জীবনের নানা রং পর্ব-২

0
903

#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব-দুই
মাহাবুবা বিথী

সবাই নামাজ পড়ে নিলো।জাবেদের মা ফিসফিস করে ওর বোনকে বললো,
—–শেলী,আমার শিউলিকে পছন্দ হয়েছে।বয়সটাও শেফালীর থেকে কম আছে।গড়ে পিঠে নেওয়া যাবে।শেফালীকে দেখলি না কটকট করে কথা বলে। বেশী বয়সের মেয়ে সহজে বশে আসতে চায় না।বাপের নাই চালচুলো উনি আবার ফ্যাশন ডিজাইনার হবে।শুনে আমার গা জ্বলে গেলো।নেহায়েৎ আমার বড় ছেলেটা পাগল।সেই জন্য এই বাড়িতে আসা।তা না হলে আমার জাবেদের জন্য কতো ভালো উচ্চবংশীয় পরিবার থেকে মেয়ে আনতে পারতাম।এরকম হাড় হাভাতে পরিবার থেকে মেয়ে আনতে হতো না।তুলি বললো,
—–মা এসব কথা তো বাড়ি গিয়েও বলতে পারতে।এরা শুনে ফেললে আমাদের সম্পর্কে কি ভাববে
—-তুই চুপ কর।তোকে এতো জ্ঞাণ দিতে হবে না।ছোট মানুষ ছোটো মানুষের মতো থাক।

এমন সময় দরজায় কে যেন নক করছে।তুলি দরজা খুলে দেখে সরুপা দাঁড়িয়ে আছে।
—-আন্টি চলেন ড্রইং রুমে বসি
—হ্যা চলো
সবাই মিলে ড্রইং রুমে চলে যাওয়ার পর শেফালী এসে রুমে ঢুকলো।রমজান মিয়াও ওর পিছু পিছু রুমে এসে শেফালীকে বললো,
—-ফ্যাশন ডিজাইনার হবো এ কথা ওখানে না বললে চলছিলো না।
—-শোনেন দুলাভাই, আমি আপুর মতো করে সংসার করতে পারবো।সারাদিন বান্দীর মতো খাটে তবুও আপনার মায়ের মন পায় না।আপনিও আপনার মায়ের কথা শুনে আমার বোনটাকে বকাঝকা করেন।
—-মুখে শুধু বড় বড় কথা বলতে শিখেছো।যাদের পরিবারে চালচুলো নেই সেই পরিবারের মেয়েদের কেউ বিয়ে করতে চায় না।কত কষ্ট করে পাত্র যোগাড় করেছি তা আমি জানি।
—–আপনাকে আমার জন্য পাত্র যোগাড় করতে হবে না।আল্লাহ আমার হাত পা দিয়েছে আমি নিজেই আমার নিজের ব্যবস্থা করে নিবো।
এমন সময় রাশেদ এসে ছেলেপক্ষের সাথে কথা বলার জন্য রমজানকে ডেকে নিয়ে গেলো।

রমজান সরুপাকে ডিনারের জন্য টেবিল রেডী করতে বলে ড্রইংরুমে বসলো।ওদের সাথে টুকটাক কথা বললো।তারপর টেবিল সাজানো হলে ছেলেপক্ষকে ডিনারে বসিয়ে দেয়।খাবার টেবিলে সবাই রান্নার খুব প্রশংসা করছে।ছেলের বাবা আজমল সাহেব বললেন।
—-রান্না কি শেফালী মা করেছে?
—-না আঙ্কেল,আমার ছোটোশালী শিউলি করেছে।অনেক লক্ষী মেয়ে।ওর হাতের রান্নার খুব স্বাদ।ওই তো আমার শাশুড়ীর সংসারটা আগলে রাখে।খুব সংসারী মেয়ে।সবধরনের রান্না জানে।দারুণ কেক বানায়।আজকের সব খাবার ওই বানিয়েছে।

