জীবনের নানা রং পর্ব-৫

0
612

#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব-পাঁচ
মাহাবুবা বিথী

মাঝে মাঝে জীবনের সময়গুলো বড্ডো বিষাদে ভরে যায়।সেই ক্ষণগুলি অনেক দীর্ঘ হয়ে যায়।এতো ঘৃণা যে মানুষটার প্রতি তার দায়টা শেফালীকেই নিতে হচ্ছে।রক্তের টান মানুষ কখনও অস্বীকার করতে পারে না।

জীবন বড় বিস্ময়।ক্ষণে ক্ষণে এর রং পালটায়।বুকের পিঞ্জিরায় থাকা দুঃখ পাখিটা করুণ সুরে ডেকে উঠে।সেই সুরের মুর্ছনায় পরাণটা ছটফটায়।শেফালীর বুকের ভিতরে একই অবস্থা বিরাজ করে।

ওর বাপের বিয়ে করা বৌ এর খোঁজখবর শেফালী নিয়েছে।
ঐ মহিলার নাম জরিনা।মহিলার কাজ হচ্ছে বয়স্ক মানুষকে বিয়ে করা। কিছুদিন সংসার করে।এরপর ব্লাকমেইল করে টাকা পয়সা নিয়ে তালাক দেয়।এই টুকুন বয়সে তিনটে বিয়ে করেছে।বাপ যদি বেঁচে ফিরে আসে উনার ধাক্কা উনি সামাল দিবে।আর যদি মরে যায় এই ধাক্কা শেফালী কিভাবে সামাল দিবে সেই ভাবনা শেফালীকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

শেফালীর মতো মেয়েরা জীবনযুদ্ধে যতই ক্ষতবিক্ষত হোক জিতে ফেরা না পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়।ঝিনুক যেমন মুক্তোকে লুকিয়ে রাখে তেমনি শেফালীরা বুকের গভীরে কষ্ট লুকিয়ে রাখে।বাহির আবরণটা ঝিনুকের মতো শক্ত মোড়কে ঢাকা থাকে।সবাই দেখে ভাবে তার মতো সুখী কেউ নাই অথচ তার ভিতরটা কষ্টে পোড়া ছাই।
ডাক্তারের ডাকে শেফালী সম্বিত ফিরে পায়।

—-এখানে আক্কাস মিয়ার লোক কে
—আমি
—–পেশেন্ট আপনার কি হন
—–আমার বাবা
—–উনার আর একটা অ্যাটাক হয়ে গেছে।খুব ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আছে।আল্লাহকে ডাকেন, হায়াত থাকলে মানুষ মৃত্যু দুয়ার থেকে ফিরে আসে।হায়াত না থাকলে শত চেষ্টাতেও মানুষ বাঁচতে পারে না।
ডাক্তার চলে যাবার পর
শেফালীর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।এই মহিলাকে এখান থেকে সরাতে হবে।তা নাহলে ঝামেলা হতে পারে।পেটের বাচ্চাটা নিয়েও ঝামেলা করতে পারে। এখান থেকে না সরালে রমিজের কানে পেটের বাচ্চার কথাটা পৌছালে মহল্লায় দ্রুত ছড়িয়ে যাবে।সামনে শিউলির বিয়ের কথাবার্তা চলছে।
শেফালী ভাবছে,
—–এমনি কপাল আমার বাপটা মরে যাওয়ার আগেও আমাদের সাথে ভিলেন গিরি করলো।
শেফালী মহিলার কাছে গিয়ে বললো,
—-শুনলেনতো ডাক্তার কি বললো?আমি আপনাকে কিছু কথা বলবো মনোযোগ দিয়ে শুনেন।আমার বাবার নামে কোনো সম্পত্তি টাকা পয়সা নাই।সুতরাং আপনার টাকা পয়সা পাবার কোনো সম্ভাবনা নাই। কেউ আপনার সন্তানের দায়িত্ব নিবে না। বরং আপনার কলঙ্ক রটবে। উনি বেঁচে থাকলে হয়তো আপনি সামলাতে পারতেন।এখন আপনার একার পক্ষে সামলান কঠিন।কিন্তু এখন উনার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ।আমি আপনাকে যে পরামর্শ দিবো এতে আপনার সব কুল রক্ষা হবে।আপনি বাজারের বাসাটা ছেড়ে দিয়ে আপনার বাবা মার কাছে চলে যান।যতদিন আপনার সন্তান হবে না আমি আপনার দেখভাল করবো।আপনার মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে যান।আরসন্তান হওয়ার পর আপনার সাথে আমার চুক্তি হবে।চুক্তি অনুসারে আমি আমার দায়িত্ব পালন করবো।আপনিও আপনার দায়িত্ব পালন করবেন। আপনি আমাদের এলাকায় কখনও আসবেন না।চুক্তি ঠিকঠাক মানলে হয়তো কিছু টাকা পাবেন।
শেফালী মহিলার বডিল্যাঙ্গুয়েজ সুক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করতে লাগলো।চেহারা দেখে মনে হচ্ছে টোপটা গিলতে শুরু করেছে।
জরিনা মনে মনে ভাবছে,বুইড়াটা অসুস্থ হয়ে ওর বিশাল লজ হয়ে গেলো।তার উপর একটু ভূলে পোয়াতি হইয়া লসের উপরে লজ।বুড়া মইরা গেলে আর কিছুই জুটবে না কপালে। এর থেকে এই মেয়ের প্রস্তাব মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।বাচ্চা হওয়ার পরের মামলা পরে বুঝে নিবে। জরিনা শেফালীকে বললো,

