জীবনের জলছবি
পর্ব ২০
এই মুহূর্তে শুধু একজনের কথাই মনে হচ্ছে টুসির, তপু দা ছাড়া কেউ এখন আর বাঁচাতে পারবে না ওকে। ভীষণ টেনশন হচ্ছে, কি ভাবে বাড়ি পৌঁছবে বুঝতে পারছে না ও। অথচ যখন এখানে আসার কথা ভেবেছিলো, এত টা বিপদে পড়বে একটুও মনে হয় নি।
এতো বছর ধরে কলেজে ক্লাস অফ থাকলেই ওরা দল বেঁধে বন্ধুরা মিলে সেবক চলে আসে, কোনো ব্যাপারই না, আবার দুপুরের মধ্যেই ফিরে গিয়ে সুন্দর বাড়ি ফেরা যায়, মা কোনো দিনও বোঝেনি আজ পর্যন্ত, কিন্তু আজকেই এটা হওয়ার ছিলো, রীতিমত অসহায় লাগছিলো ওর।
অথচ সকাল টা আজ একদম অন্য ভাবে শুরু হয়েছিল, ঘুম থেকে উঠেই টিউশন পড়ে, কলেজ করে ফিরবে বলেই বেরিয়েছিল মাকে। স্যারের বাড়ি পৌঁছে দেখলো সোমার সঙ্গে ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল তনু।
তুমি এখানে?
একদম চমকে উঠেছিল টুসি।
ফোন করছো না, যোগাযোগ রাখছো না, তাই বলতেই পারিনি আমি বন্ধুদের সঙ্গে দার্জিলিং আসছি, শেষে সোমা কে ফোন করে এখানে চলে এলাম।
সোমার ফোন নম্বর খুঁজে পেয়েছিলে তাহলে?
একটু বিদ্রুপের গলায় বলেছিলো টুসি।
আজ বিকেলের বাসে ফিরে যাবো টুসি, কিছু কথা বলার ছিলো, যদি সময় দিতে পারতে তাহলে ভালো হতো,
তনুর গলার আওয়াজেই কি বলতে চাইছে সেটা অনেকটাই বুঝতে পেরেছিলো টুসি। তবু যেনো খুব বেশি কষ্ট হচ্ছিলো না ওর, ওর যে আদৌ কোনো সময়ই ব্যাঙ্গালোর যাবার কথা ছিলো না সেটা ওর বন্ধুর কথায় বুঝতে পেরেছিলো টুসি। তাই বেশ কিছুদিন ধরেই মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ও। কিন্তু এই মুহূর্তে বন্ধুদের সামনে কোনো রকম তর্কাতর্কি ও ও চাইছিলো না, তাই কোথাও গিয়ে বসে কথা বলাটা ওর নিজেরও যুক্তিযুক্ত মনে হলো।
দার্জিলিং বেড়াতে এসেছে বন্ধুদের সঙ্গে, কিন্তু আজ পর্যন্ত ওর সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেনি কখনও। কিন্তু নিজের ভেতরের এই ক্ষোভের কথাগুলো তনু কে বলতে চাইলো না টুসি। তপু দার কথাগুলো মনে পড়ছিলো, সত্যি সেলফ রেসপেক্ট টা খুব জরুরী। সবার কাছে অভিমানী হতে নেই, যে তার দাম দিতে পারেনা, তার কাছে নিজের অভিমান, কষ্ট প্রকাশ করা মানে নিজেকেই ছোটো করা আরও।
কিন্তু সম্পর্ক শেষ করতে চায় তনু এটা বোঝা সত্বেও বসে কথা বলে মিটিয়ে নিতে চাইলো টুসি। নিজের দুর্বলতা, কষ্ট তনুর সামনে প্রকাশ পাক সেটা চায়না ও। তনু যদি এতদিনের সম্পর্ক এইভাবে শেষ করে দিতে পারে, তাহলে সেটা কে শক্ত মনে মেনে নেবার ক্ষমতা রাখে ও। কিন্তু শিলিগুড়ি শহরে ওর প্রচুর চেনা জানা, এখানে কোথাও বসে কথা বলা সম্ভব নয় ওর পক্ষে, তাই সেবক চলে আসার পরিকল্পনা করেছিল ও।
বাস থেকে নেমে তনু কে নিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসলো ও। বাসে আসতে আসতে একটাও কথা বলেনি ও, শুধু প্রশ্নগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলো মনে মনে।
চাকরি সত্যি পেয়েছিলে নাকি আমি যাতে আর ফোন না করি সেই জন্যে মিথ্যে বলেছিলে আমাকে?
