__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-১০____________
পরদিন স্কুলে যায়নি ওরা কেউ। স্কুল বন্ধ বলে নয় কিন্তু, বাড়ির প্রায় অর্ধেক মানুষ বাড়িতে নেই বলে ওরা স্কুলে যায়নি। এ যেন মানসিক নিয়ম। বিশেষ করে বাবা মা বাসা থেকে কোথাও গেলে বা বেড়াতে গেলে আর স্কুলে যেতে মন চাই না।
বাড়ির আঙ্গিনায় বসে ইয়াসমিনের মাথায় তেল লাগিয়ে দিচ্ছিলো মনি আর বীথি। তেল লাগানোর পর চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দিচ্ছিলো। কিছুটা দূরে বসে রাজ গাছের ডাল দিয়ে হান্টার বানাচ্ছিলো, গভীর মনোযোগ দিয়ে সে তার কাজ করছে। ইয়াসমিনের মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে মনি রাজকে নিয়ে মন্তব্য করলো,
-একজন নাকি পাখি শিকার করবে, হান্টার বানাচ্ছে। যে এখনও সামনের জিনিস শিকার করতে পারে না, সে শিকার করবে আবার পাখি।’
রাজ কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চুপচাপ তার কাজ করতে লাগলো। মনি আবার বলে উঠলো,
-বোবা মনে হয়। কিছু বলতে জানে না।’
রাজ এবার উঠে এসে ইয়াসমিনের উদ্দেশ্যে বললো,
-মেজো মা, ও কিন্তু আমার মার খাবে। আমি কোনো কথা বলি না ওর সাথে। ও আমাকে খোঁচায় কেন?’
মেজো মা কিছু বলার আগেই মনি বললো,
-আয়, মারতে আয়, কেমন পারিস দেখি।
-আহ! থাম তো তোরা। মনি চুপ থাক। রাজ তুই তোর কাজ কর, যা।’ ইয়াসমিন দুজনকে থামতে বললো। রাজ হাতের হান্টারটা তুলে মনির দিকে তাকিয়ে বললো,
-আরেকবার আমাকে নিয়ে কিছু বললে হান্টার দিয়ে তোর চোখ গেলে দিবো প্রথমে।’
মনি হেসে বললো,
-দে। আমার চোখ লাগবে না। ঐদিন তুই কী করেছিস সব বলে দিবো।’
-বলে দে গা…’ বলেই চলে গেল রাজ। মনির মুখের ভাবটা পরিবর্তন হয়ে গেল। সে এভাবে রাজের সাথে আবার ভাব করার চেষ্টা করে। কিন্তু পঁচা ছেলেটা, শয়তান ছেলেটা বোঝে না। রাগ হয় মনির।
.
.
বিকেলের সূর্যটা রক্তিম আভা ধারণ করেছে। সূর্যের রক্তিম আভায় খালের পানিগুলোকেও লাল দেখাচ্ছে। খালের ধারে বসে রাজ তাকিয়ে আছে কিছুটা সামনে, একজন জাল ফেলে মাছ ধরছে। রাজ গলার আওয়াজ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-আবুল চাচা, মাছ কেমন পড়ছে?
-আর মাছ? মাছগুলো জালে ধরা দিবার চাই না।’ একটু থেমে আবার বললো,
-তয় পাইছি কিছু। ঝোল কম দিয়া রাঁধতে কমু তোর চাচিকে।’
রাজ উঠে এগিয়ে গেল ওখানে। আবুলের পালক ছেলেটা ছোট একটা বালতিতে মাছগুলো ধরে আছে। এই সেই পাগলির ছেলে, যাকে সবার সম্মতিতে আবুলের বাসায় রাখা হয়েছিল। তবে আবুল এখন ছেলেটার জন্য গ্রামবাসীর কাছে চাঁদা নেয় না। চাঁদা দিতে চাইলে সে বলে,
-আমার আর চাঁদা লাগবো না। পোলাডার উপর মায়া জইন্মা গেছে। নিজে যা খামু, পোলাডারেও তাই খাওয়ামু। এও আমার পোলা, আমি ওর বাপ।’
তবে মাঝেমাঝে ছেলেটাকেও পাগলামি করতে দেখা যায়। রাত হলে কোথায় যেন হারিয়ে যায় সে। তারপর অনেক খোঁজার পর পাওয়া যায়। সবাই বলে ছেলেটার উপর মায়ের জিন ভর করেছে। তাই সেও মায়ের মতো পাগলামি করে মাঝেমাঝে। এইতো পরশু রাতেও হঠাৎ কোথায় যেন চলে যায় সে। আবুল পাগল হয়ে যায় ছেলেটাকে না পেয়ে। টর্চলাইট নিয়ে বের হয় সে, সাথে আরও কয়েকজন। অনেক খোঁজার পর ছেলেটাকে একটা বটগাছের নিচে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায়। গাছটার নিচে তার মাও প্রায় রাতে ঘুমাতো। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, ছেলেটা তার মা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না, কখনও দেখাও হয়নি মায়ের সাথে। শুধু এতটুকুই জানে তার মা ছিল একটা পাগলি। তাহলে ছেলেটা কী করে তার মা যেখানে ঘুমাতো, যেখানে ওকে জন্ম দিয়েছিল, যেখানে যেখানে ওর মা যেতো, ওখানে সেও যায়? ঐ যে সেদিন ছেলেটাকে জন্ম দিয়েই পাগলিটা চলে গিয়েছিল, তারপর থেকে কোথাও আর পাগলিটাকে দেখা যায়নি।