—–আপনি প্রতিমাসে খরচ বাবদ কত টাকা দিবেন।
—-আমি কিন্তু আপনাকে টাকা দিতে বাধ্য নই।আমাদের সাথে বাবার এখন আর কোনো সম্পর্ক নেই।শুধু মানবিকতার খাতিরে আপনার এই দুঃসময়ে সাহায্য করতে চাইছি।প্রতি মাসে আমি আপনাকে তিন হাজার টাকা দিবো।এর বেশী দিতে পারবো না।
—-আর এক হাজার বাড়িয়ে দিয়েন।আমি পোয়াতি মানুষ।
—–সে জন্যই তো দিতে রাজি হয়েছি।তবে আপনার ডাক্তারের রিপোর্ট আমাকে দেখাবেন।
শেফালী মহিলার হাতে চার হাজার টাকা গুজে দিয়ে ফোন নাম্বারটা নিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো।কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারলো না।এই আপদ আবার কি ভোগান্তি ভোগাবে তা আল্লাহ পাক জানেন।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বেলা বারটা বাজে।বাসায় ফোন দেওয়ার জন্য মোবাইল বের করে দেখে দশটা মিসকল হয়ে আছে।আগে মাকে ফোন দিলো
—হ্যালো মা,আমি হাসপাতালে বসে আছি।বাবার শরীর খুব খারাপ।
—-হ্যা শুনেছি।রমিজকে ফোন দিয়ে জানলাম।তুই আর কতক্ষণ থাকবি।বাসায় চলে আয়।
—-রমিজ আর শাহেদকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও।আমি আসছি।আপা দুলাভাই চলে আসছে?
—-না এখনও আসেনি।
—-দুলাভাইকে আব্বার অসুস্থতার কথা জানিও না।
—-ঠিক আছে।
ফোনটা রেখে শেফালী ভাবছে দুলাভাই শুনলে তার মায়ের সাথে শেয়ার করবে।আর তার মা সুযোগ বুঁজে আমার বোনটাকে কথা শুনাবে।এই পৃথিবীতে প্রতিটা মেয়েই স্বামীর সংসার বাঁচাতে সব অপমান সয়ে মুখ বুঁজে সংসার করে যায়।দিনশেষে কি লাভ হয় জানি না।আর কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে মুখরা বেয়াদব পরিশেষে নষ্টা মেয়ের তকমাও লাগিয়ে দেয়।এই হচ্ছে নারীর জীবন।
রমিজ আর শাহেদ আসার পর শেফালী রিকশা নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বেলা দুটো বাজে।সকাল থেকে শেফালীর কিছু খাওয়া হয়নি।ক্লান্তিতে শরীরটা ভেঙ্গে আসছে।নিজের অজান্তে শেফালীর চোখ দিয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়লো।এই পৃথিবীতে প্রতিটি সন্তান তার বাবার ছায়ায় সুরক্ষিত থাকে অথচ শেফালীদের সংসারে ওর বাবার কারনেই ওদের জীবনটা অনিশ্চিত গন্তব্য এগিয়ে যাচ্ছে।বাবার ভালবাসা আদরে প্রতিটি কন্যা রাজকন্যা হয়ে উঠে।শেফালীদের কপালে রাজকন্যা হওয়ার সৌভাগ্য হলো না।

