জীবনে তুমি সেরা সত্যি পর্ব -৪

0
1964

#জীবনে_তুমি_সেরা_সত্যি

পর্ব -৪

এত নিঃশব্দে রুমে ঢুকেও লাভ হলো না দিশানের । নেহাল জেগেই ছিলো। দিশান কোনমতে ঢোক গিলে ক্র্যাচটা টেবিলে হেলান দিয়ে পড়ার চেয়ারেই বসে পড়লো । ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হলো নেহালের। মেয়েটা কি কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে!
– ঔষুধ নিয়মিত খাচ্ছো?প্রেসক্রিপশন কোথায় তোমার?
দিশান আঙুল দিয়ে ড্রয়ারটা দেখিয়ে দিলো। নেহাল বের করে দেখে বললো
– আরে এই ডাক্তার তো আমার দুলাভাই হয়। মানে আমার বন্ধু আবীরের বড় বোনের হাজবেন্ড। আমাদের সাথেও অনেক ক্লোজ ৷ ভাইয়া ডাক্তার হিসেবে যেমন ভালো, মানুষ হিসেবেও দারুন! আমার সাথে তার দারুন মিলে। রাতে তো ঔষুধ আছে দেখছি,কখন খেলে? এতক্ষণ তো রুমেই আসোনি।
– মানে এখনি খাবো।
– তুমি বসো,আমি দিচ্ছি।
বলে নিজেই পানি নিয়ে ঔষুধ খাইয়ে দিলো।
– ৬ সপ্তাহ রাখতে হলে তো তোমার পুরো টেস্ট পরীক্ষা এই পা নিয়েই দিতে হবে,কথা বলেছো কলেজে?সিট কয় তালায়?
– এখনো তো সিট পড়ে নি। কলেজে কথা বলে কি হবে,পরে সিকবেডে একা পরীক্ষা দিতে হবে। তারচেয়ে যে তালাতেই হোক,উঠে যাবো।
– এটা তো অনেক কষ্ট হয়ে যাবে।
– কষ্ট তো এই অব্দি হলেও কথা ছিলো,এখন তো শুধু পিছন অংশে ভারী প্লাস্টার দেয়া, ডাক্তার বলেছে ১০ দিন পর গিয়ে এক্স-রে করিয়ে দেখাতে,তখন লাগলে পুরো দুইপাশেই ফুল প্লাস্টার করে দিবে। তখন কতটা ভারী হবে কে জানে!
চোখ ছলছল করে উঠলো দিশানের। নেহাল এবার উঠে গিয়ে দিশানের সামনে নিচু হয়ে বসলো,
– কেন যে এত হুড়োহুড়ি তোমার৷ এর আগেও কিন্তু অনেকবারই সিড়িতে,চলতে ফিরতে পড়ে গেছো,হয়তো এমন প্লাস্টার লাগে নি, তবুও কেন যে এত চঞ্চল তুমি!তোমার এই কষ্ট দেখে গিয়ে বিদেশ গিয়েও আমার চিন্তা থাকবে। এই ১০ দিনের চেকআপের দিন কি বারে পড়ছে?ও,তাহলে আমিই আছি দেশে, আমি তোমাকে নিয়ে দেখিয়ে আনতে পারবো।
– অসুবিধা হবে না আপনার কাজ থাকলেও, আমার মা যাবে, মহিলা রোগীর সাথে মহিলা কাউকে থাকতে হয়।
-ম্যাডাম, হাজব্যান্ড থাকলে কাউকে লাগে না। আমি যতদিন দেশে থাকবো ততদিন তোমার জন্য আর কাউকেই লাগবে না। । আর ওখানকার নার্সরা তো আছেই। তোমার জন্য এটুকু করে যেতে পারলেও আমার ভালো লাগবে।
মাথা নিচু করে সায় দিলো দিশান। নেহালও কথা না বাড়িয়ে শুয়ে গেলো। কিন্তু বিপত্তিটা হলো দিশান শুতে যাবার সময়। বিয়ের পরপর একরুমে যে রাতগুলোতে থাকা হয়েছে, বরাবরই দিশান ভিতরের দিকে শুয়েছে ,নেহাল বাইরের দিকটায়,মাঝে মন্টুমিয়া। সেটা ধরে নিয়েই নেহাল বাইরের দিকে ঘুমিয়েছে, কিন্তু ভাঙা পা নিয়ে তো নেহালকে ডিঙিয়ে ভিতরে যাওয়া অসম্ভব। কি করবে এখন? এতটা জার্নি করে এসে উনি ঘুমিয়েছেন,কিভাবে ডেকে তুলবে? নায়রাকে ডেকে তুলতে আরো জ্বালা, ওর রুমে নক করতে করতে ও বাদে সবাই উঠে যাবে। তাই আস্তে করে ডাকতে হলো দিশানকে,
-ভাইয়া,ভাইয়া,নেহাল ভাইয়া…..
