জীবন মানে তুমি পর্ব:১৭

জীবন মানে তুমি
লেখিকা:H.B.Irini Ori
(৬২)
একটা অন্ধকার রুমের মধ্যে কিছু দড়ি দিয়ে চেয়ারের সাথে একটা ছেলেকে বেঁধে রেখে হকিস্টিক দিয়ে রিতিমতো পেটাচ্ছে ইরাক।কিন্তু ছেলেটা একই কথা বারবার বলছে,
-“স্যার সত্যি বলছি আমি কিছু জানিনা,স্যার গো সত্যি বলছি স্যার,আমারে ছাইড়া দ্যান।”
ইরাক ছেলেটার চুলের মুঠি শক্ত করে টেনে ধরে বলে,
-“আমার বোনকে খারাপ ম্যাসেজ পাঠাচ্ছিস,ওর জীবনে অশান্তি লাগিয়ে এখন বলছিস কিছু জানিস না।ইউ্ গট্ মি স্টুপিড?”
এর মধ্যে আবরার আর ইফাজ রুমের মধ্যে ঢোকে।ইফাজ ছেলেটার কথা শুনে ওর সামনে বসে বলে,
-“ছবিটা ভালো করে দেখে বলো,তুমি সত্যিই এই মেয়েটাকে চেনোনা।কিন্তু এই মেয়েটার পাশে তো তোমার ছবি।”
ছেলেটা ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এরে আমি চিনি কিন্তু নাম জানিনা,টি এস সির মোড়ে অনেকবার দেখছি।ওই জায়গায় যেয়ে বাচ্চাদের সাহায্য করে।”
আবরার কিছু একটা ভেবে ওকে জিজ্ঞাস করে,
-“নাম কী তোমার?আর কী করো তুমি?”
-আমার নাম সুমন,টি এস সির ওখানে ছোটখাট একটা ফুসকার দোকান আছে।আজ দুপুরে কিছু পুলিশের লোক যেয়ে আমারে উঠায়ে নিয়ে আইলো,তারপর এই স্যার আমারে কী মার যে দিলো।”
-“তুমি যদি সত্যিই বলো তাহলে এই মেয়েটার সাথে তোমার ছবি কেনো এলো?”
-“স্যার,মেয়েটা আপনার কী হয়?”
-“আমার ওয়াইফ,কেন?”
-“স্যার,কিছু মনে নিয়েন না,একটা কথা বলতাম।ইনি ভার্সিটিতে পরেন,বয়সও কম।কেউ এনাকে ফাঁসাতে চাইছে।এই দিক ওইদিক না দৌঁড়িয়ে এনার ভার্সিটিতে গেলে কিছু হলেও জানতে পারবেন।এমন কেউ আছে যে চাইনা আপনারা এক লগে থাকেন।”
ইফাজ আবরারের কাঁধে হাত দিয়ে বলে,
-“হি ইজ রাইট,হতে পারে ওর ভার্সিটির কেউ এমন কাজ করছে বা ফ্যামিলির কেউ।এ বেচারা সত্যিই কিছু জানেনা।”
ইরাক এবার রেগে যেয়ে বললো,
-“যদি সত্যিই না জানে তবে এর ছবি এলো কোথা থেকে?আর ইডিট করার জন্য কমপক্ষে কিছু ক্লিয়ার ছবির দরকার হয়।যেই কাজটা করুক না কেন এ চেনে।”
-“স্যার সত্যি বলছি আমি কিছু জানিনা,প্রায় অনেক সাংবাদিক আসে আমাদের ছবি তোলে নিউজের জন্য।আমি কেমনে বললো সে কে?”