বাসার সামনে এসে ভাড়া মিটিয়ে কলিংবেল বাজালো।রমজান দরজা খুলে বললো
—–শেফালী তোমাকে এতো বিদ্ধস্ত লাগছে কেন?শরীর ঠিক আছেতো?
—–হ্যা আমি একদম ঠিক আছি।আপনারা লাঞ্চ করেছেন।
—-আমি আর সরুপা বাসা থেকে খেয়েই এসেছি।সরবত চা কিছু খাবেন?
—-না কিছু খাবো না।শিউলিকে নিয়ে জাবেদের সাথে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে যাচ্ছি।ওখানেই খাবো।

শেফালী দ্রুত কথা শেষ করে ওয়াশরুমে চলে গেলো।হাসপাতালে রোগীর যেমন অভাব নাই।রোগেরও অভাব নাই।তাই ঝড়নাটা ছেড়ে আগে শাওয়ার নিলো।গোসলের পর একটু ফ্রেস লাগছে।
রাহেলা বেগম টেবিলে খাবার রেডী করে শেফালীকে ডাকলো,
—–শেফালী খেতে আয়
—–আসছি মা
রাহেলা বেগম শেফালীকে জিজ্ঞাসা করলেন,
—-তোর বাবা কেমন আছে।
—–ভালো নেই।আমাকে বেশী কিছু জিজ্ঞাসা করো না।কথা বলতে ভালো লাগছে না।
শেফালী খাওয়া শেষ করে রুমে আসলো।শিউলির দিকে তাকিয়ে শেফালীর খুব ভাল লাগলো।বোনটা আমার এমনিতেই অনেক সুন্দরী।আজ যেন একটু বেশী সুন্দর লাগছে।জাবেদ চোখ ফেরাতে পারবে না।শিউলি জিজ্ঞাসা করলো,
—মেজ আপু বাবা কেমন আছে
—-ভালো নেই।ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়েছে।
সরুপা বললো,
—এখনও জ্ঞাণ ফেরেনি
—-না আপু।আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।তুমি দুলাভাইকে এখন কিছু বলো না।ভালো মন্দ কিছু হলে আমি ফোন দিয়ে জানাবো।আপু তুমি শিউলিকে নিয়ে রওয়ানা দাও।বেশী রাত হলে শিউলি আজ তোমাদের বাসাতেই রয়ে যাবে।
ওরা বের হয়ে গেলে শেফালী ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়লো।
সিএনজি তে বসে শিউলি ভাবতে লাগলো।সবাই হয়তো ওকে স্বার্থপর ভাবছে।অথচ ওর ভিতরের কষ্টগুলো কাউকে বােঝাতে পারবে না।কদিনপর ওর বিয়ে। রক্তের বাঁধনটাকে আলগা করে অপরিচিত মানুষগুলোকে আপন করতে হবে।ওরা ওকে আপন করুক বা না করুক তাতে কোনো সমস্যা নেই।ওই বাড়ির সবাইকে ওকেই আপন করে নিতে হবে।দুঃখিনী মা,টা হয়তো একটু শান্তি পাবে।শিউলির জীবন কতটা সুখ শান্তিতে ভরে উঠবে তা সময় বলে দিবে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here