জীবনের গল্প পর্ব:-০১

0
2083

__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-০১____________
♥এক♥

গ্রামের এক ধারেই টিনের ছাউনি দেয়া বাড়িটা একাকি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে আর কোনো বাড়ি নেই। যা আছে তা এই বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। একসময় এই বাড়িকে ঘিরেই গ্রামের সব বাড়ির অবস্থান ছিল। গ্রামের এদিকটা একটু নিচু বলে, প্রতিবছর বন্যায় ডুবে যায় সব বাড়ি। তাই ধীরেধীরে সবাই বসতবাড়ি সরিয়ে নেয় এখান থেকে। কিন্তু এ বাড়ির কর্তা আশরাফ সাহেব ভুলেও বসতবাড়ি সরানোর চিন্তা মাথায় আনেননি। বাপ-দাদার পুরোনো ভিটে। সবাই এখানেই কাটিয়ে গেছে তাদের জীবন, তিনিও মরার আগ পর্যন্ত এখানেই কাটাতে চান।
প্রায় পঁয়ষট্টির কাছাকাছি আশরাফ সাহেবের বয়স। তবে দেখতে মনে হয় চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। শক্ত সামর্থ্য শারীরিক গঠন। কাজ করতে ভালোবাসেন বেশি। অতিরিক্ত কর্মঠ ও পরিশ্রমী বলেই হয়তো বয়সের ছাপ পড়েনি এখনও শরীরে। অথচ তাঁর সমবয়সী অনেকেই বৃদ্ধ হয়ে লাঠিতে ভর দেয়।
স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান এবং নাতিনাতনি নিয়ে আশরাফ সাহেবের পরিবার। বড় ছেলে এবং বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলের ঘরে একটা ছেলে এবং একটা মেয়েও আছে। বড় মেয়ের ঘরেও একটা মেয়ে আছে। নাতি নাতনিগুলো আশরাফ সাহেবের প্রাণ। সময় পেলেই তিনি নাতি নাতনি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
.
.
হেমন্তের বিদায় পর্ব চলছিল তখন প্রকৃতিতে। শীত আসি আসি করছে। আশরাফ সাহেব তাঁর আট বছরের নাতি রাজকে কাঁধে নিয়ে জমির আইল ধরে হেঁটে হেঁটে দেখছিল পাকা ধানগুলো। রাজ তাঁর দাদুকে জিজ্ঞেস করলো,
-দাদু এই সবগুলো আমাদের জমি?’
নাতির প্রশ্নের জবাবে আশরাফ সাহেব বললেন,
-না দাদুভাই, ওদিকের জমিগুলো আমাদের না।
-দাদু, ধানগুলোতো পেকে গেছে। কাটবে না এগুলো?’
-কাল থেকেই কাটবো দাদুভাই।
-ও কী মজা! কী মজা! দাদু, এবারও ধান পাহারা দেওয়ার জন্য বাইরে একটা বাসা বানাবে না?
-হ্যাঁ দাদু, বানাবো। ঐ বাসায় তুই আর আমি থেকে ধান পাহারা দেবো রাতে।
-হুমম, বীথি আর মনিকে আমাদের সাথে রাখবো না কিন্তু।’
-আচ্ছা দাদু, রাখবো না।’ হেসে জবাব দিলেন আশরাফ সাহেব। তিনি বুঝতে পারেন, দাদুর ভালোবাসার ভাগ রাজ কাউকে দিতে চায় না। বীথি রাজের ছোট বোন, আর মনি বড় ফুফুর মেয়ে। এদের দুইজনের চেয়ে রাজ বেশি ভালোবাসা পেতে চায় তার দাদুর কাছ থেকে।
.
.
পরদিনই আশরাফ সাহেব কয়েকজন কৃষককে কাজে লাগান ধান কেটে ঘরে আনার জন্য। তিনি সকাল থেকে ছাতা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে ধান কাটার দৃশ্য দেখছিলেন। যখন যোহরের আযান হয়, পাশের একটা ডোবা থেকে ওযু বানিয়ে এক জায়গায় গামছা বিছিয়ে নামাজটা আদায় করে নিলেন। নামাজ শেষ হতে হতে আশরাফ সাহেবের ছোট ছেলে রায়হান কৃষকদের জন্য ভাত নিয়ে এসে হাজির। রায়হানের সাথে রাজও এসে দাঁড়িয়েছে হাসিমুখে। রাজকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন আশরাফ সাহেব,
-স্কুল ছুটি হয়ে গেছে দাদুভাই? এই গরমের মধ্যে কেন এসেছিস এখানে?
-আমিও দেখবো কীভাবে ধান কাটে।
-স্কুল থেকে এসে কিছু খেয়েছিস?
-ওর জন্যও খাবার দিছে এখানে….’ জবাব দিলো রায়হান।
আশরাফ সাহেব সব কৃষককে খেতে ডেকে প্লেটে খাবার সাজাতে লাগলেন। ডোবা থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে কৃষকরা খেতে বসলো। একটা প্লেটে রাজও খেতে বসলো। খেতে খেতে সে বললো,
-দাদু, বিলের মাঝে খেতে অনেক মজা না?’
-হ্যাঁ দাদু। অনেক মজা।
-বিথীকে আমি এই কথা বলেছি, ও বিশ্বাস করে না। ও বলে, বিলে খেলে নাকি কোনো মজা নাই। মনিও বলে এ কথা।
-ওরা তো এখানে খাইনি, তাই জানে না।
-দাদু, ধান সব কাটা শেষ? এগুলো ঘরে নিয়ে যাবে না?
