জীবনে তুমি সেরা সত্যি পর্ব -১

0
3683

#জীবনে_তুমি_সেরা_সত্যি

পর্ব -১
কফির মগ হাতে সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে নেহাল। ঘন্টা দুয়েক আগে বেশ জাকজমকভাবে তার সাথে দিশানের বিয়েটা হয়ে গেলো।হাউসিং কমপ্লেক্সের উপরের কমন ফ্লোরেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিলো। সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে এই কিছুক্ষণ হয় বাসায় এসে ঢুকলো তারা । বিয়ের আলোকসজ্জায় পুরো বিল্ডিং,লন ঝলমল করছে। তার রুমটাও সাদা ফুল, সাদা টুনি লাইট আর মাটির প্রদীপ দিয়ে সাজানো হয়েছে। এত অল্প সময়েও আব্বু-আম্মু তার মনের মতো সকল কিছু আয়োজন করেই বিয়েটা করিয়েছে। কিন্তু সেই মনের মতোন বিয়েতে মনের সায়টাই যে পায়নি নেহাল সেই খবর আর কাউকে জানাতে চায়নি সে। এখানে দিশানকে সে কোনভাবেই ছোট করছে না, মেয়েটার কোন নেগেটিভ পয়েন্ট সে বেরও করতে পারবে না ,যথেষ্ট সুন্দরী আর মেধাবী আবার অনেকটা ছেলেমানুষী, আহ্লাদীপনা আর চঞ্চলতায় ভরা একটা মেয়ে দিশান। চারপাশ মাতিয়ে রাখার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মেয়েটার। এখনও দারুন আড্ডা জমিয়ে রেখেছে ঘরে,বারান্দা থেকেও শুনতে পাচ্ছে ওদের হাসির শব্দ।

নেহালের ফ্রেশ হওয়াটা খুব দরকার, সেই দুপুর থেকে পড়ে থাকা পাঞ্জাবিটা পাল্টাতে পারলে বাঁচে,ফ্রেশ হয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলে মাথা ধরাটাও সেরে যেতো। তাই একটু আগে নিজের রুমের দিকে যেতেই দেখে তার ছোট বোন নায়রার সাথে তাদের দুই কাজিন সামায়রা আর তানহা মিলে দিশানের চুলের জট ছাড়াচ্ছে আর হা হা হি হি করছে চারজন মিলে।ওকে দেখে উল্টো নায়রা বলে দিলো, “ভাইয়া, একটু পরে আয় তো,ওর চুলের যে অবস্থা করছে পার্লারের ঐ মহিলা,আমি যদি কাল গিয়ে না ঝাড়ি দিছি….বলেই আবার কবে কাকে ঝারি দিছিলো সেই গল্পে ফিরে গেলো তারা। ইচ্ছে করছে নিজেই গেস্ট রুমে চলে যেতে কিন্তু বিয়ে বাড়ির আত্মীয় স্বজনে সেগুলো বুকড আবার আজ রাতে অন্য কোথাও থাকা ব্যাপারটা কেউ ভালো চোখে দেখবে না। অগত্যা কফি নিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে।

