জীবনের জলছবি (পর্ব ২)

জীবনের জলছবি
পর্ব ২
ক্রমশ এগিয়ে আসছিল মাধ্যমিক। টুসি এখন ক্লাস টেন এর ছাত্রী। গত দু বছরে অনেক পরিণত হয়েছে সে। তনু এখন তার অনেক কাছের। নিজেদের ভালোলাগা মন্দলাগা গুলো জানা হয়ে গেছে সব। ক্লাস ইলেভেন এ পড়া তনু ও এখন কলেজ পড়ুয়া। এবছর পুজোর ছুটিতে আর মামার বাড়ি যাওয়া হবেনা তার। ছুটি খুললেই টেস্ট।

গরমের ছুটিতে তাই যে করেই হোক যেতেই হবে মামার বাড়ি। মা বললো

এবছর আর যাবই না ঠিক করেছি। একেবারে পরীক্ষার পর যাবো, গিয়ে তিন মাস রেখে আসবো তোকে।

তখন এত পড়াশুনার চাপ ছিলনা। মাধ্যমিক এর পর সবাই রেজাল্ট বেরোনো পর্যন্ত আনন্দই করতো। শুনে খুশি হবে না দুঃখও পাবে বুঝে উঠতে পারেনা টুসি।

সে তো এখনও এক বছর। কি করে কাটাবে সে। মনের ভিতর টা আনচান করতে থাকে। এত কঠিন পরীক্ষা ভগবান। তিন মাস দেওয়ার বদলে এক বছর। মনটা উথাল পাথাল করে ওঠে তার। তনু তো জানেনা টুসি যাবেনা । কি করবে টুসি। কি করে জানাবে ওকে। পড়াশুনা মাথায় ওঠে তার। মায়ের প্রায় পায়ে পড়ে যায় সে।

দুদিন এর জন্য চলো মা, তুমিও তো দেখতে চাও দিদাকে, তাইনা বলো? আমি ফিরে এসে ঠিক ম্যানেজ করে নেবো দেখবে।

দিদা কে দেখতে চাওয়ার কথা তে মায়ের মনটা নরম হয়। মা র কাছে যেতে কোন মেয়ে না ভালোবাসে। বেঁকে বসেন বাবা,

এক বছর মেয়ের জন্য বাপের বাড়ী যাওয়া ছাড়তে পারছো না।
বিরক্ত কণ্ঠ বাবার। মা চুপ করে থাকেন। সত্যিই যদি রেজাল্ট খারাপ হয় মেয়ের, সারাজীবন তো কথা শুনতে হবে তাঁকেই। যে কোনো দোষারোপ তো সারাজীবন তাঁর উপরেই পড়ে এসেছে সব সময়। টুসি বোঝে, মায়ের কোনো হাত নেই এ ব্যাপারে। যা করার বাবাই পারবে। সন্ধ্যে বেলা বাবা অফিস থেকে ফিরলে, ধীর পায়ে বাবার ঘরের দরজায় দাঁড়ায় সে।

বাবা চায়ের কাপ হাতে টিভি চালিয়ে বসেছিলেন। দরজায় দাঁড়ানো টুসির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। মরিয়া টুসি বললো

বাবা প্লিজ একবার মামার বাড়ি ঘুরে আসতে দাও, এসেই খুব পড়ব আমি দেখে নিও। বড্ড বোর হয়ে যাচ্ছি, একবছর ধরে বাড়ির বাইরে না বেরোলে তো আমি পাগল হয়ে যাবো। আর পরীক্ষা তাহলে এমনিতেও ভালো হবে না।

বাবা এবার কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। মা ও ঢুকে এলো এই সময়। বললো

বয়স হয়েছে বাবা, মায়ের, কবে কি হয়ে যায়, ঘুরে আসি একটু।

অবশেষে সম্মতি মিললো বাবার। বিরাট একটা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি যেনো। মনে মনে বললো নিজেকেই, এই সুযোগ যেনো নষ্ট না হয় ঠাকুর, বাবার সামনে যেনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি রেজাল্ট নিয়ে। যাওয়ার দিন যত এগোতে লাগলো, সেই পুরোনো চিন্তাগুলো যেনো নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো ।

যদিও টুসি জানে এখন, তনু কোথাও যাবেনা, অপেক্ষা করে থাকবে তার জন্য, গরমের ছুটির শেষ দিন পর্যন্ত। তবু দুরু দুরু বুক তার। মনের মধ্যে এক আশঙ্কার চোরা স্রোত। অবশেষে ট্রেন সফর, বাস সফর পেরিয়ে আবার সেই চেনা মফস্বল শহর টা র বাস স্টপে এ পা।

স্ট্যান্ড এ নেমেই সেই চেনা নিজের বুকের ধুকপুক নিজেই শুনতে পায় টুসি। রিকশা করে যেতে যেতে তার দু চোখ শুধু খুঁজে চলে তনু কে। কিন্তু না কোথাও নেই সে, এমন কি তার প্রিয় আড্ডাস্থল বন্ধুর দোকানেও না। মনের মধ্যে ভয় বাড়তে থাকে টুসির। তাহলে কি দেখা হবেনা এবার। কোথায় খুঁজে পাবে সে তনু কে।

শেষে এসে গেলো মামার বাড়ি। খুব মন খারাপ নিয়ে ভেতরে ঢোকে টুসি। মা এর উচ্ছলিত মুখের পাশে ওর মন মরা মুখ চোখ এড়ায় না মামীর।

কিরে খুশি হোসনি তুই? মামী জানতে চায়, মা জোর করে ধরে নিয়ে এলো নাকি? কদিন না পড়লে কিছু হবে না, মামী বলে।

মা পাশ থেকে বলে ওঠেন

ওমা, ওই তো জোর করে এলো, ওর বাবা তো আসতেই দিছিলো না এবার।

তাহলে? মামীর প্রশ্ন। তারপর হটাৎ বলে ওঠে কিন্তু তোর তো এবার ভালো কাটবে না রে, তোর বন্ধুর তো খুব বড়ো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, বড়ো হাসপাতাল এ নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কি জানি কি হয় মেয়েটার।

বন্ধু? মানে তনুর বোন? ওহ, এই জন্যই ওকে কোথাও দেখতে পায়নি টুসি। পায়ের নিচের মাটি যেনো কেমন সরে যায় তার। কি হয়েছে?

সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছে, মাথায় খুব বড়ো চোট পেয়েছে, কালই তো নিয়ে গেলো কলকাতায় মামী বলে।

তনু ও কি সঙ্গে গেছে? নাকি এখানেই, মনের মধ্যে উত্তর খুঁজে চলে টুসি। কিশোরী অবুঝ মনে কোনো ভাবে তনুর সঙ্গে দেখা না হওয়ার জন্য কেনো জানিনা বন্ধুর জন্য দুঃখও ছাপিয়ে রাগ জমা হয় কোথাও।

আসলে সব কিছু তো আর বুদ্ধি, যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা থাকেনা এই বয়সে, তাই কোনো সময় ভালোবাসার মানুষকে দেখতে না পাওয়ার অসহায়তা বোধহয় নিজেকে স্বার্থপর করে তোলে। প্রচণ্ড রাগ, অসহায়তা সব মিলিয়ে ক্রমশ কান্নার রূপ নেয় একসময়। খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ চাপে টুসি।
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here