-হ্যাঁ, বিকেলেই নিয়ে যাবে।
-খড়ের উপর আমরা খেলবো, তুমি বকা দিতে পারবা না। আব্বুকেও বকা দিতে নিষেধ করে দিও।
-আচ্ছা নিষেধ করে দেবো।’
রাজের কথায় সম্মতি দিলেন আশরাফ সাহেব। বড় আদরের নাতি। কোনো কথা ফেলতে পারেন না।
.
.
বাড়ির বড় উঠানের এক পাশে ধানের শীষগুলো সব গাদা করে রাখা হলো। তারই পাশে ছোট করে বাঁশ আর তক্তা দিয়ে একটা বাসা বানানো হলো। রাতে এই বাসাতে থেকেই আশরাফ সাহেব ধানগুলো পাহারা দেবেন। নয়তো চোরের ভয় আছে।
জোৎস্না রাত। চাঁদের আলোটা চারপাশ আলোকিত করে রেখেছে। রাজ বসে আছে দাদুর সাথে ছোট্ট বাসাটিতে। বাড়ির সামনের রুমে পাড়ার ছেলে-মেয়ে, বয়স্করা টিভি দেখছিল। গ্রামে টিভি বলতে শুধু আশরাফ সাহেবের বাড়িতেই ছিল। সাদা কালো টিভি। রাতের বেলায় টিভিতে সুন্দর সুন্দর নাটক দেখায়। ধারাবাহিক নাটক। ওগুলো দেখতেই প্রতিরাতে পাড়ার সবাই মিলে ভিড় করে এ বাড়িতে এসে। এখান থেকে ওরা নিজেদের বসতবাড়ি সরিয়ে নিলেও টিভি দেখার লোভ কমাতে পারেনি।
টিভি দেখা শেষ হলে ছোট ছেলে মেয়েরা উঠানে বসে চিল্লাতে শুরু করলো। কেউ কেউ পরামর্শ করলো হা-ডু-ডু খেলবে বলে। দাদুর পাশ থেকে রাজও উঠে এলো হা-ডু-ডু খেলার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর পুরো উঠানটা জমে উঠলো। এক পাশে বয়োজ্যেষ্ঠরা বসে আড্ডা দিচ্ছে, আর একপাশে ছেলে মেয়েরা হা-ডু-ডু খেলছে। আর উপর থেকে চাঁদটাও সমানে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর বুকে এ যেন এক বাধাই করে রাখার মতো দৃশ্য।
রাত নয়টা পেরিয়ে গেলেই গ্রাম এলাকার জন্য অনেক রাত। তখন পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে যায়। তবে জোৎস্না রাতগুলোতে আরেকটু দেরিতে হয় রাত। কিন্তু দশটার পরে কেউ জেগে থাকে না। দশটার আগেই সবাই খেলা শেষ করে যার যার বাড়িতে চলে যেতে শুরু করলো। বয়োজ্যেষ্ঠরাও আড্ডা শেষ করে নিজেদের ছেলেমেয়েকে ডাক দিলেন চলে যাওয়ার জন্য। রাজ হাতমুখ ধুয়ে দাদুর পাশে গিয়ে কম্বলের ভেতর শুয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে গেল পুরো গ্রাম। দূর থেকে হঠাৎ শেয়ালের ডাক ভেসে এলো। ভয়ে দাদুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাজ।
.
.
ভোরে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মেজে হাত মুখ ধুয়ে ওযু করে নিলো রাজ। তার মা তাকে এবং বীথিকে ডেকে দুজনকেই আলাদা করে মুড়ি বেধে দিলো। তারপর মুড়ি খেতে খেতে বের হলো ঘর থেকে। মনিও চললো তাদের সাথে। মনির হাতেও মুড়ি বেধে দিয়েছে মনির মা। তিনজনে মুড়ি খেতে খেতে চললো মক্তবের দিকে। আশরাফ সাহেব ধানের গাদাগুলো তদারকি করছিলেন ছোট ছেলে রায়হানকে সাথে নিয়ে। আর তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতী বাড়ির উঠোনটা গোবর দিয়ে লেপ দিচ্ছেলেন, যাতে রোদ উঠলে তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। গ্রাম এলাকায় এটাকে বলে ‘খলা’। এখানেই ধানগুলো মাড়ানো হবে।
আশরাফ সাহেব এবার গোয়াল ঘরে গিয়ে মহিষগুলোকে খড় আর পানি দিতে লাগলেন। প্রায় দশ-বারোটার মতো মহিষ আছে গোয়ালে। এখান থেকে কয়েকটা দিয়ে আজ ধান মাড়ানোর কাজ করা হবে।
দশটার দিকে রোদের তেজ বেড়ে যাওয়ায় উঠোনটা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে গেল। আশরাফ সাহেব এবার ধানের আটিগুলো উঠানে গোবর দিয়ে লেপে দেওয়া জায়গাজুড়ে সুন্দর করে বিলিয়ে দিলেন। তারপর মহিষগুলোকে কাজে লাগালেন মাড়াইয়ের কাজে। সবগুলোর মুখে পিঞ্জারা এঁটে দিলেন যাতে ধান খেয়ে ফেলতে না পারে। কৃষকরা পেছন থেকে মহিষগুলোর হাল ধরে ‘থিতি থিতি হটহট হৈ’ এরকম অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করে মহিষগুলোর পিঠে বেতের বাড়ি মারছিল, আর মহিষগুলো সুন্দরভাবে ধান মাড়াতে লাগলো। কয়েকজন কৃষক খড় থেকে ধান আলাদা করার কাজে লেগে গেল। একপাশে বসে ছোট ছোট ছেলেমেয়ারা নির্বাক দৃষ্টিতে এই দৃশ্যগুলো উপভোগ করতে লাগলো। তারা অপেক্ষায় আছে খড়গুলো কখন স্তূপাকারে জমা হবে। তারপর তারা সেই খড়ের উপর লাফাবে, মজা করবে।
.
