জীবনের জলছবি
পর্ব ১
ভোর ছটা র ট্রেন টা যখন বাড়ির পাশের রেল লাইন ধরে ছুটে যায়, তখনি খুব রাগ হয় টুসির। একদিনও কি ট্রেন টা লেট করতে পারে না! মা ঘড়ি দেখে না, ট্রেনের আওয়াজ হলেই পাশের ঘরে শুয়ে শুয়েই টুসি কে ডাকতে থাকে, উঠে পড়ার জন্যে। আর ঠিক এই সময় তাই যেনো বড্ড বেশি করে ঘুম পায় টুসির। মায়ের গলা কানে গেলেই টুসি নতুন করে ঘুমিয়ে পড়ার জন্যে তৈরী হয়।
প্রতিদিনের মতোই আজও মায়ের গলা আস্তে থেকে জোরে হতে হতে যখন প্রায় চিৎকারের পর্যায়ে পৌঁছালো, তখন অগত্যা বিছানার মায়া আজকের মতো ত্যাগ করলো টুসি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় সাত টা, আর একটু পরেই অঙ্কের স্যার আসবেন। এই সকাল বেলায় অঙ্কের মতো বিচ্ছিরি একটা সাবজেক্ট পড়তে একটুও ভালো লাগে না। দিনটাই যেনো কেমন গোলমেলে হয়ে যায়। এই গোলমালের রেশ স্কুলের অঙ্ক স্যার কে দেখলে আরও বাড়ে। কিছুতেই একটা অংকও কেনো যেনো মিলতে চায় না শেষ পর্যন্ত।
স্যার পড়িয়ে চলে যাবার পর প্রায় তাড়াহুড়ো করে স্কুলের জন্যে তৈরী হতে লাগলো টুসি। এই ব্যাপারে মায়ের চিৎকারের কোনো প্রয়োজন পড়েনা, স্কুল কামাই করতে ও একটুও ভালোবাসে না। শুধু কোনো রকমে অঙ্কের পিরিয়ড টা কাটিয়ে দিতে পারলেই হলো। একদিন না যাওয়া মানে যে কতো খবর না পাওয়া সেটা কেউ বোঝে না। মা মাঝে মাঝে বলে তুই স্কুলে যেতে যত ভালো বাসিস, ততো মন দিয়ে যদি পড়াশুনা টা করতিস! কিন্তু স্কুলে যে শুধু পড়া শোনাই হয় না ,সেটা মা জানে না। স্কুল আসলে একটা ভীষণ আনন্দের জায়গা।
স্কুল না গেলে তো টুসি কখনও জানতেই পারতো না, যে ক্লাস টেনের মিতা দি কে বনকুল বিক্রি করে যে কাকু, সে ওদের থেকে বেশি কুল দেয়। এটা অবশ্য ওর বন্ধু মামের আবিষ্কার। মাম নাকি বেশ কয়েকবার দেখেছে। বেশ কিছুদিন এটা ওদের ক্লাসের সকলের আলোচনার বিষয় ছিলো। তারপর মিতাদি মাধ্যমিক পাস করে স্কুল ছেড়ে চলে গেলো, কাকু কিন্তু রয়েই গেলো, শুধু মিতাদির বদলে এবারের ক্লাস টেনের রূপাদি সেই জায়গা নিলো।
ওরা এখন বুঝে গেছে, বেশি কুল পেতে গেলে টেনে ওঠা বাধ্যতামূলক, তাই আপাতত সে সুযোগ ওদের নেই। ক্লাস টেন হতে অনেক দেরি আছে।
বাইরে থেকে মাম এর ডাকে মা আসছি বলে দৌড়ে বেরোলো টুসি, এই বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার রাস্তা টুকু ভীষণ আনন্দের। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পাশের বাড়ির কাকিমা কে বাজারের থলি হাতে উঠতে দেখলো টুসি।
আস্তে যা, হাত পা ভাঙবি নাকি!