আবরার অনেকক্ষণ ধরে সুমনের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে।হঠাৎ করেই ও বলে উঠে,
-“ইরাক একে ছেড়ে দে,এর দিয়ে কোনো কাজ নেই…যা বলছে সত্যি বলছে।”
ইরাক রেগে হকিস্টিক একটা বারি দিয়ে ভেঙে ফেলে বলে,
-“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তোদের এই বেচারা ছেলেটা মিথ্যা বলছে।”
-“দেখ ইরাক আমি একজন সাইক্রেটিস।কিছুটা হলেও মানুষের চোখের ভাষা বুঝতে পারি,ছাড় ওকে।”
ইরাকের প্রচন্ড পরিমানে রাগ হচ্ছে,ইচ্ছা করছে সুমনের জায়গায় আবরারের ধরে মারতে।ও একজন আর্মি অফিসার,এসব চোর-ডাকাত নিয়ে এর কাজ।আর সেই ইরাককে বলছে ওর ভুল হচ্ছে।ইরাক ওর একজন পুলিশ অফিসারকে ইশারা করতেই উনি এসে সুমনকে নিয়ে যান।এবার রাগী কন্ঠে আবরারকে বলে,
-“তুই এতো সিউর কীভাবে হলি?”
-“ছেলেটা মিথ্যা বলছে”
ইফাজ আবরারের কথা শুনে অবাক হয়ে বলে,
-“যদি তুই জানিস তাহলে যেতে কেনো দিলি?”
-“দেখ,এটা ঠিক ও ইয়ারাবীকে চেনেনা কিন্তু এটাও ঠিক কাজটা যে করেছে ও তাকে চেনে।তুই ওর হাতের ঘড়ি আর আংটি দেখেছিলি,সামান্য একজন দোকানদারের কাছে এতো দামী জিনিস আসবে কী করে?”
ইফাজ হেসে বলে,
-“বাকীটা বলা লাগবেনা বুঝে গেছি।এখন চল বাসায় যায়,পিচ্চিকে একবার দেখে আসি।জানিনা বাচ্চাটাকে মেরে কী অবস্থা করেছিস?”
-“ভাই,আর কত বলবি তোরা?আমিতো আর ইচ্ছা করে করেনি,কাল রাতে এমনিতে খুব ভয় পেয়েছি।”
-“ভালো হইছে,একমিনিট যে নাম্বার থেকে কল আসছিলো সেটার কিছু জানতে পেরেছিস?”
ইরাক ফোনটা বের করে দেখতে দেখতে বলে,
-“হামম,নাম্বারটা সিলেটের কারো নামে তোলা।আচ্ছা চল এখন।”
ওরা থানা থেকে বের হতেও গাছের আড়াল থেকে সুমন নামের ছেলেটা কাউকে ফোন করে।
-“দোস্ত,এটাই লাস্ট করলাম তোর জন্য।এরপর আমাকে এসবে জড়াবিনা।”
-“……….”
-“মার খায়নি মানে,এরা কী আমার শ্বশুড়বাড়ির লোক যে কিছু বলবেনা।পুলিশে মারলে তো থার্টি ডিগ্রী দিতো,কিন্তু এই আর্মির মার পুরু নাইন্টি ডিগ্রী ফেল।যাই হোক মিথ্যা বলে ব্যাপারটা মিটায়ছি।”
-“……..”
-“দেশে কী মেয়ের অভাব পরছে যে তুই ওর পিছনে লাগলি।তাছাড়া ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে।”
-“………..”
