জীবনের গল্প পর্ব-৩২

0
550

__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-৩২___________
রাতে দাদুবাড়িতে জমজমাট আয়োজন চললো খাবারের। দাদু বাড়িতে এখন তিনটা পরিবার। একটা ছোট চাচ্চুর, একটা মেজো চাচ্চুর, আর একটা দাদুর। দাদু আর দাদু মিলে এখন ছোট চাচ্চুর তোলা ঘরের একটা রুমে আলাদা পরিবার গড়েছে। ঐ রুমের একপাশে রান্না করা হয়, অন্যপাশে একটা খাটে বুড়োবুড়ি মিলে থাকে। পাশের আরেকটা রুমে থাকে মনি আর তার মা। তবে তারা দাদার পরিবারেই খায়। দাদুর পুরনো বাড়িটাতে মেজো চাচ্চুরা থাকে। রাজের খুব কষ্ট হলো সুন্দর পরিবারটার এমন ভাঙ্গন দেখে।
ছোট চাচি, মেজো চাচি খাবারের আয়োজন করলেও, রাজ এবং বীথি খেতে বসে দাদুর ঘরেই। খাটের উপর বসেছে ওরা খেতে, সাথে দাদুও বসেছে। দাদি আর বড় ফুফি মিলে খাবার বেড়ে দিচ্ছে, আর মনি খাবারগুলো খাটের উপর তুলে সাজিয়ে রাখছে। বিদ্যুৎ নেই। গ্রাম এলাকায় সময়ে অসময়ে বিদ্যুৎ চলে যায়। খাটের উপর একটা কুপি জ্বলছে। কুপির আলোতে মনিকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। কপাল বেয়ে কিছু চুল ঝুলে পড়েছে তার। কুপির আগুনে চুলগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছিল দেখে রাজ চুলগুলো সরিয়ে দেয়। কিছু মুহূর্ত চেয়ে থাকে দুজন দুজনের দিকে। তারপর একটা প্লেট এগিয়ে দেয় মনি রাজের সামনে। ভাত বেড়ে দিতে চাইলে রাজ বলে উঠে,
-থাক থাক, আমি নিতে পারবো।’
মনি আর জোর করলো না। রাজ নিজে বেড়ে খেতে শুরু করলো। বীথি আগেই শুরু করে দিয়ে খাওয়া। দাদুও খেতে খেতে বললো,
-খা দাদুভাই, বেশি করে খা। আমি তো চোখে তেমন ঠাহর করতে পারি না। কী কী নিছিস দেখতে পাচ্ছি না। এই মনি, ওদের প্লেটে একটু বেশি করে মাংস তুলে দে তো ভাই।
-আরে নিছি আমরা দাদু, তুমি চিন্তা করো না।
-আচ্ছা। খা দাদুভাই তোরা।’
খেতে লাগলো ওরা। নিচে বসে দিদিমণি আর ফুফু খাচ্ছে। মনি দরজার কপাটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এদিকে তাকিয়ে আছে। কুপির আলোতে ওর চেহারাটা অস্পষ্ট! শুধু গায়ের সাদা শাড়িটাই স্পষ্ট দেখা গেল। ফুফি ওর উদ্দেশ্যে বললো,
-ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয়, এখানে বসে খেয়ে নে।
-আমি পরে খাবো মা।’ বলেই চলে গেল মনি অন্য রুমে।
.
.
রাত সাড়ে এগারোটা। গ্রামের জন্য এখন গভীর রাত। নিস্তব্ধ পরিবেশ। আকাশে হালকা মেঘের আড়ালে চাঁদটা লুকোনো। একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে শিকড়ে বসে আছে রাজ। এক পাশে একটা কুকুর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, যেন পৃথিবীর সকল চিন্তা থেকে মুক্ত প্রাণীটা। সামনে বিল। বিলের জলে আকাশের মেঘগুলোকে ভাসতে দেখা গেলো। মাঝেমাঝে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটা উঁকি দিচ্ছে। ক্ষীণ বাতাস বয়ে যাচ্ছে, প্রাণভরে শ্বাস নিলো রাজ।
-ঘুমাওনি?’
