__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-৩৪___________
♥তেইশ♥
বাসায় অতিথি আসবে তাই আশরাফ সাহেবের বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার করা হয়েছে। তিনটা পরিবারকেই রাজ বলে দিয়েছে, যে কয়টা দিন চাঁদনিরা থাকবে, অন্তত সেই কয়টা দিন যেন সবাই একটু মিলেমিশে থাকে। ঝগড়াঝাঁটি, হিংসা-বিদ্বেষ যেন একটু ভুলে যায়। নয়তো এই পরিবারের যে সুনাম রাজ করেছে চাঁদনির কাছে, সব মিথ্যে হয়ে যাবে।
রাজের মুখের দিকে চেয়ে দাদুর পরিবার আর ছোট চাচ্চুর পরিবার এক হয়েছে কয়েকদিনের জন্য। ছেলে থাকতে বুড়ো-বুড়িরা আলাদা খায় ব্যাপারটা দেখতে ঠিক ভালো ঠেকবে না চাঁদনির কাছে। দুই পরিবার মিথ্যে মিথ্যে এক হলেও রাজের বেশ ভালো লেগেছে। মুহূর্তের জন্য তার চোখের কোণটা ভিজে উঠেছিল। যদি সত্যি এক হয়ে যেতো ওরা! আঙুলের ডগা দিয়ে চোখের কোণটা মুছে রাজ।
.
.
বিকেলের দিকেই পৌঁছে চাঁদনি আর তার ভাবী। সাথে রিজভীও ছিল। রাজ তাদেরকে রিসিভ করতে স্টেশনে গিয়েছিল। তারপর একটা সি.এন.জি ভাড়া করে নিয়ে আসে দাদু বাড়িতে। রাজ ওদেরকে দাদুবাড়ির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। মনির সাথে যখন পরিচয় করিয়ে দেয়, তখন চাঁদনি হেসে বলে, -ইনিই বুঝি সেই মনি, যার প্রশংসা সবসময় করতে আমার কাছে?
-হ্যাঁ।’ ইতস্তত করে তাকালো রাজ মনির দিকে। চোখাচোখি হতেই দুজনে চোখ নামিয়ে নিলো।
.
রাতের বেলায় আশরাফ সাহেবের বাড়ির উঠোনে আড্ডা জমে উঠেছে। ও পাড়া থেকেও কয়েকজন এসেছে। শহর থেকে অতিথি এসেছে শুনে দেখতে এসেছে ওরা। উঠোনে আড্ডা জমে উঠতে দেখে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল রাজের। কতগুলো বছর জীবন থেকে হারানোর পর আবার সেই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে রাজ। উঠোনে সবাই গোল হয়ে বসেছে। মাঝখানে একটা টেবিলের উপর ছোট চাচি এসে পিঠা রেখে গেছে। সবাই পিঠা নিয়ে খাচ্ছে ওখান থেকে। চাঁদনি পিঠা নিতে লজ্জা পাচ্ছিল বলে আবুল চাচার বউ কয়েকটা পিঠা নিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে দেয়। তারপর বলে,
-লজ্জা পাইতে হইবো না। খাও। তুমি আমাগো রাজের বউ হইবা মানে পুরো পাড়ার বউ হইবা। এইহানে আমরা সবাই এক।’
চাঁদনি একটা পিঠা ভেঙে মুখে দিলো।’
তখন আরেকটা মহিলা বলে উঠলো,
-আসলেই চাঁদের মতো মুখখানা। নামটা ঠিক চেহারার সাথে মানায়ছে। কে রাখছিল নামটা?
-আমার বাবা।’
-ভালা নাম রাখছে। তা তোমার বাবা মা ভালো আছে তো?’