-“রাখ তোর মোহ,বেটা নিজের বয়স দেখছিস।রাখি আমি।”
সুমন ফোনটা কেটে বাড়ির পথে রওনা দেয়।কিন্তু সুমনের জানা নেই,কেউ তার পিছু নিচ্ছে।হ্যাঁ,সুমন কারোর জন্য কাজ করে।সেই লোকটা হলো ইয়ারাবীদের খুব কাছের একজন।মুখোশের আড়ালে নিজের চেহারা ঢেকে আছে।ইয়ারাবী শ্যামলা হলেও ওর মুখে এক ধরনের মায়া কাজ করে,আর সেই মায়াতে সহজে যে কেউ জড়িয়ে যায়,আকৃষ্ট হয়ে যায় ওর প্রতি।তাই ইয়ারাবীকে পাওয়ার জন্য এক বিষাক্ত খেলায় নেমেছে সেই অজানা লোকটা।বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খেলা শুরু করেছে।যেদিন শুনেছে ইয়ারাবীর বিয়ে ঠিক হয়েছে সেদিন থেকে পাগলের মতো বিহেভ করছিলো।তবে মাঝরাতে ওর মাথায় এক ভয়ংকর প্লান আসে,যা সুমনকে দিয়ে করায়।একজনকে দিয়ে কারো স্বপ্ন ভেঙে নিজের স্বপ্ন গড়তে চেয়েছে।
একটা ড্রাগসের শিরিন্জ হাতে নিয়ে বড় একটা পেইন্টিং এর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমার পরিবারে যখন বিয়ের প্রস্তাব দিলাম তোমার বাবা ওপস্ সরি,আমার হবু শ্বশুড়মশাই মানা করে দিলো।কী বললো,আমি ড্রাগ এডিক্টেড। ভালো মানুষ নই।বলেছিলাম বিয়ের পর ছেড়ে দিবো শুনলোনা।মেয়েকে বিচারক বানাবে,আমিও দেখবো তুমি কীভাবে শান্তিতে থাকতে পারো।জানি অনেকে তোমাকে পেতে চায় কিন্তু তুমি আমারি হবে।”
হাতে ড্রাগস্ পুশ করে কাউকে কল করে ছেলেটা।তারপর হন্তদন্ত হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
(৬৩)
-“আমার শ্বাশুড়ি মা বললো,তুমি বলে আমার সাথে দেখা করতে চাওনা।ইউ্ নো আই এম ইউর হাসবেন্ড বিবি।”
আদিবা রেগে গজগজ করতে করতে বললো,
-“আপনার সাহস তো মন্দ না,আপনি আমাকে ব্লাকমিল করে বিয়ে করেছেন।আমি এই বিয়ে মানিনা।আবার আজে বাজে নামে ডাকছেন।”
হাসান হাসতে হাসতে চেয়ারে হালকা বাঁকা হয়ে বসে বলে,
-“উপরে ঠিকঠাক আর ভিতরে সদরঘাট।তো ম্যাডাম আপনার এই ভিতরের রুপটা সম্পর্কে কেউ জানে তো?আচ্ছা,ছাড়ো এসব কথাবার্তা।বলো,কাউকে কী পছন্দ করো?কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে নাকী যে এমন করছো?”
আদিবা ওর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,
-“সেটা আপনাকে বলার প্রয়োজনবোধ করিনা।”
-“হতে পারে আমি তোমাকে হেল্প করতে পারি।”
-“হেল্প আর আপনি?আমাকে কী পাগল-কুকুরে কেটেছে যে আপনার কথা বিশ্বাস করবো?”
হাসান ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“বিশ্বাস-অবিশ্বাসের যে মায়াজাল আছে সেটা কিন্তু খুব কঠিন জিনিস।তিনটা জিনিস তুমি কখনো হারালে আর কাছে পাবেনা-১.যে সময়টা চলে যাবে,২.বলে যাওয়া কথা আর ৩.ভেঙে যাওয়া বিশ্বাস।আমি জানি তুমি কাউকে ভালোবাস,এখন বলো সে কে?”
-“জীবনে কোনোদিন ছেলেদের সাথে কথা বলিনি,তাকায়নি।কিন্তু মাস দু’য়েক আগে কারো চোখে হারিয়ে গেছিলাম।হ্যাঁ,ইসলামি ভাষায় হয়তো এটাকে “যিনা” বলে কিন্তু আমার প্রথম ভালোবাসা।ওনাকে পাওয়ার জন্য আমার মাও অনেক কিছু করেছিলো কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।”
হাসান একটু আগ্রহ নিয়ে নড়েচড়ে বসে বলে,
-“কিন্তু কেন? “
-“কারন উনি সেদিন আমার খালাতো ছোট বোনকে দেখতে এসেছিলেন।ও শ্যামলা,ঘরের কাজ কিছু পারেনা তবুও ওকে পছন্দ করলো।শুধুমাত্র ট্যালেন্ট দেখে,কেন এই ট্যালেন্ট ধুয়ে কী পানি খাবে?”
-“বিয়ে হয়ে গেছে?আর তোমার সেই বোন তোমার কত ছোট?”