চমকে উঠলো রাজ মনির কণ্ঠ শুনে। তার চেয়ে বেশি অবাক হলো মনির সম্বোধনটা পাল্টে যেতে দেখে। মনি আর তুই করে বলছে না। অনেকদিনের দূরত্ব সম্বোধনটাকে পাল্টে দিছে। তুই থেকে তুমি হয়ে গেছে। রাজও তুই করে বলবে নাকি তুমি করে বলবে ভেবে পেল না কিছুক্ষণ। তারপর জবাব দিলো,
-নাহ্, তুমি ঘুমাওনি কেন?
-এমনি। ঘুম আসছে না। শহরের মানুষ তুমি, এখন কি তোমার ঘুমানোর সময়?
-শহরে ছিলাম ঠিকই, কিন্তু মনটা পড়ে থাকতো এখানে।
-তা তো দেখেছিই, আজ দশ বছর পর গ্রামে এলে।’
কী জবাব দেবে রাজ ভেবে পেল না। বাতাসে মনির সাদা শাড়িটা উড়ছে। এই মুহূর্তে মনিকে খুব অসহায় লাগছে। মনির গায়ে সাদা শাড়ির ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না আর রাজ কষ্ট পাবে ভেবে। কিন্তু মনি নিজেই তুললো কথাটা। কষ্ট মাখানো হাসিরস্বরে বললো,
-অবাক হওনি তুমি আমাকে এই অবস্থায় দেখে? গায়ে সাদা শাড়ি…
-হুমম, হয়েছি অবাক। তুমি কষ্ট পাবে তাই জিজ্ঞেস করিনি।’
-কষ্ট!’ বিদ্রুপস্বরে একটু হাসলো মনি। তারপর বললো,
-কষ্টকে আর কষ্ট মনে হয় না। ছোটবেলা থেকে পেতে পেতে সয়ে গেছে।’
কিছুটা বিরতি নিয়ে মনি আবার বললো,
-দুই বছর আগে হঠাৎ বুকের ব্যথায় মারা যান উনি।
-বুকের ব্যথা নিশ্চয়ই আগে থেকেই ছিল? ডাক্তার দেখাওনি?
-না। উনি কোনো গুরত্ব দিতেন না ওটার। আর আমার কথারও কোনো গুরুত্ব ছিল না উনার কাছে।
-কেন? বিয়ের দিন তো মনে হলো খুব ভালো লোক। তোমার খুব কেয়ার করবে, যত্ন নেবে।
-ভালো লোক তো। আমার অনেক কেয়ার করতো তিন বছর পর্যন্ত।
-তিন বছর?
-হুমম। এরপর অন্য একজনকে বিয়ে করে আনে হঠাৎ।
-হোয়াট? তুমি কিছু বলোনি?
-নাহ্। বলার মতো মুখ ছিল না। আমার কোনো বাচ্চা হয়নি তাই উনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। আমি আর কী বলবো? চুপচাপ মেনে নিয়েছিলাম।’
কী জবাব দেবে রাজ ভেবে পেল না। দুজন চুপ থাকলো বেশ কিছুক্ষণ। মনি দুজনের মাঝে দূরত্ব রেখেই দাঁড়িয়েছে। একসময় ও রাজের গায়ের উপর পড়তে চাইতো, রাজের গা ঘেষতে চাইতো, রাজের সাথে মিশে যেতে চাইতো। সেই মনি আজ বদলে গেছে অনেকটা। মাঝখানে কঠিন প্রাচীর!
-বিলটা এখনও আগের মতোই আছে। মাঠটাতে কি এখনও খেলা হয়?’ হঠাৎ নীরবতা ভেঙে বলে উঠলো রাজ। মনি জবাব দিলো,
-হুমম, শুধু বদলে গেছে মানুষগুলো।’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রাজ।
-মনি তোমার মনে আছে ঐ যে আইল দিয়ে একদিন তোমাকে তাড়া করেছিলাম। তুমি আর আমি একসাথে ধানক্ষেতে পড়ে গিয়েছিলাম?’
