জীবনের জলছবি (পর্ব ১৪)

জীবনের জলছবি
পর্ব ১৪
ইলেভেনের রেজাল্ট বেরিয়ে টুয়েলভে উঠলো টুসি। গত এক বছর যাবৎ যা চাপ চলছে, কোনো দিকে তাকানোর সময়ই পাচ্ছেনা। আগামী আরও একটা বছর এইরকমই চলবে জানে ও।

শিলিগুড়ির নতুন স্কুলে অনেক বন্ধু হয়েছে,কিন্তু মাম এর মত নয় তারা। তবুও খুব খারাপ লাগেনা ওর, আসলে এই বয়সে বন্ধুত্ব হয় খুব তাড়াতাড়ি। আর সবাই যেহেতু বিভিন্ন স্কুল থেকেই এসেছে, তাই কোনো গ্রুপ নেই এখানে, সবাই সবার বন্ধু, এটাই ভালো লাগে টুসির।

শহর টা খুব সুন্দর, একদম ছবির মত। দূর থেকে পাহাড় গুলো দেখতে খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে রাত্রে বেলা ওদের বাড়ির ছাদ থেকে দেখা যায়, আলো জ্বলছে পাহাড়ের শহরগুলোয়। কোনটা দার্জিলিং, কোন টা কর্শিয়াং আলো দেখেই ফারাক করতে পারে ওরা। সব চেয়ে মজা হয় যখন বৃষ্টি আসে। দূরে পাহাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে এখান থেকেই বুঝতে পারে ওরা।

মা তখন চিৎকার করে,

ছাদ থেকে জামা কাপড় তুলে নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি,

টুসি জামা কাপড় তুলতে তুলতেই বৃষ্টি গুলো এসে পড়ে ওদের ছাদে।

বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার সময়, বেশ একটা মজার ব্যাপার হয় প্রতিদিন, ওই সময় টয় ট্রেন টা দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পর্যন্ত যায়, ওরা ওটায় চড়ে বসে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে যায়। ওখানে নেমে রিকশা নেয় সবাই। যেহেতু স্কুলের ড্রেস পরেই ওরা ওঠে, চেকার কাকু কিছু বলেন না ওদের, উল্টে হেসে পেছনের দিকের খালি সিট গুলো দেখিয়ে দেন।

আজ স্কুলে ঢুকেই শুনলো একজন প্রাক্তন স্যার মারা গেছেন, তাই স্কুল আজ ছুটি। কিছুই করার নেই তাই দল বেঁধেই ফিরছিলো ওরা। ওদের সঙ্গে পড়ে ঋজু, ওর বাবা গুলমা টি এস্টেটের ম্যানেজার, হটাৎ করে বললো

যাবি নাকি আমাদের বাড়ি, কোনো দিন চা বাগান দেখেছিস? চল আজ তোদের দেখাবো।

এতদিন শুধু ঋজুর কাছে চা বাগানে হাতি আর লেপার্ড বেরোনোর গল্পই শুনে এসেছে ওরা, নিজের চোখে চা বাগান দেখেনি অনেকেই, বিশেষ করে টুসি তো নয়ই, তাই হুজুগে পড়ে, যাদের ইচ্ছা ছিলনা তারাও রাজি হয়ে গেলো শেষে। কারোর মা তো আর জানেনা স্কুল ছুটি, তাই ওরা চারজন দল বেঁধে ছুটির সময় হিসাব করে ফিরে আসবে ঠিক করে নিয়ে ঋজুর সঙ্গে বাসে উঠে পড়ল।

বাস টা ওদের টি এস্টেটের গেটে নামিয়ে দিল। ঋজু ওখানের অফিস থেকে ফোন করলো বাবার অফিসে। গেট থেকে চা বাগানের মূল অফিসের দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার, প্রতিদিন ঋজুর জন্য গেটে এসে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ি, সেটাই নিয়ে যায় ওকে ওদের কোয়ার্টার পর্যন্ত, আজ আগেই ছুটি হয়েছে, তাই গাড়ি আসেনি, ঋজুর ফোনে ওর বাবা গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। ওরা সবাই মিলে চেপে বসলো, গাড়িটা চা বাগানের মধ্যে দিয়ে কালো পিচের রাস্তা চিরে এগিয়ে যাচ্ছিলো। দুধারে সবুজ পাতায় ঘেরা যতদূর চোখ যায় শুধু চা গাছের সারি, মুগ্ধ হচ্ছিলো টুসি।