আজকের রাতটা নিয়ে যে শিহরণ হবার কথা ছিলো তার ছিটেফোঁটাও নিজের মধ্যে টের পাচ্ছে না নেহাল। অথচ সেই কবে থেকে কত কিছু ভেবে রেখেছিলো আজকের রাতটা নিয়ে,গল্প উপন্যাসের কত চরিত্রে নিজেকে বসিয়ে রোমান্টিসিজমের কল্পনায় ভেসেছে আর আজ জীবনে যখন সত্যি হয়ে এলো তখন একবারো সেসব কল্পনার জায়গাতে দিশানকে অন্তত ভাবতে পারছে না। চোখের সামনে হাসতে খেলতে বড় হওয়া ওর চেয়ে আট বছরের ছোট একটা মেয়েকে কি হুট করেই জড়িয়ে ধরে বউয়ের আদর দেয়া যায়? নায়রা আর দিশানের একসাথেই বড় হওয়া,ক্লাস-থ্রি এ পড়তো বোধহয় যখন এই হাউসিং কমপ্লেক্সে উঠে তারা,পরের বছর দুজন একসাথেই ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ফোরে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়। আর তখন নেহাল এস,এস,সি দিয়ে সদ্য কলেজ ভর্তি হওয়া কিশোর,ততদিনে মাসুদরানা, শার্লক হোমসের পাশাপাশি জায়গা করে নিচ্ছে সুনীল আর সমরেশ। যখন রবীন্দ্রনাথের সমাপ্তির অপুর জায়গায় নিজেকে ভেবে নিয়ে কল্পনায় মৃন্ময়ীকে আঁকতো তখন পাশের রুমে হয়তো নায়রা আর দিশানের চিৎকার চলতো স্কুলের সাদা কেডস কে যেন পা মাড়িয়ে কাদা লাগিয়ে দিয়েছে তা নিয়ে অথবা ঠোঁট ফুলিয়ে রাখতো আজো ওরা ক্লাসে কথা বলছিলো জন্য মিসের কাছে ক্লাসক্যাপ্টেন নাম জমা দিয়েছে বলে। নায়রার জন্য শখ করে কিছু আনলে ওরা দুজনই ভাগ করে নিতো। দিশানের বিশাল টেডিবিয়ারটাও নেহালের এনে দেয়া,জন্মদিনে নায়রা ওকে গিফট করেছিলো । ওটার আবার নামও রাখা হয়েছে ‘মন্টু মিয়া’। কতদিন দিশান ওদের বাসায় ফেলে রেখে গেছে মন্টুমিয়াকে,রাতে ঘুমের আগে কাউকে পাঠিয়ে নেয়াতো। দিশান বয়সের চেয়েও আরো অনেক বেশি বাচ্চা,সেই তুলনায় নায়রা ওর চেয়ে অনেক ম্যাচিওরড। নায়রা এক কথায় আগলেই রাখে দিশানকে,দশ বছরের বন্ধুত্ব তাদের,হরহর আত্মা! শুধু নায়রা কেন,আম্মুও দিশানকে নায়রার চেয়ে কম আদর করে না,এখনো দেখা যায় ওরা টিভিতে ক্রিকেট দেখছে আর আম্মু ওদের এক থালে মেখে খাইয়ে দিচ্ছে,শপিংএ গেলে অনেক জিনিস ডাবল নিয়ে নেয়,গত বছর নবীন বরণে দিশান আম্মুর শাড়ি পড়ে গেছে,ওরা দুইজনের মায়ের আলমারিতে একই অধিকারে অভিযান চালিয়েছে! কতবার তো দুইটাকেই নেহাল কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে পড়া বুঝতে এসে দুষ্টামি করলে বা মনোযোগ না দিলে। আবার স্কুল হয়তো আগে ছুটি হয়ে গেছে,দিশানের কর্পোরেট জব করা আম্মু নিতে আসার সুযোগ পাচ্ছে না বা আম্মু রান্নায় ব্যস্ত,অগত্যা নেহাল দুইটাকে দুই হাতে ধরে বাসায় ফিরেছে। কিন্তু হঠাৎ করে যখন নেহালের দেশের বাইরে যাবার সব ফাইনাল হলো,আম্মু বেঁকে বসলো, নেহালকে বিয়ে করে যেতে হবে,নয়তো ওখানে গিয়ে কারো পাল্লায় পড়লে তখন কি হবে ?তারচেয়ে পিছুটান থাকবে একটা বউ থাকলে। এতো অল্প কদিনে কোথা থেকে আর মেয়ে খুঁজে পাবে ভেবে রাজিও হয়ে গেছিলো নেহাল। কিন্তু আম্মু অসম্ভবকে সম্ভব করলো,হঠাৎই তার মাথায় চলে এলো এত কাছে অর্ধেক তার নিজের হাতেই গড়া এই মেয়ে থাকতে বাইরে কেন?