প্রশ্ন করেই মনির দিকে তাকায় রাজ। মনি তাৎক্ষণিক জবাব দিলো না। মাঠের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর শুধু উচ্চারণ করলো,
-হুমম…’
কিন্তু তার এই একটি শব্দের পেছনে লুকিয়ে আছে হাজারও আবেগ, কিছু পুরনো স্মৃতি, আর হারানোর অনুভূতি। চাঁদের কিরণ লেগে তার চোখের নিচে হঠাৎ ঝলঝল করে উঠলো। রাজ বুঝতে পারে মনি কাঁদছে। রাজ কিছু বলার আগেই মনি চোখ মুছে বললো,
-শরীর খারাপ করবে। চলো ঘুমোবে।’ বলেই আর অপেক্ষা করলো না সে। হেঁটে চলে গেল। রাজও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আকাশের চাঁদটাও মেঘের ফাঁক দিয়ে আরেকবার উঁকি মেরে লুকিয়ে গেল।
.
.
সকালে ইয়াসমিন তার মুরগিগুলোকে ডেকে খাবার দিচ্ছিল উঠোনে। সামনেই একটা গাছের নিচে লম্বা বেঞ্চিতে বসে মনি বীথির চুলে তেল মেখে আঁচড়ে দিচ্ছিল। রাজ তখন ঘর থেকে দাদুর সাথে বের হয়ে রাস্তার দিকে যাচ্ছিলো। আনমনে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে মনি তার দিকে। বীথি বলে উঠে,
-কীরে, চুল আঁচড়াচ্ছিস না কেন?’
-উহ? হুমম আঁচড়াচ্ছি।’ বলে মনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। বীথি জিজ্ঞেস করে,
-হ্যাঁ রে, ঐ ছেলেটার কোনো খবর জানিস?
-কোন ছেলে?
-আকাশ।
-তেমন কিছু জানি না। তবে বেশ কিছুদিন আগে একবার দেখেছিলাম কাঞ্চনপাড়া এলাকায়। একটা মুদি দোকান দিয়েছে সে। দোকানটা চালায়।
-ওহ্।
-তুই এখনও মনে রেখেছিস ওকে?
-হুমম, প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোলাগা, যাকে প্রথম দেখে হৃদয়ের আবেগগুলো উতলে উঠেছিল তাকে কি এতো সহজে ভুলা যায়?’
মনি বুঝতে পারে বীথি এখনও আকাশকে ভালোবাসে। ভালোবাসাগুলো এমনই, যাকে একবার মন থেকে ভালোবাসা যায়, তাকে কখনও ভুলা যায় না। এটা মনি হাড়েহাড়ে বোঝে। চুল আঁচড়ানোর এক ফাকে মনি জিজ্ঞেস করে,
-কাঞ্চনপাড়া এলাকায় যাবি একদিন?’
চমকে উঠে ঘুরে তাকায় বীথি মনির দিকে। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে তার। মনি ঠোঁটটা প্রশস্ত করে শুকনোভাবে হাসলো।
.
.
