জীবন মানে তুমি
লেখিকা:H.B.Irini Ori
পর্ব:১০
(৩৭)
-“ভাইয়া আমি ক্লান্ত,মিথ্যে মায়ায়,মিথ্যে,হাসিতে,মিথ্যে ভালোবাসায়।আচ্ছা ভাইয়া আমার সাথে এমন কেন হয়।”
-“পিচ্চি আমার কথাটা শোন,এভাবে কান্না করিসনা।কেউ নেই তো কী হয়েছে আমরাতো আছি।”
-“ভাইয়া অভিসাপ না দিলেও রুহের হায় লেগে যায়।আর ওরা যা করেছে আমি কোনোদিনও মাফ করবোনা।”
ইফাজের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে ইরাকের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ভাইয়া,ওরা যেন এখনি এই বাড়ি থেকে চলে যায়।আমি যেন কাল সকালে ওদের না দেখি।মি.ফুয়াদ যা খুশি তাই করবে আমি তা মেনে নিবোনা।আজ যদি পল্লবী আপুর যায়গায় আমি থাকতাম তাহলে…”
-“পিচ্চি আমার দিকে তাকা,শোন তুই যা বলবি তাই হবে।বেশি কান্না করিসনা,অসুস্থ হয়ে পরবি।অনু,ফুপি আপনারা এর কাছে থাকুন আমরা আসছি।”
কথাগুলো বলে ইফাভ আর ইরাক বাইরে চলে যায়।কেননা এক মুহুর্তের জন্যেও মি.ফুয়াদের ভাইদের ফ্যামিলিকে রাখা বিপদ ছাড়া কিছু নয়।
কারন সবাই যখন রাতের বেলা শুয়ে পরেছিলো তখন বিপ্লব,তৌফিক আর হৃদয় সেই জঘন্য কাজটা করতে ইয়ারাবীর রুমে যায়।তবে ওর রুমটা অন্যদিনের তুলনায় খুব বেশি অন্ধকার।
-“কীরে,আজ রুমে মনে হচ্ছে একটু বেশিই অন্ধকার।”
-“তো কী হয়েছে,চল আমাদের কাজটা করে ফেলতে হবে।”
ওরা আসতে আসতে বেডের দিকে এগিয়ে যায়।অন্ধকার হলেও এটা বুঝা যাচ্ছে বেডে তিনজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে।ওরা যেয়ে বেডের ডান সাইডের কর্নারের মেয়েটাকে ইয়ারাবী মনে করে গায়ের চাদরটা সরিয়ে দেয়।তারপর তৌফেক আর হৃদয় হাত-পা দুটা চেপে ধরার সাথে সাথে মেয়েটার ঘুম ভেঙ্গে যায়।ওর চিৎকারে পাশে ঘুমিয়ে থাকা টিকলির ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার সাথে সাথে ও বেড সাইডের সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দেয়।কিন্তু আলো জ্বালানোর পর ওরা যা দেখে শুধু অবাক না ভয়ও পেয়ে যায়।কেননা বিছানাতে শুধু পল্লবী তার মেয়ে আর টিকলি আছে।পল্লবীর আওয়াজে সবাই ইয়ারাবীর রুমে চলে আসে।
মি.ফুয়াদ পল্লবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী হয়েছে পল্লবী?চিল্লালে কেন?আর তোরা এই রুমে কেন?”
-“পল্লবী আপু কী হয়েছে?”
তৌফিক ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুই কোথায় ছিলি?”
-“আমি কোথায় ছিলাম সেটা তুই জেনে কী করবি?আর তুই এখানে কেন?”
-“আসলে চাচু আমরাতো ইয়ারাবীর সাথে একটু মজা করতে এসেছিলাম,ও চলে যাবে তাই খুব মিস করবো।”
-“আচ্ছা তো কেমন মজা করতে এসেছিলে তোমরা?বোনের গায়ের চাদর সরিয়ে দিয়ে অন্ধকার রুমে হাত-পা চেপে ধরে।”
-“এসব কী বলছে পল্লবী,বিপ্লব?”
এবার মি.ফুয়াদ খুব রেগে যান।মি.ফাতিন ওনার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“বিপ্লব সত্যিটা বলে দিলেই তো হয় আব্বু?”
-“কীসের সত্যি ফাতিন?”
