জীবনের জলছবি (পর্ব ১৯)

জীবনের জলছবি
পর্ব ১৯
তপু দাদের বাড়ি থেকে ফোন করে আসার পর প্রায় পনেরো দিন হয়ে গেছে তনু কে এক বারের জন্যও ফোন করেনি টুসি। ভীষণ রাগ হয়েছিল মনে মনে। ফোন রেখে ঘুরেই তপু দা কে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো।

ফেরার সময় ওকে বাসে তুলতে বেরিয়ে একটু গম্ভীর লাগছিলো যেনো, এত টা গম্ভীর আগে তপু দা কে কোনো দিনই লাগেনি, তপু দা কি ওদের ফোন ব্যবহার করায় রাগ করলো, মনে মনে ভাবছিল ও। কিছুটা সহজ হবার জন্য নিজেই বলেছিলো

ফুচকা খাবে তপু দা?

তুই খাবি?, চল তাহলে,

বলে ফুচকার দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলো দুজনে। ফুচকা খেয়ে স্ট্যান্ডে এসে দেখলো একটাও বাস নেই।

তুমি বাড়ি চলে যাও, বাস এলে আমি চলে যাবো।

নাহ! তোকে তুলে দিয়েই যাবো একদম, না হলে মা রাগ করবে।

তপু দার কথায় একটু হাসলো টুসি,

তুমি এখনও কাকিমা কে ভয় পাও নাকি!

তপু হেসে ফেললো, বাস আসছেই না দেখে দুজনে মিলে একটা বেঞ্চে বসলো শেষে।

কাকু কি তোমাদের সঙ্গে থাকেন না?

দু একটা কথার পর আচমকাই জিজ্ঞেস করলো টুসি। তপু র মুখ টা একটু গম্ভীর হয়ে গেলো,

তুই তো অনেকটাই জানিস, সবটা না জানলেও, বাবার সঙ্গে থাকা সম্ভব ছিলনা, তাই মা আমাকে নিয়ে এখানে চলে এসেছিল।

সেটা কি আমার জন্যই তপু দা?

খানিকটা দ্বিধা নিয়েই প্রশ্ন করলো টুসি।

তুই একটা কারণ তো বটেই তবে সবটা নয়, এর আগেও এরকম ঘটনা ঘটেছে কয়েক বার, সেই জন্যই তো তোকে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে দেখে সন্দেহ হয়েছিলো মায়ের।

তার মানে কাকিমা জানে সবটাই? তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে কাউকে বলবেনা, আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম তখন!

ইস! তপু দা কাকিমা কে বলে দিয়েছিলো! খুব খারাপ লাগছিল টুসির।

তোকে দেওয়া কথা ভুলিনি আমি, মা কে কিছু জানাই নি।

তাহলে চলে এলে কেনো?

বললাম না, আরও ঘটেছে এরকম ঘটনা,মা মনে মনে তৈরিই হচ্ছিল এরকম কিছু করার জন্য, আমি অতটা বিশ্বাস করিনি মাকে কোনো দিনও। আমার মনে হতো মা সব সময় অহেতুক সন্দেহ করে, আসলে আমি তো হোস্টেলে থাকতাম, তাই বুঝিনি অতটা, কিন্তু সেদিন তোর নিজের মুখে শুনে বুঝলাম মা ঠিক বলত, তোর ঘটনা টা জাস্ট আমাকে পুরোপুরি বাবাকে চিনতে হেল্প করেছে এটুকুই। তখন মাকে বলেছিলাম তুমি যা করতে চাও কর, আমি সঙ্গে আছি, কিন্তু তোর ব্যাপারে কোনো কথা বলিনি। খানিকটা নিশ্চিন্ত লাগছিলো টুসির।

এই ছেলেটা কে তোর নিজের যোগ্য মনে হয়?

হটাৎ করেই জিজ্ঞেস করেছিল তপু দা।

কেনো?

একটু রাগের গলায় বলেছিলো টুসি, তপু দাদের বাড়ি থেকে ফোন করেছে বলেই কি তপু দার ওকে যেকোনো প্রশ্ন করার অধিকার আছে নাকি!

আমার যেনো মনে হচ্ছে ওর দিক থেকে খুব বেশি উৎসাহ নেই, তুই বার বার ফোন করার চেষ্টা করছিস,

টুসির রাগ কে পাত্তা না দিয়েই বলেছিলো তপু।

এর সঙ্গে যোগ্যতার সম্পর্ক কি?

