জীবনের নানা রং পর্ব-১২

0
532

#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব–বারো
মাহাবুবা বিথী

জীবনের স্রোতে শিউলি বিয়ের ছ,মাস পর আবারো কনসিভ করে।এবার জাবেদ শিউলিকে কিছুদিনের জন্য শ্বশুর বাড়ি ঢাকাতে রেখে আসতে চায়।কুমিল্লায় থাকলে সংসারের কাজকর্ম সব ওকেই সামলাতে হয়।এই সময়টা শিউলির বিশ্রামের প্রয়োজন।যদিও জাবেদের মা শিউলির বাপের বাড়ি যাওয়াটা ভালোভাবে নেয়নি।ওনার কথা হচ্ছে ওনি তো শ্বশুর বাড়িতে বাচ্চা জন্ম দিয়েছেন।ওনার তো কোন সমস্যা হয়নি।ওনার মনে হলো বাপের বাড়ি যাওয়াটা শিউলির একধরণের আদিখ্যেতা।দেখি বাপের বাড়ির মানুষ কদিন নবাবজাদীকে পোষে।

অতঃপর জাবেদ শিউলিকে ওর বাপের বাড়িতে রেখে আসে।বিয়ের পর শিউলিকে পেয়ে ওর ভাই বোনরা খুব খুশী হয়।সবাই মিলে অনেক রাত আড্ডা দেয়।খুব ভোরে শেফালীর ফোনে জরিনার নাম্বার থেকে একটা ফোন আসে,
—-হ্যালো, এতো সকালে ফোন দিয়েছেন কোনো সমস্যা।
—-কাল রাতে বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়েগেছিলাম।আমার ব্লিডিং হচ্ছে। আমার কিছু টাকার দরকার।হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
—-শেফালী উনাকে কাউকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলে।হাসপাতালের ঠিকানা দিলে শেফালী ঐ হাসপাতালে টাকা নিয়ে যাবে।
একটু বেলা হলে শেফালী দোকান থেকে তিরিশ হাজার টাকা নিয়ে হাসপাতালে চলে যায়।জরিনা তখন লেবার রুমে ছিলো।পড়ে যাওয়ার কারণে সময়ের আগেই বাচ্চাটা হয়ে যায়।কিন্তু বাচ্চটাকে বাঁচাতে ইনকিউবিটরের দরকার হয়।ঐ ক্লিনিকে এই ব্যবস্থা না থাকায় শেফালী জরিনাকে সাথে নিয়ে সরকারী হাসপাতালে চলে যায়।বাচ্চাকে ইনকিউবিটরে রাখার ব্যবস্থা করে দেয়।জরিনা শেফালীকে জিজ্ঞাসা করে,
—-বাচ্চাটা বাঁচবে তো?
শেফালী বলে,
—আল্লাহকে ডাকেন।আল্লাহ হায়াত রাখলে বাঁচবে।জরিনা শেফালীকে বলে,
—-বাচ্চটাকে আমি কার পরিচয়ে বড় করবো।আমার যে আপনার বাপের সাথে বিয়ে হইছে এটাই তো তেমন কেউ জানে না।
শেফালী বলে,
—-আপনার বাচ্চাটা বাঁচবে কিনা জানি না।যদি আপনি ওকে না নিতে চান তাহলে ওর ব্যবস্থা আমি করবো।
জরিনা এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো।সে শেফালীর কাছে টাকা চায়।শেফালী ওকে কিছু টাকা দিয়ে হাসপাতালে ওকে রেখে বাড়ির পথে রওয়ানা দেয়।
সারাদিনের ক্লান্তি শেফালীর উপরে ভর করে।সন্ধের
পর শেফালীও বাড়ি চলে আসে।রাহেলা বেগম আর শাহেদ সারাদিন কোথায় ছিলো জানতে চায়।
শেফালী বলে
—ওর জরুরী কাজে এতোক্ষণ বাহিরে ছিলো।