-“এটাই যে তোর মেয়ে আমার ছেলেকে ফোন করে ডেকেছিলো।কী হলো বলছিস না কেন?”
-“ও ফোন করে কেন ডাকবে?”-মিসেস ইশানি খুব রেগে কথাটা বলে।নিক্কি তার পাশে দাঁড়িয়ে তার মধ্যে ফোড়ন কেটে বলে,
-“একটা মেয়ে মাঝরাতে কোনো ছেলেকে ফোন করে ডাকলে কী বোঝায় তুই জানিস না আপু?”
মিসেস ইশানি চুপ হয়ে যায় কথাটা শুনে।কিন্তু মিসেস রহমান নিক্কিকে জোরে একটা থাপ্পর বসিয়ে দেন।তারপর বলেন,
-“ভুলে যাসনা তোর ঘরেও মেয়ে আছে,আর ইয়ারাবী কেমন মেয়ে সেটা তোরা না জানলেও আমি খুব ভালো করে জানি।”
-“আপু,হতেও পারে ওই ফোন করে ডেকেছে।”
-“ছিঃ ইশা আমার ভাবতেও লজ্জা লাগছে তুই ওর মা।আরে পুরো দুনিয়া যখন মেয়ের থেকে দূরে সরে যায় তখন তার মা ছায়া হয়ে তার পাশে দাঁড়ায়।”
-“খালামনি আমি কেন ফোন করতে যাবো?”
-“তাহলে কী ওরা মিথ্যা বলছে?”
-“আব্বু আমার কথাটা…”
ওদের কথাটা শুনে ইয়ারাবীর কান্না করে দেয়।ইরাক,ইফাজ এতক্ষণ ধরে এদের ড্রামা দেখে চলছিলো কিন্তু ওখন আর চুপ করে থাকতে পারলোনা।ইরাক যেয়ে বিপ্লবের কাধের ওপর হাত রেখে বলে,
-“তোকে ঠিক কখন ডেকেছিলো আমাকে একটু বলবি? আর ঠিক কী কী বলেছিলো সব বল।আর শোন মিথ্যা বলায় চিন্তা করিস না,নয়তো আর্মিরা কত ডিগ্রী দেয় জানিস তো?কী হলো বল।”
-“এই তো দ্ দেড়টার দিক্ কে,ব্ বললো র্ রুমে আসতে।”
-“তো এত তুতলাসছিস কেন?তোর ফোনটা দেতো একবার?”
-“ক্ কেন?”
-“না ও ফোন করেছিলো তাই দেখবো আরকী?”
-“ও টেলিফোনে ক্ কল করেছিলো,তাই…”
-“এখন কী বলবি,তারপরও এই মেয়ের সাফাই গাইবি?”
-“হামম,খালু এখনো সাফাই গাইবো।কেননা ইয়ারাবীর কাছে ফোন থাকলে তবেও তো ও কল কবরে।”
-“মানে?”
-“আসলে কী বলেন তো খালু?আপনার মেয়ে অথচ আপনি হাসপাতাল থেকে আসার পর একবারও মাথায় হাত বুলিয়ে শুনতে চেয়েছেন এখন কেমন আছে?খালা কখনো শুনেছেন রাতে ঘুমাচ্ছিস কীনা?”
কথাটা শুনার সাথে সাথে ওনারা মাথা নিচু করে নেয়।এবার ইফাজ বলতে থাকে,
-“এ্যাজ এ ডাক্তার অর ব্রাদার,রাতে যাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারে এজন্য ওর ফোনটা আমি নিজের কাছে রেখেছিলাম।আর ও যদি তোদের ফোন করেই থাকে তাহলে ওই রুমে যেতে বলবে এটাই নয়।”
-“ঠিক বলেছো ইফাজ,আমার যায়গায় আজ ইয়ারাবী থাকলে জানিনা এনারা কী করতো?”
মিসেস ইশানি এবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“কোথায় ছিলি তুই?”