ধানক্ষেতের আইল দিয়ে দাদুর সাথে হাঁটছে রাজ। একসময় দাদু তাকে কাঁধে নিয়ে এ আইল থেকে ঐ আইলে ঘুরতো। ধানের চারাগুলো দেখতো। আজ আর সেইদিন নেই। দাদু লাঠিতে ভর দিয়ে সাবধানে পা ফেলছে। রাজ দুহাতে দাদুকে ধরে পাশাপাশি হাঁটছে। দাদু হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে ধানক্ষেতের দিকে তাকালো। রাজের উদ্দেশ্যে বললো,
-বন্যার পানি সব ধানের চারাগুলো ভাসিয়ে নিয়ে গেল।’
দাদু চোখে ভালো করে দেখতে পায় না। তবুও এটা তাঁর অনুধাবন। রাজ তাঁকে সান্ত্বনা দিতে বললো,
-এখনও যা আছে, ইন-শাহ-আল্লাহ ভালো ধান পাওয়া যাবে দাদু।
-আল্লাহ ভরসা। এই ধান বেঁচার টাকা দিয়েই তো সারাবছর চলতে হয়।’
দাদুর কথাটা বোঝার চেষ্টা করলো রাজ। কথাটার ভাবার্থ অনেক। কথাটিতে অনেক কষ্ট লুকিয়ে থাকলেও দাদুর কণ্ঠে কোনো আক্ষেপ নেই। দাদুর এখনও নিজের সংসার চালানোর সামর্থ্য আছে। নিজের ছেলেরা দেখে না বলে দাদুর মনে কোনো দুঃখ নেই। দুঃখ শুধু এটাই, দাদুর সাজানো পরিবারটা খণ্ডখণ্ড হয়ে গেছে। রাজ বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে দাদুর চেহারার দিকে। আর দাদু তাকিয়ে আছে ধানক্ষেতের দিকে, যদিও চোখে ভালো দেখে না, তবুও ধানক্ষেতের গন্ধে যেন দৃষ্টি ফিরে পায় দাদু। দাদু হঠাৎ হেসে বললো,
-জানিস দাদুভাই, গতবছর ধান বেঁচার টাকা থেকে তোর দিদিমণিকে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম। তোর দাদি যে কী খুশি হয়েছিল জানিস?’ বলেই আবারও হাসে দাদু। একদম ভেতর থেকে এসেছে এই হাসি। এই হাসিতে কোনো রাগ নেই, কষ্ট নেই, শুধু রয়েছে ভালোবাসা। রাজও মৃদু হেসে বলে,
-বুড়ো হয়ে গেছো, এখনও বুঝি বুড়ির জন্য ভালোবাসা কমেনি?
-ভালোবাসা কি কমে দাদুভাই? যাকে একবার মন থেকে ভালোবাসা যায়, মৃত্যুর পরও তাকে ভালোবাসার তৃপ্তি থেকে যায়।’ বলেই হাসে দাদু। রাজ অবাক হয়ে দেখে, দাদু এখনও তৃপ্তি নিয়ে হাসে।
.
.
♥বাইশ♥
রিকশায় পাশাপাশি বসে আছে মনি আর বীথি। রিকশা চলছে সামনে। যতো এগোচ্ছে রিকশা, বীথি ততো ঘামছে।
-কীরে এমন করছিস কেন?’ জিজ্ঞেস করে মনি।
-কেমন জানি লাগছে। আচ্ছা ও কি আমাকে দেখে চিনতে পারবে?
-পারবে। আমরা তো পেরেছি চিনতে।
-আমাকে কি মনে রাখবে সে এতদিন?
-তুই তো রেখেছিস।
-কিন্তু ও যদি না রাখে মনে?
-সেটা পরে দেখা যাবে।’
রিকশা এসে থামলো আকাশের মুদি দোকানের সামনে। দেখলো দোকান বন্ধ। বীথির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল হঠাৎ। মনি তার ফ্যাকাশে চেহারা লক্ষ করে বললো,
-মন খারাপ করিস না। আশেপাশের কাউকে জিজ্ঞেস করি চল। নাম রিকশা থেকে।’ বলে নিজেও নামলো মনি। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে মনি ভাড়া দিলো। তারপর একটা দশবছরের ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো,
-বাবু, এখানে দোকানে যে একটা লোক বসতো, লোকটা কোথায়?
-আকাশ ভাই? উনি তো দোকান খুলেনি আজ। বাসায় মনে হয়।’ ছেলেটা জবাব দিলো।
-বাসা কোথায় ওর?