-“সাত-আট বছরের,আসলে আমার প্রবলেমের কারণে কিছু বছর গ্যাপ গেছিলো।আর ওদের বিয়ে হয়ে গেছে।কিন্তু ওই মেয়েটার সাথে কীভাবে সংসার করবে তা সেই জানে।”
কথাটা অনেক রাগের সাথে বলে আদিবা।সামনে রাখা গ্লাসের জুসটুকু শেষ করে।হাসান ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুমি কী জানো,ইমাম গাজ্জালি (রহ.) মানুষের জবান বা কথার ১৪টি ব্যাধি উল্লেখ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে অর্থহীন কথা, পরচর্চা, পরনিন্দা, রুক্ষতা, অশ্লীলতা, ঝগড়া-বিবাদ, অভিশাপ, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, উপহাস, গোপনীয়তা প্রকাশ, মিথ্যা কথা ও মিথ্যা আশ্বাস ইত্যাদি। (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, পৃষ্ঠা ১০৪)। এর কোনো কোনোটি নারীর ভেতর বেশি পাওয়া যায়, আবার কোনো কোনোটি পুরুষের ভেতর। তাই আল্লাহ পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে নারীকেও এসব ব্যাধির ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘কোনো নারী যেন অপর নারীকে উপহাস না করে। কেননা যাকে উপহাস করা হয়েছে সে উপহাসকারিণীর চেয়ে উত্তম হতে পারে।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১১)”
আদিবা অবাক হয়ে হাসানের দিকে তাকায়।হাসান আবার হেসে বলে,
-“আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে, আল্লাহ তা অবহিত আছেন। আর ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান – তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের ওড়না বক্ষদেশে দিয়ে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক, অধিকারভুক্তবাদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক – যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ তাদের ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে।’ (সূরা নূর, আয়াত : ৩০ – ৩১)।
লিসেন আদিবা,এভাবে অবাক হওয়ার কিছুই নেই,আমি একজন কুরআনে হাফেজ।শুধুমাত্র পেশার কারনে এই বেশে থাকতে হয়।তোমার বাবা সবটা জেনে তবেই এই সমন্ধ এগিয়েছিলো।আর ভুল সবার হয়,আল্লাহর কাছে তওবা করে নাও।আমরা মানুষ,প্রতিনিয়ত শয়তান আমাদেরকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে।আর আমরা প্রায় তার দ্বারা পথভ্রষ্ট হই।আদিবা সব কিছু ভুলে নতুন করে শুরু করি।দেখো একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি,ভেবে দেখো তুমি।”
-“আমাকে বাসায় যেতে হবে।আসি আজ,আল্লাহ হাফেজ।”
আদিবা আর না দাঁড়িয়ে তৎক্ষণাৎ বাসার উদ্দেশ্য পার্ক থেকে বেড়িয়ে পরে।হাসান ওর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জায়গা থেকে উঠে পরে।
আজ সকালে আদিবা হাসানের সাথে দেখা করতে একটা পার্কে আসে।পার্ক বললে ভুল হবে,ওটা একটা খোলা রেস্টুরেন্ট বলা চলে।আদিবা মন থেকে এই বিয়েটাকে মানতে পারছেনা।তাই ভেবেছিলো হাসানের সাথে দেখা করে এই সম্পর্কের ইতি টানা যায় নাকী।কিন্তু হাসানের পরবর্তী কথাশুনে আদিবা চুপচাপ ওখান থেকে চলে যায়।আদিবার ছোটবেলার স্বপ্ন ছিলো কোনো হাফেজকে বিয়ে করবে যাতে পরবর্তীতে একসাথে দু’জান্নাতে যেতে পারে।সব কিছু ঠিকঠাক ছিলো কিন্তু মাঝপথে যেয়ে ওর স্বভাব-আচারন ওর মায়ের মতো হতে লাগলো।বলেনা,”সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”আর মিসেস জামান তো আদিবার মা,তাই উনি যা করবেন শিক্ষা দিবেন সেটা থেকেই আদিবা সবকিছু শিখবে..আর এটাই স্বাভাবিক।
(৬৪)
হঠাৎ মাথায় কারো আলতো হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে তাকায় ইয়ারাবী। আর পাশে তাকিয়ে দেখে মিসেস রহমান মানে ওর খালামনি বসে আছে।ইয়ারাবী উনার দিকে তাকিয়ে উঠে গেলে পেটে চাপ পরে ব্যাথায় কুকড়ে যায়।ওর খালামনি ওর দিকে তাকিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে,
-“একটা সময়ও কী শান্ত হয়ে থাকতে পারিসনা?সব সময় তাড়াহুড়া,লাগলো তো ব্যাথা।”
ইয়ারাবী ওনার দিকে একটা মাসুম চেহারায় তাকিয়ে বলে,
-“বকা দাও কেন?সারাদিন শুয়ে থাকতে কারো ভালো লাগে।আগে বলো কখন এসেছে।”
-“এইতো ঘন্টাখানিক হবে।তোর শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলছিলাম।”
-“আমাকে ডাকোনি কেন?জানো কত মিস করেছি,খালু এসেছে?”