-“আমার কাছে ছিলো,পরী জেদ করছিলো এই রুমে থাকবে তাই এ অনু আর তারা আমার কাছে ছিলো।আমার ভাবতেও লজ্জা লাগছে তোরা এই কুলাঙ্গারের সাথে আছিস।”
ইয়ারাবী আর এক মুহুর্তেও ওখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চলে যায়।
আসলে যাদের বাবা-মা নেই তাদের একটা বুজ থাকে। কিন্তু যাদের থেকেও নেই তাদের দুনিয়া কেমন সেটা তারা অনুভব করতে পারে।ইয়ারাবীর শুধু একটা প্রশ্ন:ওকে যদি ওনাদের বোঝা মনে হয় তাহলে আগেই কেন মেরে ফেললো না?বাঁচিয়ে রেখেছে কেন?
প্রতিটা মুহুর্তে নিজের জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ও বড্ডো ক্লান্ত।এই হাতে গোনা কয়েক মানুষের ভালোবাসা যদি না পেতে তবে কবেই ও মারা যেতে।মারা তো গেছে,তবে জিন্দা লাশ হয়ে বেঁচে আছে।দুঃখ,কষ্ট,সুখ,অনুভুতি সবার মাঝেই আছে তবে ইয়ারাবীর মধ্যে শুধু সুখটার ঘাটতি আছে।
বাইরে ভীষন চিল্লা-পাল্লা শুনে ইয়ারাবী রুম থেকে বের হয়।মি.ফুয়াদ বলে,
-“দেখো ইরাক,এভাবে ওদেরকে চলে যেতে দেওয়া যায়না।মানুষ ভালো ভাব্বে বলো।”
-“আপনার ভালো আপনার কাছে রাখেন।শুধু আপনার জন্য আমি এখনো এদের ছেড়ে রেখেছে,নয়তো জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়তাম।”
-“দেখ ইরাক তোরা যে ব্যাবহার করছিস তাতে মনে হচ্ছে মেয়েটা তোদের।বেশি বারাবারি করছিস কিন্তু তোরা।”
ইশানির কথা শুনে মিসেস রহমান ওনাকে থাপ্পর দিয়ে বলেন,
-“মেয়ের উপর অধিকার তোরা ৮ বছর আগেই হারিয়েছিস।ইরাক সব কটাকে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে দে।”
মিসেস ইশানি কোনো কথা না বারিয়ে নিজের রুমে চলে যান।মিসেস রহমান ওদের রাতে সরাসরি চলে যাওয়ার কথা বলে সেই রাতেই বের করে দেন।মি.ফুয়াদের আর সাহস হয়না কিছু বলার।আর বলবেই বা কোন মুখে?আপন মানুষগুলো যখর পিঠে ছুরি মারে তখন আর কিছুই করার থাকেনা।কেননা ৮ বছর আগে যা হয়েছে সেটা পুনরায় ঘটাতে চাননা।
(৩৮)
দুপুরের দিকে ইয়ারাবীদের বাসার সামনে একটা রেড কালারের কার এসে দাঁড়ালো।তার থেকে দু’টা ছেলে বের হয়ে এলো,চেহারা হুবহু এক।একজনের ব্লু জ্যাকেট,ব্লাক টি-শার্ট,বুট জুতা,চশমাটা বুকে ঝুলানো,সিল্কি চুলগুলো কপালে এসে পরছে,আরেকটা ছেলের সেম ড্রেস তবে রেড জ্যাকেট পরা।ইয়ারাবী বাইরে দোলনায় বসে ছিলো।ছেলে দু’টা ওর দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-“আমি যদি ভুল না করি তবে তুমিই ইয়ারাবী,রাইট?”
-“হ্যাঁ,কিন্তু আপনারা..”
-“আরে প্রত্যয়,প্রাপ্ত এসে পরেছিস তোরা”
ইরাক কথাটা বলেই ওদের জড়িয়ে ধরলো।
-“ভাইয়া তুমি চিনো এনাদের?”
-“হামম,কেন চিনবোনা?আমাদের ফ্রেন্ড ব্লু জ্যাকেট হলো প্রত্যয় আর রেডটা হলো প্রাপ্ত।”
-“ওহ্,ভালো আছেন ভাইয়া?”
-“আলহামদুলিল্লাহ,তুমি কেমন আছো?”
-“আমিও ভালো আছি।”
-“ইয়ারাবী উপরে আয়,মেডিসিনের টাইম হয়ে গেছে।”
অনুর কথাটা শুনে ইরাক ওকে ভিতরে যেতে বলে।
-“ভাই আবরার সত্যিই খুব লাকী হবে?”
