জীবনের গল্প পর্ব:-০৯

0
347

__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-০৯____________
♥নয়♥__________জীবনের গল্প__________ড়ির সামনের মেহেদি গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে মনি পাতাগুলোর উপর আলতো করে হাত বুলাচ্ছিল। আর কী যেন ভেবে নিজে নিজেই মৃদু হাসছিল। কিছুটা দূরে খাঁচার উপর বসে সম্রাট তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে মনি ডাকলো,
-এই সম্রাট, এদিকে আয়…’
খাঁচার উপর থেকে উড়ে এসে সম্রাট বসলো মনির কাঁধের উপর। মনি তাকে আদর করে জিজ্ঞেস করলো,
-রাজ কোথায় জানিস?’
-জানি…
-তুই একটু ওর কাছে গিয়ে ওর স্পর্শ নিয়ে আসতে পারবি?’
সম্রাট উড়ে যেতে লাগলো, পেছন থেকে মনি আবার বললো,
-শুন সম্রাট, ওর কাছ থেকে সোজা আমার কাছে আসিস, আর কেউ ডাকলে যাস না।’
সম্রাট চলে যেতেই মনি আবার মেহেদি পাতায় হাত বুলাতে লাগলো। রাজের কথা ভাবছে সে। ওর সাথে কথা বলে না ঠিকই, কিন্তু ওকে ছাড়া একটুও ভালো লাগে না তার। আরে সে না হয় একটু অভিমান করে কথা বলে না রাজের সাথে, কিন্তু রাজ কি পারে না সামনে এসে একটু কথা বলে রাগ ভাঙ্গাতে? পঁচা ছেলে একটা, শয়তান ছেলে। দোষও করবে, আবার রাগও ভাঙ্গাবে না।
-কী রে, একা একা কী ভাবছিস?’
বীথির কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো মনি। নিজেকে সামলিয়ে বললো,
-কিছু না…
-কিছু তো হ্যাঁ… নয়তো পাগলের মতো একা একা হাসছিস কেন?
-আরে কিছু না। বাদ দে তো।
-প্রেমে পড়েছিস নিশ্চয়ই?
-আরে ধুর…
-শুন না, আজ আমি না একটা চিঠি পেয়েছি।’ মনির গা ঘেষে আওয়াজটা ছোট করে বললো বীথি।
-কী বলিস?
-হ্যাঁ। রাজ ভাইয়াদের ক্লাসের একটা ছেলে, হঠাৎ করে এসে আমার বইয়ের ভেতর চিঠিটা দিয়ে পালিয়ে যায়। ওর অবস্থা দেখে আমি হাসতে হাসতে শেষ।
-তোর প্রেমিক দেখি ভীতু একটা…
-ধুর ও আমার প্রেমিক হতে যাবে কেন? আমার ভালো লাগে আকাশকে।
-ঐ লম্বা, চিকনা ছেলেটা?
-খবরদার চিকনা বলবি না। ও কত কিউট তুই জানিস? আমি যখন স্কুলে যায় ও তখন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমিও লুকিয়ে লুকিয়ে তাকায় ওর দিকে।
-এহ! ওকে আমার একদম ভালো লাগে না। সিগারেট খাই ছেলেটা। ওর সাথে মেশার আগে খোঁজ খবর নিস ওর ব্যাপারে।
-আচ্ছা নেবো খোঁজখবর। এখন চিঠিটা পড়…’ বলেই একটা চিঠি খুললো। ওখানে বড় বড় বাঁকা অক্ষরে লেখা আছে,
প্রিয় বিতি,
আমি অনেক বেবে তোমাকে চিটি দিচি। আমি তোমাকে বালোবাসি বিতি। পিলিচ আমাকে পিরিয়ে দিও না তুমি। আমি তোমাকে কুব বালোবাসবো। তোমাকে কস্ট দেবো না। জানো তোমার কতা বাবলে আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। শুদু তোমার মুখটা মনে পড়ে। তুমি চিটিটা পড়ে আমার উত্তর দিও। আমি কাল স্কুলের টয়লেটের পেচনে অপক্কা করব তোমার উত্তরের জন্য। আজ রাখি। তুমি বালো থেকো কেমন?
