জীবনের নানা রং পর্ব-৭

0
564

#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব-সাত
মাহাবুবা বিথী

খুব ভোরে জাবেদের ঘুম ভেঙ্গে যায়।শিউলির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো ও গভীর ঘুমে অচেতন। যাক বাসর রাতটা একদম নিরামিষ হয়নি। ওকে তো একটা কিস করেছিলাম। তা না হলে সারাজীবন আফসোস থেকে যেতো। ওর মুখটা খুব নিস্পাপ।শিউলির জন্য জাবেদের বুকের ভিতরে মায়া হয়।

দুটো ভিন্ন পরিবেশ আসা দুটো মানুষ যখন বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয় তখন দুজনের মনটাকে আগে দুজনকে বুঝে নিতে হয়।মনটা বুঝে নিতে পারলে দেহটা এমনিতেই কাছে চলে আসে।জাবেদও শিউলির মনটাকে বুঝে নিতে চাইছে।শিউলির ও মানসিকভাবে সময় নেওয়া উচিত।

ভালবাসা নামক গুপ্তধনটা শরীরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না।হৃদয়ের কুঠুরিতে সযতনে রাখা থাকে।হৃদয়ের ভালবাসা অর্জন করতে না পারলে শরীরি ভালবাসা দিয়ে ভালবাসার মানুষটাকে আটকে রাখা যায় না।

জাবেদ এর বাসায় সবাই খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে।জাবেদ শিউলিকে ডেকে দিয়ে ওয়াশরুমে ওজু করতে গেলো।ফজরের নামাজ পড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।শিউলিও ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে ফজরের নামাজ পড়ে নিলো।দরজা কে যেন নক করছে।শিউলি দরজা খুলে দেখলো,
—-চিনতে পারছো নাতো,নতুন বউ।চেনার কথাও না।আমি আমার পরিচয় দিচ্ছি।আমি তোমার চাচাতো জা।পাশেই আমাদের বাড়ি।আমার নাম শায়লা।আমার বর আর তোমার বর বাছপানকা দোস্ত হয়।তুমি দেখতে খুব মিষ্টি গো।
শিউলিও বললো,
—-আপনিও খুব সুন্দর
—-আমাকে আপনি করে বলবে না। তুমি করে বলবে।নাম ধরে ডাকবে।আমারও বিয়ে হয়েছে ছ,মাস।তুমি সকালে গোসল করোনি?
—-এতো সকালে গোসল করবো কেন?
—বাসর রাত কাটালে আর গোসল করবে না
শিউলি একটু লজ্জা পেয়ে বললো,
—-আমাদের মধ্যে সেরকম কিছু এখনও হয়নি।
—-(মুচকি হেসে)সেটাতো আমরা কেউ দেখতে যায়নি।তবে গোসল না করলে চাচী রাগ করবে।বাসি কাপড়ে ঘর থেকে বের হলে রেগে যাবে।ওসব ঝামেলার থেকে গোসল করে নেওয়াই ভালো।তাড়াতাড়ি গোসল করে রেডী হয়ে নাও।একটু পর তুলি নাস্তা খাওয়ার জন্য তোমায় ডাকবে।
শায়লা চলে যাওয়ার পর শিউলি গোসল সেরে রেডী হলো।এমন সময় দরজা নক করে তুলি ঘরে এসে বললো,
—ভাবি নাস্তা খেতে মা ডাকছে
শিউলি তুলির সাথে নাস্তার টেবিলে আসলো।শাশুড়ী মা শিউলিকে টেবিলে বসতে বললেন।জাবেদ শিউলির প্লেটে নাস্তা তুলে দিলো।কিন্তু শিউলি লক্ষ্য করলো শাশুড়ী মার চেহারাটা খুব গন্ভীর।