-“হামম,তোরা দাঁড়িয়ে কেন ভিতরে চল।”
-“তা নয় যাবো কিন্তু ও যদি জানেনা ওর বাড়ি না যেয়ে এখানে এসেছি মার একটাও মাটিতে পরবেনা।”
-“চিন্তা করিস না,হজম করে নিস একটু।আর শোন ইয়ারাবী যেন কখনো জানতেও না পারে তোরা ওকে চিনিস।”
-“তা নয় বুঝলাম ,কিন্তু আমার যে খুব ক্ষুদা লেখেছে।”
-“চল..”
ব্যাগগুলো নিয়ে ওরা বাসার ভিতরে যায়।প্রত্যয় আর প্রাপ্ত দুই ভাই।প্রত্যয় আর্মির চাকরি করে আর প্রাপ্ত আবরারের সাথে রিসার্চ করে।তবে কিছু কাজের জন্য দু’ভাই এক সপ্তাহ দেশের বাইরে ছিলো।
খাওয়া-দাওয়া শেষে প্রত্যয়-প্রাপ্ত দু’ভাই ইয়ারাবীর কাছে গেল।ইয়ারাবী তখন ইফাজের সাথে তারার বিষয় নিয়ে পিন্চ করছিলো।
-“ইয়ারাবী এটা তোমার জন্য”
-“এটা কী ভাইয়া?”
-“তোমার ইনগেজমেন্টে আসতে পারিনি তাই ছোট একটা গিফ্ট নিলে খুশি হবো।”
-“আপনারা এসেছেন এটাই আমার কাছে ভালো লেগেছে এগুলোর দরকার ছিলোনা।”
-“অবশ্যই ছিলো,দেখ তুমি ইরাকের বোন তাই আমাদের ও বোনের মতো।সুতরাং এটা তোমার নিতেই হবে।”
-“আচ্ছা,দিন।”
ইয়ারাবী বক্সটা খুলে দেখলো অনেক সুন্দর একটা স্টোনের কাজ করা গলার হার।ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে ধন্যবাদ জানালো।
-“তুমি এটা আজ পরলে খুব ভালো লাগবে আমাদের।”
-“ঠিক আছে ভাইয়া।”
-“পিচ্চি রুমে যেয়ে রেস্ট কর,বিকালে অনেক কাজ আছে।”
ইয়ারাবী রুম থেকে বেরনোর সময় দেখে অনু দরজায় দাঁড়িয়ে আছে,আর লক্ষ্য প্রত্যয়ের দিকে।ইয়ারাবী রুমে যেতে যেতে বলে,
-“ইরাক ভাইয়ার কাছে শুনতে হবে প্রত্যয় ভাইয়ার গার্ল ফ্রেন্ড আছে নাকী?”
-“তো আমাকে কেন বলছিস?”
-“না এমনি আর কী?আহ্”
-“কী হয়েছে?”
-“বুঝছিনা মাঝে মাঝে ব্যাথা করে উঠছে।”
-“ঔষধ নিয়েছিস তো,তাহলে”
-“জানিনা…”
-“ইফাজ ভাইয়াকে বল কথাটা..”
-“বাদদে,দেখলি না ভাইয়ারা কত সিরিয়াস।সত্যিই রে এরা যদি না থাকতো তবে আমার অসস্ত্বি অনেক আগেই বিলিন হয়ে যেত।”
-“তোর এই মাসে হয়েছে?”
-“না,ওটাতো আরো তিন-চারদিন বাকী।তবে এভাবে কখনো ব্যাথা হয়নি।শোননা,আজ তুই গোল্ডেন কালারের শাড়িটা পরিস।”
-“গাউন পরমু..আমি আনি নাই ওটা”
-“মিথ্যা,বললে একটা থাপ্পর দিবো,আমি দেখছি।তুই ওটাই পরবি।”
-“দেখ তুই যা ভাবছিস তা কিন্তু কখনো হবেনা।তুই তো জানিস আমার অতীত।ভাগ্য কখনো সহায় হয়না।”
-“তোকে বললাম তুই করবি ব্যাস,আর কোনো কথা নয়।”
রুমে বসে কথা বলছিলো, তখনি ইয়ামিলা দৌঁড়ে এসে ইয়ারাবীর কোলে ওপর বসে।এতে ও পেটে কিছুটা চাপ খায় তবে বলেনা।
-“আপু,তুই তারাপুকে বলেছিস যে তুই বলে এখানে আর আসবিনা।দেখ আমি কানে ধরছি,আজ পর্যন্ত যা করেছি তার জন্য সরি,তুই বললে কান ধরে উঠবস করবো,এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবো।তারপরও তুই আসিস।প্লীজ আপু আমি তোকে খুব মিস করবো।”
ইয়ারাবী কিছু না বলে বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে।ও আবার বলে,
-“আপু শোন আমি অনেক চকলেট জমিয়েছি সব তোকে দিবো,প্লীজ আপু।”
-“খেয়েছিস কিছু?”