ইতি
তোমার কুব চেনা একজন
চিঠিটা পড়ে হাসতে লাগলো বীথি ও মনি। হাসতে হাসতে বীথি বললো,
-সব বানান ভুল, ও আবার আমাকে চিঠি লিখে। দেখ আমার নামের বানানটাও ভুল লিখছে।’ বলেই হাসির বেগ বাড়িয়ে দিলো বীথি। মনিও হাসতে হাসতে বললো,
-ওটার চেয়ে বেশি মজা পাইছি ও তোর উত্তরের জন্য টয়লেটের পেছনে অপেক্ষা করবে এটা পড়ে।’
দুজনের হাসি যেন রুখতে চাই না আর। একজনের উপর আরেকজন পড়তে লাগলো হাসতে হাসতে। মনি আবার বললো,
-আজ রাতে সুন্দর একটা চিঠি লিখে কাল ওকে টয়লেটের পেছনে গিয়ে দিয়ে আসবি।
-আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই। তুই যাস ওর চিঠির উত্তর নিয়ে।’
-তোর মজনুর প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। তোরটা তুই রাখ।’ হাসি কন্ট্রোল করতে করতে বললো মনি।
-ওকে কালকে সারাদিন টয়লেটের পেছনে অপেক্ষা করাবো।’ বলেই বীথি খেয়াল করলো কোথা থেকে যেন সম্রাট উড়ে আসছে। সম্রাটকে দেখেই বীথি বললো,
-আয় সম্রাট, আয়…’ বলেই সম্রাটকে ধরতে গেল বীথি, মনি তাকে ধাক্কা দিয়ে সম্রাটকে হাতে নিলো। ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল বীথি। হা করে তাকিয়ে আছে সে মনির দিকে। মনি সম্রাটকে দুহাতে ধরে বুকের সাথে লাগালো, তারপর চোখ বন্ধ করে সম্রাটের ঘ্রাণ নিলো নাক দিয়ে।
আহহহ! সম্রাটের দেহে রাজের গন্ধ লেগে আছে। মনি চাইনি বীথির স্পর্শে সেই গন্ধটুকু কর্পূরের মতো উড়ে যাক। তাই সে এভাবে ধাক্কা দিয়েছে বীথিকে। বীথি উঠে এলো মনির সামনে। চোখ বড় বড় করে সে দেখতে লাগলো মনির কার্যকলাপ। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
-পাগল-তাগল হয়ে যাসনি তো বোন?
-এখন তো পাগল হওয়ার সময়…’ বলেই সম্রাটের দেহে রাজের ঘ্রাণ নিতে নিতে চলে গেল মনি।
.
.
আশরাফ সাহেব সবেমাত্র দুপুরের খাবার খেয়ে বসলেন বাড়ির ড্রয়িংরুমে। একটা সাদা-নীল লুঙ্গির সাথে একটা সাদা গেঞ্জি পরে আছেন তিনি। কাঁধের উপর একটা লাল গামছা পেঁচিয়ে চেয়ারে এক পা তুলে বসেছেন তিনি। হাতে একটা মোবাইল ফোন। নতুন জিনিস, কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তিনি জানেন না। শুধু ফোন আসলে রিসিভ করতে পারেন, আর কাউকে ফোন করতে চাইলে ডায়াল নাম্বারে গিয়ে ফোন করেন। চেয়ারে বসে এই মুহূর্তেও তিনি মোবাইলের বোতাম টিপে ডায়াল নাম্বারে গিয়ে কার যেন নাম্বার খুঁজছিলেন, তখন মোবাইলটা বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করলেন তিনি। ওপাশ থেকে শায়লার স্বামী সালাম দিয়ে বললো,
-মামা, শায়লার অবস্থা খারাপ। ওকে গতরাতে হাসপাতালে ভর্তি করেছি।
-কী হয়েছে ওর?’ আশরাফ সাহেব উত্তেজিত হয়ে বললেন।
-ব্রেন টিউমার। আপনাদের সবাইকে একবার দেখতে চাই সে। সময় থাকলে একটু দেখে যাবেন।’ গলা কেঁপে উঠতে শোনা গেল শায়লার স্বামীর। আশরাফ সাহেবের শরীরেও কাঁপুনি ধরে গেল খবরটা শুনে। কী বলবেন বুঝতে পারলেন না তিনি। শুধু মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারলেন,
-আসবো আমরা…’
ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিলো শায়লার স্বামী। আশরাফ সাহেব মোবাইল ফোনটা কোলের উপর রেখে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তিত হয়ে বসে থাকলেন। ঘেমে গেছেন তিনি। কী করবেন বুঝতে পারলেন না। স্ত্রীর নাম ধরে ডাকলেন,
-পদ্ম…’
রান্নাঘর থেকে এলেন পদ্মাবতী।
-ডেকেছেন কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন স্বামীকে।
-শায়লা হাসপাতালে। ব্রেন টিউমার ওর। এই মাত্র খবর দিলো ওর স্বামী।’
খবরটা শুনেই কেঁদে ফেললেন পদ্মাবতী। শায়লাকে পেটে না ধরলেও মেয়ের মতো করে বড় করেছেন তিনি। মেয়ের এতবড় অসুখ শুনে মায়ের মন কি না কেঁদে থাকতে পারে?
