জীবনের জলছবি (পর্ব ১৬)

টুসি এতো বছর পর তপু কে দেখে একদম অবাক হয়ে গেলো, কতো বছর পর তপু দার সঙ্গে দেখা হলো! তিন বছর নাকি চার! মনে মনে হিসেব করছিলো ও। সেই মাধ্যমিকের পরে মামার বাড়ি থেকে ফিরে এসে আর দেখা হয়নি তপু দাদের সঙ্গে। শিলিগুড়ি তে চলে আসার আগে দু একবার কাকুর কাছ থেকে তপু দার মামার বাড়ির ঠিকানা চাইবে বলে ভেবেছিলো ও, কিন্তু কাকুর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি আর।

গত বছর চারেক ধরেও কোনোদিনও তো দেখা হয়নি, এই রাস্তা দিয়েই তো প্রতিদিন যাতায়াত করে ও! আজ যদি ঘটনা টা না ঘটতো তাহলে আর কখনো দেখা হোতই না বোধহয়। টুসি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো,

কেমন আছিস? কি পড়ছিস এখন?

টুসি চমকে উঠে তাকালো, তপু দা কতো পাল্টে গেছে, গলাটাও আর আগের মতো নেই। কি রকম যেনো অচেনা লাগছে এই তপু দা কে, টুসির খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্নগুলোর জবাব দিলো ও।

সঙ্গে আসা লোকগুলো একে একে চলে যাচ্ছিলো এবার, টুসি কি করবে বুঝতে পারছিলো না, ওর কি তপু দার সঙ্গে কথা বলার জন্যে দাঁড়ানো উচিৎ, নাকি তপু দা কাজের সময় কথা বলতে গেলে বিরক্ত হবে!

কাকিমা কেমন আছে?

একটু দ্বিধা নিয়েই জিজ্ঞেস করলো টুসি, এই ডাক্তার তপুর সঙ্গে কলেজ পড়ুয়া তপু কে মেলাতে পারছিলো না ও। সেই তপু দা ওর অনেক কাছের ছিলো, যার সঙ্গে কথায় কথায় ঝগড়া করতো টুসি।

ভালো আছে, তুই কোথায় যাচ্ছিস?

টুসি কে জিজ্ঞেস করলো তপু।

কলেজে যাচ্ছিলাম, আসি এখন, তুমি কাজ করো,

বলেই বেরোনোর জন্যে পা বাড়ালো টুসি, তপু ওকে আটকালো,

এইভাবে কলেজে যাবি তুই, আজ আর কোথাও যেতে হবেনা, এখানে চুপ করে বসে থাক আধ ঘন্টা, আমার ডিউটি শেষ হয়ে যাবে তার মধ্যেই, পেছনেই কোয়ার্টার, নিয়ে যাবো তোকে, মা খুব খুশি হবে,

এবার বেশ গম্ভীর গলায় বললো তপু। বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়ে পড়লো টুসি। হাতের কেটে যাওয়া জায়গাটাও ব্যথা করছে বেশ, এমনিতেও ও আর কলেজে যেতনা, বাড়িতে ফিরে যেতো এখন। শুধু তপু দা কে এমনই কলেজ যাবার কথা বলেছিলো তখন।একটা চেয়ার ওর দিকে এগিয়ে দিল তপু, টুসি চুপ করে বসে পড়লো। তপু নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল এরপর।

টুসির খুব লজ্জা লাগছিলো, বসে বসে পুরনো কথাগুলো মনে পড়ছিলো সব। ইসস কি বোকা ছিলো ও তখন, কিভাবে কাকুর সব কথা তপু দা কে বলে দিয়েছিলো, এখন এই বয়সে এসে নিজের বলা কথাগুলো যেনো ওকেই লজ্জা দিচ্ছিলো কোথাও, কিছুতেই তপু দার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলনা। কতো ছেলে মানুষ ছিলো ও তখন!

কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওর সঙ্গে কথা বলছিলো তপু, বাবা, মা কেমন আছে জানতে চাইলো। টুসি ভয় পাচ্ছিলো একটু, যদি পুরনো কথা তোলে তপু দা। কিন্তু ও কি ভুলেই গেছে সব কিছু, একবারও টুসি কে লজ্জায় ফেলার মতো কোনো প্রসঙ্গই টানছে না, ধীরে ধীরে সহজ হচ্ছিলো টুসি।

ডিউটি শেষ করে ওকে নিয়ে কোয়ার্টারে এলো তপু দা, কাকিমা কে চিৎকার করে ডাকলো,

দেখো মা কাকে নিয়ে এসেছি।

দরজা খুলে বেরিয়ে টুসিকে দেখে একদম চমকে গেলেন কাকিমা।

ওমা! তুই! কেমন আছিস, আমি তো ভাবতেই পারছিনা তোকে আবার দেখবো কোনোদিনও। কোথায় দেখা হলো রে,

তপু দার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন।

আর বোলো না, বাসের তলায় পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে, আবার এই অবস্থায় কলেজে যেতে চাইছিলো, তাই তোমার কাছে ধরে নিয়ে এলাম।

হেসে বললো তপু,

কি কাণ্ড! শিগগির ভেতরে আয়, টুসির হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেলেন কাকিমা।