.
সন্ধ্যার আগেই সব ধানগুলো মাড়ানো শেষ। খলার উপর ধানগুলো স্তূপাকারে পড়ে আছে, কিছুটা দূরে আছে খড়গুলোর আরেকটা স্তূপ। সেই খড়ের উপর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে লাফাতে লাগলো রাজ। কয়েকবার তার মা এসে নিষেধ করে গেল খড়ের উপর এভাবে না খেলতে। শরীর চুলকাতে পারে। কিন্তু কে শুনে কার কথা? সামান্য শরীর চুলকানোর ভয়ে কি এমন মজার খেলাটা বাদ দেবে? বীথি এবং মনি এসেও তাদের সাথে খেলায় যোগ দিলো।
এভাবে খড়ের উপর বাচ্চাদের খেলা চললো রাত আটটা পর্যন্ত। দূর থেকে যখন রাজের বাবার কাশির শব্দ শোনা গেল, তখন বাচ্চারা যে যেদিকে পারে পালাতে শুরু করলো। কাউকে ভয় না পেলেও বাবাকে খুব ভয় পাই রাজ। বাবা একটু কড়া ধরনের মানুষ। তাই বাবা বাড়িতে পৌঁছার আগেই ছোটবোনকে নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে পড়লো সে। বাবা এসে চুপচাপ ছেলেমেয়েকে দেখে খাবার ঘরে চলে গেলেন।
.
.
কয়েকদিন পর ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব শুরু হলো। পায়েস পিঠার মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠলো আশরাফ সাহেবের পুরো বাড়ি। বাইরের উঠানে বসে রাজ তার দাদা-দাদির সাথে গল্প করছিল পিঠা খেতে খেতে। পিঠার একটা অংশ মুখে পুরে সে দাদুকে জিজ্ঞেস করলো,
-দাদু, তুমি ছোট থাকতে কি আমার মতো ছিলে?’
-হ্যাঁ দাদুভাই। একদম তোর মতো ছিলাম।
-দিদিমনি, তুমি কার মতো ছিলে?’ এবার রাজ তার দাদিকে করলো প্রশ্নটা। দাদি হেসে জবাব দিলো,
-আমি ছিলাম বীথি আর মনির মতো।’
দাদির মুখে নিজেদের নাম শুনে ছুটে এলো বীথি ও মনি। বীথি দাদির কোলে বসলো আর মনি বসলো দাদার কোলে, রাজের পাশে। তারপর জমে উঠলো আড্ডা। বাচ্চা তিনটে আবদার করলো দাদা দাদির বিয়ের কথা শুনতে। তাদের আবদার শুনে দাদা বললেন,
-আমি কিন্তু তোদের দাদিকে দেখে প্রথমে প্রেমে পড়িনি। তোদের দিদিমনি প্রথমে আমার প্রেমে পড়ে।’ কথাটি বলেই ‘হা হা হা’ করে হেসে উঠলেন। স্বামীর কথা শুনে পদ্মাবতী বললেন,
-না, তোদের দাদু মিথ্যে বলছে। উনিই আমার প্রেমে পড়ে প্রথমে। আমি তখন ছোট ছিলাম। প্রেম/বিয়ে এসব বুঝতাম না। তোদের দাদু আমাকে একবার দেখেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়।
-দাদু তুমি মিথ্যে বলছো?’ প্রশ্নটা করলো মনি। সম্পর্কে এরা তার নানা-নানি হলেও সে এদের দাদু-দিদিমনি বলেই ডাকে। তার বাবা বিদেশে থাকায়, তার মা তাকে নিয়ে এই বাড়িতেই থাকে তার জন্মের আগে থেকে।
মনির কথা শুনে আশরাফ সাহেব হাসলেন ‘হা হা হা’ করে। কিছুক্ষণ হাসার পর বললেন,
-তোদের দাদি তখন অনেক রূপসী ছিল। দেখতে অনেক সুন্দরি ছিল, প্রেমে না পড়ে কি উপায় আছে?’
স্বামীর মুখে নিজের প্রশংসা শুনে এই বয়সেও কিছুটা লজ্জা পেলেন পদ্মাবতী। তবে চাঁদের আলোয় তাঁর লজ্জামাখা মুখটা তেমন বোঝা গেল না। তবুও আশরাফ সাহেব কল্পনা করে নিলেন পদ্মাবতীর সেই নববধূ রূপে লজ্জামাখা চেহারাটা। পালকিতে করে তিনি এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন পদ্মাবতীকে। খুব অল্প বয়স ছিল তখন তার। তার যে স্বামী হয়েছে, সংসার হয়েছে এগুলো সে বুঝতো না। বিয়ের রাতে যখন দুজনকে একসাথে থাকতে দেয়া হলো, তখন পদ্মাবতী ঝগড়া করে স্বামীর সাথে। রেগে উঠে সে বলে,
-এই তুমি আমার সাথে থাকতে চাও কেন? লজ্জা করে না? ছেলে মেয়ে একসাথে থাকা যায় না, জানো না?’
