জীবনের গল্প পর্ব:-০৬

0
442

__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-০৬____________
অনেকক্ষণ একমনে অন্যদিকে তাকানোর পর মনি হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল পুকুরপাড়ে। খেলা রেখে দৌড়ে এলো রাজ। পেছন পেছন ছুটে এলো বীথি, রিতা আর শায়লার ছেলেটা। মনিকে নড়াচড়া করতে না দেখে ভয় পেয়ে গেল ওরা। বীথি চিৎকার করতে করতে ঘরে দৌড় দিলো খবরটা জানাতে। খবর শুনে ঘর থেকে মনির মা আর পদ্মাবতী ছুটে এলেন। পেছন পেছন আরও কয়েকজন আসতে লাগলো। তারা পুকুরপাড়ে এসে দেখে আরেক কাণ্ড ঘটে গেছে। মনি বেহুশ হয়ে পড়ে আছে, আর রাজ পুকুরের পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে এমনিই পুকুরের পানি টইটম্বুর করছে। তাতে রাজ কোনো কূলকিনারা পাচ্ছে না। আগে তাকে বাঁচাতেই পুকুরে ঝাপ দিলো মনির মা। রাজকে নিয়ে ভেজা গায়ে উঠে এলো পুকুর থেকে। রাজেরও হুশ নেই আর। মনির পাশে শুয়ানো হলো তাকে। তারপর মনির মাথায় পানি ঢেলে আর রাজের পেট থেকে পানি বের করে দুজনের হুশ ফেরানো হলো। আগে মনির হুশ ফেরেছে। হুশ ফিরতেই সে দেখে রাজের অবস্থা। কিছুক্ষণ পর রাজেরও হুশ ফেরে। তাকে জিজ্ঞেস করা হয় পানিতে কীভাবে পড়লো। সে জবাব দিলো মনিকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে পানিতে ঝাপ দেয় সে। পদ্মাবতী জিজ্ঞেস করলেন,
-ও এখানে বেহুশ হয়ে পড়েছে আর তুই ওখানে পানিতে ঝাপ দিলি কেন?’
রাজ ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বললো,
-তুমিই তো বলেছো, তুমি পুকুরে নেমে আল্লাহর কাছে চাইছো বলে আব্বু বেঁচেছিল। তাই আমিও মনিকে বাঁচাতে পানিতে ঝাপ দিয়েছি।’
রাজের কথা শুনে বড়রা পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগলো। আয়েশা বেগম ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে চুমু খেয়ে বললো,
-এমন পাগলামি আর করিস না বাপ।’
বোকা বনে গেল হঠাৎ রাজ। মনি উঠে তার হাত ধরলো। পরস্পরের দিকে তাকালো দুজন। তারপর হেসে দিলো। তাদের হাসি দেখে বাকিরাও না হেসে পারলো না।
.
.
ফাতেমার বিয়ের আগেরদিন এসেছিল শায়লা। আজ দুইদিন হয়ে গেল ওর বিয়ে হয়েছে। এখনও চলে যায়নি শায়লা। তবে আসার পর থেকে একটুও কথা হয়নি জামালের সাথে। আসলে কথা বলার সুযোগ পাইনি বিয়ের ব্যস্ততা আর জামালের বউয়ের জন্য। তবে কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে। চোখে চোখ পড়তেই সরিয়ে নিয়েছে নিজেদের দৃষ্টি।
জামাল এখন ঘরেই আছে। রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় রেস্ট নিচ্ছে। ইয়াসমিন আয়নার সামনে বসে চুলগুলো আঁচড়াচ্ছিল। আর জামাল আয়নাতে তাকিয়ে নিজের বউয়ের রূপে দৃষ্টি শক্তি বাড়িয়ে নিচ্ছিল। ইয়াসমিন মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-কী দেখছো এভাবে।
-তোমার রূপের নীল সাগরে ডুব দিচ্ছি।
-ইশ! বউয়ের প্রশংসা করছো বুঝি?
-যা ভাবার ভাবতেই পারো। তোমার হাতটা একটু বাড়াবে?
-কেন?
