পর্ব ১০ আর ১১ একসঙ্গে
জীবনের জলছবি
পর্ব ১০
গত পনেরো দিন প্রচণ্ড চাপের মধ্যে কাটিয়েছে টুসি। জীবনের প্রথম বাইরের স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দিলো ও। মাধ্যমিক শেষ হলো দুদিন আগেই। রাত্রে শুতে গিয়ে ভেবেছিলো পরের দিন অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠবে। মা কে বলে রেখেছিলো যেনো ওকে ঘুম থেকে না ডাকে।
কিন্তু সেদিনই কেনো জানেনা ওর ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো খুব ভোরে। বলা ভালো সারারাত প্রায় ঘুমই হয়নি ঠিক মতো। ভিতরে ভিতরে কেমন যেনো উত্তেজনা হচ্ছিলো। স্কুল শেষ, তাই হেড স্যার ওদের ডেকে বলেছিলেন একটা পিকনিক এর কথা। মাধ্যমিক ব্যাচের সবাইকে নিয়ে স্কুল পিকনিক, সঙ্গে থাকবেন সব স্যার, দিদিমণি রা। সেই থেকেই ওরা বন্ধুরা সবাই উত্তেজিত।
গতকাল সারাদিন বিভিন্ন রকমের পরিকল্পনা হয়েছিলো ওদের। কে কি সাজবে সেই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো। কয়েকজন দিদিমণি কে ওরা খুব ভয় পায়, একটু সেজে স্কুলে গেলেই রেগে যেতেন তাঁরা। তাই সাজা উচিত হবে কিনা এই নিয়ে ওদের মধ্যে বিতর্ক চলছিলো। অবেশেষে ওরা ভেবেছিলো যে মাধ্যমিক দিয়ে দেওয়া ব্যাচের মেয়েদের নিশ্চয়ই আর বকবেন না দিদিমণি রা।
সকালে স্কুলে গিয়েছিলো পিকনিক এর দিন আর সময় জানতে। মাম আর ও সেজে গুজে, পরনে স্কুল ড্রেস নেই, এ এক অন্যরকম এর স্বাধীনতা। বন্ধুরা সবাই দাঁড়িয়ে ছিল স্কুল গেটের সামনে। ওরা এসেই শুনতে পেয়েছিলো কালই পিকনিক, সবাইকে রেডি হয়ে পৌঁছাতে হবে আটটায় স্কুলে।
সেই মতো আজ আটটার মধ্যে সবাই স্কুলের গেটে পৌঁছে গিয়েছে ওরা। বাস দাঁড়িয়ে আছে, ছেলেদের কেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মালপত্র তোলার জন্যে, তাই মেয়েরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে শুধু। বাস ছাড়লো একটু পরেই।
তার মধ্যেই জানলার ধারে বসা নিয়ে মামের সঙ্গে একটু গন্ডগোল হলো টুসির। মনে মনে একটু রাগ হলেও জানলার দিকের সিট টা মাম কে ছেড়েই দিলো ও। আর তো কটাদিন, তারপরে ওরা সবাই আলাদা হয়ে যাবে, তাই আর ঝগড়া করতে ইচ্ছা হলনা ওর।
বাস চলতে শুরু করেছে, এর মধ্যেই মাম ও বোধহয় বুঝতে পেরেছে কিছুটা, ফেরার সময় জানলা তোর, টুসির কানের কাছে মুখ নিয়ে মিষ্টি হেসে বললো ও। মিটমাট হয়ে গেলো মুহূর্তেই, এইরকম খুনসুটি নিয়েই তো এতগুলো বছর কাটিয়ে এসেছে ওরা দুজনে। সেই ভালোলাগার দিনগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত, রেজাল্ট বেরোলেই যে যার মতো অন্য কোনো শহরে চলে যাবে জানে ওরা, তাই দুজন দুজনের আঙ্গুলগুলো জড়িয়ে ধরে বসে থাকে চুপ করে, মুহূর্ত গুলো কে থামিয়ে রাখতে চেষ্টা করে যেনো।