-আমার বাবা নেই। মা আছে। মা ভালো আছে।’
-ওহ, কষ্ট পেয়ো না মা, আমি না জেনেই জিজ্ঞেস করছি।
-না, না, ঠিক আছে।’
কথার ফাঁকে মেজো চাচি এসে সবাইকে চা দিয়ে গেল। চা খেতে খেতে আবুল চাচা দাদুর উদ্দেশ্যে বললো,
-মাইজ্জা, আমাগো রাজের কিন্তু পছন্দ আছে। দেখছনি কী সুন্দর মাইয়া পছন্দ করছে আমাগো রাজ।’
দাদু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-আবুল রে, রাজ আমার নাতি। আমার নাতির পছন্দ কি খারাপ হতে পারে? শুধু আফসোস একটা, আমি আমার নাতির পছন্দটাকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না। আগের মতো সব ভালো করে দেখার ক্ষমতা নেই আমার। সব ঝাপসা দেখি চোখে।’
দাদুর কথাটা একদম বুকের ভেতর থেকে বের হয়েছে রাজ বুঝতে পেরেছে। কথাটাতে অনেক আবেগ মেশা আছে, মেশা আছে অনেক হতাশা। রাজ দাদুর একপাশে গিয়ে কাঁধে ও মাথায় হাত রাখলো। চাঁদনিও উঠে এসে হালকা ঝুঁকে দাদুর গলাটা পেঁচিয়ে ধরলো আলতো করে। তারপর বললো,
-দাদু, আপনি আমাকে দেখতে পারবেন। আমি শহরে ফিরে গিয়ে ভালো কোনো চোখের ডাক্তারের সাথে কথা বলবো আপনার ব্যাপারে। আপনি আবার সবকিছু দেখতে পারবেন।’
দাদু আর আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না। চাঁদনিকে জড়িয়ে ধরে ওর চুলে মুখে কিছুক্ষণ শুঁকলেন। তারপর বললেন,
-তুমি বলেছো এতেই আমি খুশি হয়েছি দাদুভাই। আর কদিনই বা বাঁচবো আমি? শুধু শুধু এতগুলো টাকা নষ্ট করতে হবে না।
-যে কয়টা দিন বাঁচবেন, সেই কয়টা দিন ভালোভাবে বাঁচেন। আর কে বলছে আপনি আর কয়েকদিন বাঁচবেন? আপনি আরও অনেকদিন বাঁচবেন। রাজের মুখে আপনার অনেক কথা শুনেছি। রাজকে আপনি খুব ভালোবাসেন। আপনার প্রিয় নাতির বউকে ভালো করে না দেখে চলে যাবেন আপনি?’
চাঁদনির গালে হাত বুলাতে বুলাতে দাদু বললো,
-তোমার কথা শুনে আরও অনেক বছর বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছে দাদুভাই।’
চাঁদনি বুড়ো বুড়ি দুজনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো দুপাশে।
এতক্ষণে রাজের খেয়াল হলো, আড্ডায় সবাই থাকলেও মনি নেই। মনিকে খুঁজতে রাজ ওর রুমে এলো। দেখলো, মনি এক ধ্যানে জানালায় দুহাতের উপর থুতনি ঠেকিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আর কী যেন চিন্তা করছে গভীরভাবে। এতো গভীরভাবে চিন্তা করতে আগে কখনও দেখেনি মনিকে। মনির এ রূপ রাজের অচেনা।
-মনি…’ আলতো স্বরে ডাক দিলো রাজ। চমকে উঠে মাথার ওড়না ঠিক করে রাজের দিকে ফিরলো মনি।
-সবাই ওখানে বসে গল্প করছে, তুমি একা কী করছো এখানে?’ জিজ্ঞেস করলো রাজ।
-কিছু করছি না। ভালো লাগছে না রে, তাই বসে আছি এখানে।
-বাইরে তাকিয়ে ওভাবে কী চিন্তা করছো?
-চিন্তার কি আর শেষ আছে? কখন কী চিন্তা করি নিজেও ভেবে পাই না।
-তোমার খুব কষ্ট নারে?’
-কষ্ট!’ বিদ্রুপ করে হাসলো মনি। “বাদ দাও ওসব। তুমি সবার সাথে আড্ডা না দিয়ে এখানে কী করছো?”
-ওখানে তোমাকে দেখতে না পেয়ে এলাম।
-আমি ঠিক আছি। যাও তুমি, আড্ডা দাও।
-তুমিও চলো…
-না প্লিজ, তুমি যাও। তুমি ওখানে না থাকলে চাঁদনি হয়তো অস্বস্তি ফিল করবে।’
রাজ কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকলো মনির দিকে। তারপর পেছনে দুপা ফেলে ধীরে ধীরে বের হয়ে গেল। মনি দরজার পাশে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলো ওকে। রাজ আবার মিশে গেল আড্ডায়।
.
