সঙ্গে দেখা হয়েছিল শুভ কি দেখেছে?তাছাড়া সকালে তেমন কিছুই হয়নি। শুভ্রতা তার বাবার বন্ধুর ছেলের আলাপ করিয়ে দিয়েছে।
–স্ক্যান করার উদ্দেশ্য ডাক্তার শাহ নিশ্চিত হতে চান ম্যালিগন্যাণ্ট কিনা?সেটাই চিন্তার। সুজয়ের বাবার সামান্য কারখানার চাকরি, কি করে সামাল দেবে?তাছাড়া টিনার পড়াশুনা আছে–। রাজু ভাই কথা শেষ করেনা।
অনিমান বলল,আচ্ছা আমরা একটা ফাণ্ড তৈরী করতে পারিনা?
–ফাণ্ডে টাকা আসবে কোথা থেকে? রাজু ভাই ছাড়া সবাই বাপের হোটেলে থাকি।
–নগর লক্ষ্মী কবিতায় বুদ্ধদেব দুর্ভিক্ষে যখন বিভিন্ন সাহেব বণিক অমাত্যকে ক্ষুধার অন্ন দানের ব্যবস্থা করতে বললেন,সবাই হেট মুণ্ডে বসে রইল।সাধারন কন্যা সুপ্রিয়া এগিয়ে এসে সেই ভার মাথা পেতে নিল। অন্যরা পরিহাস করে বলল,নিজে খেতে পাওনা তুমি কিভাবে অন্ন যোগাবে?সুপ্রিয়া তখন বলেছিল,”আমার ভাণ্ডার আছে ভরে সবাকার ঘরে ঘরে–।”
–ওসব কাব্য কবিতায় চলে। শরীফ বলল।
রাজু ভাই বলল,রতির কথাটা ফেলে দেবার মত নয়। কিন্তু এখনও সেই সময় আসেনি।
বরুণ বলল,অনি লেখক ওর চিন্তাধারাই আলাদা।
–শালার গাড়ে একটা লাথি দেতো। তখন থেকে ফুট কেটে যাচ্ছে। শরীফ বলল।
–আজ অফিসে একটা মজা হয়েছে। সানাউল হক সিনিয়ার অফিসার,আমার বসও বলতে পারিস। সামনের টাউনে থাকে। ওর মেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে এইট স্ট্যাণ্ডার্ড। বাংলা পড়তে পারেনা। বাংলা পড়াবার একজন টিচারের কথা বলছিলেন। অনির কথা ভেবেছি কিন্তু অতদুর গাড়ীভাড়াতেই সব বেরিয়ে যাবে।
–গিয়ে দেখি কি রকম দেয়,না পোষালে করব না। অনিমান বলল।
–আমিও তাই ভেবেছি। দেখ কি বলে। রাজু ভাই একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলল,চিনতে পারবি তো?
–ওদিকটা কোনোদিন যাইনি। জিজ্ঞেস করে চলে যাবো।
–তাহলে কালই চলে যা। অফিসে গিয়ে আমি স্যারকে বলে দেব। রাজু ভাই বলল।
রাজু ভাই সবার জন্য ভাবে। আমাকে একটু বেশি স্নেহ করে। অনিমান ভাবে,রবি কাকুর কথাটা বলবে কিনা?পরমুহূর্তে মনে হল রাজু ভাইয়ের মাথায় অনেক চাপ,আর বোঝা বাড়ানো ঠিক হবেনা। অনিমানের তিনকুলে কেউ নেই।
করিম ভাইয়ের দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। কলেজ খোলার কিছুদিন পর ফাস্ট সেমিস্টার পরীক্ষা,এই সময় টিউশনি নেওয়া ঠিক হবে?ঠিক আছে কাল ঘুরে এসে ভাবা যাবে কত দেবে কদিন যেতে হবে?
.
.
.
চলবে……….!

[গল্পটি কেমন হচ্ছে গঠনমূলক মন্তব্য করে জানান।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here