-“হ্যাঁ,নিচে গল্প করছে সবাই।তোর খালুর ছুটি শেষ কালকে।তাই আজ তোকে দেখতে এসেছে।বিয়ের এক সপ্তাহ যেতে পারলোনা ওমনি জ্বর বাধিয়ে বসলি।”
এর মধ্যে ইকরা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
-“তা আর বলতে আন্টি,সবাকে তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো।আন্টি আপনারা কিন্তু আজ ডিনার না করে যেতে পারবেন না।”
-“আরে না না মা,আজ যেতে হবে।অন্য কোনোদিন করবো কেমন?মেয়েটাকে দেখতে এসেছিলাম শুধু।”
ইয়ারাবী ওর খালার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“প্লীজ খালামনি,খালুতো কাল বিকালে যাবে।আজ রাতে ডিনারটা করে যাও প্লীজ।”
-“দেখলেন তো এবার মেয়েও বললো।আমাদের কথা ফেললেও মেয়ের কথাতো আর ফেলতে পারবেননা।আচ্ছা,ইয়ারাবী একটু কষ্ট করে উঠে বসো ঔষধটা খেতে হবে।আবরার নিজে আসতো কিন্তু কথা বলছে তাই আমাকে পাঠালো।”
-“আপু আমি কিছু শুনতে চেয়েছি।”
ইকরা কথাটা শুনে হাসতে থাকে।ও খালার সাহায্যে আস্তে করে উঠে বসে।ইকরা মেডিসিনগুলো রেখে স্যুপ খাওয়াতে গেলে ওর খালা নিজে নিয়ে ইয়ারাবীকে খাওয়ায়।যে ভালোবাসাগুলো ওর মা-বাবার কাছ থেকে পাওয়ার দরকার ছিলো সেটা এনাদের কাছে পায়।কথায় আছেনা,”দুঃখের পরে সুখ আসে।”ঠিক তেমনি ওর পরিবারের কাছে দুঃখ,কষ্ট,যন্ত্রনা পেলেও এদের কাছে একটু সুখের ছোঁয়া পায়।ইয়ারাবী খেতে খেতে বলে,
-“খালামনি ও বাসার খবর কিছু জানো?”
-“কোন বাসার? “
-“মি.ফুয়াদের বাসার কথা বলছি…আচ্ছা,মনিরা কী চলে গেছে?কাল থেকে না ফোনটাও ধরতে পারছিনা তাই কথা বলা হয়নি।”
-“আমি যতদূর জানি হয়তো চলে গেছে,জানিস আদিবার আকদ হয়ে গেছে।”
-“ও আচ্ছা….একমিনিট কী বললে তুমি?কার সাথে?”
ওর মুখ মুছাতে মুছাতে বলে,
-“আমি বেশি কিছু জানিনা তেমন,ইশানি ফোন করে বললো,ছেলে বলে একজন ব্যাংকার।দেখতে এসে পছন্দ হয়ে গেছে তাই একবারে আকদ করেই গেলো।পরীক্ষার পরে উঠিয়ে নিবে,আমার মতে ভালোই হয়েছে।”
-“কেন?”