আশরাফ সাহেব তখন স্ত্রীকে থামিয়ে চাপাস্বরে বলে,
-এভাবে চিৎকার করো না, সবাই শুনতে পাবে। তুমি এখন আমার বউ, আমাদের একসাথেই থাকতে হবে।’
-কীসের বউ এ্যা এ্যা এ্যা….’ বাচ্চাকণ্ঠে কেঁদে উঠে পদ্মাবতী। পরে তাঁকে অনেকেই বুঝিয়েছিল যে বিয়ের পর স্বামীর সাথে একসাথেই থাকতে হয়। ধীরে ধীরে তিনি বুঝেন সব। তবুও পুরোপুরি সংসারী হতে তাঁর অনেক বছর কেটে গিয়েছিল।
-দাদু কী ভাবছো তুমি? দিদিমনির কথা ভাবছো?’ বীথির কথা শুনে আশরাফ সাহেব পুরোনো স্মৃতি থেকে বের হয়ে এলেন। হেসে বললেন,
-হ্যাঁ, তোদের দাদিকে নিয়েই তো ভাববো, আর কাকে নিয়ে ভাববো।
-আচ্ছা দাদু, তোমাদের দুজনকে একটা প্রশ্ন করি?’ অনুমতি চাইলো রাজ।
-হ্যাঁ কর।’ একসাথে জবাব দিলেন দুজন।
-তোমাদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি প্রিয়?’
-সবাই প্রিয়, তবে তোর বাবা হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান, আমাদের কলিজা।’ জবাব দিলেন পদ্মাবতী। তাঁর জবাব শুনে মনির মুখটা কালো হয়ে গেল। সে ভেবেছিল, সবচেয়ে প্রিয় সন্তান হিসেবে তার মায়ের নামটাই বলবে। মনিকে মন খারাপ করতে দেখে পদ্মাবতী বললেন,
-মুখ কালো করছিস কেন? আগে শুন সব কথা। রাজের বাবা বেশি প্রিয় কারণ তার বাবা আমাদের কোলে আসার আগে আমাদের আরও পাঁচটা সন্তান হয়েছিল। কিন্তু কেউ একমাসের বেশি বাঁচেনি।
-তারপর?’ উত্তেজিত হয়ে উঠলো বাচ্চা তিনটে। নড়েচড়ে বসলো পুরো কাহিনী শোনার জন্য। পদ্মাবতী আবার বলতে শুরু করলেন,
-তারপর যখন রাজের বাবা আমার পেটে আসে, আমি দিনরাত শুধু কাঁদতাম। ভাবতাম ওকেও বুঝি আমরা বাঁচাতে পারবো না। তখন কে যেন পরামর্শ দিয়েছিল, পুকুরে একগলা পানিতে নেমে এক নিশ্বাসে ডুব দিয়ে আল্লাহর কাছে সন্তানের মঙ্গল চাইলে সন্তান বাঁচতে পারে।’
-তুমি তাই করেছো?’ একসাথে প্রশ্ন করলো বাচ্চা তিনটা। আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠলো তারা।
-হ্যাঁ। একদিন খুব ভোরে উঠে, ফজরের নামাজ পড়ে আমি পুকুরের একগলা পানিতে নেমে পড়ি। তারপর এক নিশ্বাসে ডুব দিয়ে আমার পেটের সন্তানের মঙ্গল কামনা করি।
-তারপর আব্বু বেঁচে গিয়েছিল?’ রাজের চোখে মুখে বিস্ময়।
-হ্যাঁ, না বাঁচলে তোরা কী করে এলি পৃথিবীতে?’
-এভাবে পুকুরে নেমে কারও মঙ্গল চাইলে সে বেঁচে যায়?
-কী জানি দাদুভাই। তবে তোর বাবা বেঁচে যায়। এরপর থেকে আমার আর কোনো সন্তান মরেনি।’
কাহিনীটা শুনে বাচ্চা তিনজন একদম চুপ হয়ে যায়। কাহিনীটা তাদের কোমল হৃদয়ে গভীরভাবে জায়গা করে নেই। সবাইকে হঠাৎ চুপ থাকতে দেখে আশরাফ সাহেব বললেন,
-অনেক রাত হয়েছে। সবাই এবার ঘুমাতে যাও। মনি তোর মাকে টিভি বন্ধ করে ঘুমাতে বল।
-আমান তো এখনও ফিরেনি ঘরে।’ মন্তব্য করলো পদ্মাবতী। আমান তাদের বড় ছেলে, রাজের বাবা। ব্যবসার হিসাব-নিকাশ করে বাসায় ফিরতে তাঁর মাঝেমাঝে অনেক রাত হয়ে যায়। স্ত্রীর কথা শুনে আশরাফ সাহেব বললেন,
-বউমাকে বলে দিও আমান আসলে দরজা খুলে দিতে। তোমরা যাও। চল দাদুভাই, তুই আর আমি আমাদের বাসায় যাই।’
রাজের হাত ধরে তিনি ছোট্ট বাসাটিতে গিয়ে বিছানা ঠিক করতে লাগলেন। কিছুটা দূরে দুটো চোখ জ্বলে উঠতে দেখে রাজ দাদুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-দাদু ওগুলো কীসের চোখ? ভূত মনে হয়।’
-আরে না। ওগুলো বিড়ালের চোখ। বিড়ালের চোখ অন্ধকারে জ্বলে।’
-আর কীসের চোখ জ্বলে অন্ধকারে?’ ভয় কিছুটা কাটলো তার। তবে সম্পূর্ণ কাটেনি। দাদুর পাশে শুয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সে দাদুকে। দাদুও তাকে বুকে নিয়ে বললো,
-বাঘ, হরিণ, সিংহ এদের চোখও জ্বলে।
-কেন জ্বলে দাদু?
