জীবনের নানা রং পর্ব-এক

0
2000

#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব-এক
মাহাবুবা বিথী
আমার সামনে বসে শেফালী অঝোর ধারায় কাঁদছে।ভাই বোন মা সবার জন্য নিজের চল্লিশ বছরের পুরো জীবনটা বিলিয়ে দেবার পরেও আজ তার ভাগ্যে অপমান আর অবহেলা জুটলো।

শেফালীর সাথে আমার পরিচয় হয় মেয়ের স্কুলে।ও বীনাকে স্কুলে নিয়ে আসতো।আমি আমার মেয়ে জাবিনকে নিয়ে যেতাম।সমবয়সি বিধায় বন্ধুরমতো ও অনেক কিছু আমার সাথে শেয়ার করে।বীনা শেফালীর ছোটো বোনের মেয়ে।

শেফালী আমার কাছে ওর জীবনের গল্প বলতে শুরু করলো।আমরা স্কুলের ওয়েটিং রুমে বসে আছি।বাহির থেকে প্রতিটা মানুষকে কত সুখী মনে হয়।বুকের গহীনে বেদনার সিন্ধু লুকিয়ে রয়।

শেফালীরা তিন বোন দুই ভাই।ওদের বাড়ি পুরান ঢাকার লালবাগে।ওর বাবা ছিলো উড়নচন্ডী একজন মানুষ।ওদের নিজেদের থান কাপড়ের ব্যবসা ছিলো।সেই ব্যবসার টাকা দিয়ে জুয়া খেলে মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে মদ খেয়ে টাকা উড়িয়ে বাড়ি ফিরতো।মাঝে মাঝে মাতাল হয়ে ওর মাকে বেদম মারতো।ওরা তখন ছোটো ছিলো।এতো অকাম করে এসেও ঘরে সিংহের মতো থাকতো।খাবার টেবিলে উনি পানিটাও ঢেলে খেতেন না।ভাত তরকারী সব গরম চাই।গ্লাসের পানি শেষ হয়ে গেলে ঠক ঠক করে টেবিলে শব্দ করতেন।ওনার মা রান্না ঘর থেকে ছুটে এসে গ্লাসে পানি ঢেলে দিতেন।যদি কোনদিন ভাত তরকারী একটু ঠান্ডা হয়ে যেতো সব খাবার ওর বাবা উঠোনে ছুঁড়ে ফেলতেন।তারপর ওর মাকে ধরে পেটাতেন।ওর মা গরীব ঘরের মেয়ে ছিলো।ওর বাবা বয়সে ওর মায়ের থেকে পনেরো বছরের বড় । ওর মা দেখতে অপরুপ সুন্দরী ছিলো।

এসব দেখে বড় হওয়া শেফালীর বিয়ের প্রতি খুব একটা আগ্রহ ছিলো না।ও যখন মায়ের ফর্সা শরীরে বাবার আঘাতে দগদগে লাল দাগগুলি দেখতে পেতো বিয়ের প্রতি সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলতো।ওই প্রথম ওর বাপের এই সব আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতো।ওর ভাইবোনরা সব বড় হয়ে যাবার পর মায়ের সাথে বাপের এইসব আচরণের বিরুদ্ধে ওরা সবাই মিলে প্রতিবাদ করে।

একদিন রাতে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল।তার সাথে প্রবল বেগে বাতাস শুরু হয়েছে।আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।শেফালীরা চার ভাই বোন সেদিন বাসায় ছিলো।হঠাৎ ঘরের দরজা কে যেন জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে।শেফালী দরজা খুলে দেখে মাতাল অবস্থায় ওর বাবা দাঁড়িয়ে আছে।পাশে ওর থেকেও বয়সে ছোটো একটা যুবতী মেয়ে।ঘৃণায় শেফালীর বমি উঠে আসতে চাইলো।ওর বাবা শেফালীকে বলে
—-দরজা থেকে সরে দাঁড়া।আমি ঘরে যাবো।
—–বাজারের মেয়ে নিয়ে তোমাকে ঘরে ঢুকতে দিবো না।
কষে শেফালীর গালে চড় মেরে বলে,
—–যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা।শেফালীও বলে,
—–তোমাকে বাবা ডাকতে আমার ঘৃণা হয়।নিজেকে কোথায় নামিয়েছ।নিজের মেয়ের থেকেও ছোটো মেয়ের সাথে তুমি রাত কাটাও।
শেফালীর বাবা চিৎকার করে ওর মাকে বলে
—-ওই মাগী তোর মেয়েকে দরজা থেকে সরে যেতে বল।নয়তো তোকে আমি তালাক দিবো।

