জীবনের জলছবি (পর্ব ২১)

জীবনের জলছবি
পর্ব ২১
কলেজ থেকে বেরিয়ে কোর্টের পাশ দিয়ে হসপিটালের সামনে আসতেই তপু দা কে দেখতে পেলো টুসি। সেদিনের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় একটা অদ্ভুত খারাপ লাগার অনুভূতি নতুন করে ফিরে এলো যেনো, একদম না দেখতে পাওয়ার ভান করে মাথা নিচু করে জায়গাটা পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল ও। ততক্ষনে তপু দা ওকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসেছে,

সেদিন তো খুব রাগ দেখিয়ে চলে গেলি, বাড়ি ফিরে যে বকুনি খেতে হয়নি তার জন্য মিনিমাম একটা ধন্যবাদ দেবারও প্রয়োজন মনে করিস না নাকি,

আগের দিন যেনো কিছুই হয়নি এরকম একটা ভঙ্গি করে বললো তপু দা। আগের দিনের চেপে রাখা রাগ টা কেমন যেনো এক মুহুর্তে গলে জল হয়ে গিয়ে, হেসে ফেললো টুসি।

বাড়ি ফিরবি তো? চল মায়ের সঙ্গে দেখা করে যাবি, আমি পৌঁছে দেব তোকে, চিন্তা করিস না,

তপু দার কথায় না বলতে পারল না আর, তপু দার সঙ্গে ফিরলে মা কিছু বলবে না জানে ও, তাই কাকিমার সঙ্গে দেখা করতে ঢুকলো টুসি। কাকিমা ওকে দেখে খুশি হলো যথারীতি, বললো,

তোর কথাই ভাবছিলাম রে, সামনের মাসে দাদা বৌদির সঙ্গে দার্জিলিং যাবো, তোর মা কে যেতে বলে দিবি সেই কবে থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম, হচ্ছিলো না আর। ছুটি দেখেই যাবো, দাদার অফিস কামাই করতে হবে না তাহলে, তাই তোরও কলেজের কিছু অসুবিধা হবে না। যাবি তো তুই?

টুসি একটু ভাবলো, দার্জিলিং! ধুস! আর ভালো লাগে না, কতবার গিয়েছে ও। ওদের যত আত্মীয় স্বজন আসে এখানে বেড়াতে, প্রায় তাদের সবার সঙ্গেই একবার করে দার্জিলিং ঘোরা হয়ে গেছে ওর। টুসি কে চুপ করে থাকতে দেখে কাকিমা একটু অবাক হলো,

কি রে! যাবিনা তুই! তোর মা তো বললো কলেজে ছুটি থাকলে তোর অসুবিধা হবে না!

না, কাকিমা অসুবিধা নয়, দার্জিলিং যেতে আর ভালো লাগে না, অনেকবার গেছি, বড্ড ঘিঞ্জি শহর!

একটু হেসে বললো টুসি। কাকিমা এবার হাসলো,

আরে সেতো আমাদেরও, কিন্তু তাতে কি! সবাই মিলে যাবো, আনন্দ হবে, এই আর কি! তুই তো সবাইকেই চিনিস, চল না ভালো লাগবে।

সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছে কাকিমা, তপু দার মামার বাড়ির সবাইকেই চেনে টুসি, অনেকবার তপু দাদের বাড়িতে দেখেছে ও। মামার ছেলেটা তপু দার ই বয়সী, মাঝে মাঝেই পিসির বাড়ি ছুটিতে গিয়ে থাকতো, তপু দার মতোই টুসির পেছনে লাগতো খুব।

ঠিক আছে যাবো কাকিমা, মা কে বলছি গিয়ে,

রাজি হয়ে গেল ও, কাকিমা খুশি হলো খুব।কাকিমার সঙ্গে কিছুক্ষন গল্প করে তপু দার সঙ্গে বেরোলো টুসি। তপু দা কোনো কাজে মালদা যাচ্ছিলো, ট্রেন ধরবে বলে, এক সঙ্গে রিকশায় চেপে বসলো ওরা,

বাড়ির সামনে টুসি কে নামিয়ে দিয়ে যাস কিন্তু,

বার বার করে বলে দিলো কাকিমা, না বললেও তপু দা যে ওকে একা ছেড়ে দেবে না বুঝতেই পারছিলো ও।