-ঐতো ওটা আকাশ ভাইয়ের বাসা।’ সামনে একটা বাড়ির দিকে ইশারা করলো ছেলেটা।
-আমাদের একটু নিয়ে যেতে পারবা ওখানে?’
-চলুন…’
মনি ও বীথি আকাশের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। ছেলেটা ভেতরে চলে গেল আকাশকে ডাকতে। বাইরে দাঁড়িয়ে মনি ও বীথি একটু আনইজি ফিল করলো। পাড়ার লোকগুলো তাদের দিকে কীভাবে যেন তাকাচ্ছে। হয়তো শহরের কোনো মেয়ে ভেবে অবাক হচ্ছে। অবাক হচ্ছে তাদেরকে একটা কুঁড়েঘরের মতো ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
একটুপর ভেতর থেকে বের হলো রোগা-সোগা একটা লোক। মুখে হালকা দাড়ি। পরনে একটা লুঙ্গি আর গেঞ্জি। চিনতে একটু কষ্ট হলেও চিনলো বীথি আকাশকে। আকাশও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। পুরো বিষয়টার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। মনির দিকে তাকিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে উচ্চারণ করলো,
-আপনারা?’
-বীথি আপনাকে দেখতে চাইলো, তাই নিয়ে এলাম।
-আমার বাড়িঘরের অবস্থা ঠিক নেই, এখন আপনাদের কোথায় বসতে দিই?’ বলেই দ্বিধায় পড়ার মতো করে হাসলো আকাশ।
-অসুবিধে নেই, আমরা বসতে পারবো।
-ভেতরে আসুন কী আর করা। যেরকম বাড়ি আর কি।’
আকাশ ওদের দুজনকে ভেতরে নিয়ে গেল। একটা তিন বছরের মেয়ে এসে আকাশকে বাবা বলে ডাক দিতেই বীথির ভেতরের অস্তিত্ব যেন চুরমার হয়ে গেল নিমিষেই। আকাশ মেয়েটাকে কোলে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলো,
-আমার মেয়ে, শান্তা।’
বীথির মনটা আরও ভেঙে গেল তখন। মনি বুঝতে পারলো ওর অবস্থা। আড়ালে সে বীথির একটা হাত শক্ত করে ধরলো যেন বীথি নিজেকে সামলাতে পারে। বীথি নিজেকে সামলিয়ে আকাশের মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আদর করলো। হাসার চেষ্টা করলো সে। নিজের ভেতরের অবস্থা বুঝতে দিলো না সে আকাশকে। শান্তাকে আদর করে সে আকাশকে জিজ্ঞেস করলো,
-ভাবীকে দেখছি না। ভাবী কই?’
একটা আঠারো-উনিশ বছরের মেয়ে বের হলো মাথায় ঘোমটা দিয়ে। দেখেই বোঝা যায় গ্রামের কোনো অতি সাধারণ ঘরের মেয়ে সে। এটাই আকাশের বউ। মেয়েটা ইতস্তত করে হাসলো, কী বলবে হঠাৎ ভেবে পেলো না। হয়তো নিজেকে সে মনি বীথির কাছে অতি সামান্য ভাবছে। একটা ভাঙা সোফা ইশারা করে সে বললো,
-বসুন না?’