ইসস, না এলে যা মিস করতাম না

বলেই ফেললো ও ঋজু কে।

আরে দাঁড়া,আরও কত কি দেখাবো তোদের, চা পাতা কি ভাবে তৈরি হয় দেখেছিস কোনো দিনও, চল আজ দেখাই তোদের,

বলছিলো ঋজু। ওদের বাড়ি পৌঁছানোর পর কাকিমা ও খুব খুশি হলেন, কাকু বললেন বিকেল বেলা গাড়ি ওদের শিলিগুড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবে, কাকিমার হাতের লুচি খেয়ে বাগান দেখতে বেরোলো ওরা।

সারাদিন আনন্দ করার পর তিনটে নাগাদ ওরা ঠিক করলো এবার ফিরে যাবে, কারণ বাড়িতে ঠিক সময়ে না পৌঁছালে সবার মা ই চিন্তা করবেন। ঋজু গাড়ির জন্য ফোন করতে গেলো, ফিরে এসে বললো,

গাড়িটা একজন কে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে আনতে গেছে, ফিরে এলেই তোরা বেরিয়ে পড়বি।

ওরা ক্রমশ চিন্তায় পড়ছিলো, সন্ধ্যে হয়ে আসছে, গাড়ি ফিরছে না, ঋজুর বাবার অফিসে ফোন থাকলেও ওদের কারুর বাড়িতে ফোন নেই, কি করে বাড়িতে খবর দেবে বুঝতে পারছিলো না। এবার টুসির কান্না পাচ্ছিলো, মনে মনে মায়ের ভয় পেয়ে যাওয়া মুখটা যেনো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল ও।

বাবা নিশ্চয়ই এতক্ষনে অফিস থেকে ফিরে এসেছেন, মা কান্না কাটি শুরু করেছেন নিশ্চয়ই, কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিলো না ওরা। অথচ কাকুর ও কিছু করার নেই, উনি সমানে অফিসে ফোন করে যাচ্ছেন, গাড়ি এখনও ফেরেনি।

রাত প্রায় আটটা, গাড়িটা ফিরলো অবশেষে, ওদের বাড়িতে ওরা যে কতটা বিপদে পড়বে ঋজুর বাবাও বুঝতে পারছিলেন সেটা, তাই ওদের সঙ্গে গাড়িতে ঋজু কে নিয়ে চড়ে বসলেন উনিও। ওদের প্রত্যেকের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে সবার বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন কাকু, প্রায় সব বাড়িতেই একই অবস্থা, কারুর ছেলে মেয়েরাই স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেনি আজ, উদ্বিগ্ন বাবা মা দের শান্ত করে আবার পরের জনের বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল গাড়ি টা।

টুসি দেখলো ওদের বাড়ির সামনে একটা ছোট খাটো ভিড় জমে গেছে, থানায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাবা, খুব লজ্জা লাগছিলো ওর। যাইহোক কাকুর কথা শুনে অবশেষে শান্ত হলেন বাবা, ভিড় টা খালি হয়ে গেলো, কাকু আর ঋজু চলে যাবার পর ঘরে ঢুকে এলো টুসি।

এতকাল শুধু মায়ের কাছেই বকুনি বা মার খেয়েছে টুসি, বাবা কোনোদিনও কিছু বলেন নি, বরং প্রশ্রয় দিয়েই এসেছেন সব সময়, তাই মা কে নিয়েই ভয় পাচ্ছিলো ও। মা কি করবে ভেবে বুকের ভেতর টা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছিলো ওর।

আজ কিন্তু অন্যরকম হলো, মা কিছু বলার আগেই দরজা বন্ধ করে সামনে দাঁড়ালেন বাবা। টুসি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর গালে সজোরে এসে পড়লো একটা চড়, মাথাটা ঘুরে গেল একটু, টাল সামলে দাঁড়ানোর আগেই বাবা ঠান্ডা গলায় বললেন,

আগামী ভবিষ্যতে যখন তুমি এই ধরনের কোনো কাজ বাড়িতে না জানিয়ে করার কথা ভাববে তখন এই চড় টার কথা মনে করবে।

দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন বাবা, আর ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে খাটে বসে পড়লো টুসি। জীবনে প্রথম বার বাবার হাতের চড় টা এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিলো ওর কাছে, যে সারা জীবনেও ভুলতে পারবেনা বুঝতে পারছিলো ও।
ক্রমশ
(একটু ব্যস্ততার মধ্যে আছি, তাই পর্বগুলো একটু অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছে, আশা করছি এবার আর সমস্যা হবে না। নতুন জায়গায় নতুন জীবন শুরু হলো টুসির, আজকের পর্ব কেমন লাগলো জানাবেন কিন্তু🙏)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here