তপু দা কাকিমা কে সেদিন অন্তত কিছু জানায়নি, সেটা কাকিমার এক্সপ্রেশন দেখেই বুঝতে পারছিলো ও, না হলে এত সহজ ভাবে ওকে নিতে পারতেন না তিনি। আস্তে আস্তে তপু দার ওপর শ্রদ্ধা তৈরি হচ্ছিলো টুসির।

মনে মনে কোথাও যেনো একটা ভালোলাগা ও তৈরি হচ্ছিলো, অন্য কেউ হলে এই সুযোগে ওকে কত ছোট করতে পারতো সবার সামনে, কিন্তু তপু দা এত বছরেও কাউকে জানায়নি, এটা ভেবেই অদ্ভুত একটা কৃতজ্ঞতা বোধ আসছিলো।

কাকিমা কিছুতেই ছাড়লেন না, দুপুরে খেয়ে যেতেই হবে বলে আটকে রাখলেন ওকে। টুসির মনে পড়ছিল এমন কতদিন গিয়েছে, স্কুল থেকে ফিরে মা বাজারে গিয়েছে শুনে কাকিমার কাছে বাড়ির চাবি নিতে গিয়ে ভাত খেয়ে বাড়ি ফিরেছে। সেই সব দিন গুলো কত সুন্দর ছিলো, আজ এত বছর পরে কাকিমা কে দেখে সেই ছোট্ট শহরের সুন্দর সুন্দর স্মৃতিগুলো নতুন করে ফিরে ফিরে আসছিলো যেনো। সেই স্কুল বাড়িটা, ওদের বাড়ি, খেলার মাঠ, মাম সব কিছুই টুসিকে সেই ফেলে আসা দিনগুলোয় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো নতুন করে।

সারাদিন ধরে কাকিমার সঙ্গে গল্প করে বিকেলের দিকে বেরোলো টুসি। তপু দা দের ফোন আছে কোয়ার্টারে, নম্বর টা মা কে দিতে বললো কাকিমা,

এরপরের দিন মা কে নিয়ে আসবি কিন্তু,

বার বার করে বলে দিলো কাকিমা। মা ও খুব খুশি হবে জানেই ও, একসময় মা আর কাকিমা সারাদিন এক সঙ্গে কাটাতো, কি যে বোকামি করে ফেলেছিল টুসি, ওর জন্যই একটা সম্পর্ক নষ্টই হয়ে গেলো বোধহয়। ও যদি মা কে না বলতো এত কিছু তো হতনা আজ।

কাকুর কথা লজ্জায় কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলনা আর, কাকিমা বা তপু দা ও কেউ এই বিষয়ে একটা কথাও বললো না। কিন্তু কাকিমার মাথায় সিঁদুরের দাগ দেখতে পেলো ও। ওকে একা ছাড়লেন না কাকিমা,

একদম বাসে তুলে দিয়ে তবে আসবি,

তপু দা কে বললেন। তপু দা ওকে কিছু ওষুধ পত্র বুঝিয়ে দিলো আর বললো

দরকার পড়লে ফোন করতে ভুলবি না কিন্তু।

রাস্তায় বেরিয়ে একসাথে হাঁটছিলো দুজনে,

কি ভাবিস এত রাস্তা পার হবার সময়, এখনও ওই রকম লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটিস নাকি!

হেসে জিজ্ঞেস করলো তপু দা। এই তপু দা কে টুসির চেনা লাগছিলো, এবার সেই পুরোনো তপু কে ফিরে পাচ্ছিলো ও। মুচকি হাসলো টুসি,

আরে ভাবছিলাম বলেই তো এত কিছু হলো, আর তোমাদের সঙ্গে দেখা হলো,

প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলে উঠলো ও।

তা ঠিক, এত বছর পরে তোকে দেখবো ভাবিনি, খুব চমকে গিয়েছিলাম, প্রায় বছর চারেক হতে চললো তাইনা?

হ্যাঁ, অথচ এতো বছরে একবারও তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি বলো!

আমি তো ছিলাম না এখানে, মা এখানে এসে আগে মামার বাড়িতে ছিলো, তারপর আমি জাস্ট মাস ছয়েক হলো এখানে জয়েন করে মা কে কোয়ার্টারে নিয়ে এসেছি,

টুসির কথার উত্তরে নিজে থেকেই বললো তপু দা। তারমানে কাকু ওদের সঙ্গে থাকেনা, তপু দার কিছু বলা আর কিছু না বলা কথাগুলো নিজেই বুঝতে পারছিল ও।

বিয়ে করোনি তুমি?

হটাৎ করে জিজ্ঞেস করলো টুসি। কেমন একটু চমকে উঠে তাকালো তপু দা, তারপর বললো
নাহ!,
কেনো?

আর কোনো উত্তর দিলো না তপু দা, টুসি ও আর বেশি কিছু জানতে চাইলো না, এত বছর পরে প্রথম দিনই সব কিছু জানতে চাওয়া উচিৎ নয়, আস্তে আস্তে সবটাই জানা যাবে, মনে মনে ভেবে নিলো ও। ওকে বাসে তুলে দিয়ে নেমে গেলো তপু দা, জানলা দিয়ে হাত নাড়লো টুসি।
ক্রমশ
( এবারের পর্ব গুলো নতুন, আগের গল্পে ছিলো না। গল্পের শেষ টা একই আছে, কিন্তু মাঝের পর্বগুলো অনেকটাই আলাদা, যাঁরা আগে পড়েছিলেন, তাঁরা হয়ত মনে করতে পারবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here