কথা বলল ওর মা-বাবার সাথে,দিশান কেবল এইচ,এস,সি ২য় বর্ষে থাকায় দ্বিধা থাকলেও সায় দিলো তারা,একমাত্র মেয়েটা হাতের কাছেই থাকবে তাহলে আবার সবার এতটা আদরেও থাকবে। তিনদিনের মাথায় বিয়েটাও আজ হয়ে গেলো! এর মাঝে না করার শক্ত যুক্তিই দাঁড় করাতে পারলো না নেহাল। দিশানকে নিয়ে কোনদিনও আলাদা কিছু ভাবে নি,ওকে নায়রার অনুষঙ্গ হিসেবেই দেখে এসেছে,অপরিচিতাকে নতুন করে তাও গ্রহণ করা যায়, কিন্তু দশ বছরের অবস্থান মুছে নতুন অবস্থানে টেনে তোলা অনেক কঠিন! আম্মু হাসতে হাসতে বলেছিলো কত ফার্স্ট কাজিনের মাঝে বিয়ে হয় আর তুই আছিস বোনের বান্ধবী নিয়ে!যা ভাগ!!ফলাফল আজ সে সই সাবুদ করে কবুল বলে দিশানকে মন্টুমিয়াসহ তার ঘরে নিয়ে এসেছে!!!!
কিন্তু নিজের ভূমিকা নিয়ে কিছুই ভেবে উঠতে পারছে না নেহাল। মানে এখন না হয়, একটু পর ওর তো ঘরে গিয়ে ঢুকতে হবে। সেখানে দিশানকে কিভাবে ফেইস করবে ভাবছে! বিয়ের কথা হবার পর এই তিনদিনে এক-দুবার ওর সামনে পড়েছে দিশান। কিন্তু কোন কথা হয়নি । নেহাল ভেবে রেখেছিলো ওর বিয়ে ঠিক হবার পর ওর হবু বউকে নিয়ে অফিসিয়াল ডেটিংএ যাবে। দুজন মিলে কোন পছন্দের জায়গা ঠিক করবে একটু লং ড্রাইভে যাবার জন্য, পরে কোন রেষ্টুরেন্টে ডিনার করবে! আর তার হবু বউ এর সাথে দেখা হয়েছে ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে ! বিয়েটা করে এক জীবনে অনেক স্বপ্নই অধরা রয়ে গেলো! এসব যখন ভাবছে হঠাৎ পিঠে হাতের স্পর্শে ঘুরে তাকালো, মা কে দেখে বললো,”শুয়ে পড়োনি কেন? সারাদিন তো বেশ পরিশ্রম গেলো!”
মা সে কথার জবাব না দিয়ে বললো,”তুই এখানে যে?”
-“কি করবো বলো,আমার রুম তো আর আমার একার থাকতে দিলা না,রুম তো তোমার আদরের লেডিস টিমের দখলে,আমি তো সেখানে বহিরাগত ”
মা বললো,”হ্যাঁ রে বাবু, তোর এই হঠাৎ বিয়েটার জন্য আম্মুর উপর অনেক রেগে আছিস, না?”
-“রাগ না আম্মু, আমি আসলে অপ্রস্তুত, আমার নিজেকে গোছানোর সময়টাতে এটা আমার জন্য বাড়তি একটা প্রেসার। সংসার তো সহজ কিছু নয়! তার জন্য মনকে এবং নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম কেবল । ”
-আম্মুকে ভুল বুঝিস না বাবু,আমি নিজেও ভাবি নি এত তাড়াতাড়ি কোন মেয়ে পাবো বা আমরা চাইলেও কোন মেয়ের ফ্যামিলি রাজি হবে কিন্তু কি অদ্ভুত জানিস হুট করে যখন মাথায় দিশানের নামটা এল, তুই বিশ্বাস কর আমি আর একটুও দেরি করতে চাই নি। মেয়েটা আমার বড্ড আদরের রে, তুই আমার কথা মিলিয়ে নিস মেয়েটা বড় লক্ষ্মী, তোর সংসারের কঠিন রাস্তাটা ও কি সহজ করে নেয় তুই মিলিয়ে দেখিস! একদিন তুই আমাকে বলবি দিশান তোর জন্য কত পারফেক্ট চয়েস ছিলো আমার!
হালকা একটা হাসি দিলো নেহাল। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-ছেলেটা কবে এত বড় হলো!!আজ বউ ঘরে নিয়ে চলে এলো!!
-অনেক হইছে আহ্লাদ, আম্মু প্লিজ তোমার নারী বাহিনীকে আমার প্রতি একটু সদয় হতে বলো। আমি চোখ দুটো জাস্ট খুলে রাখতে পারছি না।
-ওদের আওয়াজ থেমে গেছে মনে হচ্ছে, নায়রুর রুমে চলে গেছে বোধহয়। যা বাবা,তুই ঘরে যা। নতুন জীবনে আম্মুর অনেক দোয়া রইলো বাবা।
-যাও তুমিও শুয়ে পড়ো,অসুস্থ না হয়ে পড়ো এত পরিশ্রমে!