-“হ্যাঁ,মনি খাইয়ে দিয়েছে।শোন আম্মু তোকে ডাকছে,অনুদি তুমিও আসো।”
-“আমার কোনো কথা নেই তার সাথে।”
-“ঠিক আছে,”- ইয়ামিলা চুপচাপ ওর কোল থেকে নেমে চলে যায়।”
ইয়ারাবী মুচকি হেসে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।এই রুম, বেলকনি আর ছাদ যে ওর কত আপন।নিজের দুঃখ কষ্টের প্রতি রাতের সাক্ষী এরা।এদের ছেড়ে যেতে হবে।ইয়ারাবী কখনো চাইতো না এত জলদি ওর বিয়ে হয়ে যাক।কিন্তু একটু শান্তির জন্য ওকে এই কাজটা করতে হলো।কী জানে বিয়ের পর আবরাররা কেমন ব্যবহার করবে ওর সাথে।ওকে আর পড়তে দিবে নাকী?কথাগুলো ভাবতে ভাবতে টের পায় কেউ ওর কাধে হাত রেখেছে।ওর অনুকে ভেবে বলে,
-“তোর জন্য কী এখন দাঁড়াতেও পারবোনা।বললাম তো খাবোনা।”
-“জেদ পরে দেখাস, আগে খেয়েনে।”
আওয়াজটা শুনে ও অবাক হয়।কেননা এটা ওর মায়ের আওয়াজ।ঘুরে তাকিয়ে দেখে ওর মা।
-“খাওয়ার সময় ইরাক ছিলোনা বলে ইফাজকে পাতা পড়িয়ে কেটে পরলি।এখন খেয়েনে,”
-“বললাম না আমি খাবোনা,কেনো বারবার বিরক্ত করেন?”
-“তুই বিরক্ত হোস বা অন্যকিছু,তোর যদি কিছু হয় তোর খালা আমার জ্যান্ত কবর দিবে।আয় আমি তোকে খাইয়ে দি।”
-“এতো দরদ কেন দেখাচ্ছেন বলেন তো?খাবারে কিছু কী মিশিয়ে এনেছেন?”
-“এসব কী বলছিস তুই?যেমনি হোক তুই আন্টির সাথে এমন কথা বলবিনা।”
-“আমি যা বলেছি সেটা এনাদের স্বভাবে আছে।”
-“তোর খেতে ইচ্ছা করলে খা নয়তো খাবিনা।আর আপনি করে কথা কেন বলছিস?”