রাজ আবুলের পালক ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো,
-কী রে মন্টু, মাছ কেমন পাইছে দেখি।’
বলেই বালতিতে হাত লাগাতে চাইলে মন্টু বালতি সরিয়ে ফেলে। রাজ ক্ষীণ ধমক দিয়ে বলে,
-ঐ দেখি… তোর মাছ নিয়ে নেবো না।’
মন্টু এবার বাবার দিকে তাকায়। আবুল ছেলেকে বলে,
-দেখা বাপ।’
বাবার কথা শোনার পরেই মন্টু মাছ দেখতে দিলো রাজকে। কিছুক্ষণ বালতির মাছগুলো দেখে রাজ বললো,
-ভালোই তো পাইছো চাচা। কিছু বিক্রিও করতে পারবা।’
রাজের কথা শেষ হতেই মন্টু বাবাকে বললো,
-বাবা, ওখানে জাল ফেলো। বড় মাছ পাবা।’
ছেলের কথায় জাল ফেললো আবুল। দেখা গেলো সত্যি সত্যি বড় দুইটা মাছ ধরা পড়লো জালে। কিন্তু মন্টু কী করে জানলো ওখানে জাল ফেললে বড় মাছ পাওয়া যাবে? মাছগুলোকে তো ভাসতেও দেখা যায়নি। অবাক হলো রাজ। তবে অবাক হয়নি আবুল। হয়তো সে মন্টুর এরকম আরও অনেক আচরণ দেখেছে।
.
.
♥দশ♥
রাতে হাসপাতাল থেকে খবর এলো শায়লার অবস্থা আরও বেশি খারাপ হয়ে পড়েছে। তাই যারা এখান থেকে ওকে দেখতে গিয়েছে, তারা আসতে পারবে না। কিন্তু শায়লা সবাইকে দেখতে চেয়েছে। তাই আশরাফ সাহেব জামালকে বললেন, ওরাও যেন হাসপাতালে শায়লাকে দেখতে যায়। ওর বাঁচার আশা তেমন নেই।
তাই পরদিন ভোর হতেই জামাল সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। হঠাৎ শায়লা এভাবে মৃত্যুমুখী হয়ে পড়বে বুঝতে পারেনি জামাল। বড় চাপা স্বভাবের মেয়েটা। সবকিছু চেপে যেতে পারে। তাই অসুখের শুরুর দিকেও কাউকে জানতে দেয়নি। শেষ মুহূর্তে এসে ওরা জানতে পারে, ওর বাঁচার আশা ক্ষীণ।
একটা মেয়ে কীভাবে এত কষ্ট বুকে আগলে রাখতে পারে?
ট্যাক্সি দ্রুত ছুটে চলেছে। একমনে জামাল সামনে তাকিয়ে আছে ড্রাইভারের পাশে। এই মুহূর্তে সে এখানে বসে থাকলেও তার মনটা ছুটে গেছে সুদূর অতীতে। অতীতের স্মৃতিগুলোর ফাঁকে জামাল শায়লাকে খুঁজতে লাগলো। ছোট থাকতে খুব মায়াবী ছিল সে। ওর মায়াবী চেহারার আবদারগুলো কখনও ফেলতে পারতো না জামাল। একবার সন্ধ্যের দিকে শায়লা আর জামাল কাগজের নৌকা বানিয়ে খালের পানিতে ভাসিয়েছিল। কিন্ত একটু করে ভেসেই শায়লার নৌকাটা উল্টে যায়। শায়লা তখন ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে চোখ মুছতে মুছতে। জামাল বলে,
-শায়লা, আমি তোমাকে আরেকটা নৌকা বানিয়ে দেবো।
-না, না, আমার ঐ নৌকাটাই তুমি ঠিক করে দাও।’ আবাদার করে শায়লা। ওর মায়াবী চেহারাটার দিকে তাকিয়ে আর আবদার ফেলতে পারে না জামাল। প্রচণ্ড শীত, তবুও নেমে যায় সে ঠাণ্ডা পানিতে। শায়লার নৌকাটা যখন ঠিক করে আবার ভাসিয়ে দিতে যায়, তখন একটা লেখাতে চোখ আটকে যায় তার। কাগজের নৌকায় শায়লা তার কাঁপা কাঁপা হাতে লিখেছিল,
-আমি আমার জামাল ভাইয়াকে খুব ভালোবাসি।’
একবার শায়লার দিকে তাকায় জামাল। শায়লা তখন খুশিতে হাততালি দিতে থাকে। জামালও ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে ভাসিয়ে দেয় নৌকাটা। শায়লার খুশি দেখে প্রচণ্ড শীতের কথা ভুলে যায় সে নিমিষেই।
.