-কারণ এদের চোখে রক্ত বেশি।
-ও…’
আর কোনো কথা বলে না রাজ। একটুপর ঘুমিয়ে পড়ে দাদুর বুকে। শিশুদের চোখে একটু তাড়াতাড়িই ঘুম নেমে আসে।
.
.
♥দুই♥
অনেকক্ষণ ধরে রাজ, মনি আর বীথি তাদের দাদুর জন্য অপেক্ষা করছে। দাদু সেই সকালে বাজারে গেছে, বিকেল হয়ে গেছে এখনও ফিরছে না। দাদুর জন্য এভাবে অপেক্ষা করার কারণও আছে। দাদু বাজারে গেলে প্রতিবার তাদের জন্য মজার মজার খাবার নিয়ে আসে। আজও খাবারের আশায় তিনজনে মিলে বিলের মাঝে আছে দাদুর অপেক্ষায়। পাশেই পদ্মাবতী তাঁর মেয়ে এবং বউমাকে নিয়ে বাতাসে কুলা দিয়ে ধান ওড়িয়ে পরিষ্কার করে নিচ্ছিলেন। হঠাৎ বাতাস কমে যাওয়ায় তাঁরা চটের উপর বসে বাতাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন আর বাচ্চা তিনটের কাণ্ড দেখছে, আর হাসছে। কারণ দূর থেকে তাঁরা সাদা পাঞ্জাবি পরা কাউকে আসতে দেখলে ‘দাদু আসছে, দাদু আসছে’ বলে চিৎকার করে উঠে। তারপর রাস্তায় ছুটে যায় তিনজন। কিন্তু কাছে এলে দেখা যায়, ওটা তাদের দাদু না। তখন তারা আবার বিলের মাঝে ফিরে আসে মন খারাপ করে।
একটু পর দূর থেকে আরও একজনকে সাদা পাঞ্জাবি পরে আসতে দেখা গেল। রাজ বললো, ‘
‘-ওটা দাদু, চ্যালেঞ্জ।’
-ওটা দাদু না।’ বীথি আর মনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলো রাজের। রাজ আবার বললো,
-ঠিক আছে, কাছে আসলে দেখা যাবে।’
তারপর আবার তিনজন উত্তেজিত হয়ে অপেক্ষা করে লোকটা কাছে আসার জন্য, কার কথা ঠিক হয় দেখার জন্য। বীথি এবং মনি রাজের কথার বিপরীতে চ্যালেঞ্জ ধরলেও তারা মনে মনে চায় যেন রাজের কথাই ঠিক হয়, ওটা যেন দাদু হয়।
তারপর যখন লোকটা কাছে এলো, তিনজনে চিৎকার করে উঠলো,
-এই, দাদু এসে গেছে।’
তিনজনে একসাথে দৌড় দিলো আবার রাস্তায়। দৌড়াতে দৌড়াতে রাজ বললো,
-আমার কথাই ঠিক হয়েছে, আমি বলেছি এটা দাদু।’
তার কথার উত্তর দেওয়ার সময় নেই বীথি এবং মনির। তারা এখন আরেকটা চ্যালেঞ্জে আছে, কার আগে কে দাদুকে ছুঁতে পারে। তিনজনে একসাথে গিয়ে দাদুকে ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-দাদু, আমাদের জন্য কী আনছো?
-তোমাদের জন্য নতুন জামা আনছি।’ জবাব দিলেন আশরাফ সাহেব। নতুন জামার কথা শুনে তিনজনে খুশিতে লাফাতে লাগলো। হঠাৎ দাদু নতুন জামা কেন আনলো, তা আর জানতে চাইলো না।
বাড়িতে এসে যখন তারা নতুন জামা হাতে নিয়ে উঠানে বের হলো, তখন তাদের খুশি আর দেখে কে? ভেতর থেকে দাদু চিৎকার করে বলে,
-জামা ময়লা করিস না। কাল আমরা বেড়াতে যাবো সবাই….’
বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে তিনজনের খুশিতে নতুনমাত্রা যোগ হলো।
.
.