-“মামী আমাকে দাও,তুমি যেয়ে প্রোগ্রামের বাকী কাজগুলো করে ফেলো।”
মিসেস ইশানি চলে যাওয়ার পর ও তারার দিকে একটা রাগী লুক নিয়ে বলে,
-“তুমি যাই বলোনা কেন, আমি এখন খাবোনা ব্যাস।”
-“দিদি,এটা যে কী পরিমানের ঘাড়ত্যাড়া তা ভগবান জানে।”
-“তবে অনু এর ত্যাড়ামি শুধু ইরাক ভাইয়া ছুটাতে পারে।বুঝলি পুতুল,আসার সময় ইরাক ভাইয়াকে দেখলাম বাইরে থেকে এলো।”
-“ব্লাকমিল..আমারও সময় আসবে।”
-“হ দেখমু,এখন খেয়েনে।”
-“দাও…”
তারা ইয়ারাবীকে সুন্দর করে খাইয়ে দেয়।অনু ইয়ারাবীর রাগী ফেস দেখে হাসতে থাকে।
(৩৯)
দুপুরের পর থেকে জারবা নিজের রুমে বসে রেডি হচ্ছে।আবরার কোক খেতে খেতে ওর রে ঢুকে বলে,
-“কীরে পেত্নী,দুই ঘন্টা ধরে দেখছি আয়নার সামনে বসে আছিস।”
-“ছোট ভাইয়া আমাকে খবরদার পেত্নী বলবিনা।”
-“আচ্ছা তো রানী ভিক্টোরীয়া কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি।”
-“বাহ্ রে তুই জানিস না।আমি ভাবী আর দাদু ছোট ভাবীদের বাসায় যাবো,মেহেন্দীর প্রোগ্রাম তাই।”
-“আমিও যাবো…”
-“যাও ভাগো নেবোনা তোমাকে।”
-“প্লীজ দেখ তুই ম্যানেজ করনা আমার লক্ষী বোন।দেখ ভাইয়ার বিয়েতে তুই করেছিলি,সুতরাং আমাকেও করতে হবে।”
-“ধমক দিচ্ছো,কাজ হবেনা।”
-“আচ্ছা বল তোর কী লাগবে,একবার দেখেই চলে আসবো।”
-“ফ্রেন্ডরা সবাই মিলে সিলেট ঘুরতে যাবে,আমিও যাবো।যদি রাজী থাকো ট্রাই করবো।”
-“অন্যকিছু বল”
-“তাহলে আমিও কিছু করতে পারবোনা,ভাগো এখান থেকে।”
জারবা গুছিয়ে ইকরার কাছে চলে যায়।আবরার ওর বোনের ভিলেনি দেখতে থাকে।আবীর এসে ওর কাধে হাত রেখে বলে,
-“কাল থেকে তো সারাজীবনের জন্য পাবি।”
-“দেখ ভাইয়া,তুইও কিন্তু ভাবীর সময় গিয়েছিলি।তাই ঠান্ডা বারি আমাকে দিতে আসিস না।”
-“আরে বাবা শোন,”
-“তোমাদের কারো সাথে কথা নেয়,চল চেলসি তুই আর আমি ঘুমিয়ে থাকি।আজই লাস্ট বারের মতো আমার কাছে ঘুমাতে পারবি।”
আবীর ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।এই ছেলেটা প্রচন্ড রকমের ঘাড়ত্যারা।আল্লাহ জানে ইয়ারাবী একে সামলাবে কীভাবে?
বিকালের দিকে ইয়ারাবী একটা সবুজ লেহেঙ্গা পরে বসে আছে।হালকা সাজিয়েছে,গলায় প্রত্যয়দের দেওয়া নেকলেস।অনু ইয়ারাবীর জোরাজুরিতে শাড়িটা পরেছে।ইয়ারাবী কী করতে চাইছে সেটা অনু খুব ভালো করেই জানে।কিন্তু ও আর চাইনা ধোকা খেতে।ভালোবাসায় মানুষের দেওয়া ধোকা কী জিনিস সেটা অনু খুব ভালো করে জানে।কেউ কেউ নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যতের মোহে পরে সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষের হাত ছেড়ে দেয়।হারায় মানুষ আবার নতুন স্রোতের টানে ভেসে যায় আর কেউ কেউ থেকে যায়।কিন্তু অনুর জীবনে এমন কেউ থেকে যায়নি।আসলে অনু তাদের প্রিয়জন নয় প্রয়োজন ছিলো।আসলে খুব সহজে সবাইকে বিশ্বাস করে নেয় বলে বারবার ঠোকে যায়।
-“অনু খুব খারাপ লাগছে।”
-“কাল শ্বশুড়বাড়ি যাবি তাই আজ থেকেই খারাপ লাগছে তোর..”
-“বিল্লি কোথাকার?বলছি তোর কানের দুলটা চেন্জ কর,ওটাতে খারাপ লাগছে।”
-“পারবোনা।”
-“তুই করবি নাকী বল?”
-“আচ্ছা করছি,এতো রাগিস ক্যান তুই।”
পার্লার থেকে কয়েকটা মেয়ে এসেছে,মেহেন্দীর জন্য।ইয়ারাবীর খুব বিরক্ত লাগছে।সেই ক্লাস এইটে থাকতে লাস্ট নিজের হাতে মেহেদী দিয়েছিলো।তারপর আর কখনো নেয়নি।তবে অন্যকে দিয়ে দিয়েছে।জারবা,ইকরা আর ওদের দাদু এসেছে।মেয়েরা সবাই মেহেদী লাগাচ্ছে হাতে।হঠাৎ পার্লারের একটা মেয়ে ইয়ারাবীকে বলে,
-“আপু,ভাইয়ার নামটা বলো..”