.
গাড়ির ‘ভ ভ’ শব্দে জামালের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। গাড়ি কতদূর ছুটে এসেছে সেদিকেও তার খেয়াল নেই। সে ভাবতে থাকে শায়লার কথা। প্রথম যেদিন ওদের সম্পর্ক হয়, শায়লা সেদিন একটা নীল শাড়ি পরেছিল। জামাল কোথা থেকে যেন কিছু বেলি ফুল এনে শায়লার খোপায় গুঁজে দিয়ে বলে,
-এখন আরও সুন্দর লাগছে তোমাকে।’
শায়লা মৃদু হাসে। খুশি হয় সে। জামাল আবার বলে,
-তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে, আমার কাছ থেকে কখনও দূরে যেও না শায়লা।’
-কিন্তু আমার বিয়ে হয়ে গেলে তো দূরে চলে যেতেই হবে।’ ভ্রু নাড়িয়ে বললো শায়লা। জামালকে কিছুটা চিন্তিত দেখালো। কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করে জামাল বললো,
-আমিই বিয়ে করবো তোমাকে, কোথাও যেতে দেবো না। আমার বউ হবা তুমি?’ বলেই শায়লার হাত ধরলো জামাল। নরম তুলতুলে হাত। স্পর্শেই বুকে কাঁপন ধরায় জামালের। তার কথা শুনে শায়লা কিছুই বলতে পারে না লজ্জায়। মুখটা ঘুরিয়ে নেয়। তার লজ্জামাখা চেহারাটা সেদিনে ক্ষণিকের জন্য চোখে পড়ে জামালের। ঐ চেহারাটা সেদিন যে দেখতো, নিশ্চিত প্রেমে পড়ে যেতো সে শায়লার। জামালও পারেনি তার প্রেমকে আর রুখতে। শায়লা তার হাতটা ছাড়িয়ে মুখটা নিচু করে চোখ তুলে তাকায় জামালের দিকে। তারপর মৃদু হেসে মাথা নাড়ে। আরও বেশি পাগল হয়ে যায় তখন জামাল। কপালের পাশ থেকে চুলগুলো সরিয়ে চলে যেতে থাকে শায়লা। জামাল বুকের বাম পাশে হাত দিয়ে ভাবে, জীবনটা যদি এখানেই থেমে যেতো!
কিন্তু জীবন থামেনি। গতিময় জীবন পাড়ি দিতে দিতে আজ শায়লা শেষ মুহূর্তে চলে এসেছে। হয়তো তার জীবনে সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই।
.
.
ট্যাক্সি এসে থামলো হাসপাতাল চত্বরে। জামাল সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। এতজন সবাই একসাথে রোগী দেখার নিয়ম নেই হাসপাতালে। তাই প্রথমে জামাল ইয়াসমিনকে পাঠালো বীথি আর মনিসহ। রাজ আর ছেলেকে নিয়ে সে বাইরে করিডোরে বসলো বাবার পাশে। আশরাফ সাহেবসহ তখন সবাই চিন্তিত শায়লার জন্য। জামাল অনেক সংশয় নিয়ে প্রশ্ন করলো,
-ওর অবস্থা এখন কেমন?’
আশারাফ সাহেব জবাব দিলেন,
-বাঁচবে না মেয়েটা। আল্লাহ যদি একটু মুখ তুলে তাকায় তাহলে বাঁচতে পারে। হঠাৎ হঠাৎ সবকিছু ভুলে যায়, কাউকে চিনতে পারে না। কথাও ঠিকমতো বলতে পারে না।’
আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না জামাল। এতটুকু শুনেই চোখের কোণা ভিজে উঠেছে তার। আড়ালে চোখের কোণা মুছে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। কিছুক্ষণ পর ইয়াসমিন বেরিয়ে এলো বীথি ও মনিকে নিয়ে। ওদের মুখও মলিন হয়ে আছে। জামালের পাশে বসতে বসতে ইয়াসমিন ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
-দেখে আসেন। আমার খুব খারাপ লাগছে দেখে। কী মানুষ কী হয়ে গেল!’