-নরম তুলোর ছোঁয়া নেবো…’
হেসে হাতটা বাড়ালো ইয়াসমিন। জামাল তার হাতটা ছুঁয়ে আলতো করে চুমু খেলো। তারপর হাত ধরে টান দিলো ইয়াসমিনকে। এলোমেলো চুলে ইয়াসমিন এসে পড়লো স্বামীর বুকে। জামাল চোখ বুজে স্ত্রীর চুলের মিষ্টি ঘ্রাণ নিলো। ইয়াসমি চাপাস্বরে বললো,
-কী করছো, দরজা খোলা, কেউ এসে পড়বে তো…
-তাহলে দরজাটা অফ করে আসো।’
স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির হাসি হাসলো জামাল। ইয়াসমিনও লজ্জামাখা হাসি দিলো। তারপর উঠে দরজটা বন্ধ করে দিলো। দরজার ওপাশে যে শায়লার ছায়াটা মুহূর্তেই সরে গেল তা নজরে পড়েনি তার। শায়লা তখন লুকিয়ে একবার দেখছিল জামালকে। আসার পর থেকে একটু ভালো করে দেখাও হয়নি প্রিয় মানুষটাকে। ওদের স্বামী স্ত্রীকে ওভাবে দেখে শায়লা বুঝলো ভালোই আছে জামাল। প্রিয় মানুষটা সবসময় ভালো থাকুক এটাই চাই সে। এর চেয়ে বড় কোনো চাওয়া নেই তার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাসলো শায়লা। এ হাসির অর্থ বোঝা গেল না। তবে এ হাসি নিশ্চয়ই আনন্দের না।
শায়লার ছেলেটা ঘুমাচ্ছে। পাশে বসে একটা হাদিসের বই পড়ছে ছেলের বাবা। স্ত্রীকে রুমে ঢুকতে দেখে বই থেকে চোখ না সরিয়েই সে বললো,
-শায়লা, আমাদের ব্যাগ গুছিয়ে নাও। সকাল হতেই আমাদের রওনা দিতে হবে। মাদ্রাসায় ক্লাস আছে।’
শায়লা অন্যমনস্ক হয়ে ঘুমন্ত ছেলের দিকে তাকালো। শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা। একটু আগেই শুয়ে দিয়েছিল সে ছেলেটাকে। এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময় এই শৈশব। কোনো কিছুর চিন্তা নেই, কাউকে নিয়ে ভাবতে হয় না, ঘুমোতে গেলেই ঘুম চলে আসে। কিন্তু শায়লার অনেক রাত কেটেছে নির্ঘুম। মাথার ভেতর কতশত চিন্তার আনাগোনা হয়। ঘুমোতে চাইলেও ঘুম আসে না।
স্ত্রীকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শায়লার স্বামী আবার বললো,
-শায়লা আমার কথা শুনছো?’
-এ্যা!’ স্বামীর কথায় সম্বিত ফিরে পেল শায়লা।
-বলছি, ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে নাও। সকালেই বেরোতে হবে আমাদের।
-হুমম…’ অস্ফুটে শব্দ করে শায়লা ধীরভাবে হাত চালালো ব্যাগ গুছাতে।
.
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে জামাল দাঁত ব্রাশ করছিল উঠানে পায়চারী করতে করতে। ইয়াসমিন তার জন্য টিউবওয়েল চেপে গোসলের পানি নিচ্ছিল বালতিতে। জামাল ব্রাশ করতে করতে টিউবওয়েলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। স্বামীকে দেখে ইয়াসমিন বললো,
-শায়লা আপুরা একটু আগে চলে গেছে…’
মনটা কিছুটা খারাপ হয়ে গেল জামালের। তবে তা বুঝতে দিলো না স্ত্রীকে। ব্রাশ করা থামিয়ে বললো,
-এতো সকাল সকাল চলে গেল কেন? দুপুরে খেয়েদেয়েই তো যেতে পারতো।
-দুলাভাইয়ের নাকি ক্লাস আছে তাই…
-ওহ…’
নীরবে সরে এলো জামাল। ঘরে এসে যে রুমটাতে শায়লারা থেকেছিল ঐ রুমে ঢুকলো সে। শায়লা এভাবে কিছু না বলে যাবে না। নিশ্চয়ই কিছু লিখে গেছে তার জন্য। বালিশের নিচে একটা সত্যি সত্যি চিরকুট খুঁজে পেল সে। ওখানে শায়লা লিখেছে,
-আগের চাইতে তোমাকে বদলে যেতে দেখে ভালোই লাগছে। পিছুটান, মায়াটান কিছুই নেই তোমার। মন থেকে বলছি, আমি সত্যি খুশি হয়েছি তোমাকে বদলাতে দেখে। আগের মতো এখন আর ভোরে ঘুম ভাঙে না তোমার। যাওয়ার আগে একবার দেখার খুব ইচ্ছে ছিল তোমাকে। কিন্তু আফসোস! দেখতে পারলাম না। ভেতরে গিয়েও যে একবার দেখবো সেই অধিকার তো শুরুতেই হারিয়ে ফেলেছি। আবার কবে দেখা হবে জানি না। ভালো থেকো তুমি…’
চিরকুটটা পরে কিছুক্ষণ থমকে থাকলো জামাল। আসলেই কি সে বদলে গেছে? নাকি বদলে যাওয়ার ভান করছে। জীবনের সাথে খাপ খেয়ে চলতে হলে মাঝেমাঝে বদলে যাওয়ার অভিনয় করতে হয়। বাইরে স্ত্রীর ডাক শুনে চিরকুটটা লুকিয়ে ফেললো জামাল। তারপর গোসল করতে গেল সে।
.
