জীবনের জলছবি (পর্ব ১২)

জীবনের জলছবি
পর্ব ১২
আগের বার যা গন্ডগোল হয়েছিলো, এবার নিশ্চয়ই আর কোনো ভুল করবে না তনু, অবশ্যই মিষ্টির দোকানের সামনেই দেখা যাবে তাকে, কারণ তনু জানে গরমের ছুটি শুরু হয়ে গেছে স্কুল গুলোয়। যে কোনো দিন টুসি এসে পড়তে পারে এখন। বাসে বসে বসে এসবই ভাবছিলো টুসি।

কি রে নামবিনা না নাকি, চল তাড়াতাড়ি,

মায়ের কথায় সম্বিত ফিরল ওর। বাস টায় প্রচণ্ড ভিড়, হাতে ধরা লাগেজ নিয়ে কোনো মতে থেকে ঠেলে ঠুলে গেটের দিকে এগোতে চেষ্টা করলো। এক হাতে বাসের হ্যান্ডেল ধরা অন্য হাতে লাগেজ, হিমশিম খাচ্ছিলো ও। বাস টা প্রায় স্ট্যান্ডে ঢুকে এসেছে, এমন সময় পিছন থেকে কেউ ওর কোমরে হাত রাখলো, বুঝতে পারলো ও, কিন্তু সেই মুহূর্তে করার কিছু ছিলোনা।

মেয়েদের অনেক সমস্যা, প্রতিবাদ করতে গেলেই লোকজন ভিড় বাসে ওরকম একটু হয়েই থাকে বলে ঝাঁপিয়ে পড়বে এক্ষুনি। কিন্তু কোনটা ভিড়ে ধাক্কা লাগা আর কোনটা যে ইচ্ছাকৃত, মেয়েদের থেকে আর কেই বা বেশি ভালো বোঝে। টুসি বুঝতে পারছিলো লোকটা ওদের সঙ্গেই নামবে, পেছন ফিরে ঘুরে লোকটার মুখ দেখার মতো জায়গা ও বাস টায় ছিলো না।

অসহ্য রাগে মাথা গরম হয়ে উঠছিলো ক্রমশ। লোকটা পেছন থেকে ওকে প্রায় জড়িয়ে ধরে ওর সঙ্গেই বাস থেকে নামলো। এতক্ষনে লোকটা র মুখ দেখতে পেলো টুসি, একজন মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক, যদিও ভদ্রলোক কে আদৌ ভদ্রলোক বলা উচিত কিনা মনস্থির করে মুশকিল।

টুসি কিছু বলার আগেই পাশ থেকে একজন ভদ্রমহিলা চিৎকার করে উঠলেন,

কি হচ্ছে এটা?

ভদ্রমহিলার চিৎকারে মুহূর্তের মধ্যেই প্রচুর মানুষ জমা হয়ে গেলো ওখানে। লোকটি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলো এবার, কিন্তু জমা ভিড় টা তাকে সেই সুযোগ দিলোনা একটুও। আচমকাই সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা হাত লোকটার চোয়াল লক্ষ্য করে একটা ঘুষি চালালো, টুসি চমকে উঠে তাকিয়ে দেখলো তনু।

এরপর চারদিক থেকে ঘুসির বন্যা চলতে লাগলো প্রায়, অবশেষে কিছু লোক ওর মধ্যে থেকে টেনে বার করে নিয়ে গেলো লোকটা কে, না হলে বোধহয় আজ মরেই যেতো ও। ভীষণ লজ্জা লাগছিলো টুসির, সবাই ওর দিকেই তাকিয়ে, ভদ্রমহিলা ওর ভালো করতে গিয়ে বোধহয় খারাপই করলেন শেষে।

মেয়েদের অনেক জ্বালা, বিশেষ করে এই সব মফস্বল অঞ্চলে যেখানে সবাই সবাই কে চেনে, সেখানে আগামী দিন গুলোতে সবাই ওকে নিয়েই আলোচনা করবে এটাই শুধু মনে হচ্ছিলো ওর।

তনু তার মানে ওর জন্য এবার বাস স্ট্যান্ডেই অপেক্ষা করছিলো, কিন্তু এটা ভেবেও কেনো জানি এবার একটুও খুশি হতে পারছিলো না টুসি। তনুর সামনে ঘটনা টা ঘটে যাওয়ায় আরও খারাপ লাগছিল ওর, কিন্তু এই খারাপ লাগার জন্য নিজেও কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলো না। সব মিলিয়ে এখানে আসার আনন্দ টাই যেনো এক ধাক্কায় অনেক টা কমে গেলো সেটাই মনে হচ্ছিলো ওর।

মনে মনে এক পাশে দাঁড়িয়ে এই সবই ভাবছিলো, হটাৎ ওর হাত থেকে ব্যাগটা টা কেও নিয়ে রিকশায় রাখলো। তাকিয়ে দেখলো মা রিকশায় উঠে বসেছে, আর তনু লাগেজ গুলো রিকশায় তুলে দিচ্ছে। কোনো কথা না বলে তনুর দিকে এক বারও না তাকিয়ে সোজা রিকশায় উঠে বসলো টুসি।