শাশুড়িকে কাঁদতে শুনে দুই ছেলের বউ এসে তাঁর পাশে দাঁড়ালো। তারাও জানলো খবরটা। মুখটা কালো হয়ে গেল তাদের। আশরাফ সাহেব বললেন,
-শায়লা সবাইকে দেখতে চাইছে, সবাই তো একসাথে এভাবে যেতে পারবো না। তোমরা কে কে যাবে এখন রেডি হয়ে আসো। আমি আরেকটু খোঁজখবর নিই ওদের।’
.
.
বিকেলের দিকে ওরা বের হলো। আশরাফ সাহেব, পদ্মাবতীর সাথে বড় ছেলে আমান আর ছেলের বউ আয়েশা বেগমও চললো। শেষ মুহূর্তে এসে মনির মাও বের হলো। মাকে যেতে দেখে মনিও বায়না ধরলো যাওয়ার জন্য। কিন্তু তাকে সাথে নিলো না মা। সে গেলে বীথিও যেতে চাইবে। এতগুলো মানুষ নিয়ে হাসপাতালে রোগী দেখতে যাওয়া ঠিক হবে না। পরে না হয় এরা গিয়ে একবার দেখে আসবে।
ওরা চলে যেতেই বাড়িটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেল। সন্ধ্যার দিকে রাজ বাইরে থেকে ঘরে ফিরে ‘মা মা’ বলে চিল্লালো। এখনও কিছুই জানে না সে এসবের। মা, দাদা, দাদি কাউকে দেখতে না পেয়ে সে অবাক হলো। বীথিকে জিজ্ঞেস করলো,
-মা কোথায় গেছে রে?’
বীথি কিছু বলার আগেই মনে বললো,
-সারাদিন বাইরে থাকলে কি ঘরের খবর জানবে কেউ?’
রাজ মেজাজ দেখিয়ে বললো,
-তোকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি আমি। তুই আমার সাথে কথা বলিস না, আমার কথায় নাক ঢুকাস কেন?’
-বয়ে গেছে আমার কারও কথায় নাক ঢুকাতে।’ নাক ছিটকে উঠে চলে গেল মনি। তারপর বীথি সব খুলে বললো রাজকে।

.
.
শায়লার অসুখের খবরটা ইয়াসমিন ফোন করে জানিয়েছে জামালকে। জামাল তখন বাইরে ছিল। ইয়াসমিন যত সহজভাবে খবরটা জানিয়েছিল, জামাল তত সহজে নিতে পারেনি তখন খবরটা। হাত থেকে ফোন পড়ে গিয়েছিল তার। খোলা আকাশের নিচে, রাস্তার উপর, এতগুলো মানুষের সামনে তার চোখ বাধা মানেনি, চোখের কোণা বেয়ে অশ্র বেরিয়ে এসেছিল। জোরে কাঁদতে না পেরে ভেতরটা ফেটে আসছিল তার। এক এক করে শায়লার সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভাসতে লাগলো তার। রাতে যখন ঘরে ফিরেছে সে, তখনও চোখ দুটো তার ভেজা ছিল। ঘরের বাইরে ইচ্ছে মতো কেঁদে চোখ দুটো মুছে তারপর ভেতরে ঢুকেছে সে। স্বামীর এমন মলিন চেহারা দেখে ইয়াসমিন আর কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। শুধু নরম স্বরে একবার খেতে ডাকলো। কিন্তু জামাল খিদে নেই বলে শুতে চলে গেল। ইয়াসমিনও আর জোর করলো না। নিজের চার বছরের ছেলেটাকে খেতে দিলো বীথি ও মনির সাথে। ওদেরকে খেতে দিয়ে ইয়াসমিন বললো,
-রাজকেও খেতে ডাক… ও কোথায়?’
-দাঁড়াও, আমি ডাকছি….’ বলেই অর্ধেক খাওয়া রেখে হাত না ধুয়ে রাজকে ডাকতে গেল মনি। রাজ তখন পড়ার রুমে বসে কী যেন করছিল। মনি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কোনো কিছু সম্বোধন না করে বাতাসকে বলার মতো করে বললো,
-খেতে ডাকছে…’
রাজ ফিরে তাকালো না। কোনো উত্তরও দিলো না। একটু অপেক্ষা করে মনি আবার বললো,
-কেউ একজনকে খেতে ডাকছে, সে যেন খেতে আসে।’
রাজ এবার বললো,
-কারও না ডাকলেও চলবে আমাকে। আমি এমনিতেই খেতে আসবো।’
-হুহ!’ নাক ছিটকে চলে গেল মনি। রাজও উঠে দাঁড়ালো খেতে যাওয়ার জন্য।
.
.
(চলবে…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here