নদীর ধারে একটা সুন্দর পিকনিক স্পট, সবচেয়ে ভালো লাগে জায়গাটা খুব নিরিবিলি, হুল্লোড়ে মেতে ওঠে ওরা। টুসি আর মাম আলাদা হয়ে যায়, নিজেদের মতো করে উপভোগ করতে থাকে মুহূর্তগুলো। নদীর ধারে একটা পাথরের উপর বসে গল্পো শুরু করে ওরা। হটাৎ করেই ওদের দুজনকে চমকে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় বাপী।
বসে পড়ে ওদের পাশেই। আজ আর লাজুক নয় সে, সোজাসুজি তাকায় টুসির দিকে।
বাইক চালিয়ে এসেছি তোমাদের বাসের পেছনে, তোমার উত্তরের জন্য, উত্তর না নিয়ে ফিরবো না,
শান্ত কণ্ঠে জানায় সে।
মাম আর ও দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। এতদূর চলে এসেছে শুধু আমার জন্যে, এই ভাবনাটা খানিকটা দুর্বল করে তোলে ওকে। হ্যাঁ বা না কোনো কিছুই বলা হয়ে ওঠেনা আর।
নিজের মনের দোলাচলে নিজেই অবাক হয় টুসি, কেনো সোজাসুজি না বলতে পারছে না ও, এই ভাবনা ঘিরে ধরে ওকে। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে উঠে দাঁড়ায় বাপী, মৌন ভাব সম্মতির লক্ষন বলেই ধরে নেয় সে,
হেসে বলে কাল সকালে আসছি তোমার বাড়ির সামনে,
বলেই দ্রুত ওখান থেকে বেরিয়ে যায়। টুসির আচরণে অবাক হয় মাম, কারণ ও জানে তনুর কথা, তাই ওর এই চুপ করে থাকার কোনো কারণ ও খুঁজে পায়না।
কি হলো তোর? না বললি না কেনো ওকে?
প্রশ্ন করে মাম। এই প্রশ্নের উত্তর তো নিজেই খুঁজে পায়না টুসি, শুধু চুপ করে বসে থাকে জলের দিকে তাকিয়ে। ফিরে আসার সময় বাসের জানলায় বসে লাল হয়ে আসা আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের মনকেই ধিক্কার জানায় ও। তনুর মুখ টা ভেসে ওঠে চোখের সামনে, আর নিজেই যেনো নিজের কাছে ছোট হয়ে যেতে থাকে টুসি।
পর্ব ১১
মায়ের শরীরটা একটু খারাপ ছিলো কদিন ধরে, তাই রান্না করছিলো টুসি, ওর যেটুকু ক্ষমতা সেই মতোই। শীলা কাকিমাও তরকারি দিয়ে যাচ্ছিলো প্রতিদিনই। ছাদে কাপড় মেলে দিয়ে গিয়েছিলো কাজের পিসি, সেগুলো আনতে বিকেল বেলায় ছাদে উঠেছিলো ও, দেখলো তপু দা আর কাকিমা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। টুসি একটু অবাক হলো, তপু দা কবে এলো! কাকিমা তো কিছু বলেনি মা কে!
মা কেমন আছে রে আজ?
ওকে দেখেই জানতে চাইলো কাকিমা,
ভালো আছে কাকিমা, তপু দা আসবে বলোনি তো!
কাকিমা যেনো একটু থতমত খেলো টুসির মনে হলো, কাকিমা কিছু উত্তর দেবার আগেই কথাটা যেনো ঘুরিয়ে দিলো তপু দা,
তুই নাকি রান্না করছিস শুনলাম, তোর সেই বিখ্যাত ডিম ভাজা তো?