তনু কে কোনো কথা শুরু করতে না দিয়েই বলেছিলো টুসি, তনু চমকালো, ও যে ধরা পরে গেছে সেটা ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলো টুসি।
তোমার কথা বলতে ভালো না লাগতেই পারে, হতে পারে তুমি সম্পর্কটা আর কন্টিনিউ করতে চাওনা, কিন্তু সেটা সোজাসুজি বললেই ভালো লাগতো,
শান্ত গলায় বলেছিলো ও, তনু চুপ করেছিলো। টুসি ঠিক করেই নিয়েছিলো তনু কিছু বলার আগে ওকেই সবটা বলে দেবে ও। এই জোর করে একতরফা টেনে নিয়ে যাওয়া সম্পর্কটা ওকে কোনো সময়ই ভালো থাকতে দেয়নি।
আর মনে হয় এটা কন্টিনিউ করা সম্ভব হবে না তোমার বা আমার কারও পক্ষেই, এটাই আসলে আমার সঙ্গে দেখা করে বলতে চেয়েছিলে তাই তো? চার বছর অনেকটা সময় তাই না, আমি না ফোন করলে তো তোমার তরফ থেকে কোনো চেষ্টা থাকতো না বোধহয়! কোনোদিনও তো আসতে পারোনি এখানে আজ পর্যন্ত! অনেকটা দূরত্ব হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে, সত্যি কথা বলতে কি তুমি কি চাও আমি জানিনা, কিন্তু আমি আর এটা টেনে নিয়ে যেতে চাইনা।
টুসির কথায় চোখ নামিয়ে নিলো তনু, তনুর এক্সপ্রেশান বুঝিয়ে দিচ্ছিলো অনেক কিছু। ও যে এই কথা গুলোই বলতে চাইছিলো সেটা বুঝতে পারছিল টুসি। একবারের জন্যেও টুসির কথার প্রতিবাদ করেনি ও, টুসিকে আটকানোর চেষ্টা করেনি। কিন্তু কেনো এমন করলো ও! ও কি অন্য কাউকে ভালোবাসে!
প্রশ্নগুলোর উত্তর খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো টুসির, কিন্তু নিজেকে সংযত করলো ও। এগুলো জিজ্ঞেস করা মানেই তনুর সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলা। নিজেকে শক্ত করলো টুসি, এত টা নরম নয় ও, কেনো যেনো নিজেও বুঝতে পারছিলো সেটা, এত বছরের একটা সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে জেনেও ওর খুব বেশি একটা খারাপ লাগা তৈরি হচ্ছিলো না আর ও তো গত বেশ কিছুদিন ধরেই তনুর ব্যবহারে বুঝতেই পারছিলো সেটা।
তোমার আলাদা নতুন কোনো কথা বলার আছে? যদি না থাকে তাহলে উঠে পড়, আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। আর তোমারও তো ফেরার আছে বন্ধুরা অপেক্ষা করছে নিশ্চয়ই!