কেনো কে জানে তনুর ওপরই ওর সব চেয়ে বেশি রাগ হচ্ছিলো তখন, লোকটাকে মারতে যাবার দরকার কি ছিলো, না মারলে তো এত কাণ্ড হতো না আর। তনু ওর দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরেও মুখটা অন্য দিকেই ঘুরিয়ে রাখলো ও।

রিকশা টা যখন পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তনু ওর দিকে তাকিয়ে পাঁচটা আঙ্গুল দেখালো আড় চোখে দেখলো টুসি, মন টা একটু ভালো হয়ে গেলো ওর।

টুসির মামাতো দাদা তনুর বন্ধু। সে যে বিষয় টা কিছুটা আঁচ করতে পারছিলো, তার আচরণ থেকেই স্পষ্ট বুঝতে পারছিলো টুসি। দুদিন থেকে মা চলে গেছে আজ সকালে। বিকেলে দাদার সঙ্গে ছাদে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলো ও। এমনিতে হাসিখুশি দাদার গম্ভীর মুখ কিছুটা হলেও অস্বস্তি তৈরি করছিলো টুসির মনে।

দাদা ওর বেশ প্রিয়, নামে দাদা হলেও বন্ধুত্ব গলায় গলায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কিছুতেই সাহস করে দাদাকে আর বলা হয়ে ওঠেনি তনুর কথা টা। তার জন্য মাঝে মাঝেই নিজের খুব খারাপ লাগে, কিন্তু এই না বলতে পারাটা, বলা ভালো না বলতে চাওয়া টার জন্য আসলে দায়ী কিন্তু তনুই।

ও কোনো দিনই চায়নি ওর বন্ধু এটা জানুক, তাহলে নাকি আস্তে আস্তে সব বন্ধুরাই জেনে যাবে। কথা টা যে খুব ভুল নয় সেটা বোঝে টুসিও, তাই প্রায় গত দু বছর ধরে তৈরি হওয়া সম্পর্কটার সম্বন্ধে দাদা কে কিছুই বলে উঠতে পারেনি আজও। দাদা কি কিছু জানে, নাকি অন্য কোনো কারণে গম্ভীর সে, মনে মনে এসবই ভাবছিলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

চমক ভাঙলো দাদার কথায়,

একটা হেল্প করতে পারবি?

দাদার গম্ভীর মুখে হাসি দেখতে চাওয়া টুসি বিনা দ্বিধায় হ্যাঁ বলে দেয় মুহূর্তে।

আমার একটা মেয়েকে ভালো লাগে, বলে উঠতে পারছিনা কিছুতেই, একটু হেল্প করনা প্লিজ।

উফফ্! কি শান্তি, ভেতর টা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে টুসির। যাক বাবা, তাহলে ও যা ভেবেছিলো তা নয়, দাদার গম্ভীর মুখের কারণ অন্য জায়গায়।

আরে বলনা কে সে, এক্ষুনি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি,

মুখে বললেও মনে মনে মামী জানতে পারলে কি হবে ভেবেই কেমন মুখটা শুকিয়ে গেলো টুসির। কিন্তু এখন আর ফেরার কোনো পথ নেই। আগেই তির ছুঁড়ে ফেলেছে ও।

তনু কে চিনিস তো তুই আমার বন্ধু, ওরই মাসতুতো বোন সৌমী, এখন থেকে ঘন্টা খানেক লাগে ওর বাড়ি, আমাদের কলেজেই পড়ে। সমস্যা কোথায় জানিস তো তনুর প্রবল আপত্তি এতে, আরে আমার কাকে ভালো লাগবে ও ঠিক করবে নাকি? আর তাছাড়া আমি জানি সৌমীর ও আমাকে পছন্দ, কিন্তু ও সব ব্যাপারেই মাথা ঘামায় বড্ড,

এক নিশ্বাসে বলতে থাকে দাদা। সর্বনাশ! এবার কি হবে? এতো হেল্প করতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনলো মনে মনে ভাবে টুসি। আর তনুর ই বা সব বিষয়ে মাথা ঘামাবার যে কি দরকার বুঝে পায়না ও। সেদিনই যেমন বাস স্ট্যান্ডে অহেতুক লোকটাকে মারতে গিয়ে সবার সামনে যে আসলে ও টুসিকে ই লজ্জায় ফেললো সেটা একটুও বুঝলো না।

সেদিন তনুর হাতের তোলা পাঁচ আঙ্গুল দেখে ঠিক পাঁচটায় গিয়েই নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছেছিল টুসি। কিন্তু গিয়েই এই নিয়ে ঝগড়া হয়ে গেলো এক প্রস্থ, রাগ করে বাড়ি চলে এসেছিলো ও, তনু ও একটুও রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করেনি কারণ দুজনেই জানে এখন তিন মাস সময় আছে তাদের কাছে।

এই রাগ, অভিমানের খেলা এমনিতে বেশি দিন চালানোর সময় ওদের হাতে থাকেনা অন্য সময়, কিন্তু এবারের ব্যাপারটা অন্যরকম, তাই এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হওয়া ঝগড়াগুলোর রেশ ও দুজনেই ধরে রাখতে চাইছিল, বেশ অন্যরকম একটা ভালোলাগা ও লুকিয়ে থাকে তাতে। যা হয় হোক, দরকার হলে তনুর সঙ্গে ঝগড়া করে ও দাদার পাশে দাঁড়াবে, মনে মনে ভেবে নেয় টুসি।
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here