.
ভোরে চেঁচামেচি শুনেই ঘুম ভাঙলো রাজের। মেজো চাচা কী নিয়ে যেন চিল্লাচ্ছে আসাদের উপর। ওখানে যেতেই দেখলো ঘটনা যতো ছোট ভেবেছে রাজ, ততো ছোট না। আগের রাতে আসাদ ঘরে ফিরেনি, ভোর হতেই আসাদ হাজির বাড়িতে। সাথে ঐ চাকমা মেয়েটাও আছে। মেজো চাচ্চু খুব রেগে গেছে আসাদের উপর। তার হাতে একটা লাঠি আছে, লাঠি দিয়ে কয়েকটা মারতেও দেখা গেল আসাদকে। আবারও মারতে গেলে রাজ গিয়ে আটকায় মেজো চাচ্চুকে।
-থামো চাচ্চু, এভাবে সমস্যার সমাধান হবে না।’ তারপর রাজ আসাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
-আসাদ তুই এটা কী করেছিস? বাবা মার অবাধ্য হয়েছিস বলে, এতোটা অবাধ্য হওয়া ভালো না।’
আসাদ নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
-এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুমি কিছু বলবে না রাজ ভাই।
-ছিঃ, তুই এতোটা নষ্ট হয়ে গেছিস, ভাবতে পারছি না আসাদ। প্রেম করেছিস ভালো কথা, কিন্তু এভাবে একটা মেয়েকে বাবা মার অনুমতি ছাড়া ঘরে তুলে আনলি?
-আমি কী করবো, কী না করবো তা কি তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে?’ রাজের দিকে চোখ তুলে কথাটা বললো আসাদ। তখন জামাল তার ছেলেকে আরেকটা লাঠির আঘাত করলো সাথে সাথে। আসাদ দেরি না করে বেরিয়ে গেল মেয়েটার হাত ধরে। জামাল তার ছেলের উদ্দেশ্যে বললো,
-চলে যা, আর কখনও আসবি না এ ঘরে।’ বলেই হাতের লাঠিটা ছুড়ে মারলো দূরে। একপাশে দাঁড়িয়ে মুখে শাড়ির আঁচল গুজে কাঁদতে লাগলো ইয়াসমিন ছেলের জন্য। আসাদের এমন অধপতন দেখে একেকজনে একেক কথা বলতে লাগলো ফুফি, চাচিরা। রুমের ভেতর থেকে আশরাফ সাহেব আসাদের এমন অধপতনের জন্য ইয়াসমিনকে দোষ দিতে লাগলেন নিজের মতো। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদনি এবং তার ভাবী এদিকে চেয়ে আছে দেখে লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলো রাজ।
.
.
চাঁদনিদের গ্রাম ঘুরে দেখাচ্ছে রাজ। ইচ্ছে ছিল মনিকেও সাথে নিবে। কিন্তু মনি সেটা সহ্য করতে পারবে না। চাঁদনির সাথে চোখের সামনে রাজকে মিশতে দেখলে খুব কষ্ট পাবে মনি। রাজ জানে মনির ভালোবাসা এখনও আগের মতোই আছে, একটুও কমেনি। শুধু তার ভালোবাসা আটকা পড়ে আছে সাদা শাড়ি নামক দেয়ালটার ওপারে। হয়তো এখনও সে আগের মতোই চঞ্চল। কিন্তু আগের মতো সে তার চঞ্চলতাটুকু প্রকাশ করতে পারে না। ‘অধিকার’ নামক শব্দের কাছে সে বন্দী। অধিকার আর গায়ের সাদা শাড়িটা তার গতিরোধ করে রাখে। রাজও পারে না চাঁদনিকে কষ্ট দিয়ে মনির দিকে হাত বাড়াতে। একটা মেয়ের মন ভেঙে অন্য মেয়েকে খুশি করা এটাও নিশ্চয়ই একটা বড় অপরাধ। তাই সবকিছু ভেবে রাজ আর সঙ্গে নেয়নি মনিকে। তবে মনি আড়াল থেকে একবার উঁকি দিয়ে দেখেছিল। হয়তো আড়াল থেকেই চায় সে, রাজ অন্তত ভালো থাকুকু।
