জীবনের জলছবি
পর্ব ১৭
ক্রিসমাসের ছুটি শুরু হয়ে গেছে কলেজে। প্রবল ঠান্ডায় জমতে জমতে ভোর বেলা টিউশন যাচ্ছিলো টুসি। গত কাল বাবাদের অফিস ক্লাবে ক্রিসমাসের পার্টি ছিলো, এই পার্টি গুলো ওর একটুও পছন্দ নয়, বড্ড বেশি আর্টিফিসিয়াল যেনো।
কয়েকদিন ধরেই যাবে না বলে জেদ ধরে বসেছিলো ও, কিন্তু মা শুনলো না কিছুতেই। ও নাকি বড্ড বেশি অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে বলছিলো মা। অগত্যা যেতেই হলো। ওখানে গিয়ে যথারীতি শুধু শাড়ী আর গয়নার গল্প শুনে শুনে ক্লান্ত টুসি একটা সাইডে গিয়ে চুপ করে বসেছিলো।
মন টা খুব খারাপ হয়ে ছিলো, সেই তপু দা দের বাড়ি থেকে ফেরার পরও প্রায় দিন পনেরো কেটে গিয়েছে, তনু কোনো যোগাযোগ করেনি। তার ওপর ছুটি বলে সোমার সঙ্গেও দেখা হচ্ছে না আর, কি করা যায় ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনস্ক ছিলো ও।
তুমি বোস বাবুর মেয়ে না?
প্রশ্ন টা শুনে একটু অবাক হয়ে তাকালো, সামনে দাঁড়িয়ে একজন প্রায় মায়ের বয়সী ভদ্রমহিলা। আস্তে ঘাড়টা নাড়লো ও।
মা কোথায়? মা কে একটু ডেকে দাও তো,
প্রশ্ন শুনে এদিক ওদিক তাকিয়ে মা কে ডেকে দিলো ও।
এই তো আপনাকেই তো চাইছিলাম
বলে টুসি কে ছেড়ে হাসি মুখে মায়ের দিকে এগিয়ে গেলেন মহিলা, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ও। কিন্তু বিপদ যে একটুও কাটেনি সেটা বাড়িতে ফিরে বুঝলো, যখন মা বললেন ভদ্রমহিলা নাকি তাঁর ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ের সম্বন্ধ করতে চেয়েছেন। মাথায় বজ্রাঘাত হলো ওর। সর্বনাশ! এবার কি করণীয় কিছুই বুঝতে পারছিলো না।
সারা রাত প্রায় জেগেই কাটিয়ে আজ ভোর বেলায় পড়তে বেরিয়ে পড়েছে। টিউশন এ ঢুকে গোমড়া মুখে চুপ করে বসেছিলো ও। দিয়া বললো
কি রে সকাল বেলায় এই রকম একটা পাঁচের মতো মুখ বানিয়ে বসে আছিস কেনো?
টুসি কিছু বলার আগেই দেবু বললো
আরে ওর প্রেমিক ওকে ছেড়ে চলে গেছে রে,
কথা টা সবাই মজা হিসাবে নিলেও টুসি কিন্তু আরও গম্ভীর হয়ে গেলো। প্রায় কেঁদে ফেলছিল আর একটু হলেই, নেহাত ও অন্য কারোর সামনে কাঁদতে পারে না তাই নিজেকে সংযত করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ওর মুখ দেখে শেষে দেবুর নিজেরই খারাপ লাগলো,
আরে আমি জাস্ট মজা করছিলাম রে, তুই তো সিরিয়াস হয়ে গেলি, সরি কিছু মনে করিস না।
টুসি কি করে বোঝাবে যে ও এখন নিজেও কোনো কোনো সময় এটাই ভেবে ফেলছে মাঝে মাঝে। তনুর ফোন না করার কোনো কারণ যে নিজেও খুঁজে পাচ্ছে না ও।
ওর মুখ দেখে বন্ধুরা বোধ হয় আন্দাজ করলো কিছুটা। সবাই মিলে ঘিরে ধরে জানতে চাইছিলো ওরা। বলবো কি বলবো না ভাবতে ভাবতে শেষে বলেই ফেললো টুসি। দেবুই কিন্তু বুদ্ধি টা দিলো শেষ পর্যন্ত।
এটা আবার একটা সমস্যা নাকি, কি ক্যাবলা রে তুই, নিজেই একটা ফোন করে দ্যাখনা, তনু না থাকলেই বা কি, ওর বন্ধুর দোকান টা তো আর উঠে যায়নি, যত্তসব, এই মেয়েদের ন্যাকা কান্না দেখলেই বিরক্ত লাগে আমার।
যদিও বড্ড বাজে ভাবে বললো দেবু, তাও এত সহজ একটা সমাধান পেয়ে ওকে মনে মনে রাগ হলেও ক্ষমা করে দিলো টুসি। আর সত্যিই তো নিজেকে ক্যাবলাই লাগছিলো ওর, একটুও মাথায় আসেনি এটা, ও তো একটা ফোন করে নিতেই পারে তা না করে বোকার মতো তনু র ফোনের অপেক্ষায় বসে ছিল। আজই টিউশন থেকে বেরিয়েই ফোন করবে ও, না হলে যেহেতু কলেজ নেই এখন তাই অন্য কোনো অজুহাত দিয়ে বেরোনো যাবেনা বাড়ি থেকে কোনো মতেই।
উত্তেজনায় ঠিক ভাবে পড়ায় মন দিতে পারছিলো না আর, স্যার কি বোঝাচ্ছেন প্রায় মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। কোনো মতে পড়া শেষ করে বেরিয়েই বুথে গিয়ে দাঁড়ালো, ওপারে বেজে যাওয়া প্রত্যেকটা রিংয়ের আওয়াজ যেনো ওর হৃদস্পন্দন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। অবশেষে ফোন টা তুললো কেউ, ও প্রান্তে হ্যালো, শুনেই উদগ্রীব হয়ে বললো
তনুর খবর জানো কিছু?
