জীবনের জলছবি (পর্ব ২২)

জীবনের জলছবি
পর্ব ২২
বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে প্রায় মাস খানেক হলো, আবার সেই ব্যস্ততার জীবন শুরু হয়ে গেছে। কলেজ, টিউশন সব মিলিয়ে একটুও সময় পাচ্ছিলো না টুসি।

তনুকে সেদিনের পর থেকেই আর একবারের জন্যও ফোন করেনি ও, সত্যি বলতে কি খুব যে খারাপ লাগা আছে সে জন্য তাও নয়, আসলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো কে যেনো অনেক টা ছেলে মানুষি বলেই মনে হয় এখন, ছোটো বেলার ভালো লাগা গুলো বোধহয় বদলে যায় সময়ের নিয়মে, যে তনুর সঙ্গে দেখা করার জন্য এক সময় পাগল হয়ে থাকতো টুসি, প্রায় চার বছর না দেখা হওয়া সত্বেও খুব বেশি যে কষ্ট ছিলো ওর তা তো নয়, এখন সেটা বুঝতে পারে ও।

ওর শিলিগুড়ির জীবনে ব্যস্ততার রোজ নামচার মধ্যে শুধু সপ্তাহে একটা নিয়ম মাফিক ফোন ছাড়া আর কি কিছু অস্তিত্ব ছিল তনুর, মনে মনে ভাবে টুসি।

বরং এখন যেনো তপু দার সঙ্গে কয়েক দিন দেখা না হলেই কেমন একটা খারাপ লাগা তৈরি হয়, মাঝেই মাঝেই কোনো কারণ ছাড়াই ও কাকিমার সঙ্গে দেখা করতে চলে যায় কলেজ থেকে ফেরার পথে। কিন্তু আসলে যে ও তপু দা র সঙ্গে দেখা করতে চায়, সেটা মুখে না মানলেও মনে মনে স্বীকার করে নিজেই। তপু দা কে ভালোবেসে ফেলেছে ও, কিন্তু ও নিজে কিছু বলবেনা, তপু দার বলার জন্য অপেক্ষা করবে, ও জানে তপু দা ওকে ভালোবাসে। সেদিনের বলা কথা গুলো মনে পড়ে ওর।

তপু দা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল,

কিছু হবে না কাকুর, আমি আছিতো, বলেছিলো তপু দা।

ভীষণ নিশ্চিন্ত লেগেছিলো ওর, কোন বিশ্বাসে মনে হয়েছিল যে বাবার কিছু হবে না জানে না ও, কিন্তু কেমন যেনো স্থির বিশ্বাস ছিল তপু দা যখন বলেছে তখন সত্যি কিছু হতে দেবে না বাবার। বাবা না সুস্থ হওয়া পর্যন্ত ওখানেই ছিলো টুসি রা, কাকিমা একবারের জন্যও বাড়ি ফিরতে দেয়নি ওদের, ওই কদিনে তপু দা ও টুসি নিজেরাও যেনো অনেক টা কাছাকাছি এসেছিলো দুজনে। একদিন রাতে ছাদে দাঁড়িয়েছিলো দুজনে,

ওই ছেলেটার সঙ্গে আর কথা বলিস?

হটাৎ করেই জিজ্ঞেস করেছিলো তপু দা, ঘাড় নেড়েছিলো টুসি,

তুমি বোধহয় ঠিকই বলেছিলে, আমিই শুধু একতরফা নিজেকে ছোটো করে সম্পর্কটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম!

মন থেকে বার করে দে ওসব, পড়াশুনা কর!

তুমি কাউকে ভালোবাসো তপু দা?

টুসির কথায় খানিকক্ষন চুপ করেছিলো তপু, তারপর আস্তে করে টুসির চোখে চোখ রেখে বলেছিলো,

বাসি তো! সেই ছোটবেলা থেকেই!

ও আর কোনো কথা বলতে পারছিলো না, তপু দার চোখের ভাষা পড়ে নিতে একটুও অসুবিধা হয়নি ওর!

তাকে বলেছো যে তুমি তাকে ভালোবাসো?