ওর বাবাও রাগের মাথায় মৌখিকভাবে ওর মাকে তালাক দেয়।তখন শেফালী ডিগ্রী পড়ে।ওর ছোট বোন শিউলি এইচএসসি পরীক্ষা দিবে।ওর বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।ছোট ভাই শাহেদ এসএসসি পরীক্ষা দিবে। সবার ছোটো ভাইটা ক্লাস টেন এ পড়ে।
যার ফলে ওর মাকে বাড়ি থেকে ওরা যেতে দিলো না।ওর বাবাকে বাড়ি আসতে নিষেধ করে দিলো।বাড়িতে আসলেও ওর বাবাকে ওরা উঠোনে একটা রুম বানিয়ে দেয়।পরবর্তীতে ওখানেই ওর বাবা থাকে।নিজের রান্না নিজে করে খায়।ওদের বাড়িটা ছিলো যৌথ বাড়ি।ওর দাদার নামে কেনা হয়েছিলো।

শেফালীর বাবা চাচা দুই ভাই ছিলো।ওর দাদী মারা যাবার পর ওর দাদা সম্পত্তি ছেলেদের মাঝে ভাগ করে দেন।দুটো বাড়ি দুটো ছেলেকে দিয়ে দেন।ওর দাদা ওর চাচার সাথে থাকতো।ওর বাবা এতো খারাপ মানুষ ছিলো কিন্তু ওর চাচা খুব ভদ্র বিনয়ী ছিলো।সরকারি চাকরি করতো।পাশাপাশি পৈত্রিক ব্যবসা চালাতো।
ওর বাবাকে সংসারী করার জন্য ওর দাদা অপরুপ সুন্দরী বয়স
কম মেয়েকে ছেলের বউ করে নিয়ে আসেন।কিন্তু ওর বাবার স্বভাবের কোন পরিবর্তন হয় না।তাই ওর মাকে যখন ওর বাবা তালাক দেয় তখন ওর দাদা বেঁচে ছিলো। এই বাড়িটা ওর দাদা ওর মায়ের নামে লিখে দেয়।কাপড়ের দোকানটা ওর মায়ের নামে রেজিস্টি করে দেয়।ওর বাবা তখন আয় রোজগারহীন হয়ে পড়ে।প্রতি মাসে হাত খরচ বাবদ অল্প কিছু টাকা ওর ভাই শাহেদ ওর বাপের হাতে ধরিয়ে দেয়।

এদিকে শেফালীর বাবার এই স্বভাবের জন্য শেফালীর বিয়ের প্রস্তাব তেমন একটা আসে না।তারপরও ওর বড় বোন অনেক চেষ্টা করে শেফালীর জন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে আসে।ছেলে ঠিকাদারী করে।পাশাপাশি ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা আছে।ছেলের নাম জাবেদ

ছেলে পক্ষ হয়তো রাজি হতো না।ওদেরও সমস্যা আছে তাই রাজি হয়েছে।ছেলের বড় ভাই পাগল ছিলো।তবে সবসময় পাগলামী করতো না।বছরের
বিশেষ ঋতুতে ওর পাগলামী বেড়ে যেতো।তখন ওকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হতো।প্রথমে শেফালী মত দিতে চায়নি।কিন্তু শেফালীর মা যখন বললো
—–মারে তোর বাবার কাহিনীর জন্য আত্মীয় স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারি না।সবাই বলে যার বাবা এরকম তার ছেলেমেয়েরা আর কি শিখবে?কেউ প্রস্তাব নিয়ে আসে না।অনেক কষ্টে সরুপা আর জামাই তোর জন্য এই প্রস্তাব নিয়ে আসছে।তুই রাজি না হলে সরুপা জামাইয়ের কাছে ছোটো হয়ে যাবে।এমনিতেই আমার মেয়েটা স্বামীর বাড়িতে দিনরাত্রি তোর বাবাকে নিয়ে খোটা শুনে।
এই কথা বলে শেফালীর মা অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো।যার ফলে শেফালী এই প্রস্তাবে রাজি হয়।

সেদিন ছিলো শুক্রবার।সারাদিন ধরে অনেক রান্না হলো।যদিও ছেলে পক্ষ বিকালে আসার কথা।নাস্তা খেয়ে চলে যাবে কিন্তু শেফালীর দুলাভাই বললো,
—–শিউলি তোমরা রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে রেখো।
পোলাও রোস্ট খাসির রেজালা মাছ ভাজি কাবাব শিউলি রান্না করলো।শিউলির হাতের রান্না খুব মজা হয়।তাই রান্নার দায়িত্ব ওর উপর পড়লো।খাবার শেষে ডেজার্ট হিসাবে পায়েস আর দই বানালো।