সেদিনের আমার বলা কথাগুলোয় রাগ করিস না, খুব খারাপ লেগেছিলো, তাই বলে ফেলেছি,

রিকশায় বসে বললো তপু দা।

আমি জানো তো, পরে বাড়ি গিয়ে ভেবেছিলাম, সত্যিই বোধহয় আমার তোমাকে ওই ভাবে ডেকে পাঠানো উচিত হয়নি সেদিন, কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ব্যবহার করতে চাইনি। কেনো জানিনা, নিজেই বুঝতে পারিনা হটাৎ করে কোনো বিপদে পড়লে আমার তোমার কথাই কেনো মনে হয় সব সময়, আর হয়ত না জেনেই তোমাকে আমার অনৈতিক কাজ গুলোর সঙ্গে জড়িয়ে ফেলি, যাইহোক ভবিষ্যতে এরকম আর কোনো দিনও করবো না কথা দিচ্ছি তোমাকে,

খানিকটা অভিমানের সুরে বললো টুসি।

ছেড়ে দে ওসব কথা, বল আগের দিন কি হলো? ঠিক আছে তো সব কিছু?

নাহ! ঠিক কোথায় আর, এই সম্পর্ক টা আর আমরা কন্টিনিউ করবো না ঠিক করেছি, ও বলেও দিলো সেটা, তাছাড়া আমার সঙ্গে দেখা করতে তো আসেনি, আসলে বেড়াতে এসেছিলো, সময় ছিলো তাই দেখা করলো,

একটানা উত্তেজিত হয়ে বলেই যাচ্ছিলো টুসি।

ধৈর্য রাখ, দেখ ঠিক হয়ে যাবে হয়ত আস্তে আস্তে, তোর হাতেও তো এখনও সময় আছে অনেক

বলেই চুপ করে গেলো তপু দা।

না গো আমরা এটা আর এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছি না, আসলে কি জানো আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড হয়ে গেছে বোধহয়, এত দিনের একটা সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলো, কিন্তু আমার যতটা খারাপ লাগার লাগলো না কেনো বলোতো, আমি জানোতো নিজেই বুঝতে পারছিনা সেটা, এখন মনে হয় এগুলো বোধহয় ছোটবেলার একটা মোহ ছিলো শুধু, এই বয়সে এসে সেটা কিছুটা হলেও ফিল করতে পারছি আমি, একসময় কিন্তু খুব ভালো লাগতো ওকে!

অনেকক্ষণ কথা বলার পর মনে হলো এত কথা তপু দা কে বলছে কেনো ও, এই সব কথা গুলো তপু দা কে ওর বলতে ইচ্ছা করছে কেনো? মনে হতেই চুপ করে গেলো টুসি।

ভালোলাগা আর ভালোবাসা দুটো এক জিনিস নয়, ভালো তো আমাদের কতজনকেই লাগে, কিন্তু তাদের সবাইকেই আমরা ভালোবাসি না, এমন কেউ কেউ আসে আমাদের জীবনে যাদের কে ভালো লাগতে লাগতে এক সময় তারা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়, ভালো লাগা কখন যে ভালোবাসায় বদলে যায় আমরা নিজেরাই বুঝতে পারিনা, বুঝলি?

হাসলো তপু। বাড়ি এসে গিয়েছিল, একটু অবাক চোখে তপু দার দিকে তাকিয়ে, আসছি বলে নেমে পড়লো টুসি।

শোন, যেকোনো কাজ সেটা নৈতিক হোক বা অনৈতিক আমাকে দরকারে ডাকিস কিন্তু,

বলে টুসি কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রিকশা ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেলো তপু।

রাত্রে পড়ার পরে প্রায় বারো টা নাগাদ ঘুমিয়ে ছিল সবে, মায়ের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেলো হটাৎ,

ওঠ তাড়া তাড়ি, বাবা কেমন করছে দ্যাখ

, লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলো টুসি। তারপরে, পাশের বাড়ির কাকু কে ডেকে রিকশা নিয়ে মা আর ও মিলে হসপিটালে পৌঁছে বাবাকে ভর্তি করতে করতে সকাল হয়ে গেলো। ইসস, এখন যদি তপু দা থাকতো, শুধুই মনে হচ্ছিলো ওর, সব কাজ সেরে মা কে নিয়ে হসপিটালের পেছনে তপু দাদের বাড়ি গেলো টুসি। কাকিমা সব শুনে আর বাড়ি ফিরতে দিলেন না ওদের। সন্ধ্যে বেলায় তপু দা ফিরে এলো, তখন মা আর কাকিমা টুসি কে বাড়িতে রেখে বাবা কে দেখতে গিয়েছেন হসপিটালে। দরজা খুলতেই ওকে দেখে চমকে গেলো তপু,

তুই এখানে? কি হয়েছে তোর? এইরকম চেহারা কেনো?

বাবা কাল রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তোমাকে কতো বাজে প্রয়োজনে ডেকেছি, আর কাল আসল প্রয়োজনের সময় তুমি ছিলে না তপু দা, আমার খুব একা লাগছিলো, বলেই তপু কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো টুসি।

ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here