রাগ হয়ে গেলো টুসির, সেই কবে কোন ছোটবেলায় মা বাড়িতে ছিলো না একবার, কাকিমার সঙ্গে বাজারে গিয়েছিলো, তখন ডিম ভেজেছিল ও। উপর টা পুড়ে গিয়েছিল আর ভেতরটা কাঁচা ছিলো, সেই থেকে ও রান্না করে বললেই তপু দা সেই ডিমের কথা মনে করায়!
নিজেও তো খেয়েছিলে, ফেলে তো দাও নি তখন! তাহলে এতো শোনাও কেনো!
রাগের গলায় বললো টুসি।
ঠিক বলেছিস! আর কখনো ওকে খাওয়াবি না তো!
বলতে বলতে হেসে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো কাকিমা। তপু দা দাঁড়িয়ে ছিলো, তাই টুসিও দাঁড়িয়েই রইলো, আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে ও! তপু দা খুব বাজে, সব সময় পেছনে লাগে ওর। সবে কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে শুরু করতে যাচ্ছিলো টুসি, তপু দার কথায় থমকে গেলো,
আমরা চলে যাচ্ছি টুসি, তোর সঙ্গে আর হয়ত কখনো দেখা হবে না!
কাকুর ট্রান্সফার হয়ে গেছে নাকি! কোথায় যাচ্ছো তোমরা?
হটাৎ করে কেমন যেনো কান্না পাচ্ছিলো টুসির। বাবাদের এই ট্রান্সফারের জন্য কতো বন্ধু যে চলে গেছে ওদের, কতজনের সঙ্গে আর কখনো দেখা হয় নি আজ পর্যন্ত। তপু দাও চলে যাবে! ইস! পেছনে লাগলেও তপু দা আসলে খুব ভালো, সেটা মনে মনে জানে ও।
তপু দারও মন খারাপ টুসি বুঝতে পারছিলো, কাকিমার সামনে মজা করলেও এখন কেমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, টুসির প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না।
চিঠি লিখবে তো তপু দা?
মন খারাপের গলায় জিজ্ঞেস করলো টুসি।
কাকুও তো ট্রান্সফার হয়ে যাবেন শুনলাম, তোরাও তো চলে যাবি, মা বললো। কোন ঠিকানায় চিঠি লিখবো বল?
টুসির মন টা আরো খারাপ হয়ে গেলো, সত্যি তো কোন ঠিকানায় চিঠি লিখবে তপু দা! ওরা তো কেউ কারোর ভবিষ্যতের ঠিকানা জানে না!!
আমি মামার বাড়ি চলে যাচ্ছি তপু দা, তোমরা কবে যাবে? ফিরে এসে আর দেখা হবে না?
কান্না জড়ানো গলায় বললো টুসি, ওর যেনো কেমন এখন আর তনু র কথাও মনে পড়ছে না, খুব মন খারাপ লাগছে তপু দার জন্যে। কে জানে আবার কে আসবে ওই বাড়িটায়, তারা শীলা কাকিমা, তপু দার মতো হবে কি!
কোনো একদিন তোকে নিশ্চয়ই খুঁজে বার করবো টুসি, দেখা তো হবেই
হাসলো তপু দা,
চল নিচে যাই,
দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে ঘরে ঢুকছিলো, তপু দা পেছন থেকে ডাকলো,
শোন, ডিম ভাজা টা খেতে ভালোই ছিলো বুঝলি তো,
বলেই মুচকি হেসে নিজেদের বাড়িতে ঢুকে গেলো তপু দা, টুসির আরও বেশি করে কান্না পেয়ে গেলো!