পুরো গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলো রাজ ওদের। মাঝেমাঝে চাঁদনি ফোনের ক্যামেরায় প্রকৃতির ছবি তুলছিল। গ্রামের সবুজ প্রকৃতি, ধানক্ষেত, খাল বিল সবকিছু মুগ্ধ করছিল ওদের। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছে ওরা গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর আচরণ দেখে। গ্রামের মানুষগুলো সহজেই সবাইকে আপন করতে পারে, যা শহরের মানুষদের মাঝে সচরাচর দেখা যায় না। শহররের শক্ত দালানের মতো ওখানকার বেশিরভাগ মানুষগুলোও হয় একটু রুক্ষ। এদিক থেকে গ্রামের মানুষগুলো একটু আলাদা। চাঁদনি ওদের সাথেও ছবি তুললো। পড়ন্ত বিকেলে ওরা এলো নদীর ধারে। নদীর জল এদিক থেকে ওদিকে বয়ে যাচ্ছে দেখে চাঁদনির চোখে মুখে মুগ্ধতা ফুটে উঠলো। রাজ বললো,
-এটা আমার প্রিয় জায়গা ছিল। ছোটবেলায় যখন মন খারাপ হতো, তখন এখানে এসে বসে থাকতাম। চেয়ে থাকতাম নদীর জলের দিকে।’
-সত্যি, অসাধারণ দৃশ্য। আমার খুব ভালো লাগছে।’ মৃদু হেসে বললো চাঁদনি।
-ইশ! এখানে না আসলে কখনও চোখের সামনে দেখা হতো না জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। আমার খুব ভালো লাগছে।’ বললো ভাবী। ভাবীর কথার জবাবে রাজ বললো,
-রাতের বেলায় বেশি সুন্দর লাগে ওদের মাছ ধরার দৃশ্যটা। কুপি জালিয়ে মাছ ধরে ওরা। দূর থেকে খুব সুন্দর লাগে দৃশ্যটা।
-তাহলে তো মিস করা যাবে না দৃশ্যটা।’ বলেই বাঁহাত দিয়ে কপালের ডান পাশ থেকে চুল সরালো ভাবী। ডানহাতের উপরে শাড়ির আঁচলটা ঝুলে আছে তার। নদীতে নৌকা দেখে রিজভি চিৎকার করে উঠলো,
-মা, নৌকা নৌকা…’
-ওয়াও! চলো ভাবী নৌকায় চড়বো।’ বললো চাঁদনি।
-ভয় করে, যদি পড়ে যায়?’ ভ্রু কুঁচকালো ভাবী।
-আরে কিছু হবে না। চলো তো…’
নৌকার দিকে গেল ওরা। ওদেরকে দেখে কিছুটা দূর থেকে আবুল চাচা ডাক দিয়ে বললো,
-কী মিয়া রাজ, বউমারে নিয়া ঘুরতে আইছো?’
-হ্যাঁ চাচা…’ গলার আওয়াজ বাড়িয়ে জবাব দিলো রাজ। তারপর একজন একজন করে নৌকায় উঠতে লাগলো। আবুল চাচা আবার ডাক দিয়ে বললো,
-দেইখা শুইনা উইঠো, বউমা পইড়া যাইবো দেইখো।’
রাজ হাসলো আবুল চাচার কথা শুনে। চাঁদনি এবং রিজভী আগেই উঠে পড়েছে নৌকাতে। কিন্তু ভাবী ভয়ে উঠতে পারছে না। রাজ ভাবীর হাত ধরে তুললো। তারপর বৈঠা হাতে নিয়ে দক্ষ মাঝির মতো নৌকা চালাতে লাগলো। অন্য পাশ থেকে চাঁদনি বললো,
-মাঝি গো, আমারেও নিবা তোমার পাশে?
