জীবনের গল্প পর্ব-২৮

0
311

__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-২৮___________
বীথিকে একা ফিরতে দেখে আয়েশা বেগম জিজ্ঞেস করলো,
-কীরে মা, তোর ভাইয়া কই?’
-ভাইয়া কোথায় যেন কাজ আছে বলে গেল, আমাকে কিছু জানায়নি।
-তো কেমন দেখলি তোর ছোট বেলার বান্ধবীকে? অনেক বড় হয়ে গেছে, না?
-আমি কি বড় হয়নি মা?
-রিতার তো বিয়ে হয়ে গেছে। তোর বাবা বলছে এখন তোরও বিয়ে দেবে। ভালো কোনো পাত্রের সন্ধান করছে তোর বাবা।
-আমি বিয়ে করবো না এখন। তোমরা ওসব নিয়ে বেকার চিন্তা করো না মা…’ বলেই নিজের রুমে যাচ্ছিল বীথি। বাধা দিয়ে মা বললো,
-এই দাঁড়া না, রিতা কেমন আছে বল? ওকে সাথে নিয়ে আসিসনি কেন?
-অন্য একদিন আসবে ও।
-ওর বাচ্চাটা কেমন আছে?
-ভালো। দেখতে খুব কিউট ওর বাচ্চাটা।
-সময় করে একদিন নিয়ে আসিস ওদের। আমারও দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
-আচ্ছা মা নিয়ে আসবো। আমার একটু মাথাব্যথা করছে, রেস্ট নিবো।
-আচ্ছা যা…’
বীথি রুমে চলে এলো। ফ্যানটা ছেড়ে বেডে শুয়ে পড়লো। মায়ের মুখে বিয়ের কথাটা শোনার পর থেকে কেমন জানি লাগছে তার। চোখের সামনে হারানো একটা ছবি ভেসে উঠলো। রোগা পাতলা আর লম্বা গড়নের ছেলেটা একসময় লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখতো। রোগা পাতলা হলেও ছেলেটাকে ভালো লাগতো বীথির। আজ কোথায় আছে, কেমন আছে ছেলেটা, জানে না বীথি। আদৌ কি বেঁচে আছে? ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বীথির।
.
.
পার্লার থেকে চাঁদনি বেরিয়ে এলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাজ। নীল শাড়িটা পরেছে সে। তার উপর পার্লারের সাজ। মনে হচ্ছে যেন নীলের সমারোহে একটা চাঁদ ভেসে উঠেছে।
-কী দেখছো ওভাবে?’ লজ্জাভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে চাঁদনি।
-দিনের বেলায় চাঁদ দেখছি।’ চাপাকণ্ঠে বললো রাজ। চাঁদনির কাঁধে হাত রেখে ওর চোখের উপর দৃষ্টি রাখলো সে। লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেললো চাঁদনি। তারপর বললো,
-সত্যি করে বলো না, কেমন লাগছে?’
-বলবো?’
-হুমম…’ মাথা ঝাকালো চাঁদনি। রাজ ওর থুতনিটা ধরে মুখ উপরে তুলে বললো,
-এতক্ষণ একা একা বাইরে বসে থাকতে বোরিং লাগছিল, এখন তোমার চাঁদমুখখানা দেখে সব অবসাদটুকু শূন্যে মিলিয়ে গেছে।’
-হয়ছে, আর বলতে হবে না। খালি বেশি বেশি বলে। চলো এখন।’ বলেই রাজকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো চাঁদনি। রাজ বললো,
-দাঁড়াও না। আরেকটু দেখি আমার পাগলিটাকে।
-রাস্তার মাঝে দেখাদেখি চলবে না। বিয়ে করে নিয়ে যাও, যতো খুশি, যেভাবে খুশি দেখে নিও।
-তাই না?
-হুমম…’
একটা রিকশা থামালো চাঁদনি। ওটাতে দুজন উঠে ফিরে চললো বাসার দিকে।
.
.
♥বিশ♥
সন্ধ্যা থেকে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে, থামার নাম নেই। তবে বাইরে যে বৃষ্টি হচ্ছে বদ্ধ ঘরের ভেতর থেকে বোঝার উপায় নেই। গ্রামে থাকতে বৃষ্টির দিনগুলো খুব উপভোগ করা হতো। টিনের চালে শব্দ করে পড়তো বৃষ্টির ফোঁটা। সেই শব্দ শুনে মনের মধ্যে অন্যরকম এক ভালো লাগা কাজ করতো। সেই ভালো লাগায় শরীরটা নিজে নিজেই গুটিয়ে যেতে চাইতো। রাতের বেলায় বৃষ্টির শব্দ শুনে শুনে ঘুমালে খুব অল্প সময়ে চোখে ঘুম নেমে আসতো। দিনগুলো আজ বড্ড মিস করে রাজ। পুরোনো দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে বেড থেকে নেমে দাঁড়ালো রাজ। জুতা জোড়া পরে হেঁটে বীথির রুমে এলো সে। বীথি তখন জানালাটা খুলে দিয়ে অন্ধকারে তাকিয়ে হাতটা বের করে বৃষ্টির ফোঁটা ধরার চেষ্টা করছে। রাজ ওর পাশে বসতে বসতে বললো,
-কীরে, কী করিস?’
বীথি হাতটা ঢুকিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো। বৃষ্টির ছিটকা লেগে আছে ওর মুখে। অন্য হাত দিয়ে মুখ মুছে সে জবাব দিলো,
-কিছু করি না।
-মন খারাপ?
-না।
-তাহলে ওভাবে উদাসীন হয়ে বাইরে তাকিয়েছিলি কেন?
-ভালো লাগছিল বৃষ্টির ফোঁটার সাথে খেলতে। ভাইয়া, তোর সাথে একটা কথা শেয়ার করার ছিল….