.
বাইরে ঝুমঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বাচ্চারা উঠোনে ভিজে ভিজে আনন্দ করছে। আয়েশা বেগম এসে কয়েকবার নিষেধ করে গেল এদের ঠাণ্ডায় অসুখ লাগবে বলে। কিন্তু এমন বৃষ্টিতে কি আর বাচ্চাদের মন মানে? ভিজতে ভিজতে ওরা দেখলো ও পাড়াতে বেশ কিছু মানুষ জটলা হয়েছে ছাতা মাথায় দিয়ে। কী হয়েছে দেখার জন্য বাচ্চাদের আগ্রহ বেড়ে গেল। সবাই একসাথে চিৎকার করতে করতে দৌড় দিলো ওদিকে কার আগে কে যেতে পারে ওখানে। জটলাতে এসে তারা দেখলো একটা পাগলি বাচ্চা জন্ম দিছে। বাচ্চাটাকে জন্ম দিয়েই পাগলিটা হেঁটে চলে যেতে লাগলো বাচ্চাকে রেখে। একটা লোক বাচ্চাটাকে চাদরে মুড়িয়ে নিলো যাতে ঠাণ্ডা না লাগে। আর বাচ্চাটার মা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একমনে একদিকে হেঁটে চললো। তার অতিক্রান্ত পথটুকু রক্তে ভিজে যাচ্ছে। এসবের কোনো অনুভূতি নেই তার। কারণ সে পাগলি। তাইতো সদ্য জন্ম দেয়া বাচ্চাটাকেও সে ছুঁয়ে দেখেনি। এসবের মায়া টানে না এদের। কেবল পাগলরাই এই মায়াজাল থেকে মুক্ত। ছাতা মাথায় দিয়ে আশরাফ সাহেব পাগলিটার গমনপথে চেয়ে রইলেন। তারপর সবার উদ্দেশ্যে মন্তব্য করলেন,
-মানুষ কত খারাপ দেখছো। একটা পাগলি মেয়েকেও তার কামলীলা থেকে মুক্তি দেয়নি। এই পাগলি মেয়েটা কয়েকবছর ধরে রাস্তায় রাস্তায় এভাবে ঘুরে। হয়তো কোনো একদিন সে মানুষ নামের পশুটার ভোগের শিকার হয়।’
যে লোকটা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েছে, সে বললো,
-আপনারা মুরব্বি যারা আছেন, তাঁরা একটা আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত নেন এই বাচ্চাটাকে কী করা হবে।
-হুমম, তাই করতে হবে…’ বলেই আশরাফ সাহেব নাতিদের লক্ষ করলেন। তাদেরকে ভিজতে দেখে ধমক দিয়ে বাসায় চলে যেতে বললেন। তারা আবারও চিৎকার করতে করতে বাসার দিকে দৌড় দিলো। বাসায় গিয়ে তারা পাগলির বাচ্চা জন্ম দেয়ার খবরটা একজনের আগে আরেকজন বর্ণনা করবে।
.
.
রাতে এশার নামাজ পড়েই মুরব্বিরা মসজিদে আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত নিলেন পাগলির বাচ্চাটার ব্যাপারে। পাগলির বাচ্চা বলে কেউ বাচ্চাটাকে নিতে চায় না। তবে আবুল নামের একজনের একটা মেয়ে থাকলেও তার কোনো ছেলে নেই। মুরব্বিরা সিদ্ধান্ত নিলো আবুল এই বাচ্চাটাকে লালনপালন করবে। আর মাসে মাসে পাড়ার সবাই মিলে চাঁদা তুলে আবুলের হাতে দিবে বাচ্চাটার জন্য। চাঁদার কথা শুনে আবুলও রাজি হয় বাচ্চাটা নিতে।
বাচ্চাটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আশরাফ সাহেব ঘরে ফিরলেন। ঘরে ফিরে দেখলেন তার বড় ছেলে আমান ছোট ছেলে রায়হানকে মারছে। আশরাফ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
-কী হয়ছে, ওকে এভাবে মারছো কেন?’
আমান বললো,
-বাবা ও কী করেছে জানো?
-কী করেছে?
-ও ইয়াসমিনের খালাতো বোন ফারিয়াকে নাকি ভালোবাসে। ফারিয়ার একবার বিয়ে হয়েছে। একটা বিধবা মেয়েকে নিয়ে সে পুকুরপাড়ে বসে কীসব করছিল, আমি দেখেছি।’
আশরাফ সাহেব রায়হানের সামনে দাঁড়ালেন। ঘটনার সত্যতা জিজ্ঞেস করলেন। রায়হান কোনো উত্তর দিলো না। চুপ করে রইলো। তখন আশরাফ সাহেব জোরে একটা চড় বসালেন তার গালে।
.
.
(চলবে….)
.
.
(ব্যস্ততার কারণে আজ একটু ছোট হয়ে গেল…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here