-আসো…’ মৃদু হাসলো রাজ। চাঁদনি ভাবীর পাশ থেকে উঠে রাজের পাশে এসে বসলো। তারপর সেও রাজের সাথে কিছুক্ষণ বৈঠা চালালো নদীতে। খুব মজা পাচ্ছে সে। মাঝেমাঝে সে হাতটা নদীর পানিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে। রাজের মাথায় তখন দুষ্টুমি বুদ্ধি এলো একটা। চাঁদনি যখন নদীর পানিতে হাত ডুবালো, রাজ ওকে ভয় দেখানোর জন্য বললো,
-নদীতে কিন্তু কুমির আছে।’
সাথে সাথে আঁতকে উঠে রাজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চাঁদনি। দুজনে তখন নৌকা থেকে পড়ে যায় নদীতে। পানি থেকে মাথা তুলেই হাসতে থাকে রাজ। হাসতে হাসতে বললো,
-ছোট নদীতে কুমির আসবে কোথা থেকে?’
-আমাকে ভয় দেখায়ছো তুমি?’ মুখের কুলিসব রাজের মুখে মেরে কৃত্রিম রাগ দেখালো চাঁদনি। রাজ একটা ডুব দিয়ে উঠে বললো,
-আমি কি জানতাম তুমি এভাবে ভয় পেয়ে আমাকে সুদ্ধ ফেলে দেবে?’
-শয়তান, খচ্চর।’ বলেই রাজের বুকে কিল-ঘুষি মারতে লাগলো চাঁদনি। নৌকার উপর থেকে হাসতে লাগলো ভাবী আর রিজভী।
.
.
সন্ধ্যার দিকে একটু আঁধার আঁধার হলে ওরা ঘরে ফেরে। টিউবওয়েলে গোসল করে নেয় চাঁদনি। বেশ ভালো লাগে তার। টিউবওয়েল চেপে কখনও গোসল করেনি সে। আজীবন ঝর্ণা ছেড়ে বা ট্যাবের জলে গোসল করেছে সে। আজ নতুন অভিজ্ঞতায় মনটা হঠাৎ নেচে উঠলো। টিউবওয়েলের শব্দটাও মধুর লাগছে কানে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে গোসল করলো সে টিউবওয়েলে। সে বের হওয়ার পর রাজ গোসল করতে যাচ্ছিল। আশেপাশে কেউ নাই দেখে রাজ বললো,
-আবার চলো, একসাথে গোসল করবো।
-ফাজিল…’ বলে রাজের বুকে কিল মেরে হাসলো চাঁদনি। রাজ বললো,
-অন্তত একটা চুমু খেতে দাও…’
-যাও গোসল করে এসো।’ বলেই রাজকে টিউবওয়েলের দিকে ধাক্কা দিলো চাঁদনি। তারপরে চলে এলো।
রুমে এসে চাঁদনি তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছিল, একটুপর দরজা দিয়ে উঁকি দিলো মনি। শব্দ শুনে তাকালো চাঁদনি। মনিকে দেখে বললো,
-ও মনি আপু, আসুন আসুন, আসুন….’
মনি ভেতরে ঢুকলো। চাঁদনি জিজ্ঞেস করলো,
-ভাবী কি ভেতরে আছে?’
-হ্যাঁ, উনি ভেতরে আছেন।
-ও আচ্ছা…
-কেমন বেড়ালেন আজ?
-খুব ভালো। নৌকায় চড়ার সময় বেশি মজা পেয়েছি।
-হুমম, দুজন তো একেবারে নৌকা থেকে পড়ে গেছেন।’ নির্লিপ্ত হাসলো মনি। চাঁদনিও হাসতে হাসতে বললো,
-ও আমাকে কুমিরের ভয় দেখিয়েছিল, আমি ভয় পেয়ে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। তখন দুজনেই পড়ে যায় পানিতে।’ হাসি থামলো না চাঁদনির। হঠাৎ মনি প্রশ্ন করে,
-খুব ভালোবাসেন না ওকে?’
-হুমম, অনেক ভালোবাসি।
-আজীবন ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবেন ওকে। কখনও হারাতে দেবেন না। খুব কষ্ট এতে।’
মনিকে সিরিয়াস হতে দেখে চাঁদনির ঠোঁট থেকে হাসির রেখাটা মুছে গেল। মনিকে সে জিজ্ঞেস করলো,
-আপনি নিশ্চয়ই আপনার স্বামীকে খুব ভালোবাসতেন?’