-“তুই ছোট মানুষ অতো বুঝতে হবেনা।”
-“তাহলে ছোট মানুষের বিয়ে কেন দিলে?মাত্র আঠারোতে পা রেখেছিলাম,আমার স্বপ্নতো তুমি জানতে তাহলে?”
মিসেস রহমান ওর চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলে,
-“কেন করেছিলাম সেটা সময় হলেই জানতে পারবি সোনা,আর তোর স্বপ্ন সেটা পুরন হবে চিন্তা করিস না।”
ইয়ারাবী কিছু একটা ভেবে বলে,
-“খালামনি খালুকে একটু রুমে ডাকবে,তোমাদের সাথে কথা আছে।”
-“আচ্ছা,তুই থাক আমি ডেকে আনছি।”
ওর খালা চলে যেতেই ইয়ারাবী বেডবক্স থেকে নিজের ফোনটা হাতে নেই।আসলে ওই ছবিগুলো দেখার পর থেকে ওর কিছুই ভালো লাগছেনা।ও ছবির ছেলেটাকে আরেকবার ভালো করে দেখার জন্য ফোনটা অন করে।কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো,একটা ছবিও ওর ফোনে নেই,আর না সেই নাম্বারের কোনো ম্যাসেজ।ইয়ারাবী আর কিছু চিন্তা করতে পারছেনা,আজকাল কোনো কিছুতে গভীর চিন্তা করলে মাথা ঝিমঝিম করে।ও ফোনটা রাখতেই অনুর কল আসে।রিসিব করার সাথে সাথে অনু চিল্লিয়ে বলে,
-“বিয়ে করে আমাকে পর করে দিলি,আমি কিছুনা তাইনা।ঠিক আছে আমিও কথা বলবোনা।”
-“আচ্ছা…”
-“কী আচ্ছা,আমি না বললেও তুই বলবি,আর আমি বলবোনা কেন?একশবার বলবো,এটা আমার মৌলিক অধিকার।”
ইয়ারাবী ওর কথা শুনে হেসে দিয়ে বলে,
-“বুঝলাম,এখন বল কী হয়েছে?এভাবে রেগে আছিস কেন?”
-“রাগবো না তো নাচবো নাকী?বেয়াদব তুই অসুস্থ আমাকে একটাবারও জানাসনি।একটা ম্যাসেজ তো করতে পারতিস।”
-“সিরিয়াসলি, অনু কাল ফোনটা টাচ অব্দিও করতে পারিনি।”
-“হুমম বুঝলাম,এখন বল কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছে যে তোর মাথায় রাগ উঠে গেছিলো?”
-“আজাইরা কথা কোথায় পাচ্ছিস বলতো?”
-“দেখ আমারে বুঝাতে আসবিনা,আমি জানি তুই খুব বেশি কষ্ট পেলে বা রাগ উঠলে শাওয়ারের নিচে বসে থাকিস।”
-“বাদ দে অনু,দেখা হলে তোকে বলবো।”
-“আচ্ছা এখন রাখি”
-“আম্মুটা বলে আমাকে খুঁজছিলো?”
ইয়ারাবী সামনে তাকিয়ে দেখে ওর খালা-খালু রুমে ঢুকছে।ওনাদেরকে দেখে ইয়ারাবী একটু ঠিক হয়ে বসে।
-“কেমন আছো খালু?”
-“আলহামদুলিল্লাহ,তবে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম যখন শুনলাম তুমি অসুস্থ।”
-“আমার কথা ছাড়ো,আগে বলো ওই বড় দু’টা ছেলে কী তোমার নিজের নাকী ব্রিজের নিচে কুড়িয়ে পেয়েছো?”
-“নাউজুবিল্লা,এটা কী কথা মামনি?”