কিন্তু গভীর ঘুমের ভারী শ্বাসপ্রশ্বাস তখনো চলছে। অগত্যা অনেক ইতস্ততার পর হাত রাখলো নেহালের উপর,আলতো করে ধাক্কা দিয়ে ডাকলো। এবারও প্রথমে নেহালের কোন হেলদোল হলো না। আবার একটু জোরে ধাক্কা দেয়াতে চমকে উঠলো।
-কি হয়েছে ? কোন অসুবিধা?
-না মানে ভাইয়া, আপনাকে ডেকে তোলার জন্য স্যরি। কিন্তু আমি আসলে এই পা নিয়ে ভিতরের দিকে শুতে পারছি না৷ আমার শোয়ার জন্য সামনের দিকটাতে জায়গা দিতে হবে।
-ও হো,এটা তো মাথাতেই আসে নি। দাঁড়াও, সাবধানে উঠো।
বলে সামনে জায়গা করে দিতে একটু গড়িয়ে মাঝামাঝি চলে গেলো নেহাল। মন্টুমিয়া তাই ভিতরের কিনারে চলে গেলো। দিশানকে একদম চেপে সামনের দিকে শুতে হলো যেন দুইজনের মাঝে কিছুটা ফাঁকা থাকে। এই প্রথম এতটা কাছে শুয়ে কেমন অস্বস্তি হচ্ছিলো দিশানের। কিন্তু নেহাল আবার ঘুমিয়েও গেছে। এখন আর ডাক দেয়া যায় না। মনে অস্বস্তি রেখেই তাই ঘুমাতে হলো।
বেশ লম্বা একটা ঘুম দিয়ে চোখ মেলে তাকালো নেহাল। আড়মোড়া ভাঙতেই দিশানের গায়ে হাত লাগলো। রাতের কথা ঝাপসা মনে পড়ে গেলো । ঘুমের ঘোরে ছিলো একদম। তাই মন্টুমিয়াকে এই পাশে আনার কথা মনে হয়নি। দিশানকে তাই চেপেই শুতে হয়েছে বোধহয়। এখন ঘুমের মাঝে তিন বাঁকা হয়ে নেহালের প্রায় গা ঘেঁষে আছে। নেহাল এক দৃষ্টে তাকিয়ে দেখছে দিশানকে। এভাবে কখনোই দেখা হয়নি ওকে। বিয়ের আগে তো স্রেফ নায়রার বন্ধুর চোখেই দেখেছে, আর বিয়ের পরে নেহাল নিজেই একটা দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে,বরং তারচেয়ে দিশানই সহজভাবে নিয়েছে সব। এই যে কাল রাতের ব্যাপারটা,দিশান কত সাবলীলভাবে শুয়েছে। যেহেতু নিজে থেকে নেহাল কাছে টানে নি তাই একটু দূরত্ব রেখে শুয়েছে, তবে জড়তা নেই। সে তার ঘুম যে উপভোগ করছে তা বোঝা যাচ্ছে। বাচ্চাদের মতো ত্যাড়াবাঁকা হয়ে ঘুমাচ্ছে কিন্তু পোশাক তার একবিন্দুও নড়েনি। হাটু অব্দি কমলা রঙের একটা টপস আর সাদা রঙের ঢোলা প্যান্ট টাইপ পড়া যেটার প্লাস্টার করা পা এ সাইড দিয়ে সেলাই খুলে ফিতে দেয়া,খুব সম্ভবত পা ভাঙার পর এই সিস্টেম করে নিয়েছে পড়ার সুবিধার জন্য, তার উপর গলায় সাদা একটা ওড়না পেঁচিয়ে নেয়া। কিন্তু নেহালের সমস্যা এই জায়গাগুলোতেই, এই যে পাশে শুয়ে আছে তবু তাকে বউ ভাবতে পারছে না। তার ভাবনায় তার বউ এখন থাকতো শাড়ি পড়া,পাশ ফিরে ঘুমানো,এলো চুল থাকতো পিঠের অনাবৃত অংশে,কোমড়ের