-আমি..?’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুহাতে ভর দিয়ে বিছানায় বসলো মনি। আবার যখন মুখ খুলতে যাবে, তখন বাইরে রাজের আর্তচিৎকার শোনা গেল। দুজনে ছুটে গেল বাইরে। বাইরে তখন একটু একটু করে চাঁদের আলো উজ্জ্বল হচ্ছিল। রাজকে দেখা গেল কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে পেটে হাত চেপে ধরে আছে। মনি তাকে ধরে উত্তেজিত হয়ে বললো,
-রাজ, রাজ, কী হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন?’
রাজের হাতটা রক্তাক্ত দেখালো, হাত দিয়ে সে পেটের রক্ত আটকানোর চেষ্টা করছে। রক্ত দেখে একসাথে জোরে চিৎকার করে উঠলো মনি ও চাঁদনি। ভেতর থেকে তখন সবাই বেরিয়ে এসেছে। সবাইকে উত্তেজিত দেখালো। ভাইকে দুহাতে ধরে কেঁদে ফেললো বীথি। রায়হান এসে টর্চের আলো ফেললো রাজের পেটে। আৎকে উঠলো তখন সবাই। রায়হান চিৎকার করে বললো,
-তাড়াতাড়ি ওর রক্ত বন্ধ করতে হবে। একটা কিছু নিয়ে আসো।
-কে করেছে এটা? দেখেছিস ওকে?’ জিজ্ঞেস করলো বড় ফুফু। রায়হান তখন রাস্তার উপর টর্চের আলো ফেলে। আসাদকে পালিয়ে যেতে দেখা গেল। পালিয়ে সে মন্টুর দোকান পর্যন্ত চলে গেছে। সবাই তখন আসাদকে গালমন্দ করতে থাকে।
ভেতর থেকে একটা গামছা আর পানি নিয়ে আসে রেশমা। গামছা দিয়ে রায়হান রাজের ক্ষতস্থানটা ভালোভাবে বাঁধে, তারপর ওকে পানি পান করতে দেয়। আশরাফ সাহেব উঠোনে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে,
-শয়তানটাকে কেউ দেখলে পুলিশে ধরিয়ে দিবে। এখানে আর ওর জায়গা নেই।’
রাজ গামছার উপর থেকে পেট চেপে ধরে দাদুকে বললো,
-দাদু, ওসবের দরকার নেই। তেমন আঘাত হয়নি। একটু করে লেগেছে ছোরাটা। ডাক্তারের কাছে গিয়ে সেলাই আর ব্যান্ডেজ করে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
-চল, আর দেরি না করে এখনই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় তোকে।’ বলেই রায়হান স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললো,
-আমার শার্টটা নিয়ে এসো তো। ওকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।’
রেশমা ভেতরে গেল শার্ট আনতে।
.
.
হাতে একটা পানির গ্লাস নিয়ে রাজের ঘরে ঢুকলো মনি। দেখলো রাজ বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। বাঁহাতটা তার পেটের ব্যান্ডেজের উপর। পাশে বসে চাঁদনি ওষুধ খাওয়াচ্ছে রাজকে। চাঁদনিকে দেখে মনি কৃত্রিম হেসে বললো,
-ও আপনি আছেন? আমি আরও ওষুধ খাওয়াতে এলাম ওকে।’
-আমি খাওয়াই দিচ্ছি। আপনার ভাইটা না একটা ঘাড় ত্যাড়া। ওষুধ খেতে চাচ্ছে না।’
-ওহ, ভালোবাসা দিয়ে খাওয়ান, খাবে নিশ্চয়ই।’ আবারও কৃত্রিম হেসে হাতের গ্লাসটা নিয়ে বের হয়ে গেল মনি। চাঁদনি রাজের মুখে ওষুধ দিয়ে গ্লাসটা মুখের সামনে ধরলো। তারপর বললো,
-কোনো হাসপাতালের ডাক্তার না কিচ্ছু না, ফার্মেসীর ওষুধ বিক্রেতার চিকিৎসায় তুমি ভালো হবে? আমার টেনশন হচ্ছে খুব।
-আরে টেনশন করো না। এরাই গ্রামের ডাক্তার। এদের চিকিৎসায় তো গ্রামের হাজার হাজার লোকের অসুখ ভালো হচ্ছে। আমিও সুস্থ হবো দেখো।’
ফোনটা বেজে উঠে রাজের। ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকায় সে। চাঁদনি আলতো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-কে?’