ছেলেকে ইয়াসমিনের হাতে দিয়ে নীরবে উঠে দাঁড়ালো জামাল। ধীরপায়ে হাঁটতে লাগলো শায়লার কেবিনের দিকে। পেছন পেছন রাজও যেতে লাগলো। জামাল যখন কেবিনের দরজা খুললো, চোখে পড়লো শায়লাকে। পাশে বসে আছে তার স্বামী। জামাল ঢুকতেই শায়লার স্বামীটা উঠে দাঁড়ালো। শায়লাও মুখ ঘুরিয়ে তাকালো। মাথায় চুল নেই তার। খুব শুকিয়ে গেছে সে। জামালকে দেখেই টপটপ করে অশ্রু পড়তে লাগলো ওর চোখ বেয়ে। ওর স্বামী বললো,
-এই প্রথম ও নিজ থেকে ঘাড় ফেরালো। হাসাপাতালে আনার পর থেকে যেদিকে ওকে ফিরানো হতো, শুধু ওদিকেই চেয়ে থাকতো। কিন্তু এখন আপনার গন্ধ পেতেই ও নিজ থেকে কিছু করলো।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শায়লার পাশে বসলো জামাল। শায়লা চেয়ে আছে ওর দিকে। চোখ বেয়ে অবিরত জল গড়িয়ে ওর সারা দেহ ভিজিয়ে দিচ্ছে। জামাল নিজের কান্না চেপে ওর চোখ মুছতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। আরও বেশি অশ্রু ঝরতে থাকে ওর চোখ বেয়ে। জামাল হাতে কয়েকটা আঙুর নিয়ে ওর মুখের সামনে ধরলো। শায়লার স্বামী তখন বললো,
-ও কিছু খেতে পারে না। খাই না কিছু।’
কিন্তু স্বামীকে অবাক করে দিয়ে শায়লা হা করলো। জামাল একটা আঙুর ওর মুখে দিলো। খেতে খেতে ও লী যেন বিড়বিড় করলো। জামাল কান নিয়ে গেল ওর মুখের পাশে। আবারও বিড়বিড় করলো শায়লা। অস্পষ্ট হলেও জামাল বুঝতে পেরেছে কথাটা। ও জিজ্ঞেস করেছে,
-কেমন আছো?’
জামাল আর চোখের জল রুখতে পারেনি প্রশ্নটা শুনে। ওর চোখ বেয়েও কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মিশে গেল শায়লার অশ্রুর সাথে। কোনো জবাব দিতে পারে না সে। শায়লার স্বামী কিছু বোঝার আগেই নিজের অশ্রু মুছে ফেললো জামাল। তারপর শায়লার চেহারার দিকে তাকায় সে। চুল নেই, তবুও এখনও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী বলে মনে হলো তাকে। তবে আফসোস হচ্ছে, যে চুলে আদর করে সে ফুল গুঁজিয়ে দিতো, সেই চুলগুলো নেই তার মাথায়। যে ঠোঁটের লজ্জামাখা হাসি দেখে সে পাগল হতো, ঐ হাসিটুকুও অনেক খোঁজার চেষ্টা করে জামাল। কিন্তু ব্যর্থ হয়। ঐ হাসির জায়গায় ঠোঁটদুটো চাপা কান্নায় কাঁপছে। জামাল হঠাৎ খেয়াল করে তার ডানহাতটা ধরে আছে শায়লা। কোন ফাকে সে তার হাত ধরেছে তা জামাল বুঝতে পারেনি। শক্ত করে ধরে আছে শায়লা। হয়তো ছাড়তে চায় না। জামাল বুঝতে পারে না এ অবস্থায়ও এত শক্তি কোথায় পেল সে? আবারও বিড়বিড় করলো শায়লা। মুখটা ওর কানের কাছে নিয়ে গিয়ে কথাটা শুনে জামাল। বিড়বিড় করে শায়লা বলছে,
-ভালো থেকো…’
এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। তবুও হাতটা ছাড়েনি সে জামালের।
.
.