আশরাফ সাহেবের মেজ ছেলে জামাল। ওর জন্য কয়েকদিন ধরে পাত্রীর খোঁজ করা হচ্ছে, কিন্তু পছন্দ মতো পাত্রী মিলছে না। আগেরদিন বাজারে গিয়ে আশরাফ সাহেব তাঁর পরিচিত এক লোকের কাছে ভালো একটা পাত্রীর সন্ধান পেয়েছে। তবে একটু দূরে। আজ সেই পাত্রীকেই দেখতে যাবে।
বাড়ির সামনের রাস্তায় তিনটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। রাজ, বীথি এবং মনি আগে থেকেই নতুন জামা পরে একটা ট্যাক্সিতে গিয়ে বসে আছে। ধীরে ধীরে সবাই রেডি হয়ে বের হলো। গ্রামের কয়েকজন মুরব্বি এবং সম্মানিত লোকও সাথে চললো পাত্রী দেখতে। প্রায় এক ঘণ্টা পর ওরা পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলো। এই এক ঘণ্টা সময় বাচ্চা তিনটে অনেক মজা করেছে গাড়িতে, আশেপাশের দৃশ্য দেখে আনন্দ পেয়েছে। যখন মনে হতো তাদের সাথে সাথে আশেপাশের দৃশ্যগুলোও ছুটে চলেছে, তখন লাফাতে শুরু করে গাড়ির ভেতরেই।
তবে পাত্রীর বাড়িতে পৌঁছার পর তিনজনই চুপচাপ হয়ে যায়। অপরিচিত জায়গা, অচেনা অনেক চেহারার মাঝে চুপ থাকাটাই ভালো।
সামনের একটা কক্ষে বসে বয়স্করা আড্ডা দিচ্ছে। মহিলা আর বাচ্চারা ভেতরে। রাজ তার মায়ের কোলে বসে শরবতের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। বীথি আর মনি ইতিমধ্যে একটা বান্ধবী জুটিয়ে নিয়েছে। সেই বান্ধবীর সাথে তারা দুজন খেলতে বেরিয়ে গেছে। রাজ এক নিশ্বাসে বাকি শরবতটুকু শেষ করে মায়ের কোল নেমে বাইরে যাওয়ার পথ খুঁজলো। তখন কোথা থেকে একটা যুবতি মেয়ে এসে তাকে কোলে করে অন্য একটা কক্ষে নিয়ে গেল। ঐ কক্ষে আরও অনেকগুলো যুবতী মেয়ে ছিল। রাজ পুরো কক্ষে তার সমবয়সী কাউকে দেখতে না পেয়ে অস্বস্তিবোধ করছিল। এই মেয়েগুলো তাকে এভাবে তুলে নিয়ে এলো কেন? চোখ টিপটিপ করে তাকালো সে সবার দিকে। যে মেয়েটা তাকে কোলে নিয়েছে, সে তার গালটা টেনে সবাইকে বললো,
-বাচ্চাটা কত্ত কিউট না!’
এবার তাকে অন্য একটা মেয়ে কোলে নিলো। সেও তার গাল টেনে জিজ্ঞেস করলো,
-কী নাম বাবু তোমার?’
-রাজ…’ নিচের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো সে। লজ্জা পাচ্ছে সে। মেয়েটা আবার জিজ্ঞেস করলো,
-যার জন্য পাত্রী দেখতে আসছো, সে তোমার কে হয়?
-আমার মেজ চাচ্চু।
-আর আমি তোমার কে হবো?’
রাজ চুপ করে রইলো এমন প্রশ্ন শুনে। তখন সব মেয়েরা একসাথে হেসে দিলো। মেয়েটা হাসি থামিয়ে আবার তার গাল টেনে আদর করে বললো,
-আমি তোমার মেজ চাচি হবো, বুঝছো?’
রাজ কোনো জবাব দেয় না। অস্বস্তি বেড়ে গেছে তার। এই মেয়েগুলো তাকে নিয়ে মজা করছে। দরজার দিকে তাকালো সে। তার অবস্থা বুঝতে পেরে মেয়েটা বললো,
-চলে যাবে?’
-হুমম…’
মেয়েটা তার হাতে কিছু চকলেট দিয়ে বললো,
-যাও…’
মুক্তি পেয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে এলো রাজ। তারপর বীথি ও মনিকে খুঁজতে লাগলো। সামনে একটা সুপারি বাগানে ওদের দেখা গেল। ওরা তাদের সমবয়সী একটা ছেলের সাথে কী নিয়ে যেন ঝগড়া করছে। রাজ এগিয়ে গেল ওদিকে। তাকে দেখে বীথি ও মনি দৌড়ে এলো নালিশ করতে। মনি বললো,
-রাজ, দেখ ঐ ছেলেটা শুধুশুধু ঝগড়া করছে আমাদের সাথে।’
রাজকে পেয়ে ওদের সাহস বেড়ে গেছে এখন। বীথি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আমার ভাই এসে গেছে, এবার আয় ঝগড়া করতে।’
তার কথা শেষ হতেই মনি দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো। তারপর আবার দৌড়ে চলে এলো রাজের পাশে। ছেলেটা তখন মাটি থেকে উঠে মনিকে মারতে এলে, রাজ রুখে দাঁড়ালো। ওরা তাকে ভরসা করছে দেখে তারও সাহস বেড়ে গেছে। গলা উঁচু করে আঙুল দেখিয়ে বললো,
-ঐ কাকে মারতে আসছিস?’
ঘটনার রেশ বাড়তে দেরি হলো না। একটু পর একজনের উপর আরেকজন গড়াগড়ি খেতে লাগলো মাটিতে। বীথি আর মনিও দাঁড়িয়ে থাকলো না। নতুন বান্ধবীকে সাথে নিয়ে রাজের শক্তি বাড়িয়ে দিলো তারা। তিনজনে ছেলেটাকে চেপে ধরলো মাটিতে। আর রাজ তার গলা চেপে ধরলো। ভাগ্যিস কোথা থেকে একটা বয়স্ক লোক আসায় ছেলেটা বেঁচে গেছে সেই যাত্রায়। রাজ নিজের গা থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বিজয়ের হাসি দিলো বোনদের দিকে তাকিয়ে। বীথিদের নতুন বান্ধবীটা তখন বললো,
-ঐ ছেলেটা খুব খারাপ। সবার সাথে শুধু ঝগড়া করে। কেউ দেখতে পারে না তাকে। আরও মারা উচিত ছিল তাকে।
-নাম কী তোমার?’ রাজ জিজ্ঞেস করলো মেয়েটাকে।
-আমার নাম রিতা। তোমার নাম কী?
