#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব-চার
মাহাবুবা বিথী
রাতের খাবার শেষ করে সবাই শুয়ে পড়লে মেইন গেটে তালা দিয়ে রাহেলা বেগম ছাদে চলে যায়।কি ভাগ্য নিয়ে রাহেলা বেগম পৃথিবীতে এসেছে? জন্মের সময় মা মরে গিয়েছে। সৎমার সংসারে বড় হয়েছে।বাবা বাড়িতে থাকলে দুমুটো ভাত জুটতো। না থাকলে বাসি পঁচা ভাতের পান্তা জুটতো।সৎ মার অত্যাচার থেকে বাঁচতে রাহেলাও বিয়ের বিষয়ে আগ্রহী ছিলো। বাবাও নিজের সংসারের সুখ বজায় রাখতে কোনো খোঁজ খবর না নিয়েই শেফালীর বাপের সাথে রাহেলার বিয়ে দেয়।বিয়ের আগে রাহেলা ভেবে ছিলো বড় লোকের বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে ভাতের কষ্ট আর পেতে হবে না।সত্যিই রাহেলার ভাতের কষ্ট হয় নাই কিন্তু দুঃখের নকশীকাঁথায় যার জীবন মোড়ানো থাকে তার দুঃখ কষ্টের অভাব হয় না।এখন আর বাবাও বেঁচে নেই।এতো বড় বিশাল পৃথিবীতে ওর মাথায় হাত রাখার কেউ নাই।আল্লাহপাকের রহমত আছে বলে ও এখনও বেঁচে আছে।
ঘুম আসছে না। শেফালী ছাদে চলে যায়।আজ আষাঢ়ের ভরা পূর্নিমা।হাস্নাহেনার সুবাস ভেসে আসছে। মনটা ভালো নেই।ছাদে গেলে শেফালীর মন ভালো হয়ে যায়। যাবার সময় কান্নার শব্দ শুনতে পায়।রাত একটা বাজে।এতো রাতে কে কাঁদে?
ছাদের কোনায় হাসনাহেনা গাছের আড়ে একটা ছায়া দেখা যায়।ওদের বাড়িটা একতলা ছাদের বাড়ি।শেফালী জিজ্ঞেস করে,
—-কে ওখানে
—-আমি (কান্না লুকিয়ে)
—-আম্মু তুমি ঘুমাওনি।প্রেসার হাই হয়ে যাবে।ঘুমিয়ে পড়ো।
—-কি ভাবে ঘুমোবো মা।আমি ঘুমটাকে কবে বিদায় দিয়েছি।মাঝে মাঝে সারা রাত জেগে থাকি। চোখের পাতা ভারী হয়ে যায়।তাও ঘুম আসে না। শেফালী তুই কি খেয়াল করেছিস আজ তোর বাবাকে কেমন উদভ্রান্তের মতো লাগছিলো।তাই ভাবছি শরীর খারাপ করলো নাতো।
—মা তুমি এতো রাতে ওই নষ্ট লোকটার কথা ভেবে ঘুম কামাই দিচ্ছো।আমিতো সবসময় আল্লাহকে বলি পৃথিবীতে প্রতিদিন এতো মানুষ মরে উনার মরণ হয় না কেন।
—এভাবে বলিস না।তোর তো বাবা হয়।আমার সাথে এখন কোন সম্পর্ক নাই তবুও সেতো আমার সন্তানদের বাবা।মাঝে মাঝে ভাবি আমার কোথায় ঘাটতি ছিলো?লোকটা ঘরমুখো হলো না
—-খাছলোত নষ্ট হয়ে গেলে মরে গেলেও তার পরিবর্তন হয় না। আমার দাদী তার এই বড় সন্তানটিকে মানুষ করতে পারেনি। দাদা শাসন করতে গেলেই দাদী ঢাল হয়ে দাঁড়াতো।অতি আদরে সন্তান কখনও মানুষ হয় না। তুমি কখনও ওই লোকটার কথা আমার সামনে বলবে না।আমাদের সংসারের সে হচ্ছে শনি।