সেদিন রাতেই মৃত্যু হয় শায়লার। মরার আগে সে স্বামীর কোলে মাথা রেখেছিল। নিজের ছেলেটাকে ধরে কেঁদেছিল। হয়তো সবকিছুর মায়া ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছিল তার। একে একে কতকিছুই তো তাকে ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু মায়া জিনিসটা মৃত্যুর সময়ও তার পিছু ছাড়লো না। নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার আগমুহূর্তে সে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু ঝরালো। তারপর ছেলের হাতটা ছাড়তে ছাড়তে চোখ বুজলো ধীরে ধীরে।
.
.
শায়লার ইচ্ছে ছিল মৃত্যুর পর তার কবরটা যেন মা বাবার কবরের পাশেই হয়। তাই শায়লার লাশটা আশরাফ সাহেবদের এলাকায় নিয়ে আসা হয়। যখন খাঁটিয়ায় তুলে ওর লাশটাকে জানাজা পড়াতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, পেছনে মানুষের ঢল নেমেছিল। খাঁটিয়ার সামনের দিকটা ধরেছিল শায়লার স্বামী এবং জামাল। দুজনের মনের অবস্থা হয়তো একই। দুজনই ভালোবাসে শায়লাকে। কখনও ভাবেনি ওরা, এভাবে ভালোবাসার মানুষটার লাশ কাঁধে বইতে হবে। আচ্ছা, সব লাশের ওজন কি এতো ভারি হয়? নাকি শায়লার লাশটাই শুধু এত ভারি মনে হচ্ছে। সহ্য করতে পারছে না জামাল।
জানাজা পরার আগে জামাল শেষবারের মতো আরেকবার দেখে নেয় শায়ালার চেহারাটা। এই চেহারাটা আর কখনও দেখা হবে না। জানাজার পরেই চিরদিনের জন্য মাটির কবরে চলে যাবে। এই দেহটার সাথে কত হাসি-খুশি, কষ্টের স্মৃতি মিশে আছে, একটু পরেই দেহটা মিশে যাবে মাটির সাথে। ভাবতেই কষ্ট হয় জামালের। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অজান্তে।
জানাজার জন্য সামনের সারিতে দাঁড়ায় জামাল। প্রচুর মানুষ হয় ওর জানাজায়। হয়তো ভালো মানুষগুলোর বিদায় বেলায় এভাবেই সমাগম ঘটে তাদের। একটু পর জানাজার নামাজ শুরু হলো। নিজের বউয়ের জানাজা নিজেই পড়ালো শায়লার স্বামী। এও কি কম কষ্টের? বিধাতা হয়তো জানতো নিজের বউয়ের জানাজা পড়াতে হবে তাকে, তাই হয়তো ইসলামিক এলেম দিয়েছিল তাকে।
জানাজার পর শায়লার লাশটা কবরে দেয়া হয়। নিজহাতে ওর লাশটা কবরে নামায় শায়লার স্বামী এবং জামাল। তারপর সবাই মিলে মাটিচাপা দিতে থাকে। বাবা মার কবরের পাশে আরেকটা কবর হয় শায়লার। কবর দেয়া হয়ে গেলে কবরের চারপাশে বেড়া দেয়া হয়। তারপর একসাথে সবাই মোনাজাত করে দোয়া করে ওর বিদেহী আত্মার জন্য।
.
.
শায়লার চেহারাটা কিছুতেই সরাতে পারছে না জামাল চোখ থেকে। জানাজা পড়ে আসার পর থেকে সেই যে রুমে এসে শুয়েছে, ক্ষণিকের জন্যও বের হয়নি। শুধু শায়লার চেহারাটা ভাসে চোখের সামনে। ইয়াসমিন এসে স্বামীকে খেতে ডাকলো কয়েকবার। কিন্তু খাওয়ার রুচি যেন সব শেষ হয়ে গেছে তার। আবারও এলো ইয়াসমিন। স্বামীর পাশে বসে ম্লান কণ্ঠে বললো,
-আমি জানি তোমার মনের অবস্থা। ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু সবাই সহ্য করতে পারে না।’
স্ত্রীর কথা শুনে চমকে উঠে জামাল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-তুমি জানো আমি শায়লাকে ভালোবাসতাম?’
চোখ টিপে ইয়াসমিন বলে,
-হ্যাঁ, আমি সব জানতাম। শুরু থেকেই সব জানি আমি। শুধু তোমাকে বুঝতে দিইনি, যাতে তুমি নিজেকে আমার কাছে ছোট না ভাবো। আমাদের সংসারে যাতে কলহ না হয়।’
জড়িয়ে ধরে জামাল স্ত্রীকে। তারপর চোখের পানি ছেড়ে দেয়। ইয়াসমিন হাত বুলাতে থাকে স্বামীর পিঠে।
.
.
(চলবে….)