-আমার নাম রাজ।
-আজ থেকে তুমিও আমার বন্ধু, কেমন?
-আচ্ছা…’ হেসে দিলো রাজ।
-চলো আমরা ওদিকে গিয়ে খেলি…’
-দাঁড়াও, দাঁড়াও… বীথি, ছোট চাচ্চু ওখানে কী করছে রে?’ অবাক হলো রাজ। তারা দেখলো তাদের ছোট চাচ্চু রায়হান রান্নাঘরের পেছনে মাঝেমাঝে উঁকি দিয়ে তাকাচ্ছে। ওরা চারজন চুপিচুপি গেল ছোট চাচ্চুর পেছনে। দেখলো একটা মেয়েও ওখান থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে ছোট চাচ্চুকে। তা দেখে ছোট চাচ্চু খুব খুশি হচ্ছে। রাজ তার ছোট চাচ্চুর পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
-ছোট চাচ্চু, আমরা মেজ চাচ্চুর জন্য পাত্রী দেখতে এসেছি, তোমার জন্য না।’
রায়হান ওদেরকে দেখে চমকে উঠে বললো,
-তোরা? তোরা এখানে কী করছিস? যা এখান থেকে।
-যাবো না। বলে দিবো আব্বুকে সব, তুমি আব্বুকে ভয় পাও না?’
রায়হান রাজের হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে বললো,
-যা এবার…
বীথি ও মনি কোমরে দুহাত দিয়ে দাঁড়ালো। ভাব ভঙ্গিমায় বুঝিয়ে দিলো তাদেরকেও টাকা দিতে হবে। রায়হান আরও তিনটা পাঁচ টাকার নোট বের করে রিতাকেসহ দিলো। টাকা পেয়ে চারজন দৌড়ে গেল দোকানের দিকে। তাদের খুশি আর দেখে কে।
.
.
দুপুরের পর খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই বসলো। মহিলারা খাওয়ার আগেই পাত্রীকে দেখে নিয়েছে। এবার পুরুষরা দেখবে। সবাই বসে আছে পাত্রী দেখার জন্য। দাদুর কোলে বসে আছে রাজ। দাদুকে সে ফিসফিস করে বললো,
-দাদু, আমি বউকে দেখেছি। খুব পঁচা। আমার গাল টানে শুধু।’
নাতির কথা শুনে হাসে আশরাফ সাহেব।
-তাই নাকি দাদু? খুব পঁচা বউ? তোর গাল টেনেছে? তোকে তো আদর করেছে গাল টেনে।
-আমাকে চকলেটও দিছে।
-তাইলে তো খুব ভালো বউ।’ বলতে বলতে আশরাফ সাহেব ঠিক হয়ে বসলেন। পাত্রীকে নিয়ে এসে জামালের পাশে বসানো হলো। গাড়ি থেকে নেমেই সে এক পলক দেখেছিল পাত্রীকে। তখনই পছন্দ হয়ে যায়। এখন একটু সাজগোজ করে আসায়, আরও বেশি মনে ধরে গেল তার। বিয়ে এই মেয়েকেই করবে সে।
আশরাফ সাহেব পাত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন,
-নাম কী তোমার মা?
-ইয়াসমিন।’ নিচু হয়ে জবাব দিলো পাত্রী। লজ্জা পাচ্ছে সে ভীষণ। তবে পাত্রীর অবস্থা দেখে খুব মজা পাচ্ছে রাজ। ওরা তাকেও এরকম অবস্থায় ফেলেছিল তখন।
-কত ক্লাস পর্যন্ত পড়েছো?’ আবার জিজ্ঞেস করলেন আশরাফ সাহেব।
-মেট্রিক পাশ করেছি।
-আরবি পড়তে পারো?
-হ্যাঁ পারি…’
ছেলের জন্য পাত্রী পছন্দ হয়েছে আশরাফ সাহেবের। তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। তবে সবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
-তোমরা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবা?’
সবাই একসাথে জবাব দিলো,
-আমাদের পাত্রী পছন্দ হয়েছে।’
আশরাফ সাহেব তারপর জামালকে জিজ্ঞেস করলেন পাত্রী পছন্দ হয়েছে কি না। জামাল নিচু হয়ে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লো। রাজ দাদুর কোল থেকে নেমে পাত্রীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দুহাত কোমরে রেখে বললো,
-কেমন লাগছে এখন? আমাকে তখন লজ্জায় ফেলেছিলে না সবাই মিলে?’
ইয়াসমিন কোনো কথা না বলে রাজের গালটা আবার টেনে দিলো। সাথে সাথে হেসে উঠলো সবাই।

.
.