-“আবরার,কেন?”
-“নামটা হাতে লিখবো তাই।”
বরের নাম ইয়ারাবীর মুখে শুনে ওর বড় খালা ওকে বলে,
-“কী মেয়েরে তুই বরের নাম মুখে নিস।”
-“মুখে নিবো না খাবো সেটা আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার।আপনি নাক না গলালে খুশি হবো।”
মিসেস ইশানি ওনার বোনকে দেখে বলেন,
-“আপু আদিবা কই?”
-“আর বলিস না,জানিনা মেয়েটার কী হলো?”
-“কেন, কী হয়েছে?ঠিক আছে তো ও?”
-“কাল তোদের এখান থেকে যাওয়ার পর রুমে যেয়ে ঘুমিয়ে পরে।আর তারপর রাত 2টার দিকে ভয়ে চিল্লিয়ে ওঠে।বারবার বলছে ওর ঘরে কেউ আছে,অথচ আমি বা ওর বোন কেউ কিছুই দেখিনি।তখন তো ঘুমালো, আর ৪টার দিকে ওয়াশরুমের আয়নায় বলে নিজের জায়গায় অন্য কাউকে দেখেছে বলে,এসব নিয়ে সারাদিন খুব ভয়ে ছিলো।”
-“বেশি হেয়ালি করিস না বিষয়টা,ভালো একটা হুজুরকে দেখা।আমার তো ভয় করছে যদি উল্টো-পাল্টা কিছু হয়ে যায়।”
-“দেখি,হতে পারে মনের ভুল।”
-“বলছিনা একদম হেয়ালি করবিনা।মেয়ে হলো সোনার খনি,ছোট অবহেলায় অনেক কিছু হয়ে যায়।আমার তো ভয় করছে।”
মেহেদী লাগানোর পর সবাই নাচ,গান করছে।ইয়ারাবীর দু’হাত ভর্তি মেহেদী।অনু্ও লাগিয়েছে,খুব সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে।ইয়ারাবীর চোখ দু’টো ওর ভাইদের খুঁজছে।নিলয় এসে একটা মিষ্টি মুখে দিয়ে বলে,
-“কিছু খুঁজছো আপু?”
-“ইরাক ভাইয়া কোথায় রে?”
-“বাইরে, দেখলাম ফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলছে।ডাকবো নাকী?”
-“না আমি যাচ্ছি।”
ওর উঠে দাঁড়ানো দেখে তারা বলে,
-“কীরে কোথায় যাচ্ছিস?”
-“এইতো একটু বাইরে,তোমরা মজা করো।”
ও বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে,নিচে থেকে ওর বেলকনির যে সিড়ি,ওটাতে বসে সবাই কথা বলছে।ইয়ারাবী ইরাককে কিছুটা দূরে থেকে ডাক দেয়।
-“কিছু বলবি পিচ্চি?”