অবশেষে বিকাল বেলা ছেলেপক্ষ চলে আসলো। সবার আগে সরবত দেওয়া হলো।নাস্তা হিসাবে শিউলির হাতের বানানো চিকেন ফ্রাই নুডুলস কেক পরিবেশন করা হলো।শিউলি ছেলেপক্ষের সামনে যায়নি।ও দেখতে শেফালীর থেকে সুন্দরী।অনেকটা ওর মার মতো।শাহেদ আর রাশেদ খাবার পরিবেশন করলো।এরপর ছেলের মা শেফালীর মাকে বললো,
—–আপা এবার মেয়েকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন।
—–সরুপা, ভিতরে গিয়ে শেফালীকে নিয়ে আয়।
সরুপা ভিতরে গিয়ে শেফালীকে নিয়ে আসলো।শেফালী খুব ফ্যাশন সচেতন মেয়ে।সুন্দর করে সাজতে পারে।ও আজকে অফ হোয়াইট জমিন আর লাল পারের কাঞ্জিভরন শাড়ির সাথে ম্যাচ করে মুক্তোর কানের দুল গলার নেকলেছ আর হাতে কাঁচের লালচুড়ি পড়েছে।ওকে অনেক সুন্দর লাগছিলো।ছেলের বাবা বললো,
—-আসো মা,আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি
শেফালী ওদের মুখোমুখি সোফায় বসলো।আড় চোখে শেফালী জাবেদকে দেখলো।জাবেদ বেশ সুদর্শন। কোন সন্দেহ নেই এতে।কিন্তু শেফালীর কেন যেন মনে হলো এই ছেলেকে নিয়ে জীবনে সুখী হওয়া অনেক কঠিন।বাবা মার বাধ্য ছেলেরা যেমন জাবেদকে শেফালীর কাছে সে রকম মনে হয়েছে।বাবা মার বাধ্য হওয়া দোষের না কিন্তু স্ত্রীকেও মুল্যায়ন করতে হয় তা না হলে স্ত্রীর জীবনটা তেজপাতা হয়ে যায়।ছেলের মা বললো,
—–তুমিতো এখন ডিগ্রী পড়ছো।
শেফালী মাথা নাড়লো।
—–তোমার কি আরও পড়াশোনা করার ইচ্ছে আছে।
—-জ্বি,ডিগ্রী পাশ করে ফ্যাশন ডিজাইনের উপরে ছ,মাসের একটা কোর্স করার ইচ্ছা আছে।তারপর ফ্যাশন ডিজাইনার হিসাবে কাজ করবো।
ছেলের মা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন,
—–আমার আসলে একটা সংসারী মেয়ে দরকার।তুমি সংসার সামলিয়ে করতে পারলে করবে।
সরুপার জামাই রমজান মিয়া শেফালীর উপর বিরক্ত হলো।মনে মনে ভাবছে এমনিই প্রস্তাব আসে না, তার উপর উনি আবার ফ্যাশন ডিজাইনার হিসাবে কাজ করবেন।
জাবেদের বাবা শেফালীকে বললো,
—-মা, তুমি এখন ভিতরে যেতে পারো।একটু পরেই মাগরিবের আযান দিবে।আমরা সবাই নামাজ পড়ে নেই।
জাবেদের মা সরুপাকে বললো,
—–সরুপা আমি আর আমার বোন নামাজ পড়বো।ভিতরের রুমে একটু ব্যবস্থা করে দাও।
সরুপা ঘরের ভিতরে গেলো।ওর পিছনে জাবেদের মা খালা আর বোনও গেলো।সরুপা ওদেরকে শেফালীর রুমের কাছে নিয়ে গেলো।শিউলি ওদের সাড়া পেয়ে বের হতে গিয়ে মুখোমুখি হয়ে গেলো।এদিকে শিউলিকে আড়াল করে নিয়ে যেতে ওদের মাও ছুটে এসেছে।তার আগেই শিউলি রুম থেকে বের হওয়ার সময় ওদের সাথে দেখা হয়ে গেলে জাবেদের মা শেফালীর মাকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-আপা ও কি হয় আপনার।
আমতা আমতা করে শেফালীর মা বললো,
—–ও আমার ছোটো মেয়ে শিউলি।সামনে এইচএসসি দিবে তাই পড়াশুনা করছিলো।
—-আপনার ছোটো মেয়েটা বেশ সুন্দরী।অনেকটা আপনার মতো।শিউলিকে জাবেদের খালা জিজ্ঞাসা করলো,
—–কি নাম তোমার মা
—-শিউলি
——খুব সুন্দর নাম
শিউলি তাড়াতাড়ি ওদের সামনে থেকে কেটে পড়লো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here