মনি ও বীথি বসলো। আকাশ তার বউকে বললো,
-কী আছে দেখো, চা নাস্তা নিয়ে এসো। আর বাসার মোরগটা জবাই করে রান্না করো।
-না, না, কিছু করতে হবে না। আমরা এখনই চলে যাবো। তাড়াতাড়ি করে বললো বীথি। একটু থেমে আবার বললো,
-আসলে গ্রামে আসলাম অনেক বছর পর। ভাবলাম আপনাকে একটু দেখে যায়।’ কণ্ঠটা নিচু হয়ে এলো বীথির। মনি তার কাঁধে হাত রাখলো। ভরসার হাত।
বেশ কিছুক্ষণ পর ওরা চা নাস্তা খেয়েই উঠে দাঁড়ালো। বের হয়ে আসার সময় আকাশের মেয়েটাকে আবার আদর করে দিলো বীথি। তারপর আকাশ থেকে বিদায় নিয়ে বললো,
-আসি…’ করুণ শুনালো কণ্ঠটা। হালকা কেঁপে উঠলো তার কণ্ঠ। আকাশ মাথা কাত করে বিদায় জানালো। বের হয়ে এলো ওরা। আকাশে মেঘ দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি হতে পারে। একটা রিকশা ডেকে দুজনে উঠে পড়লো। বীথি চুপচাপ, কোনো কথা বলছে না। মনি তার একটা হাত নিজের কোলো নিয়ে শক্ত করে ধরে বললো,
-আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। দেখ, ওকে দেখে আমার কিছুতেই তোর উপযুক্ত বলে মনে হয়নি। তোর কপালে নিশ্চয়ই অনেক ভালো কেউ আছে।’
মনির কথা শেষ হতেই জমে থাকা এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো বীথির চোখ বেয়ে।
.
.
দাদুকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে রাজ একটু গ্রাম ঘুরতে বের হয়েছিল। তাদের স্কুলটার পাশে আসতেই থমকে দাঁড়ালো সে। স্কুল ছুটি হয়েছে। হৈ-হুল্লোড় করে বাচ্চারা দৌড়াচ্ছে ঘরের দিকে। কয়েকজন টিচারকেও দেখা গেল বের হয়ে আসতে। সেই বাংলা ম্যাডামকে কোথাও দেখা যায় কি না দেখলো রাজ। কিন্তু দেখতে পেল না। হয়তো ম্যাডাম আর এই স্কুলে চাকরি করে না, অথবা পেনশন পেয়ে গেছে।
আকাশ থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। রাজ ফেরার জন্য পা বাড়াতে চাইলে তার চোখ আটকে গেল বাংলা ম্যাডামের উপর। ম্যাডাম একটা ছাতা খুলে বের হয়ে আসছে। ম্যাডামের সামনে যাবে কি যাবে না ইতস্তত করতে লাগলো রাজ। তারপর কোনো কিছু না ভেবেই ম্যাডামের সামনে গিয়ে সালাম দিলো রাজ। ম্যাডাম সালামের জবাব দিয়ে চেয়ে থাকলেন রাজের দিকে। হয়তো চিনতে পারছেন না তিনি রাজকে। রাজ বললো,
-ম্যাম, আমি রাজ। আপনার ছাত্র ছিলাম।
-তুমি সেই দুষ্ট ছেলেটা না?’ কাচের চশমাটা ঠিক করে চোখে লাগিয়ে ম্যাডাম হাসলেন।
-জ্বী ম্যাম। ভালো আছেন?
-হ্যাঁ, তোমার কী খবর? গ্রামে হঠাৎ?
-সবার কথা খুব মনে পড়ছিল, তাই এলাম।
-তা স্টাডির কী খবর? পড়ো নাকি জব করো?
-মাস্টার্সে আছি। পাশাপাশি জবেরও চেষ্টা করছি।
-গুড। তো ভালো তো আছো, না?
-জ্বী ম্যাম।
-বৃষ্টি হতে পারে। তোমার সাথে তো ছাতাও নেই। ভিজতে পারো, তাড়াতাড়ি চলে যাও।
-জ্বী ম্যাম।’ আবারও সালাম দিয়ে পাশ কাটালো রাজ ম্যাডামকে। ম্যাডামও ছাতা মাথায় দিয়ে চলে যেতে লাগলো। রাজ একবার ঘুরে তাকালো। ম্যাডামের সেই রূপ আর নেই। বৃদ্ধা হয়ে গেছে ম্যাডাম। মাথার চুল প্রায় সব পেকে গেছে। অথচ একদিন এই ম্যাডামকেই তার ভালো লাগতো, প্রেমে পড়েছিল সে এই ম্যাডামের। কিশোর বয়সের প্রেম। ভাবতেই হাসি পায় রাজের। বৃষ্টি আরও বাড়তে লাগলো। দ্রুত পা চালালো রাজ।
.