উঠে দাঁড়িয়ে বললো টুসি।
বন্ধুত্বটা নষ্ট করো না, যোগাযোগ রেখো, ভালো লাগবে,
এতক্ষনে কথা বললো তনু, টুসি কোনো উত্তর দিলো না, সামনেই একটা বাস কে আসতে দেখে হাত দেখালো ও। বাসে উঠেও কথা ছিল না কিছু আর বলার মতো, দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়েছিলো।
হটাৎ করেই প্রায় শিলিগুড়ি ঢোকার মিনিট পনেরো আগে খারাপ হয়ে গেলো বাস টা। সময় পেরিয়ে যাচ্ছিলো, একটার পর একটা বাস সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে, হাত দেখালেও দাঁড়াচ্ছে না, তনুর বাস আর টুসির বাড়ি ফেরা দুটোরই দেরি হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ। শেষে কোনো উপায় না দেখে তপু দা কে ফোন করলো টুসি,
তপু দা খুব বিপদে পড়েছি, একটু প্লিজ নিয়ে যাবে আমাদের এসে,
একদম লজ্জার মাথা খেয়ে বললো, কেনো জানে না ওর মনে হচ্ছিল ওর কথা ফেলতে পারবে না তপু দা। কিছুক্ষন পরে গাড়ি নিয়ে এসে ওদের তুলে নিয়ে তনু কে বাস স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিল তপু, টুসি পরিচয় করালেও একটু মৃদু হাসি ছাড়া একটাও কথা বললো না তনুর সঙ্গে।
তনু নেমে যাবার পর টুসি সামনের সিটে এসে বসেছিলো, ওর ভীষণ লজ্জা লাগছিলো, তপু দার গম্ভীর মুখটা ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলছিল ওকে।
সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, বাড়িতে গেলে ওকে অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে টুসি জানে, সেই গুলমা যাওয়ার স্মৃতিটা ঘুরে ফিরে আসছিল মনের মধ্যে। বাবার হাতের চড়টা কোনো দিনও ভুলবে না টুসি। কি বলবে মনের মধ্যে গুছিয়ে নিচ্ছিলো ও,
তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে,
সম্বিত ফিরল তপু দার কথায়। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করালো তপু দা, ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আজ তপু দা যা উপকার করেছে ও কে না বলার সাহস টুসির ছিলো না।
তুই নিশ্চয়ই বাড়ির কথা ভাবছিস, কাকিমা বকবে কিনা চিন্তা করছিস?
চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসে বললো তপু দা, টুসি অবাক হয়ে তাকালো। চিন্তা করিস না,তোর বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি তুই আমাদের বাড়ি এসেছিস, কাকু কিছু বলবে না তোকে, গলা টা একটু গম্ভীর শোনালো যেনো।
তুই কি আমাকে ব্যবহার করছিস টুসি?
তপু দার প্রশ্নে চমকে তাকালো টুসি।
তুই এখন আর ছোটো নেই, সবই বুঝিস বোধহয়, আমার যে তোর প্রতি দুর্বলতা আছে সেটাও বুঝতে পেরেছিস তাই তো? সেই জন্য তোর সব অন্যায় কাজ কে বৈধতা দেবার জন্য আমাকে ব্যবহার করছিস, জানিস আমি তোকে না বলতে পারবো না তাই,
খুব কঠিন গলায় বললো তপু। তপু দা ওকে এতো ছোটো ভাবলো,খুব খারাপ লাগছিলো টুসির, আর একটাও কথা না বলে বেরিয়ে এসে সোজা একটা বাসে চেপে বসলো ও। তপু পেছন পেছন বেরিয়ে এলো
টুসি, দাঁড়া,
একবারও ফিরে তাকালো না আর। বাড়িতে ফিরেও খারাপ লাগাটা গেলো না, তনুর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার দুঃখটা ছাপিয়ে গিয়ে কোনো জায়গায় যেনো একটা কাঁটা খচ খচ করতে লাগলো মনের ভেতরে।
রাত্রে শুয়ে ভাবছিলো টুসি, সব পুরনো কথা গুলো মনে পড়ে যাচ্ছিলো। ও তো সত্যিই জানতো তপু দা ওকে ভালোবাসে, সেই কবেই তো বলেছিলো ওকে, কিন্তু তা সত্বেও সব প্রয়োজনে কেনো তপু দার কথাই মনে হয় ওর, কেনো একবারও মনে হয় না যে ও ফোন করে বিরক্ত করছে হয়ত, আজও তনু থাকা সত্বেও ও কেনো ফোন করতে গেলো তপু দা কে, কোন অধিকারে এত টা কনফিডেন্ট ছিলো যে ওকে ফেরাবে না তপু দা, নিজের মধ্যেই প্রশ্ন গুলো জাগছিলো টুসির।
ও কি তপু দা কে ভালোবেসে ফেলছে ক্রমশ, তাহলে তপু দা কি সত্যিই ঠিক বললো,ও কি সব জেনেই ব্যবহার করছে ওকে, ভীষণ একটা খারাপ লাগা ঘিরে ধরছিলো ওকে, আর কোনো দিনও কোনো প্রয়োজনে ফোন করবে না ও, মনে মনে ঠিক করলো টুসি।
ক্রমশ
( টুসির জীবন এবার অন্য খাতে বইতে চলেছে, পুরনো সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, কেমন লাগবে আপনাদের, যদি টুসি সত্যিই তপুর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়?)