তপু দার মুখ থেকে উত্তর টা শুনতে চাইছিলো ও, তপু একটু চুপ করে থেকে বলেছিলো,

সে যে সবই বোঝে সেটা আমি জানি, কিন্তু বলার সময় আসেনি এখনো, যখন সময় হবে বলবো নিশ্চয়ই,

বাসে বসে এইসব ভাবতে ভাবতেই কিছুটা অন্যমনস্ক ভাবে বাড়ির স্টপেজটাই পেরিয়ে যাচ্ছিলো আর একটু হলেই, ভাগ্যিস মুখ চেনা কন্ডাক্টার কাকু,

কি হলো নামবে না নাকি আজ,

বলে ডাকতেই হুঁশ ফিরলো ওর। তাড়াহুড়ো করে বাস থেকে নামলো শেষে। বাড়িতে ঢুকেই দেখলো শীলা কাকিমা বসে আছে। মা আর কাকিমা গল্প করছিলো, ওকে দেখেই মা বললো,

শীলা আমাকে দার্জিলিং যাবার কথা বলতে এসেছে, কিন্তু বাবার শরীর খারাপ তাই আমি আর যাবো না বলেছি। ওরা তো ছুটির দিন দেখেই যাচ্ছে, তুই চলে যাস বরং।

টুসির খুব আনন্দ হলো, যখন এর আগে কাকিমা দার্জিলিং যাওয়ার কথা বলেছিলো তখন ওর যাবার ইচ্ছে ছিলো না খুব একটা, কিন্তু এখন অন্য রকম পরিস্থিতি। তপু দাদের বাড়ি থাকার সময় যে মুহূর্তগুলো ও তপু দার সঙ্গে কাটিয়েছে, তারপরে এটা ওর কাছে একটা বড়ো প্রাপ্তি। দুজনে একসঙ্গে থাকার আর একটা বড়ো সুযোগ এটা, তাই টুসি এককথায় রাজি হয়ে গেলো।

কাল সকালে সাতটার মধ্যে তৈরি হয়ে থাকিস টুসি,

বলে কাকিমা চলে গেলো, টুসি ব্যাগ গোছাতে লাগলো। যদিও মাত্র দুদিন, তবুও সেটাই অনেক ওর কাছে, কি কি নেবে আর কি নেবেনা ভাবতে ভাবতেই রাত কাটিয়ে ফেললো ও। উত্তেজনায় ভালো করে ঘুমই হলো না টুসির, কখন তপু দার সঙ্গে দেখা হবে ভেবে মনে মনে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলো ও।

সকালে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হতে হতেই নিচে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ শুনতে পেলো টুসি, প্রায় দৌড়েই সিঁড়ি দিয়ে নামলো ও। গাড়ির সামনে পৌঁছে অবাক হয়ে গেলো, সামনের সিটে তপু দার পাশে একটা মেয়ে বসে আছে, পেছনের সিটে কাকিমা আর কাকিমার বোন। ওকে দেখেই পেছনের দরজা খুলে ডাকলো কাকিমা, অগত্যা সামনে বসার আসা ছেড়ে পেছনে কাকিমার সঙ্গেই বসলো ও।

কাকিমার বোন কে ও চেনে, আগে অনেকবার দেখেছে কিন্তু সঙ্গের মেয়েটা কে চিনতে পারছিলো না। তপু দার মাসীর কোনো মেয়ে নেই সেটা জানে টুসি, তাই মেয়েটা কে এটা জানার জন্যে ভীষণ কৌতুহল হচ্ছিলো ওর। আস্তে আস্তে শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠছিলো গাড়ি, ও অস্থির হচ্ছিলো মনে মনে। তপু দার মামারা ওদের নিজেদের গাড়িতে আছে, ঘন্টা খানেক পরে সেবকে পৌঁছে গাড়িটা দাঁড় করালো তপু দা, আগে থেকেই মামাদের গাড়ি টা দাঁড়িয়ে ছিলো ওখানে।

গাড়ি থেকে নেমে একটা দোকানে ঢুকে ব্রেকফাস্টের জন্য বসলো ওরা। মামাদের গাড়িতে মেয়েটার বাবা মা ছিলো তারাও নেমে এলো। ওরা মাসীর দেওর আর জা এবার কথায় কথায় বুঝতে পারলো টুসি। এদের আগে কখনো দেখেনি, একদম অচেনা মানুষের সঙ্গে বেড়াতে যেতে অস্বস্তি হয় ওর। কিন্তু এই মুহূর্তে আর কিছু করার নেই, ওরা যাবে এটা আগে জানলে আসতো না ও।