.
বাড়ির সামনে কলসি আর বালতি বসিয়ে বৃষ্টির পানি নিচ্ছিল মনি। রাজকে ভিজে ভিজে আসতে দেখে সে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-ভিজছো কেন?’
বৃষ্টির শব্দে রাজ শুনতে পেল না ওর কথা। ভিজে একদম গোসল হয়ে গেছে সে। কাছে এসে পকেট থেকে পলিথিনে মুড়ানো মোবাইল আর মানিব্যাগটা বের করে মনির হাতে দিলো। ওগুলো হাতে নিয়ে মনি বললো,
-বৃষ্টি থামলে আসতে পারোনি? এখন ঠাণ্ডা লাগলে কী করবা?’
-তুমি সেবা করতে পারবা না?’ হাসতে হাসতে ভেজা শার্ট খুললো রাজ। মনি তার কথার জবাব না দিয়ে বললো,
-ঐ যে সাবান। তুমি গোসল করে নাও। ব্যাগ থেকে তোমার কাপড় আনছি…’ বলেই ভেতরে ঢুকে গেল সে। রাজ সাবানটা নিয়ে গায়ে মাখতে লাগলো।
একটুপর মনি এসে তার কাপড় রেখে গেল। রাজ বৃষ্টির পানিতে গোসল সেরে কাপড় চেঞ্জ করে নিলো। তারপর ভেতরে এলো। ভেতরে দাদু খাবার সামনে নিয়ে ওয়েট করছিল তার জন্য। সে আসতেই দাদু বললো,
-আয়, বস এখানে।’ বলেই একটা প্লেট এগিয়ে দিলো দাদু। রাজ খেতে বসে পড়লো। খেতে খেতে দিদিমাকে জিজ্ঞেস করলো,
-দিদিমা, বীথি কই? ও খায়ছে?
-খাইনি। কী হয়ছে জানি না, মন খারাপ করে বসে আছে তোর ফুফির রুমে।’ জবাব দিলো দিদিমা।
-কিছু জিজ্ঞেস করোনি?
-জিজ্ঞেস করলে বলে না।
-আচ্ছা, আমি দেখছি।’ রাজ ফুফির রুমে গেল। বীথি ওখানে জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে। খুব বেশি মন খারাপ হলে বীথি এভাবে বসে থাকে। রাজকে ভেতরে আসতে দেখে ফুফি বললো,
-আয় রাজ, খেয়েছিস তুই?
-না ফুফি, খেতে বসেছিলাম মাত্র। শুনলাম বীথির মন খারাপ, ও কিছু খায়নি, তাই উঠে এলাম।
-কী জানি কী হয়েছে। এতো করে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলে না আমাদের।
-কী রে বীথি, কী হয়েছে তোর?’ বোনের মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো রাজ।
-কিছু হয়নি রে, তুই যা, খেয়ে নে।’ বলতে বলতে চোখ মুছলো বীথি।
-বল আমাকে, বলবি না?’
-কিছু হয়নি তো…’
রাজ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখন তার কাঁধে হাত রেখে মনি চোখে ইশারা করে বলে,
-ছেড়ে দাও ওকে, তুমি খেয়ে নাও।’
বাধ্য ছেলের মতো মনির কথা শুনলো রাজ। রুম থেকে যখন বের হয়ে যাচ্ছিল সে, তখন চোখে পড়লো একটা সেলাই মেশিন।
-কার এটা?’ ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো রাজ।
-আমার। মাঝেমধ্যে অবসর সময়ে কাপড় সেলাই করি…’ পাশ থেকে ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিলো মনি। রাজ কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকলো মনির দিকে। বুঝে নিলো সে সবকিছু। এ বাড়িতে মাকে নিয়ে মনি বোঝা হয়ে থাকতে চায় না। তাই সেলাই মেশিন চালায়।

(চলবে….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here