—-তারপরও সে তোদের বাবা।এখনি যদি লোকটার ভালমন্দ কিছু হয় ফেলে দিতে পারবি।পারবিনা।তখন ঠিক ছুটে যাবি।সময় হলে আমার এই কথার অর্থ বুঝতে পারবি।মিথ্যে মায়ার সংসারের টান এতো বেশি হয় বলেই দিন শেষে সবাই জীবনের রঙ্গমঞ্চে বেঁচে থাকতে চায়।
শেফালী ওর মাকে বলে
—-বাচ্চা পয়দা করলেই বাবা মা হওয়া যায় না মা।বাবা মা হতে গেলে যোগ্যতা লাগে।বাবা হচ্ছে মাথার উপর বিশাল ছাদ।বাবার ছায়া হচ্ছে একটা বিশাল বট গাছের ছায়া।যে ছায়া পৃথিবীর সব উত্তাপ থেকে সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখে।বাবার কাঁধ হচ্ছে সবচেয়ে চওড়া যেখানে সংসারের সব বোঝা সে একাই বয়ে বেড়ায়।আর আমাদের কাছে বাবা হচ্ছে এক আতন্কের নাম।আমাদের বাবার কর্মের জন্য আত্মীয় স্বজন কারো কাছে মুখ দেখাতে পারি না।মা তুমি ওই লোকটার কথা আর বলো না।ঘুমিয়ে পড়ো।কাল সকালে আপা দুলাভাই আসবে।শিউলিকে নিয়ে জাবেদের সাথে দেখা করতে যাবে।
রাহেলা বেগম কথা না বাড়িয়ে নিচে নেমে গেলেন।
শেফালী তার ছেলেবেলায় হারিয়ে গেলো।ওদের যৌথ পরিবার ছিলো।এই অঞ্চলে বড়ব্যবসায়ী হিসাবে ওদের অনেক নামডাক ছিলো।সদরঘাট থেকে জাহাজে করে ওদের তৈরি কাপড় পৃথিবীর অনেক দেশে চলে যেতো।এখন অবস্থা অনেক পড়তির দিকে।মদ আর মেয়ে মানুষ নিয়ে পড়ে থাকলে সংসারের উন্নতি হয় না। দাদী মারা যাবার পর এই সংসার আলাদা হয়।শেফালীর এখনও মনে আছে,দাদী সব সময় মাকে ফকিন্নীর ঝি বলতো।বাবাযে মার উপর এতো অন্যায় করতো কোনদিন বাবাকে শাসন করেনি।বরং দাদীকে বলতে শুনেছে,
“বেডা মাইনষের রাগ নাকি বাদশাহ,আর বেডী মাইনষের রাগ বেশ্যা”ওর খুব রাগ হতো দাদীর উপর।
একটু বড় হওয়ার পর দাদীকে এই কথার অর্থ জিজ্ঞেস করেছিলো।দাদী বলেছিলো,
—–শোনরে বইন,বেডা মাইনষে রাগ করে ঘরেততে বাইর হইলে সে রাজার মতই ঘরে ফিরে।তার শরীরে কলঙ্ক লাগে না।আর মাইয়া মানুষ ঘরেততে বাইর হইয়া গেলে লোকে তারে কলঙ্কিনী বলে।ঘরের বাইরে তারে নষ্ট করার লাইগা অনেক ফাঁদ পাতা থাকে
শেফালী দাদীরে বলেছিলো,
—-দাদী আমি তোমার সাথে একমত না।মেয়েদের জন্য এই তকমাগুলো পুরুষেরাই লাগিয়ে দিয়েছে।যাতে তাদের শত অত্যাচার সহ্য করে ঘরে বন্দি থেকে যায়।আর নিজেরা নষ্ট হইলেও সমস্যা নেই।
শেফালী যখন ছোটোবেলায় ওর বাবাকে মাকে পেটাতে দেখতো ওর মনে হতো থানায় পুলিশ স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য আসামীকে পেটায়।আমার মাতো কোনো অন্যায় করেনি।ও তখন জায়নামাজ নিয়ে বসে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করতো।আল্লাহ মার খেতে খেতে আমার আম্মুটা যেন মরে না যায়।তাহলে আমরা মা ছাড়া কেমন করে বেঁচে থাকবো।আল্লাহ তুমি আমার মাকে বাঁচিয়ে রাখো।