খানিকটা বিরক্ত গলায় বলেছিলো টুসি।

যোগ্যতা মানে টাকা, পয়সা বা পড়াশুনার কথা বলছি না, নিজেকে বার বার ছোটো করার মধ্যে কি নিজের আত্ম সমান বিসর্জনের মতো একটা ব্যাপার থাকেনা, নিজেই ভেবে দেখিস। তুই তো কোনো দিক থেকে ওর থেকে কম নোস, তাহলে বার বার ফোন তুই করিস কেনো? সেলফ রেসপেক্ট টা খুব জরুরী, এটা মাথায় রাখিস।

টুসি কোনো উত্তর দিলোনা এবার, ওরও মনে হচ্ছিলো তপু দা খুব একটা ভুল বলেনি, ও কি সত্যিই নিজেকে ছোটো করে ফেলছে খুব, আর কিছু বলার আগেই বাস এসে গেলো, বাসে বসে বসে তপু দার বলা কথা গুলোই ভাবছিলো টুসি।

সেই থেকেই আর ফোন না করার ডিসিশন নিয়ে রেখেছে ও। ভাবতে ভাবতেই কলেজ এসে গেলো, বাস থেকে নেমে গেটের দিকে বন্ধুদের জমা ভিড়টার দিকে এগোলো টুসি। কিছুটা এগোতেই সোমার সঙ্গে দেখা হলো,

ওই তোর ফোন এসেছিলো কালকে,

শুনেই একটু চমকে গেলো ও। যাক অবশেষে ফোন করলো তাহলে, এবার নিজে থেকে আর করবে না ঠিক করেই নিয়ে ছিলো ও।

কি বললো?

সোমাকে জিজ্ঞেস করলো।

তোকে ফোন করতে বলেছে,

বলেই চলে গেলো সোমা। একবার বললেই ফোন করা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছিল না ও, সেদিনের তপু দার বলা কথাগুলো মনে পড়ছিল। তার মানে ইচ্ছা করলেই এতদিন সোমার বাড়িতে একবার খবর দিতেই পারতো, কিন্তু দেয়নি তখন, সেখানে এবার টুসি আর ফোন করবে না বলে দেওয়ায় সোমাকে ফোন করতে পারলো।

মানে তপু দা খুব একটা ভুল বলেনি, নিজেই ভাবছিলো টুসি। সেদিন সোমার ফোন নম্বর হারিয়ে গেছে বলে যে ওকে মিথ্যে বলেছিলো তনু, সেটাও বুঝতে পারলো টুসি। কোনো মতেই ফোন করবে না মনে মনে ভেবে নিলো ও।

গত চার বছরে এক বারও দেখা হয়নি ওর সঙ্গে, কিন্তু প্রত্যেক সপ্তাহে নিয়মিত ফোন করে গেছে টুসি, আসবে বলা সত্বেও একবারও আসেনি তনু, সময় জানা থাকা সত্বেও কোনো কোনো দিন দু বার, তিন বার ফোন করতে হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ে ফোনের সামনে থাকেনি ও, আজ তপু দার বলা কথাগুলো মেলাতে গিয়ে এসবই মনে পড়ছিল টুসি র।

প্রতি মুহূর্তে তো সত্যিই নিজেকে ছোটো করে ফেলেছে ও, সেই জন্যই বোধহয় যা খুশি করছে তনু এখন, এমনকি চাকরি পেয়েও এত সহজে ছেড়ে দিলো সেটা, একবারও টুসি র কথা ভাবেনি, ক্রমশ ক্ষোভ জন্ম নিচ্ছিলো টুসির মনে।
ক্রমশ
( কালকের পর্বটা একটু ছোটো হয়েছিলো বলে অনেকেই বলেছিলেন, তাই আজ একটু বড়ো লিখতে চেষ্টা করলাম। কিশোরী বয়স পেরিয়ে তরুণী হবার পথে এখন টুসি, আগের ভালো লাগা গুলো বদলে যায় সময়ের নিয়মে, মন অনেক পরিণত হয়, এই টুসি তাই কিশোরী টুসির থেকে অনেকটাই আলাদা, এই পর্বগুলো তে টুসি কে আমি সেরকম ভাবেই ধরতে চেয়েছি, কেমন লাগছে এই টুসি, জানাবেন কিন্তু🙏)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here