-বাবা…’
ফোন রিসিভ করে রাজ বলে উঠে,
-হ্যাঁ বাবা, বলো…’
-কী অবস্থা তোর এখন?’ ওপাশ থেকে বাবা জিজ্ঞেস করে।
-ভালো বাবা।
-তোর মা টেনশন করছে তোর জন্য খুব। ধর, তোর মায়ের সাথে কথা বল…’
মায়ের কণ্ঠ শোনা গেল তখন,
-রাজ, কেমন আছিস বাপ এখন?
-ভালো মা। আর টেনশন করো না। আঘাত অতোটা সিরিয়াস না…
-মায়ের মন, টেনশন না করে কি পারি বল?’
এভাবে ফোনে কথা চলতে থাকে ওদের মা ছেলের। চাঁদনি উঠে বাইরে আসে। বীথিকে দেখা গেল হাতে তেলের বোতল আর চিরুনি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। চাঁদনি ওকে ডাক দিলো,
-এই বীথি…’
বীথি চাঁদনির দিকে ফিরে মৃদু হাসলো। চাঁদনি বললো,
-আসো, আমিই তোমাকে তেল মাখিয়ে দিচ্ছি চুলে…’
বীথি ঠোঁটটা আরও প্রসারিত করে। দুজনে গিয়ে উঠোনের একপাশে গাছের ছায়ায় বসে। দখিনা বাতাসে গাছের শো শো আওয়াজ শোনা গেল। দুজনের জামা আর চুল আলতোভাবে উড়তে লাগলো বাতাসে। চাঁদনি বীথির পেছনে বসে ওর মাথায় তেল মাখিয়ে দিতে লাগলো। বীথি হেসে বলে উঠলো,
-এই সময় আমার পাশে না থেকে ভাইয়ার পাশে থাকা উচিত তোমার।’
-তোমার ভাইয়ার পাশে তো সবসময় থাকবো। তার ফাঁকে তো নন্দিনীকেও একটু সময় দিতে হবে। একটাই মাত্র নন্দিনী আমার।’ চাঁদনিও হাসলো। চিরুনি দিয়ে বীথির মাথার চুল আঁচড়ে দিতে লাগলো সে।
♥চব্বিশ♥
ঘুম আসছিল না বলে অনেকক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করলো মনি। বারবার ছোটবেলার কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে তার। সেই যে ছোটবেলায় বর বউ খেলতো রাজের সাথে, রাজ বাহির থেকে আসার মতো করে এসে ‘বউ’ বলে ডাক দিতো, আর সে বের হয়ে লক্ষ্মী বউয়ের মতো রাজের সামনে দাঁড়াতো। দিনগুলো বড় মধুর ছিল। মধুর দিনগুলোই তাড়াতাড়ি স্মৃতি হয়ে যায়। মাঝে মাঝে রাজ ওকে মারতো, মার খেয়ে মনির তখন রাগ হতো। কিন্তু আজকাল বড্ড মিস করে সে রাজের সেই মারগুলো। বারবার মনে হয়, আরেকবার যদি রাজ ওকে মারতো ওভাবে।
ছটফট করতে করতে বিছানা থেকে নামে মনি। রাজ হয়তো এখনও বাইরে বসে আছে। রাজকে একবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব, কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। চাঁদনিরা আসার পর থেকে রাজের সাথে মনির খুব একটা কথা হয়নি। মনি নিজেই দূরে দূরে থাকতো রাজের।
আলতো পা ফেলে শাড়ির আঁচলটা গায়ে পেঁচিয়ে বাইরে আসে মনি। ভরা পূর্ণিমা রাত। আকাশটাও একদম স্বচ্ছ আজ। স্বচ্ছ আলোতে মনি দেখলো রাজ আর চাঁদনি বাইরে বসে গল্প করছে। রাজের কাঁধে মাথা রেখে বসেছে চাঁদনি। মনি আর এগোলো না ওদিকে। কয়েক মুহূর্ত ওখানে দাঁড়িয়ে আবার ফিরে গেল রুমে। একইভাবে বসে থাকলো রাজ আর চাঁদনি। নির্লিপ্ত কণ্ঠে চাঁদনি রাজকে বলে,
-ভাবী বলছে কাল চলে যাবে। অনেকদিন তো বেড়ানো হলো।
-ভাবীর কি আর ভালো লাগছে না এখানে?