-“ভাইয়া একটু শুনে যাওনা।”
ইরাক যেয়ে ইয়ারাবীর সাথে কিছু কথা বলে।তারপর ইয়ারাবী ভিতরে চলে গেলে ইরাকও বাকীদের নিয়ে ভিতরে চলে যায়।তবে প্রত্যয়কে আলাদা নিয়ে কানে কানে কিছু বলে।
সবাই খুব মজা করছে।প্রত্যয় সোফায় বসে ফোন টিপছে।মিনা প্রত্যয়কে মিষ্টি দিতে গেলে ইয়ারাবী নিষেধ করে।তারপর কৌশলে অনুকে দিয়ে কাজটা করায়।প্রত্যয় প্রথমে খেয়াল করেনা,কিন্তু যখন মেহেদী দেওয়া হাত দেখে তখন মুখের দিকে তাকায়।প্রত্যয় একটা বাঁকা হাসি দিয়ে প্লেটটা নিয়ে নেয়।অনু রাগী চোখে ইয়ারাবীর দিকে তাকাই।
অনেক মজা করে সময়টা কেটে গেলো।সেইদিন রাতে আর কিছু হয়নি।সকালবেলা সকলে বিয়ের আয়োজন নিয়ে ব্যাস্ত।তারার হাত কেটে যাওয়াতে পার্লার থেকে মেয়েরা এসেছে সাজাতে।ইয়ারাবীর বিয়ের গাউনটা অনেক ঘেরের।
জারিকাতো হা করে তাকিয়ে আছে গাউনের দিকে।এমন গাউন ওর বরের দুই বছরের আয়েও কেনা সম্ভব নয়।জারিকার হাসবেন্ড সব সময় সাধ্যের মধ্যে চেষ্টা করে ওর সখ পুরন করার।কিন্তি জারিকা, মিলিস্তা, নাফিসা এদের সভাব ওর মায়ের মতো।যত দেওয়া হয় তো আরো চায়।এজন্য সংসারে অশান্তি লাগিয়ে বাপের বাড়ি পরে থাকে।
মিলিস্তা গাউনটাই হাত রেখে বলে,
-“হ্যাঁ রে ইয়ারাবী,তোর বররা অনেক বড়লোক তাইনা।তবে কী জানিস বিয়েতে গাউন পড়লে কেমন একটা খ্রিষ্টান খ্রিষ্টান লাগে।”
আসলে যাদের সভাব অন্যের জিনিসের দোষ ধরার তারা হাজার ভালো কিছু হলেও দোষ ধরবে।ইয়ারাবী ওর কথায় হেসে বলে,
-“তাহলে আপু বাকী মুসলিম কান্ট্রিতে বিয়েগুলো খ্রিষ্টানদের মতো হয়।”
মিলিস্তা খুব ভালো করে জানে এ সেই ছোট ইয়ারাবী না।যাকে হাজার বকলে মারলেও চুপ করে থাকবে।মিলিস্তা,জারিকা চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে যায়।তবে আজ সকাল থেকে ইয়ামিলা বোনের সাথে আঠার মতো লেগে আছে।কাছ ছাড়া হচ্ছেনা।ইয়ারাবী গাউনটা পরে বেরিয়ে আসলে হেজাব বেধে সুন্দর করে ওড়না দিয়ে দেয়।ব্রাইডাল মেকআপ করিয়ে গহনাগুলো পরিয়ে দেয়।মাশাল্লাহ্ অনেকটা সুন্দর লাগছে ইয়ারাবীকে।অনু আজ খয়েরী কালারের একটা গাউন পরেছে।হালকা সেজেছে,না সাজলে আবার বিধবা বিধবা লাগে।
ইয়ারাবীকে ওর খালা মিসেস রহমান খাইয়ে দিয়ে যায়।সবাই ছবি তুলছে,এর মধ্যে আবরাররা চলে আসে।আবরারকে আজও অনেক সুন্দর লাগছে।ও আজ সেম কালারের শেরওয়ানি পরেছে।অনু আস্তে আস্তে ইয়ারাবীর কানে বলে,
-“দোস্তে, এই পোলা যদি হিন্দু হতো উঠায়ে নিয়ে বিয়ে করতাম।”
-“বিল্লি কোথাকার,শেষমেষ আমারটার উপর নজর দিলি।দাঁড়া তোর হচ্ছে।”
-“ভালো লাগছে তাই কয়ছি,তোর ভাগ্য ভালো তোর বিয়েতে নৌশিন নেয়।তুই তো জানিস ও কেমন গ্রুমের উপর নজর দেয়।”
-“ওই মেয়ের কথা বলবি নাতো,পরের সংসারে অশান্তি করে শান্তি পায়।”
-“ঠিকই বলছিস।”
-“ওই শোন,প্রত্যয় ভাইয়াকে কেমন লাগছে বলতো?”
-“কিডা প্রত্যয় আর কিডা প্রাপ্ত আমিতো তাই চিন্তে পারছিনা।তবে একটা জিনিস বুঝছিনা কাল থেকে এদের মধ্যে একটা আমাকে দেখে বাকা হাসি মারছে।”
-“বুঝায় বসয় হলে তবেই বুঝবি।”
-“তোর থেকে আমি দু’বছর আড়াই মাসের বড়ো।”
ইয়ারাবী আর কিছু বলেনা।ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।কাজী এসে বিয়ে পড়াবে এমন সময়…