উল্টো দিক থেকে উত্তর এলো
কেনো কি হয়েছে? শুনিনি তো কিছু! কিছু হয়েছে নাকি!
না না কিছু হয়নি। ওর ব্যাঙ্গালোরে যাবার কথা ছিলো, ও কবে গিয়েছে জানো তুমি?
ছেলেটা কেমন যেনো অবাক হয়ে গেলো,
ব্যাঙ্গালোরে? তাই নাকি! জানিনা তো!
মানে? যায়নি তনু? ওকি মিথ্যে কথা বললো!
নিজের বিস্ময় চেপে টুসি খুব ধীর গলায় প্রশ্ন করলো,
ও কি ওখানেই আছে?
না এখানে নেই, তবে তুমি কথা বলতে চাইলে ডেকে দিচ্ছি, আধ ঘন্টা পরে করো, ডাকবো?
ছেলেটা বললো।
না কোনো দরকার নেই আর
বলে ফোন টা রেখে দিল টুসি। রাগ, দুঃখ, কষ্ট সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল, বাড়ি টা অনেক দূরে মনে হচ্ছিল, অত টা পথ হেঁটে ফিরতে পারবে কিনা বুঝে উঠতে পারছিলো না আর।
কোনো রকমে প্রায় টলতে টলতে একটা রিকশা কে হাত বাড়িয়ে ডাকলো। হেঁটে বাড়ি যাবার ক্ষমতা হারিয়েছে ও। দল বেঁধে বাড়ি ফিরছে বন্ধুরা,
কিরে কথা হলো?
ওকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো কেউ, কোন উত্তর না দিয়ে রিকশা করে বাড়ি ফিরে এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল টুসি। তনু যায়নি, এই কথাটা অবাক করছিলো, তাহলে ফোন করলো না কেনো, না যাওয়ার কারণই বা কি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না ও।
যেদিন শেষ কথা হয়েছিলো, সেদিন ওকে এতো কথা বলেছিলো, তাহলে কি এমন হলো যে ও গেলনা ভেবে পাচ্ছিলো না কিছুতেই। ওকি সব কথাই মিথ্যে বলেছে টুসি কে, কিন্তু কেন এমন করবে ও! টুসি কিছুই মেলাতে পারছিলো না।আর কোনো দিনও কথা বলবে না ওর সঙ্গে, যাই হয়ে যাক না কেনো নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করছিলো টুসি।
যদি না যাওয়াই হয়ে থাকে সেটাও তো সোমা কে জানাতে পারতো, তনু জানত ও কতটা চিন্তায় আছে অথচ ওর একবারের জন্যও টুসির জন্য খারাপ লাগলো না, ভাবতে ভাবতে ক্রমশ এবার কষ্টের বদলে প্রবল রাগ হচ্ছিলো।
মা এসে দরজায় ধাক্কা দিলো,
কি রে খাবি তো নাকি? ওঠ কতো বেলা হয়ে গেছে!
ভালো লাগছে না মা, রাতে ঘুম হয়নি, কিছু খাবোনা আমি,
বলে দরজা খুলতেও উঠলো না ও। কিছুক্ষন প্রবল রাগের পর হটাৎ করে মনে হলো ওর কোনো বিপদ হয়নি তো? এরকম তো করেনি কোনো দিনও, ভাবতে গিয়েই মনে হলো, ইস ওর আধ ঘন্টা অপেক্ষা করে তনু র সঙ্গে কথা বলেই আসা উচিত ছিলো।
রাগের মাথায় তখন ও শুধু নিজের কথাই ভেবেছে, তনুর কিছু হতে পারে এটা তো এক বারের জন্যও মনে হয়নি। নিজের বোকামির জন্য নিজের ওপরই এখন রাগ হচ্ছিলো। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই, কোনোমতেই আর বাড়ি থেকে বেরোনো যাবেনা, আবার পরশু দিন পড়তে গিয়ে চেষ্টা করতে হবে।
ক্রমশ
( এবার থেকে প্রতিদিনই পোস্ট করতে পারবো আশা করছি, পর্বগুলো কেমন লাগছে জানাবেন প্লিজ)