রাশেদ সহ বাড়ির সবাই এক সাথে নাস্তা খেয়ে নিলো।শিউলি আড় চোখে রাশেদের দিকেও তাকালো।রাশেদের চেহারাটা খুব বিমর্ষ লাগছে।হয়তো বাড়ির জন্য ওর মন খারাপ লাগছে।এভাবে অপরিচিত জায়গায় ও কখনও থাকেনি।
নাস্তা খাওয়া শেষ করে জাবেদ শিউলিকে নিয়ে আবেদের ঘরে গেলো।আবেদ কে শিকল দিয়ে খাটের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে।জাবেদ আবেদের পাশে গিয়ে বসলো,
—–ভাইয়া এই দেখ নতুন বউ
আবেদ বললো,
—এই নতুন বউ আমার শিকলটা খুলে দাওনা।
জাবেদ বললো,
—-ও খুলতে পারবে না।আমি একটু ফ্রি হয়ে শিকল খুলে তোমায় বাহিরে ঘুরতে নিয়ে যাবো।
শিউলি আবেদকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-ভাইয়া তুমি নাস্তা খেয়েছো।
—-হ্যা খেয়েছি।তোমার নাম কি?
—-আমার নাম শিউলি।
জাবেদ বললো,
—ভাইয়া আমি এখন উঠি।পরে এসে তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবো।
জাবেদ শিউলিকে নিয়ে আবেদের রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে গেলো।আবেদকে দেখে শিউলির মনটা খারাপ হয়ে গেলো।বাহ্যিক দিক থেকে আবেদকে দেখলে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ মনে হয়।অথচ শিকল দিয়ে ওকে বেঁধে রাখা হয়।শিউলি জাবেদকে জিজ্ঞাসা করলো,
—–তোমরা ভাইয়াকে বেঁধে রাখো কেন?
জাবেদ বললো,
—–এমনিতে ভাইয়া চুপচাপ থাকে কিন্তু হঠাৎ করে খুব হিংস্র হয়ে উঠে।তখন শক্তিতে ভাইয়ার সাথে পারা যায় না।
—-তোমরা ভাইয়ার চিকিৎসা করাওনি
—-ঢাকায় নিয়ে ডাক্তার দেখাতে মাকে বহুবার বলেছিলাম।মার ধারণা ভাইয়াকে জ্বিনে ধরেছে।ভাইয়া একা একা কথা বলে।আবার কাকে যেন দেখতে পায়।তাই মা পীর ফকির কবিরাজের কাছে চিকিৎসা করায়।
শিউলি খেয়াল করেছে আবেদের সারা শরীরে অনেক মাধুলি বাঁধা ছিলো।

যোহরের ওয়াক্ত শুরু হলে জাবেদ ওর বাবার সাথে মসজিদে নামাজ পড়তে গেলো।এই ফঁাকে রাশেদ শিউলির সাথে দেখা করতে আসলো।শিউলি রাশেদকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-তোর কি মন খারাপ ভাই?
—-হুম,একটু খারাপ।তোকে কিছু কথা বলি তুই আবার দুলাভাইকে বলিস না।আমার সম্পর্কে খারাপ
ভাববে।গতকাল আমরা আসার পরে দুলাভাই আর ওনার বাবার সাথে আন্টির ঝগড়া হয়েছে।আন্টি হয়তো ভেবেছিলো আমাদের বাসা থেকে ফার্নিচার দেওয়া হবে।কিন্তু দুলাভাই বলেছে,উনিই শ্বশুর বাড়ি থেকে কিছুই নিতে চাননি।তাই আমরাও দেইনি।তোমার শ্বশুরও দুলাভাইর সাথে একমত প্রকাশ করে।আন্টি আরও বলেছে,ওরাতো ভদ্রতা করে দিতে পারতো।ওদের পরিবারের যা দুরাবস্থা দিবেই বা কোথা থেকেে? আমাকে আন্টি জিজ্ঞাসা করেছিলো,
—-আমাদের সংসার কিভাবে চলে।
—-আমি বলেছি আমাদের দোকানের আয় দিয়ে সংসার চলে।
আন্টি বলেছে,
—-আছেতো,নাকি তোমার উড়নচন্ডি বাবা সব উড়িয়ে দিয়েছে।
আপু এই কথাগুলো শুনে আমার খুব মন খারাপ হয়েছে।শিউলি রাশেদকে বললো,
—-রাশেদ তুই বাড়িতে এই কথাগুলো বলিস না।সবার মন খারাপ হবে।
—-আপু আমি আজকে চলে যাই।আমার থাকতে আর ভালো লাগছে না।

