জীবনের জলছবি (পর্ব ৭)

জীবনের জলছবি
পর্ব ৭
আজ কালীপুজো। মা বলেছে রাত্রি বেলায় পড়ার ছুটি। তাই সকাল থেকেই পড়া কিছুটা এগিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে । দ্রুত বিছানা ছাড়ে টুসি। সেদিনের ঘটনার পর দুদিন মনটা একটু বিক্ষিপ্ত হয়েছিলো, এখন আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে উঠছে ক্রমশ।

কাকিমা ও কিছু বলেনি, যদিও আসেও নি ওদের বাড়িতে আর। তবে তপু দা কিছু বললে নিশ্চয়ই আসতো, তার মানে তপু দা কিছু বলেনি কাকিমা কে বুঝতেই পারছিলো টুসি।

আর এক সপ্তাহ বাকি টেস্টের। সব কিছু মন থেকে সরিয়ে ফেলে পড়ায় মন দেওয়ার চেষ্টা করে। বাবার অফিস ও আজ ছুটি। তাই রান্না ঘরে ব্যস্ততা বেড়েছে মায়ের। দুপুর পর্যন্ত একটানা পড়ে টুসি। মা স্নান করতে যাবার তাড়া লাগায়। স্নান করে খেয়ে উঠে, মোমবাতি গুলো ঘরের জানালায় লাগিয়ে সেট করতে থাকে। তাতে সন্ধ্যে নামলে মোমবাতি গুলো তাড়াতাড়ি জ্বালানো হয়ে যায়।

মাম আসবে সাতটা নাগাদ। দশমী র ঘটনার পর থেকে কয়েকদিন কোনো কারণে রেগে ছিলো মাম। এখন আবার সব ঠিকঠাক। আসলে ওরা দুজনে কিছুতেই ঝগড়া করে থাকতেই পারেনা। ছোট থেকে দুজনে কম ঝগড়া তো করেনি আজ পর্যন্ত, কিন্তু সব টাই মিটমাট হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি।

দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। বাড়িতে বাড়িতে মোমবাতি আর প্রদীপ জ্বালানো চলতে থাকে, মা আর ও মিলে খুব দ্রুত জ্বালিয়ে ফেলে মোমবাতি গুলো। মোমবাতি জ্বালানো শেষ করেই তৈরি হয়ে যায় টুসি, মাম এলেই পুজো মণ্ডপ এ বেরিয়ে পড়তে হবে।

আজ সব বন্ধুরা মিলে রাত জাগবে মণ্ডপে। সবাই নিজেদের বাড়ি থেকে অনুমতি আদায় করেছে। মা পইপই করে মনে করায়

মণ্ডপ ছেড়ে কোথাও যাবেনা কিন্তু।

কোনো মতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ছুটতে ছুটতে সিঁড়ি দিয়ে নামে। আজ মণ্ডপ ভিড়ে উপছে পড়ছে। অনেকেই অঞ্জলী দেবে, তারা পুজোর থালা নিয়ে নাম লিখে জমা দিচ্ছে। ওরা ভিড় থেকে সরে নিজেদের বন্ধুদের কাছে এসে দাঁড়ায়।ওদের দুজনের জন্য চেয়ার রেখে দিয়েছিলো বন্ধুরা, এখনও যারা এসে পৌঁছয় নি তাদের জন্যও রাখা আছে। গুছিয়ে বসে আড্ডা দেওয়া শুরু হয়।

রাত বাড়তে থাকে ক্রমশ, সবাই ভোগ খাবে বলে এসেছে বাড়ি থেকে, তাই কারুরই ফেরার কোনো তাড়া নেই। পুজো শেষ হতে অনেক দেরি, ধৈর্য্য শেষ হয়ে আসছিলো ওদের। খিদে পেয়ে গিয়েছে সবারই, কিন্তু ভোগ খেতে গেলে পুজো শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।

মাঝখানে কিছু খাওয়া তো যেতেই পারে। দল বেঁধে খাবারের স্টল এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা। তিনটে চাউমিন কিনে স্টলের সামনে থেকে সরে গিয়ে ভাগাভাগি করে খেতে শুরু করে, সঙ্গে গল্পও চলতে থাকে। হটাতই মাঠের কোণের অন্ধকার জায়গা থেকে একজোড়া চোখ লক্ষ্য করছে তাকে, বুঝতে পারে টুসি।

কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, দশমীর বিকেলের কথা মনে পড়ে তার। সেদিন খুব রাগ দেখিয়ে সাইকেল নিয়ে চলে গিয়েছিলো, তাহলে আজ আবার কেনো, নিজেকেই প্রশ্ন করে ও। মাম এখনও লক্ষ্য করেনি কিছু, ও জানতে পারলে আবার কিছু গন্ডগোল হবে, একটু ভয় লাগে টুসির।

খাওয়া সেরে আবার চেয়ার এ বসে ওরা। চারিদিক ফাঁকা হচ্ছে আস্তে আস্তে। যারা পুজো দেখতে এসেছিলো সবাই ফিরে গেছে মোটামুটি, শুধু ওদের পাড়ার লোকেরাই আছে এখন, তারা ওদের মতোই পুজোর ভোগের জন্য অপেক্ষা করছে।

বাপী সেই তখন থেকে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, ওই দিকে না তাকিয়েই বোঝে টুসি। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে, নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে ও। একসময় পুজো শেষ হয়। ভোগ দেওয়া শুরু হয়েছে, খুব বেশি ভিড় নেই, লাইন দিয়ে দাঁড়ায় ওরা। ভোগ শেষ হবার পরই দ্রুত খালি হতে শুরু করে মণ্ডপ, ওরাও বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

বন্ধুরা আলাদা হতে শুরু করে একে একে, শেষ পর্যন্ত মাম ও বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ঠিক দুটো বাড়ি পরেই টুসি থাকে, মাম কে হাত নেড়ে এগিয়ে যায় ও। বাড়ির গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে সবে, হটাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে ওর মুখোমুখি দাঁড়ায় বাপী।

দ্রুত ওর হাতে ধরিয়ে দেয় একটা কাগজ, আর তারপরেই সাইকেল চালিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে টুসি, বাড়ির গেট খুলতেও ভুলে যায়। খানিকক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে ধাতস্থ হয়ে গেটে হাত দিয়ে গেট খুলতে খুলতে হঠাৎই লক্ষ্য করে সামনের বাড়ির তপুদা দের বাড়ির জানলায় একটা ছায়া সরে গেলো। কাকিমা নয় তো! ভয়ে বুকের ভেতর টা হিম হয়ে যায় টুসির, যদি কাকিমা হয় তাহলে মায়ের কানে পৌঁছতে আর সময় লাগবে না!

ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here