খাঁজে থাকতো জড়িয়ে ধরার নীরব আহ্বান,নেহাল সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ডুবে যেতো ভালোবাসাবাসিতে। হয়তো দিশানের মতে এতটা সুন্দরী সে চায় নি, ফর্সা গোল মুখে ফোলা ফোলা গাল আর পাতলা ঠোঁটে দিশান অনেক বেশি সুন্দর, তারচেয়েও বেশি আদুরে তার মুখভঙ্গি। নেহাল তাই তুলতুলে গালদুটো একটু টেনে দিয়ে সাবধানে নেমে গেলো বিছানা থেকে। কোমড় জড়িয়ে শোয়ার জন্য দিশানকে না হয় আরেকটু নারী হয়ে উঠার সময় দেয়া যাক।
সারাদিন মিটিং আর কনফারেন্স নিয়ে ব্যস্ততায় কেটে গেলো নেহালের। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হলো, মা জেগেই ছিলেন,পরদিন পরীক্ষা বলে নায়রা আর দিশানকে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মা-ছেলের কিছুক্ষণ গল্পের পর নেহাল রুমে ঢুকে গেলো। দিশানের ঘুম ভাঙবে বলে আর আলো জ্বালালো না। টেবিল ল্যাম্পের আলোতেই ফ্রেশ হয়ে নিলো। বিছানায় উঠে শুতে গিয়ে টের পেলো দিশান ফুপিয়ে কাঁদছে। তড়িৎ উঠে বসে দিশানের গায়ে হাত রাখলো,
– কি হয়েছে দিশান? কাঁদছো কেন? পায়ের ব্যাথা বেড়েছে?ঔষুধ খেয়েছো?
দিশান তবু ফুপিয়ে যাচ্ছে। উল্টো নেহালের স্পর্শে কান্নার দমক বেড়েছে।
– আরে কি হয়েছে বলবে তো?
– আমার… পরীক্ষা… শুরুর…. আগের… রাতে…অনেক… টেনশন…হয়…
আরেকটু দম নিয়ে বললো
– সারা রাত উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখি, কখনো জোর করে খাতা নিয়ে যাচ্ছে, কখনো দেখি পরীক্ষা শেষের পর হলে ঢুকেছি, কখনো দেখি আমার অনেক লেখা বাকী কিন্তু সময় শেষ হয়ে গেছে,এসব দেখে ছাড়া ছাড়া ঘুম হয়,মা আমার সাথে ঘুমায় পরীক্ষার দিনগুলো।
– তা এখন কি স্বপ্নে দেখলে শুনি?
– দেখলাম কাল তো বাংলা ১ম পত্র পরীক্ষা আমাদের, কিন্তু হলে গিয়ে শুনি ইংরেজি ১ম পত্র পরীক্ষা, আগেই নাকি নোটিশ দিয়েছে, সবাই জানতো শুধু আমিই বাংলার জন্য প্রিপারেশন নিয়ে গেছি।
– আচ্ছা ধরো এমন যদি হয়ও, ইংরেজি তো মুখস্থর কিছু না, আর তোমার বেসিক তো খুব ভালো দেখেছি, ইংরেজি সায়েন্স ফিকশন আমার কাছ থেকে নিয়ে পড়তে, আর তুমি তোমার কলেজের টপারদের একজন, তাহলে তোমার তো অসুবিধা হবার কথা না। ভালোভাবেই দিয়ে আসতে পারবে।
– কিন্তু না পড়ে তো ঐশী,শর্মীর চেয়ে মার্কস কম আসবে। ঐশী তো অনেক বাঁকা কথা বলবে।
– তো তুমি কি ঐশীর বাঁকা কথা থেকে বাঁচতে ভালোভাবে পড়ালেখা করো?