শিউলি ওর শাশুড়ির মুখ ভার করে থাকার কাহিনী বুঝতে পারলো।ওরও মনটা খারাপ হয়ে গেলো।যে সুখের সন্ধানে জাবেদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধলো সেই সুখ কি আদৌ ধরা দিবে?নাকি চিরকাল অধরাই থেকে যাবে। দুপুরের খাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম নিয়ে জাবেদ রাশেদকে বাসে উঠিয়ে দিলো।রাশেদের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো।অপমানে ভিতরটা দগ্ধ হলো।আপুটাকে না জানি কতো অপমান সহ্য করতে হয়।

সান্ধকালীন চা খাওয়ার সময় শ্বশুর সাহেব শিউলিকে জিজ্ঞাসা করলেন,
—-শিউলি রাশেদ এভাবে চলে গেলো তোমাদের বাসার সব খবর ভালোতা?
—-হ্যা বাবা সবাই ভালো আছে।আসলে ও কখনও বাড়ি ছেড়ে কোথাও থাকেনি।এই জন্য হয়তো চলে গেলো।
শাশুড়ী মা বললেন,
—-বৌমা কাল থেকে তুমি সকালে রান্নাঘরে চলে এসো।আবেদকে সময় দেওয়ার পর আমার আর শরীরে শক্তি থাকে না।
শ্বশুর বললো,
—–আর দুটেদিন পরে শিউলিকে রান্নার দায়িত্ব দিতে।
শিউলির শাশুড়ী ওর শ্বশুরকে বললো,
—-দুটো দিন কেন দুবছর বৌমার ঢোকার দরকার নেই।তবে তুমি রান্নাঘরের দায়িত্বটা পালন করো।পরের উপর দিয়ে বড় বড় কথা বলা যায়।নিজের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেখো কেমন লাগে।

বাবা মার ঝগড়া দেখে জাবেদের অস্বস্তি হচ্ছিলো।শিউলি ওর শাশুড়িকে বললো,
—-মা আপনি টেনশন নিয়েন না।কাল থেকে রান্না আমিই করবো।আমার রান্না করার অভ্যেস আছে।
—-হুম,রমজান তো আমাদের বলেছে,তুমি খুব সংসারী মেয়ে।

রাতে ডিনার শেষ করে শিউলি বেডরুমে চলে আসলো।বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে থাকলো।আর নিরবে চোখের পানিতে বালিশ ভিজে গেলো। লাইট অফ করে জাবেদ শিউলির পাশেই শুয়ে পড়লো ।শিউলির বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠলো।অন্ধকারে জাবেদ শিউলিকে বললো,
—-শিউলি তুমি কাঁদছো
—(কান্না লুকিয়ে)না কাঁদছি না।
আমি ঠিক বুঝতে পারছি তুমি কাঁদছো।জাবেদ শিউলিকে বুকে টেনে নিয়ে আদরে ভরিয়ে দিলো।আর বললো,
—-মায়ের কথায় কিছু মনে করো না।আমার মাকে একটু ম্যানেজ করে নিও।আমি তোমাকে খুব ভালবেসে ফেলেছি।তোমার ভালবাসাটাও আমার চাই।নারীর বুকে শুধু নরম পেলব মাংসপিন্ড থাকে না।সেই মাংসপিন্ডের আড়ালে একটা হৃদপিন্ড থাকে।সেই হৃদপিন্ডের ভিতর ভালবাসা নামক গুপ্তধন রক্ষিত থাকে।সেই গুপ্তধনটা আমি তোমার কাছে চাই।শিউলি আবেগে আপ্লুত হয়ে জাবেদকে জড়িয়ে ধরলো।এক লহমায় বুকের ভিতরের কষ্টগুলো শুন্যে মিলিয়ে গেলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here