এদিকে দোকান থেকে এত টাকা নেওয়ার কারণে শাহেদের সাথে মনোমালিন্য হয়।শাহেদ শেফালীর কাছে টাকার হিসাব চায়।শেফালী ওকে বলে,
—শাহেদ আমি তোমাকে টাকার হিসাব দিতে বাধ্য নই।এই টাকায় আমারো অধিকার আছে।
শাহেদ বলে,
—-আমি আমার বাবার বড় ছেলে।ছেলে সন্তান হিসেবে তোমার থেকে আমার অধিকার বেশী।তাই তুমি আমাকে হিসাব দিতে বাধ্য।
শেফালী রাহেলা বেগমকে বলে,
—-মা শাহেদ কি বলছে?তুমি কিছু বলছ না।
রাহেলা বেগম বলে,
—ওতো ভূল কিছু বলছে না।তুই বললেই পারিস টাকাটা কোথায় খরচ করেছিস।
শেফালী বলে,
—-ঠিক আছে, আজ না হোক কাল এই টাকা আমি তোমাদের ফেরত দিয়ে দিবো।
এই কথা বলে শেফালী কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুমে চলে আসে।
রাত হয়ে যায়।শেফালী ডিনার না করেই শুয়ে পড়ে।
শিউলির দিকে তাকিয়ে কষ্ট মাখা হাসি দিয়ে বলে
—-তুই ভাত খেয়েছিস।নিজের শরীরের অযত্ন করিস না।
শিউলি বলে,
—-আমি খেয়েছি। তুমি তো কিছু খেলে না।
শেফালী বলে,
—আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।পরে খেয়ে নিবো।
শেফালী ঘুমের ভান করে শুয়ে শুয়ে ভাবে,ওর জীবনটা কত অদ্ভূত।যার জন্য চুরি করে সেই বলে চোর।শেফালী ওর বাবার এই অপকর্মের কথা কাউকে জানাতে চায় না।বাবাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষের কাছে খোঁটা শুনতে ভালো লাগে না।ওরাতো বাবার ছেলে সন্তান।ছেলেদের গায়ে কলঙ্ক লাগে না।এই সমাজ মেয়েদেরকেই কথা শুনায়।শাহেদের কথায় শেফালী অনেক আহত হয়।শেফালী তো নিজের প্রয়োজনে এই টাকাটা খরচ করে নাই। ওরা যাতে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারে তাই ওর এই গোপনীয়তা।অথচ ওরা শেফালীর উপর এই বিশ্বাসটুকু রাখতে পারলো না।এই সংসারের ভালোর জন্য এই বিষটুকু ও একাই পান করে নিলো।অথচ ওর আপনজনেরাই ওকে কাঁঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলো।যাদেরকে বুক দিয়ে এতোকাল আগলে রাখলো তারাই ওকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়।মেয়েরা মনে হয় পিতৃগৃহে প্রথম লিঙ্গ বৈষম্যর শিকার হয়।ওর ভাইরা তো কোনো দিন মায়ের জন্য বাবার বিরুদ্ধে লড়াই করেনি।অথচ ও বড় হওয়ার পর থেকে মায়ের জন্য বাবার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।মা ও আজ ছেলেদের হয়ে কথা বললো। শেফালীর উপর বিশ্বাস রাখতে পারলো না। শাহেদ কেবল ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। এখনি শেফালীকে
ডমিনেট করতে চায়।
আসলে স্বার্থের কারণে মানুষের চরিত্রের রংগুলো বদলে যায়।তারপর ও শেফালীর মতো মেয়েরা ভালবেসে বুক দিয়ে আপনজনদের আগলে রাখে।