আম্মু চলে যেতেই আবার অস্বস্তি চেপে বসলো।ধুর এত ভেবে কিছু হবে না।দিশান ব্যাপারটা কিভাবে দেখছে সেটাও অনেক বড় ব্যাপার করে। দিশানের হাবভাব বুঝেই সবটা হ্যান্ডেল করবে সে। ধীর পায়ে রুমের দিকে এগুলো নেহাল৷

রুমের দরজাটা খোলাই আছে,কিন্তু ভিতর থেকে কোন শব্দই পাওয়া যাচ্ছে না। তবু সামনে এগুতে এগুতে কয়বার গলাটা শব্দ করে পরিস্কার করে নিলো। তারপরও কেন সাড়া না পেয়ে রুমে ঢুকে দেখলো রুম ফাঁকা। তবে ওয়াসরুমে পানির শব্দে বুঝলো দিশান ফ্রেশ হচ্ছে। এবার নেহালও চটজলদি ওর টিশার্ট-ট্রাউজার নিয়ে বাইরের কমন ওয়াসরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। এসে দেখে এবার ওয়াসরুম খোলা, কিন্তু দিশান এখনো রুমে নেই। নায়রুর ঘরে গেছে নিশ্চয়। আসুক, মন চায় থাকুক,যা খুশি করুক,খালি বিছানা পেয়ে আর কিছু ভাবতে পারলো না নেহাল। একপাশে যথেষ্ট জায়গা রেখে কোলবালিশটা মাঝে রেখে আরেকপাশে শুয়ে পড়লো । আর শোবার সাথে সাথেই একদম ঘুমে তলিয়ে গেলো সে।
একটা আলসে আরাম অনুভূতি নিয়ে বেশ বেলা করেই ঘুমটা ভাঙলো নেহালের। বেশি ঘুমের কারণে মাথাটা এখনো টলছে । হ্যাংওভার কাটিয়ে উঠে বসতেই মনে হলো দিশান কোথায়?চকিতেই বিছানায় তাকিয়ে বুঝতে পারলো রাতে এ বিছানাতেই ঘুমিয়েছে সে। নিজের উপরই মেজাজ খারাপ হলো,মেয়েটা তাহলে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে?নেহালের বদ্ধ ধারণা ছিলো দিশান নায়রার রুমেই থেকে যাবে,তাই তার অপেক্ষা না করেই ঘুমিয়ে পড়েছে। দিশানের বর্তমান মানসিক অবস্থাটা বুঝা গেলো না বলে সারাটা দিন ওকে হ্যান্ডেল করা আরো কঠিন হয়ে গেলো। এতো তাড়াহুড়োয় আয়োজন করে রিসিপশন না হলেও আজ আবার কজন কাছের আত্মীয় পরিজন আসবে,তাদের সামনে অন্তত কিছু বুঝতে দেয়া যাবে না। হাসিমুখে নতুন জামাই ভাব নিয়ে ঘুরতে হবে!ধুর!!!একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছাড়লো সে । নামতে নিয়ে উল্টো দিকের দেয়ালে চোখ পড়লো,তাদের বিয়ের একটা ছবি বাঁধাই হয়ে ঝুলছে সেখানে। নিশ্চয় আম্মুর কাজ! আম্মু এত চটজলদি সব কেমনে করে!!!কাল অনুষ্ঠানের একদম প্রথম দিকে তোলা ছবিটা, দিশান কেবল তখন পার্লার থেকে ফিরে বসেছে স্টেজে,নায়রা তখন ঠেলে তাকেও পাশে বসিয়ে দিয়েছিলো,তখনকার তোলা ছবিটা। দিশানের বউ সুলভ হাসির বদলে মিষ্টি একটা প্রাণোচ্ছল হাসি, বরং নেহালের মুখভঙ্গিতেই অস্বস্তি । তবে যা-ই হোক,দুজনকে কাপল হিসেবে একসাথে মানিয়েছে খুব এটা মানতেই হবে! খানিক আগের বিরক্তিটা মুছে একটা স্মিতহাসি ফুটে উঠলো নেহালের ঠোঁটে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here