গত কয়েকদিন যাবৎ গুছিয়েই যাচ্ছে, কম জামা কাপড় তো নয়, এবার তো প্রায় তিন মাস থাকা মামার বাড়িতে। দিন গুলো যেনো ফুরোচ্ছে না আর, মনে মনে ভাবে টুসি।
সেই কবে গিয়েছিলো, প্রায় এক বছর হতে চললো তনুর সঙ্গে দেখা হয়নি, গিয়েও যে খুব ভালো কেটেছিলো তা তো নয়। মনে পড়তেই এক রাশ অভিমান জমা হলো মনে, চোখ ভরে এলো জলে, গিয়ে এবার নিজে থেকে কথাই বলবে না আর এখন থেকেই ভেবে নিলো টুসি।
তনুর ওপর অভিমান হলেই যে কেনো বাপির কথা মনে পড়ে, বোঝেনা ও। সেদিন পিকনিক থেকে ফিরে নিজেরই খুব খারাপ লেগেছিলো, তাই পরের দিন বাপি যখন বাড়ির নীচে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো নিজেকে শক্ত করে বসেছিল ও। এক বারের জন্যও বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়নি।
কিছুটা বোধহয় আন্দাজ করতে পেরেছিলো বাপি, তাই এর পর থেকে টুসির বাড়ির নিচে আর কখনো আসেনি ও। আর একটু হলেও এত সহজে সমস্যার সমাধান করতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বেঁচে ছিলো টুসিও।
মায়ের জন্য মনটা একটু খারাপ লাগছিলো, কোনোদিনও মা কে ছেড়ে এত দিন থাকেনি, এই তো সবে শুরু, মনে মনে ভাবে টুসি। এরপর তো হোস্টেল জীবন শুরু হবে ওর, আর কোনো দিনও বাড়িতে থাকা হবে কিনা কে জানে, বাবার ট্রান্সফার হবার কথা চলছে, যদি হয় তাহলে হয়তো আবার মায়ের কাছে থাকতে পারবে ভাবে ও।
যাইহোক, এখন এই সব ভেবে আগামী তিন মাসের তনুর সঙ্গে থাকার আনন্দ এক চুলও কমতে দিতে চায়না টুসি। গত এক বছরের জমে থাকা কথা, রাগ, অভিমান, ভালোবাসা সব টুকু উজাড় করে দিতে চায় সে। গলার ভিতরে কেমন যেনো একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে তার।
অবশেষে, এসে যায় সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত, ট্রেনে চড়ে বসে মায়ের সঙ্গে টুসি। বাবা তুলে দিয়ে যায় ট্রেনে, তিন মাস বাবাকে দেখতে পাবেনা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে যায় ওর। ইসস, যদি বাবাও সঙ্গে যেতো, কিন্তু সব কিছু যে এক সঙ্গে পাওয়া যায়না বোঝে টুসি। তবু কিশোরী মন তার সব ভালোবাসার মানুষদের এক সঙ্গে পেতে চায়, সবাই কে নিয়ে ভালো থাকতে চায় প্রতি মুহূর্তে, নিখুঁত হোক তার জীবন, প্রতি মুহূর্তে এটাই কামনা থাকে তার।
অদ্ভুত এক দোলাচলে ভুগতে থাকে টুসি, তাই ট্রেন যখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, ক্রমশ সরে সরে যাচ্ছে বাবার মুখ, তখন কেনো জানেনা, হটাৎ করে ট্রেন থেকে নেমে পড়তে ইচ্ছে হয় তার, জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হয় বাবা কে, মনে হয় ফেরত চলে যায় বাবার সঙ্গে।
কোনো কিছুই করা হয়ে ওঠেনা আর, ট্রেন বেরিয়ে যায় প্ল্যাটফর্ম থেকে, বাবা কে দেখতে পাওয়া যায়না আর, জানলায় মাথা রেখে চুপ করে বসে থাকে টুসি, তনু আর বাবার মুখ এক সঙ্গে এসে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়, কাকে বেশি ভালোবাসে বুঝতে পারেনা ও।
ক্রমশ
(কালীপুজো, ভাইফোঁটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, তাই দুদিন পোস্ট করা হয়নি, আজ দুটো পর্ব দিলাম একসঙ্গে। কেমন লাগলো জানাবেন প্লিজ 🙏)