শেফালী পাশের রুম থেকে রমজান মিয়ার কথা শুনতে পাচ্ছে।ওর কথাগুলো দুলাভাইয়ের খুব গায়ে লেগেছে।বেশ হয়েছে দুলাভাইকে কথা শুনানোর ইচ্ছে ছিলো আজ সুযোগ বুঝে শুনিয়ে দিয়েছে।দিনরাত আপাকে বাবাকে নিয়ে কথা শুনতে হয়।পান থেকে চুন খসলেই ও বাড়ির সবাই আপাকে বলে,”যার বাবা বাজারের মেয়ে নিয়ে পড়ে থাকে তার মেয়ের স্বভাব চরিত্র কতটুকু ভালো হবে”।
মাকে নিয়েও মাঝে মাঝে আপাকে কথা শুনতে হয়।আমার মা এর সমস্যা আছে।মা পারেনি বাবাকে ঘরে আটকিয়ে রাখতে।
তার উপর আপার ইউটেরাসে টিউমার আছে।ডাক্তার বলেছে খুব তাড়াতাড়ি অপারেশন করে ফেলতে।অথচ দুলাভাই অপারেশন করাচ্ছে না।আপার দুটো মেয়ে।ছেলে হয়নি।সুতরাং তার ছেলে চাই।আপা মরুক কি বাঁচুক তাতে কোন সমস্যা নাই।
দরজায় কে যেন নক করছে।খুলে দেখে সরুপা।
—ড্রইং রুমে আয়।ওরা চলে যাচ্ছে।
শেফালী সরুপার সাথে ড্রইং রুমে গেলো।ছেলের মা বললো,
—–মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে।তবে বাসায় গিয়ে সবার সাথে আলোচনা করে আমাদের মত জানিয়ে দিবো।
ছেলেপক্ষ চলে যাওয়ার পর রমজান শাশুড়ীকে বললো,
—-মা আমি আপনার মেয়েদের জন্য ছেলে দেখতে পারবো না।আপনার পরিবারের যা অবস্থা অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে ছেলে খুঁজতে হয়।আবার কথাও শুনতে হয়।ওদের তো হাত পা আছে।ওরা নিজেদের ব্যবস্থা নাকি নিজেরাই করে নিবে।তাহলে তো আমার দরকার নাই।
—বাবা তুমি শেফালীর কথায় কিছু মনে করো না।ওদের বয়স কম।জীবনের জটিলতা ওর কিভাবে বুঝবে।
রমজান রাতের খাবার খেয়ে সরুপাকে নিয়ে মতিজিলে চলে গেলো।মতিজিলে সরুপার শ্বশুর বাড়ি।রমজাম ওখানে দুহাজার স্কয়ার ফিটের একটা ফ্লাট কিনেছে।
যদিও শাশুড়ি রমজানকে থেকে যেতে বলেছিলো কিন্তু বাসায় ওর মা আর বাচ্চা দুটো একলা আছে।সুতরাং ওর পক্ষে থাকা সম্ভব না।
বাসায় এসে রমজান সরুপার উপরে একচোট নিলো।
—-শোন সরুপা,মানুষ যখন সুখে থাকে তখন তার দুঃখ বিলাস শুরু হয়।বেশী সুখে আছোতো, দেখবো তোমার বোনদের কোন রাজপুত্র এসে বিয়ে করে নিয়ে যায়।তোমার বোনদের কতটা রাজরানী বানিয়ে রাখে।আমার মা তোমাকে দয়া করে বউ করে এনেছে।কোথায় আমার মার আরও সেবা যত্ন করবে তা,না, সারাক্ষণ আমার মায়ের বদনাম বলে বেড়াও।
—-তোমরা তো আমায় বউ করে এনে আমার পরিবারকে উদ্ধার করেছো।ঠিক আছে শেফালীর হয়ে আমি তোমার কাছে মাফ চাইছি।
রমজানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সরুপা ওয়াশরুমে চলে গেলো।

ওদিকে শেফালীর মা রাহেলা বেগম চিন্তায় অস্থির।ওরাতো বললো মেয়ে পছন্দ হয়েছে।তবে শেফালীকে পছন্দ করেছে না শিউলিকে। যদি শিউলি পছন্দ করে থাকে তাহলে শেফালীকে রেখে শিউলিকে বিয়ে দেওয়া ঠিক হবে।বড় কে রেখে ছোটকে বিয়ে দিলে পরে বড়টার আর বিয়ে হয় না।সবাই ভেবে নেয় মেয়ের খুঁত আছে।

আবার যদি কাউকে পছন্দ না হয় এসব চিন্তায় রাহেলা বেগমের রাতে ঘুম হয় না।অতীত স্মৃতি গুলি হাতড়ে বেড়ায়।বিয়ের পর প্রথমে শেফালীর বাবা রফিক মিয়া কিছুদিন ভালোই ছিলো।রাহেলার একটা করে বাচ্চা হয় আর রফিক মিয়ার স্বভাবে আবার পরিবর্তন হয়।পর পর তিনটা মেয়ে হওয়াতে খুব নাখোশ হয়েছিলো।এরপরে মেয়ে হলে নাকি রাহেলাকে ডিভোর্স দিবে।মেয়ে পয়দা করে নাকি রাহেলা খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে।চতুর্থবার ছেলে হওয়াতে এ বাড়ির ভাত তার কপালে রইলো।কিন্তু রাতে নাকি রাহেলা বেগম সুখ দিতে পারে না।এই অজুহাতে বাহিরে রাত কাটানো শুরু করে।মদ খেয়ে বেড়ায়।আবার ঘরে এসে রাহেলা বেগমকে বেদম পেটায়।গরীব ঘরের মেয়ে।কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।বাবা বেঁচে নেই।মা ভাইয়ের সংসারে থাকে।তাই মাটি কামড়ে এখানেই পড়ে থাকে।
সারা রাত রাহেলা বেগমের চোখে ঘুম এলো না।ভোরের আলো ফুটতেই বিছানা থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে নেয়।ছেলে পক্ষ থেকে কি খবর আসে সেই চিন্তায় রাহেলা বেগম অস্থির হয়।শেফালী শিউলিরা ঘুম থেকে উঠে নাস্তা বানায়।রাহেলাকে নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকে।রাহেলা বলে,
—-তোরা সবাই খেয়ে নে।আমার এখন খেতে ইচ্ছা করছে না।পরে খাবো।
শেফালী ঠিক বুঝেছে,মা আসলেই ওর বিয়ে নিয়ে খুব চিন্তায় আছে।ওর কেন জানি মনে হচ্ছে ওরা শিউলিকে পছন্দ করবে।কারন দুলাভাই ও ওকে খুব একটা পছন্দ করে না।ওর স্পষ্ট কথা দুলাভাইয়ের ভালো লাগে না।খাবার টেবিলে দুলাভাই যেভাবে শিউলির প্রশংসা করলো পছন্দ করলে ওরা শিউলিকেই করবে।
বিকালের দিকে হন্ত দন্ত হয়ে রমজান মিয়া শেফালীদের বাসায় আসলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here