– না তো, আমি নিজের জন্য পড়ি। আমি হারতে বা খাটো হতে পছন্দ করি না। আমি আমার যোগ্যতায় বিশ্বাসী। তাই সেটা নিয়ে কাউকে বাঁকা কথা বলার সুযোগ দিতেই চাই না।
– ব্রাভো!!! এই আত্মবিশ্বাসটুকু রাখো নিজের মাঝে। আর শোন জীবনে প্রতিটাদিন সমান হবে না,কোনদিন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদে পড়তেই পারো, ঐদিন ঐ পরিস্থিতিতে যেটুকু বেস্ট দেবার দিবে আর বিপদ পার হলে আবার স্বরূপে ফেরার সাহস রাখবে। বিপদ তোমাকে পিছিয়ে দিক, কিন্তু থামিয়ে যেন না দিতে পারে, মনে থাকবে?
দিশানের খুব ভালো লাগলো নেহালের কথাগুলো, এবার হাসি ফুটে উঠলো মুখে। মাথা দুলিয়ে সায় দিলো যে মনে রাখবে কথাগুলো। তারপর বললো,
– ভাইয়া আপনি অনেক ভালো বোঝান ! আমার এবার থেকে উল্টো পাল্টা জিনিস মাথায় এলে আপনাকে ফোন দিবো,ওকে?
– প্রথম কথা হলো দিশান…আমি তোমার কে হই?
দিশানের হাসিমুখটাতে লজ্জার আভা ফুটে উঠলো এই প্রথম। চোখজোড়া নামিয়ে নিলো। নেহাল তাড়া দিলো,
– কে হই ?
দিশান অস্ফুট স্বরে বললো,
– হাসব্যান্ড
– তাহলে হাসব্যান্ডকে ভাইয়া ডাকতে শুনছো কাউকে?
– তো কি বলে ডাকবো?
– এখন সবাই যেভাবে বলে..নাম ধরে বলো,অসুবিধা নেই।
– হায় হায়! নাম ধরে বলতে পারবো না।
– তাহলে টিভি সিনেমায় যেমন দেখায় জান,বেইবি….
– ছিঃ ছিঃ!!!
– তাহলে আগের দিনের নাটক সিনেমার মতো ওগো শুনছো বলবে?
– ধ্যুত!! ব্যাকডেটেড!!!
– কিন্তু আমাদের মায়েদের মতো…নেহালের আব্বু,দিশানের আব্বু বলে ডাকার জন্য তো আগে তাকে আসতে হবে,তাই না?ততদিন কি ডাকবে?
দিশানের আবার লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। নেহাল গালগুলো সকালের মতো টেনে আদর দিয়ে বললো,
– চিন্তা ভাবনা করে যা খুশী ডাকো,কিন্তু ভাইয়া আর না। ওকে? একই বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে ভাইয়া ডাকটা কেমন লাগে বলো তো? এখন দ্বিতীয় কথাটা শোন,তুমি দরকারে যেমন অবশ্যই আমাকে ফোন দিবে তেমনি অদরকারে আরো বেশি ফোন দিতে পারো । কিন্তু তার জন্য তো আমার নাম্বার জানতে হবে। তুমি কি আমার মোবাইল নাম্বার জানো?
– এই দেশের নাম্বার আমার মোবাইলে সেইভ করা আছে কিন্তু UK র নাম্বার জানা নেই।
– দাও মোবাইলটা, সেইভ করে দিচ্ছি।
মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে এখানকার নাম্বার “Nehal Vaia 1205 ” দিয়ে সেইভ করা।
– 1205, মানে ফ্ল্যাট নাম্বার কেন সাথে?
– নীচতালায় একটা পিচ্চি নেহাল আছে যে,তাই
– আমি ‘Vaia 1205’ কেটে শুধু Nehal দিয়ে সেইভ করে দিলাম। তুমি নাম বদলে মনের মতো বসিয়ে নিও। আর তৃতীয় কথাটা হলো তুমি এক্ষুনি ঘুমাবে, কোন চিন্তা মাথায় না নিয়ে। আমি কি তোমার মাথায় বিলি কেটে দেবো?
– লাগবে না। মাথা এখন ফাঁকা আছে। ঘুম এসে যাবে। আপনিও ঘুমিয়ে পড়ুন। গুডনাইট।
– সিউর?
– ১০০℅
– ওকে,তাহলে গুডনাইট।
বলে দুজন কাঁথা মুড়ি দিলো। একটু সহজ হয়ে দুজনেই একটু স্বস্তিতে ঘুমিয়ে গেলো।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here