-কী কথা? বল…
-মা বাবা এসব কী শুরু করেছে? আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলছে ওরা…
-ঠিকই তো করছে। তুই কি বিয়ে করবি না?
-করবো। তবে এখন না।’ মুখটা ঘুরিয়ে অসহায় কণ্ঠে জবাব দিলো বীথি।
-তুই কি এখনও সেই ছেলেটার কথা ভাবিস? দেখ, ছেলেটার খোঁজ তুই গ্রামে থাকতেই পাসনি। ওর জন্য এভাবে নিজের জীবনটা শেষ করে দিস না।
-ভাইয়া আমাকে আরেকটু দেখতে দে। যদি কখনও বাবা মার সব অভিমান ভেঙে আমাদের গ্রামে যাওয়ার সুযোগ হয়, তখন ওকে খোঁজার চেষ্টা করবো। তখন যদি খুঁজে না পাই তাহলে বিয়ের কথা চিন্তা করবো। তুই একটু বাবা মাকে বুঝিয়ে বলবি, ওরা যেন বিয়ের কথা না তুলে এখন?
-আচ্ছা বলবো।’ বোনের কাঁধে হাত রাখলো রাজ। তখন ঘরে প্রবেশ করলো আয়েশা বেগম। ছেলের দিকে তাকিয়ে আয়েশা বেগম বললো,
-রাজ, তোর বাবা কোথায় দেখতো একটু। এখনও ফিরলো না। ফোনও অফ তোর বাবার।
-বাবার সাথে ছাতা নেই?
-না। তুই একটা ছাতা নিয়ে বের হয়ে দেখতো বাপ…
-আচ্ছা দেখছি। ছাতা দাও…’
আয়েশা বেগম দুটো ছাতা নিয়ে এসে রাজের হাতে দিলো। কিন্তু তাকে আর বের হতে হলো না। আমান সাহেব এসে দরজায় কলিংবেল বাজালো। দরজা খুলে দিয়ে আয়েশা বললো,
-এ কী, তুমি তো একেবারে ভিজে গেছো।
-কী করবো? ভিজে ভিজে আসতে হলো।
-তোমার ফোন অফ কেন?
-চার্জ নেই ফোনে।
-আচ্ছা, বাথরুমে গিয়ে গোসল করে নাও। আমি কাপড় দিচ্ছি।’ বলেই ছেলের হাত থেকে ছাতা জোড়া নিয়ে আবার ভেতরে গেল আয়েশা বেগম। আর আমান সাহেব ভেজা শার্টটা খুলে বাথরুমে ঢুকলেন।
রাজ নিজের রুমে এসে দরজাটা আটকিয়ে বেডে শুয়ে পড়লো। তারপর চাঁদনিকে ফোন দিলো। প্রথমবার ফোন রিসিভ করলো না চাঁদনি। দ্বিতীয়বার রিসিভ করে বললো,
-সরি রাজ, বুঝতে পারিনি তুমি ফোন দিছো।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। কী করছো বলো? বিয়ের অনুষ্ঠান কেমন চলছে?
-আর বিয়ের অনুষ্ঠান? বৃষ্টির কারণে অনেকেই আসতে পারেনি।
-ইশ! আফসোস! তো কী করছো এখন?
-মামাকে স্টেজে তুলে মজা করছিলাম। তুমি কল দিছো, তাই একপাশে সরে এসেছি।
আমার জন্য এতো টান?
-তো হবে না? একটা মাত্র হবু বর আমার।…’
-তাই বুঝি?’ হাসলো রাজ।
-হুমম…’
-কিন্তু আমার একটা ভয় হয়…
-কীসের ভয়?
-হারানোর ভয়। যদি কখনও তোমাকে হারিয়ে ফেলি?
-চুপ এমন কথা মুখে আনবা না।
-জানো, আমাদের বংশে প্রেম কখনও সার্থক হয় না। ভালোবেসে কষ্ট পেলো আমার মেজো চাচ্চু, ছোট চাচ্চু, শায়লা ফুফি তো হারানোর কষ্টটা বুকে নিয়েই পরপারে পাড়ি জমালো। তখন এতসব বুঝতাম না, বুঝতাম না প্রেম কী, প্রেমের কষ্ট কী। আমার ছোট বোনটাও একটা ছেলেকে পছন্দ করতো, ছেলেটাও ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতো, কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারেনি নিজের ভালোবাসার কথা। আর মনি। মনি আমাকে খুব ভালোবাসতো…’ এতটুকু বলেই বিদ্রুপ করে একটু হাসলো রাজ। তারপর বললো,
-কিন্তু মনি কখনও তার ভালোবাসার কথা জানাতেই পারেনি আমাকে। আমিও বুঝতাম না ওসব। একসময় নিজের প্রেমকে বুকের মাঝে চাপা দিয়ে, হাজারও কষ্ট বুকে নিয়ে অন্যের সাথে বিয়ের পিড়িতে বসে মনি। ভালোবেসে কেউ সার্থক হয়নি, কেউ না। তাই আমারও ভয় হয়, হারিয়ে ফেলবো না তো তোমাকে?
-না, আমি কখনও হারাতে দেবো না তোমাকে। খুব ভালোবাসি তোমাকে।
-আমিও….
-তুমি আর ওসব ভেবো না। দেখো আমাদের একদিন ঠিকই মিলন হবে। আচ্ছা রাখি এখন, আমাকে ডাকছে…’
-আচ্ছা…’
ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিলো চাঁদনি। রাজ নিজের ফোনটা বুকের উপর রেখে চোখ বুজলো। তারপর বৃষ্টির শব্দ শোনার চেষ্টা করলো। বাইরে তখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে….
.
.
(চলবে…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here