উচ্চশিক্ষিত রুমানাকে অন্ধ করে দেয় তার স্বামী,পড়া লেখার করার জন্য জুঁইয়ের আঙ্গুল কেটে দেয় তার স্বামী।আর শেফালীর বাবা তো অশিক্ষিত চন্ডাল।ওর কাছে আর কতটা ভালো আশা করা যায়।শেফালী নিজেকেই নিজে সান্তনা দেয়।
দূরে রাত জাগা পাখি ডানা ঝাপটায়।সারমেয় করুনস্বরে ডেকে যায়।ওর বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। কোনো অমঙ্গলের ইঙ্গিত নয়তো। শেফালী রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো।একটু পরেই ফজরের আযান শোনা যায়।শেফালী ওজু করে নামাজ পড়ে নেয়।
ভোরের দুধসাদা আলো ফুটতে শুরু করেছে।এমন সময় ডোরবেলটা বেজে উঠলো।
এতো সকালে কে আসলো?শেফালী দরজা খুলে দেখে দোকানের কর্মচারী রমিজ দাঁড়িয়ে আছে
—-রমিজ এতো সকালে কি মনে করে?কোন সমস্যা
—-আপা একটা খারাপ খবর আছে।খালুজানরে হাসপাতালে ভর্তি করছে।রাতে হঠাৎ করে বুকে ব্যথা উঠছিলো।ঘরেই বমি করছে।বউটা আমারে ফোন দিছে।আমি আইসা খালুরে হাসপাতালে ভর্তি করছি।টাকা পয়সাও আমি দিছি।
—-কত টাকা খরচ হইছে।আমারে জানাইও আমি দিয়ে দিবো।কোন হাসপাতালে ভর্তি করছো।হাসপাতালে কে আছে?
—-ঐ মহিলাটা আছে। সলিমুল্লাহ মেডিকেলে ভর্তি করছি আপা।আচ্ছা তুমি দোকানে বসো।হাসপাতালে আর যেতে হবে না।আমি যাচ্ছি।
শেফালী শিউলিকে বলে রিকশা নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হলো।মানুষের জীবন বড় বিচিত্র।যে বাবাকে সে সহ্য করতে পারে না তার অসুস্থতায় ঘরে বসে থাকতে পারলো না।ভাগ্য তাকে টেনে আনলো।
শেফালী খুব শক্ত ধাঁচের মেয়ে তারপরও শেফালীর চোখ দিয়ে বর্ষার নোনা জল ঝরছে।এ কিসের টানে শেফালী কাঁদছে।যে মানুষটা নিজেও সারা জীবন সুখ পেলো না তার আশে পাশের মানুষগুলোকে সুখে থাকতে দিলো না।কতটা নির্বোধ হলে মিথ্যা মরীচিকার পিছনে ছুটে জীবনটাকে বরবাদ করে ফেলে।
হাসপাতালের সামনে এসে ভাড়া মিটিয়ে কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।ওকে দেখে মহিলা ছুটে এসে বললো,
—–ওনার এখনও জ্ঞাণ ফিরে নাই।জ্ঞাণ না ফেরা পর্যন্ত ডাক্তার কিছু বলবে না।
শেফালী মহিলার দিকে তাকিয়ে দেখলো মুখটা পাংশুটে।শেফালী বললো
—-আপনি সকালে কিছু খেয়েছেন।
—-হ্যা খেয়েছি।রমিজ খাবার কিনে দিয়েছিলো।তারপর শেফালীকে এও জানিয়ে দিলো সে দুমাসের পোয়াতি।
এ কথা শুনে শেফালী মাথা ঘুরে পড়ে যাবার উপক্রম হলো।ও কি করে এই ঝড় সামলাবে।সামনে শিউলির বিয়ে।দু চোখে অন্ধকার নেমে আসছে।অবেলায় ধেয়ে আসা বানের ঢল কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কে জানে।
চলবে