রাতে খাওয়ার পরে হোটেলের বারান্দায় একাই দাঁড়িয়েছিলো টুসি। এখানে আসার জন্যে এখন খুব আফসোস হচ্ছে। সারাদিন খুব বাজে কেটেছে আজ। ব্রেকফাস্টের পরে আবার গাড়ি চালাতে শুরু করেছিলো তপু দা, পাহাড়ি রাস্তা বলে খুব বেশি কথা বলছিলো না, কাকিমা বোনের সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত, টুসির ভালো লাগছিলো না। হোটেলে এসেও ওর মামার ছেলে শুভ দার সঙ্গেই কাটালো তপু দা, দু একটা সাধারণ কথা ছাড়া টুসির সঙ্গে কথাই বললো না।

বাধ্য হয়ে মেয়েটার সঙ্গেই গল্প করার চেষ্টা করেছিলো টুসি, কিন্তু মেয়েটা ভীষণ অমিশুকে, টুসির সঙ্গে গল্প করার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না ওর। বিকেলে ম্যালে কাকিমা র সঙ্গে বসেছিলো টুসি, মেয়েটা তপু দা আর শুভ দার সঙ্গে আলাদা করে ঘুরতে চলে গেলো। কাকিমা ওকে ওদের সঙ্গে যেতে বলছিলো কিন্তু তপু দা নিজে ওকে ডাকলো না তাই টুসির একটু অভিমান হলো, ও কাকিমার সঙ্গেই বসে রইলো।

মেয়েটা সেই ম্যাল থেকেই ওদের সঙ্গে গল্প করছিলো, সারা সন্ধ্যে হোটেলে ফিরেও তপু দাদের ঘরে শুভ দা, তপু দা আর ওই মেয়েটা গল্প করতে লাগলো। এতক্ষনে মেয়েটার নামটাও জেনে গেছে ও, সীমা। ওরা কেউ টুসি কে একবারের জন্যেও ডাকে নি।

তুই এখানে কি করছিস একা একা? ঘরে আসছিস না কেনো?

টুসি পেছনে ফিরে দেখলো তপু দা ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, এতক্ষনে মনে পড়লো ওর কথা! ওর খুব অভিমান হলো, কোনো উত্তর না দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলো টুসি। তপু দা বোধহয় টুসির অভিমান কিছুটা বুঝতে পারলো, আস্তে আস্তে ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। টুসি এবার কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই পেছন থেকে মেয়েটার গলায় ফিরে তাকালো,

তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো! আমি কখন থেকে খুঁজছি তোমাকে! চলো তাড়াতাড়ি,

টুসি তপু দার দিকে তাকালো, তপু দা একটু অস্বস্তিতে পড়েছে বুঝতে পারছিলো ও। তপু দা কি মেয়েটার কথায় চলে যাবে, এটা ভাবতে ভাবতেই শুভ দা চলে এলো তপু দা কে ডাকতে। এবার আর কিছু করার ছিলো না,

তুই ও চল ভেতরে, এখানে একা কি করবি?

টুসি কে বললো শুভ দা, টুসি মাথা নাড়লো, ওর যেতে ইচ্ছে করছিলো না।

তোমরা যাও, আমি এবার ঘুমাতে যাবো,

বলে আর কোনো দিকে না তাকিয়েই ঘরে ঢুকে পড়লো টুসি। ওর কেনো যেনো খুব মন খারাপ লাগছিলো, শুধুই মনে হচ্ছিলো সীমা মেয়েটা যেনো তপু দা কে একদম ঘিরে রেখেছে, ওকে তপু দার কাছে একবারের জন্যেও পৌঁছতে দিচ্ছে না! তপু দাও তো সারাদিন ওর সঙ্গেই কাটালো, টুসির কথা মনে হয়নি একবারও। অথচ ও তো শুধু তপু দার জন্যেই এসেছিলো এখানে, তাহলে কি ও শুধুই নিজের মতো করেই ভেবে এসেছে সব কিছুই, তপু দা আসলে এসব কিছুই ভাবে নি ওর সম্বন্ধে!
ক্রমশ
( একটু অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছে পর্বগুলো মাঝে মাঝে, চেষ্টা করছি তাও, সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তাই, মাঝে মাঝেই রিচ কমে যাচ্ছে ভীষণ, সবাই একটু লাইক, কমেন্ট করবেন প্লিজ 🙏)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here