পাত্রী যখন সবার পছন্দ, তাই আর দেরি না করে ঐদিনই বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে দিলো। বিকেলের দিকে আশরাফ সাহেব সবাইকে নিয়ে বের হলেন চলে যাওয়ার জন্য। সুপারিবাগান দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় রোদের সোনালী আলো পাতার ফাঁক দিয়ে এসে মাটিতে পড়ায়, খুব সুন্দর লাগছিল দৃশ্যটা। সামনের রাস্তায় তাদের ট্যাক্সিগুলো দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাক্সিগুলোর পাশে অনেকগুলো বাচ্চা ছেলেমেয়ে ঘোরাঘুরি করছে। কয়েকজন আবার চালক সেজেছে। আশেপাশের বাড়ি থেকে কিছু মেয়ে ও মহিলারা লুকিয়ে তাদের দেখছিল। এটাই স্বাভাবিক। নিজের এলাকায় নতুন মেহমান দেখলে, বিশেষ করে এরকম পাত্রী দেখতে আসলে আশেপাশের মেয়ে আর মহিলাদের আগ্রহের সীমা থাকে না। কেউ কেউ পাত্রের ভালোমন্দ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করে। পাত্র এমন, পাত্র তেমন ইত্যাদি ইত্যাদি। গাড়িতে উঠার আগে রাজ একবার পেছনে তাকালো। বীথি ও মনিও তাকালো পেছনে। দেখলো রিতা তার পরিবারের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরকে তাকাতে দেখে হাত নেড়ে হাসিমুখে বিদায় জানালো।
.
.
রাতের বেলায় আশরাফ সাহেবের বাড়ির উঠানে জমে উঠলো গ্রামবাসীদেরর আড্ডা। আড্ডার বিষয়বস্তু নতুন পাত্রীকে নিয়ে। এলাকার কিছু মহিলা আর কিছু মধ্যবয়স্ক লোক এসেছে পাত্রী সম্পর্কে জানতে। চাঁদের আলোতে উঠানে বসে চলতে লাগলো তাঁদের আলাপ। রাজের মা সবার জন্য চা বানিয়ে আনলো। চা খেতে খেতে আসর জমিয়ে তুললো পদ্মাবতী। তিনি বললেন,
-পাত্রী আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। আমার জামালের সাথে বেশ মানাবে। দেখতে লম্বা, সুন্দর।’
এক মহিলা জিজ্ঞেস করলো,
-পাত্রী কীভাবে হাঁটে? ওকে হাঁটাওনি, খালাম্মা?’
পদ্মাবতী উত্তর দেওয়ার আগে তার বড় মেয়ে, অর্থাৎ মনির মা রসিয়ে বললো,
-তা আবার হাঁটায়নি? পাত্রী যখন এসেছে আম্মা আগে ওর হাঁটা দেখতে চেয়েছে। আমি বললাম ওসব পরে দেখো। না, আম্মা আগে হাঁটাই দেখবে। বেচারি এসে বসতে পারলো না, হেঁটে দেখাতে হলো।’
মনির মার কথা শুনে সবাই হাসিতে ফেটে পড়লো কিছুক্ষণ। পদ্মাবতী বললেন,
-তো হাঁটা দেখবো না বল? হাঁটা সুন্দর না হলে আর কেমন বউ?’
তখন আরেকজন লোক বলে উঠলো,
-খালাম্মা ঠিক বলেছে, হাঁটা সুন্দর না হলে কেমন বউ? আমার জন্যও যখন রিপার আম্মুকে দেখতে যায়, তখন আমার মা আগে ওর হাঁটা দেখে।’
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই কথার হাল ধরে তার বউ বললো,
-আমি কয়েকবার এদিক থেকে ওদিকে হেঁটে দেখানোর পর আমাকে বসতে বলেছে।’
-বড্ড ভালো ছিল তোর শাশুড়িটা। কিন্তু আজ বেঁচে নেই।’ একটু করুণ করে বললেন পদ্মাবতী।
-হুমম, খুব ভালো ছিল আমার শাশুড়িটা। রিপার জন্মের তিনমাস পর মারা গেছে। খুব আদর করতো আমার মেয়েটাকে।’
এভাবে আড্ডার রেশ একদিক থেকে আরেকদিকে বয়ে চললো কিছুক্ষণ। তখন আরেকটা লোক আড্ডার রেশ আবারও একইদিকে নিয়ে এসে আশরাফ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
-মাইজ্জা, তোমার কাছে কেমন লেগেছে তোমাদের বউকে?’
-সবার ভালো লেগেছে, আমারও ভালো লেগেছে।’ হেসে বললেন আশরাফ সাহেব।
-বউয়ের দাঁতগুলো কিন্তু খুব সুন্দর। হাসলে দাঁতগুলো আরও বেশি সুন্দর লাগে। আগেরবার আরেকটা মেয়ের দাঁত বড় ছিল বলে আমরা পছন্দ করিনি।’ এই প্রথম আড্ডায় শরিক হলেন রাজের মা। এতক্ষণ তিনি ভেতরে কাজ করছিলেন। কাজ শেষ করে এখন এলেন সবার সাথে আড্ডা দিতে। তাঁর কথা শেষ হতেই মনির মা বললো,
-হ্যাঁ, একটা দাঁত বড় বড় ছিল বলে পছন্দ হয়নি, এর আগে আরেকটার মাথায় চুল কম ছিল বলে পছন্দ হয়নি।’
এবার পদ্মাবতী মন্তব্য করলেন,
-তবে আমার আমানের জন্য এত পাত্রী দেখতে হয়নি। প্রথমবারই আমরা পছন্দ করেছি আয়েশাকে।’
শাশুড়ির মুখে নিজের প্রশংসা শুনে কিছুটা গর্ববোধ করলেন আয়েশা বেগম। এভাবে আড্ডা চললো আরও বেশ কিছুক্ষণ। যখন বাচ্চা তিনটা এসে ঘুমানোর আবদার ধরলো, তখনই তাদের আড্ডা শেষ হলো।
.
.
(চলবে….)
.
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here