-তা না, এখানে কাটানো দিনগুলো আমাদের জীবনে শ্রেষ্ঠ দিন হয়ে থাকবে। আসলে ভাইয়া ফোন করে বলছে চলে যেতে। মাও নাকি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’ রাজের কাঁধ থেকে মাথা তুললো চাঁদনি।
-ওহ্! তাইলে তো চলে যেতে হবে।
-হুমম। আর তুমিও তো প্রায় সুস্থ। তোমার ব্যান্ডেজ খোলার পর যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মা অসুস্থ তাই আর থাকতে পারছি না।’
-আমার জন্য চিন্তা করো না। ব্যান্ডেজ তোলার পর একেবারে সুস্থ হয়ে যাবো।
-ঠিকমতো ওষুধ খাবা কিন্তু।
-তুমি না থাকলে কে ওষুধ খাওয়াবে?’ দুষ্টুমি করলো রাজ।’
কয়েকমুহূর্ত চুপ থেকে চাঁদনি বললো,
-এ বাড়িতে এমন একজন আছে, যে আমার চেয়েও বেশি কেয়ার করে তোমার।’
রাজ বুঝতে পারে চাঁদনি কার কথা বলছে। চাঁদনি আবার বললো,
-মনি আপু আসলেই খুব ভালো মেয়ে। তোমার প্রতি ওর একটা এক্সট্রা কেয়ার আছে, এই কয়দিনে আমি যা লক্ষ করলাম।
-ছোটবেলা থেকেই ও ওরকম। আমার প্রতি ওর টানটা একটু বেশি।
-হুমম, ও হয়তো তোমাকে খুব ভালোবাসতো, বা এখনও ভালোবাসে, তুমি হয়তো বুঝতে পারোনি ওর ভালোবাসা।
-তা ঠিক, আমিই বুঝিনি।
-বুঝলে আর আমার সাথে জড়াতে না, তাই না?’
প্রশ্ন শুনে চাঁদনির দিকে চেয়ে থাকে রাজ।
.
.
ভোর হতে আর দেরি নেই। মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। মনি এতক্ষণে যেন হুশ ফিরে পেল। জানালার পাশে বসে, থুতনিটা জানালায় ঠেকিয়ে এতক্ষণ সে গভীরভাবে ছোটবেলার কথা চিন্তা করছিল। আযানের শব্দ শুনতেই চিন্তায় বাধ পড়লো তার। স্বাভাবিক হয়ে মাথায় ওড়না টেনে দিলো। একটু পর দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল। হয়তো দাদু আর দিদিমা নামাজ পড়তে উঠেছে। সেই ছোটবেলায় নানা আর নানিকে দাদু আর দিদিমা বলে ডাকতো রাজদের দেখাদেখি, সেই ভুলটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে।
টিউবওয়েল চাপার শব্দ শোনা গেল বাইরে। মনিও বের হলো। দেখলো, দিদিমা জগে করে পানি নিয়ে এসে দাদুকে দিছে। আর দাদু উঠোনে বসে জগের পানি দিয়ে ওযু করছে। মনিকে দেখে দিদিমা বললো,
-যা, ওযু করে নে…’
-কে?’ ওযু করতে করতে জিজ্ঞেস করলো দাদু।
-মনি।’ জবাব দিলো দিদিমা।
-ওহ। যা, ওযু করে নামাজ পড়ে নে।’
মনি নীরবে টিউবওয়েলের দিকে এগিয়ে গেল। নিয়মিত নামাজ না পড়লেও মাঝেমাঝে পড়ে সে। এখন থেকে নিয়মিত পড়ার চেষ্টা করবে। টিউবওয়েলে চাপ দিলো মনি। টিউবওয়েলটা যেন করুণ সুরে কেঁদে উঠলো তখন। দূর থেকে আরও কয়েকটা টিউবওয়েলের শব্দ শোনা গেল।
.
.
চলবে….