সাতদিন হলো শিউলি বাপের বাড়িতে এসেছে।মা ভাই বোন সবাই অনেক আদর করছে।ওর শ্বশুর বাড়ী ওর সংসারের গল্প শুনছে।সবাই আগের মতই আছে শুধু ওর অবস্থানটা বদলে গেছে।বিয়ের আগের জোরটা এখন আর মায়ের সংসারে নাই।ও যেন এখন এ বাড়ির অতিথি।তাই সেদিন শাহেদ আর শেফালীর তর্কাতর্কির সময় ওর মনে হয়েছিলো শেফালীর হয়ে শাহেদকে কিছু কথা বলা দরকার।কিন্তু ও বলতে পারেনি।এ বাড়ির পরিবেশে ওর এইটুকু বোধদয় হয়েছে ওর বাপের বাড়ির কোনো বিষয়ে এখন আর কথা বলার কোনো অধিকার ওর নাই।

বিয়ের আগে ওর একটা রুম ছিলো।সেটা এখন রাশেদের। শিউলি এখন শেফালীর রুমে থাকে।জাবেদ আসলে শেফালী মায়ের সাথে রুম শেয়ার করে।শেফালীর রুমে তখন শিউলি আর জাবেদ থাকে।এ বাড়িতে কোনোকিছুতেই ওর কোনো অস্তিত্ব নেই।তারউপর মায়ের কথায় ওর অস্বস্তি হতে লাগলো।
রাহেলা বেগম শিউলিকে জিজ্ঞাসা করলেন,
—-শিউলি তুই কি ও বাড়ি থেকে ঝগড়া করে এসেছিস?
—-তোমার এ কথা মনে হলো কেন মা?
—-সেবার তোর বাচ্চাটা এবরশোন হলো।তাই হয়তো এবার তুই নিজ থেকেই চলে এসেছিস।এই জন্য বলছি।তুই রাগ করিস না মা।তোর শাশুড়ীটা তো সুবিধার না।একটু মানিয়ে নিয়ে থাক।
শিউলির অস্বস্তি হতে থাকে।শাহেদ আবার শিউলিকে বলে,
—–আপু তুই আর কিছুদিন থেকে যা।
শিউলি মুখে কাউকে কিছু বলে না।শুধু বুকের ভিতর কষ্টগুলি জমা হয়।

জাবেদ শিউলিকে দেখতে শ্বশুর বাড়ি চলে আসে।শিউলি জাবেদের সাথে কুমিল্লা চলে যায়।

শিউলিকে কুমিল্লায় রেখে পরদিন জাবেদ ঢাকায় চলে আসে।সকালে নাস্তার টেবিলে শাশুড়ি মরিয়ম শিউলিকে বলো
—পনেরো দিন ও বাপের বাড়ির ভাত তোমার কপালে জুটলো না।এটাই হচ্ছে জীবনের কঠিন বাস্তবতা।বাপ ভালো জুতের হলে তাও বাপের বাড়িতে মেয়েদের কদর হয়।আর বাপ যদি বেঁচে না থাকে বাপের বাড়িতে মেয়েদের বান্দিগীরি করে খেতে হয়।আমার জীবনের বাস্তবতা আমাকে এটাই শিখিয়ে দিয়েছে।তাই হাজার দুঃখ কষ্ট সয়েও মেয়েরা সংসার করে খায়।
—-শিউলি শাশুড়িকে কিছু বলে না।কথাগুলো শিউলির বুকের ভিতরে তীরের ফলার মতো বিঁধলো।
শাশুড়ীকে ও পছন্দ করে না কিন্তু আজকের কথাগুলো ওর চিরন্তন সত্য মনে হলো।

জীবনের দুঃখ কষ্ট বেদনার পথ মাড়িয়ে মাঝে মাঝে নিজেকে অনেক সুখী মনে হয়।বাবা কোনদিন মাকে ভালবাসেনি বলে আল্লাহর কাছে সব সময় প্রার্থনা করতো,এমন একটা মানুষ যেন ওর জীবনসঙ্গী হয় যে ওকে খুব ভালবেসে যাবে।আর ওর ভালবাসার ইরেজারে দুঃখ কষ্ট বেদনাগুলো মুছে যাবে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here