কাকিমা র ধমকে একটু আস্তে আস্তে নামতে চেষ্টা করলো, এক্ষুনি কাকিমা মা কে গিয়ে বলে দেবে, যদি সত্যি পা ভাঙে, তাহলে মা যা! এক্ষুনি আর একটা পাও ভেঙে রেখে দেবে।
আজ স্কুলের শেষ দিন গরমের ছুটির আগে, এরপর প্রায় একমাস পরে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে, তাই সবাই একটু দুঃখিত। টুসি অবশ্য ভীষণ আনন্দ আছে, কবে থেকে ও দিন গুনছে এই দিন তার জন্যে, এবার ওর মামার বাড়ি যাবার পালা।
মামার বাড়ি এই নামটার মধ্যেই কেমন যেন একটা আবদার লুকিয়ে থাকে। তাই মামার বাড়ি যাবার আকর্ষণ বোধহয় অমোঘ। কিন্তু টুসির কাছে মামার বাড়ির টান কিছুটা অন্য কারণেও। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মেয়েটি সারা বছর শুধু গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটির জন্য অপেক্ষা করে থাকে।
তার অন্যতম বড়ো কারণ তনু। ছোট্ট মফস্বল শহরে থাকা ছেলেটি কে দেখলে বুকের মধ্যে যেনো হাতুড়ি পেটার আওয়াজ হয় তার। ছোট থেকেই মামার বাড়ি যাওয়া তো ছিলই, কিন্তু জানা ছিলনা এই আকর্ষণের কথা। অথচ তনুর বোন ছিলো টুসির অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। কিন্তু তার দাদার দিকে তাকিয়ে দেখার বয়স ছিলনা তখন।
সদ্য ক্লাস এইট এ ওঠা টুসি যখন আগের বার পুজোর ছুটিতে মামার বাড়ি গিয়ে ডাকতে গেলো বন্ধু কে, দরজা খুলে দাঁড়ালো তার দাদা। সদ্য কৈশোর পেরোনো তরুণ টি কে দেখে চমকে উঠলো টুসি। তরুণ টিও নির্বাক। বোনের বান্ধবী কে তো ছোট থেকেই চেনে, কিন্তু এরকম করে তার চোখে তো সে ধরা দেয়নি আগে। দুজনেই একসাথে খানিকটা হলেও অপ্রস্তুত। কয়েক মুহূর্তের দৃষ্টি বিনিময় তারপর দরজা থেকে সরে গেলো তনু।
সরে গেল ঠিকই কিন্তু সারাক্ষন দৃষ্টি রয়ে গেলো টুসির মুখে। টুসি ও বুঝতে পারছিল সবটাই। ঘরের কোনো একটা কোন থেকে একটা চোখ সমানে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই শুরু। ক্রমশঃ বন্ধুর সঙ্গে কমে আসতে লাগলো যোগাযোগ, বরং অনেক বেশি করে দেখা হয়ে যেতে লাগলো তার দাদার সঙ্গে। যখনই যেখানেই যাচ্ছে টুসি, তার দেখা হয়ে যাচ্ছে তনুর সঙ্গে। সে নাকি এদিকেই কোনো দরকারে এসেছিলো।
তখন মোবাইল এর যুগ নয়। ভরসা বলতে পাড়ার মোড়ে তনুর বন্ধুর দোকানের লান্ডলাইন। আর টুসি? সে তো অনেক দূরের এক ছোট্ট শহরের বাসিন্দা। ঠিকানা তো নেওয়া হলো, কিন্তু চি ঠি এলে তো মায়ের হাতেই পড়বে। অতএব শুধু ছুটির অপেক্ষা। সে সময় যোগাযোগ ব্যাবস্থা ছিলনা বলেই বোধহয় মানুষের মধ্যে অনেক বেশি ধৈর্য্য ছিলো। কোনো কিছুই তো আর সহজ লভ্য নয়।
ছুটির দিন গুলো যত এগিয়ে আসতো আনন্দের সঙ্গে চিন্তাও বাড়ত টুসির। যদি দেখা না হয়, যদি অন্য কোথাও চলে যায় ওই সময়, কি হবে তাহলে। কিশোরী মন উদ্বেল হয়ে উঠত তার। বাস থেকে যখন পা দিতো স্টপেজ এ মনে হতো হাত পা কাঁপছে তার। ভগবান কে ডাকা তার মিথ্যে হতনা কোনো দিনও। রিকশা করে যেতে যেতেই দেখতে পেতো তনু দাঁড়িয়ে আছে বন্ধুর দোকানে। একটু খানি একঝলক ওই দেখা যেনো হৃদ স্পন্দন থামিয়ে দিতো টুসির।
তনুর ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা মুচকি হাসি চোখ এড়িয়ে যেতো না। এরপরের দিনগুলো ছবির মত কেটে যেত তার। চলে যাবার কয়েকদিন আগে থেকেই শুধু কান্না পেতো টুসির। তনুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আগেই কান্না চলে আসতো তার। কিশোরী মন বড্ড কষ্ট পেতো, সব কিছু যেনো খালি খালি লাগতো তার।
তনু তখন সদ্য তরুণ। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই, তাই বোধহয় নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতো সে। আর বলতো মাত্র তো চারটে মাস বাকি পুজো আসতে, আবার দেখা হবে তো আমাদের। দুই সদ্য কিশোরী আর সদ্য তরুণের কাছে এই সময় যেনো ভীষণ দ্রুত গতিতে চলে যাওয়া কিছু মুহূর্তে পরিণত হতো, যা তারা থামিয়ে রাখতে চাইতো অনন্ত কালের জন্য।
অবশেষে আবার উপস্থিত সেই সময়, স্কুল থেকে ফিরেই শুধু কল্পনার জাল বুনে চলে টুসি, এখনও পর্যন্ত প্রিয় বন্ধু মাম কেউ কিছু বলে নি ও, মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচ খচ করছে তাই সব সময়। মাম যদি জানতে পারে যে ওকে বলেনি টুসি, ওর সঙ্গে একদম কথাই বন্ধ করে দেবে। এবার ফিরে এসেই জানিয়ে দিতে হবে ওকে, মনে মনে স্থির করে টুসি।
ক্রমশ
ছবি অন্তর্জাল
( এটা আমাদের অনেকেরই মেয়েবেলার গল্প, কেমন লাগলো প্রথম পর্ব, সবার মতামতের আশায় রইলাম ❤️)