-“না বলে কী করবো বলতো?তুমি কত রোমান্টিক,ইমু ভাইয়াও ঠিক তোমার মতো রোমান্টিক। তাহলে ওই বড় দু’টা নিরামিষ কীভাবে হলো?বুড়ো হয়ে যাচ্ছে বিয়ে দিবেনা।”
ওর খালু একটু নড়েচড়ে বসে বলে,
-“হামম,বিয়েতো দিতে হবে,কিন্তু সমস্যা তোমার ভাইয়াদের নিয়ে।”
-“খালামনি-খালু আমি ইফাজ ভাইয়ার জন্য একটা মেয়ে দেখেছি।আমার খুবই ভালো লেগেছে,দেখে রাখো তোমরা।পরে ইরাক ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখে একসাথে দু’টাকে বলির পাঠা বানিয়ে দিয়ো।”
ওর খালা সব শুনে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুই যখন দেখেছিস ভালো হবে কিন্তু তোকে কে বললো?ছেলেরা বিয়ে করলে বলির পাঠা হয়।”
-“কেন খালু তো বলে,ছেলেরা বিয়ে করলে বলির পাঠা হয়ে যায়।উদাহরন হিসাবে নিজেকে দেখিয়ে বলে,তোমাকে বিয়ে করে নাকী তার জীবন যায় যায়।”
ইয়ারাবীর কথাশুনে ওর খালা ওনার স্বামীর দিকে রাগী চোখে তাকায়।ওনিতো শুকনো ঢোক গিলে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেড়িয়ে যান।
সারাটা বিকেল অনেক হাসি-মজায় কেটে যায়।মিসেস রহমানরা ডিনার করে রাতে চলে যায়।আবরার ওর স্টাডি রুমে কিছু কাজ সেরে রুমে যেয়ে দেখে ইয়ারাবী আস্তে করে বেড থেকে নামছে।
-“দাঁড়াও আমি আসছি,”
-“আমি পারবো,যদি কিছু মনে না করেন কাবার্ড থেকে কাপড়টা বের করে দিবেন।আসলে ওই পর্যন্ত হেঁটে যেতে খারাপ লাগছে।”
আবরার ওর কাপড় বের করে ওকে ওয়াসরুম পর্যন্ত দিয়ে আসে।ইয়ারাবী কাপড় পরে বেড়িয়ে আসলে আবরার ফ্রেস হয়ে এসে ইয়ারাবীর পাশে বসে।আজ সকাল থেকে আবরার খুব নরমাল বিহেব করছে।আগের আবরার আর এখনকার আবরারের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
মেয়েদের জীবন মানে কিছু অবহেলা,কষ্ট-যন্ত্রণা মিশে থাকে।দুঃখের সাথে যেন সন্ধি করা থাকে তাদের।আর ইয়ারাবীর তো সেটা ছোটবেলা থেকে।কোনো কোনো সময় আসে নির্বাক শ্রোতা হয়ে শুধু দেখে যেতে হয়,আর আজ সেটাই করছে ও।আজ আবরারের প্রতিটা কাজ ও খেয়াল করছে।ওর ওভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে আবরার ওকে প্রশ্ন করে,
-“কিছু লাগবে তোমার?”
-“না”
আবরার ওর সামনের চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলে,
-“এই ছোট একটা “না” শব্দের মধ্যে কিন্তু অনেক কিছু লুকিয়ে থাকে।জানো কিছু কষ্ট খুব অদ্ভুত হয়ে থাকে।যখন সবার সাথে থাকে তখন এক কোণে লুকিয়ে থাকে,আর যখন একা হয় তকন নীরবে অশ্রু ঝড়ায়।”
-“আপনার আবার কীসের কষ্ট?”
-“পাগলি আমি আমার নয় তোমার কথা বলছি।”
ইয়ারাবী মাথা নিচু করে নিয়ে বলে,
-“আমার কীসের কষ্ট থাকবে,আমার কোনো কষ্ট নেই।”
আবরার ইয়ারাবীকে আস্তে করে ধরে শুয়ে দিয়ে বলে,
-“তুমি কী জানো ইয়ারাবী, ইসলামে সাধারণভাবে কথা ও কাজে যেকোনো ধরনের মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মিথ্যা বলার কারণে তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১০)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইচ্ছা বা কৌতুক কোনোভাবেই মিথ্যা গ্রহণযোগ্য হয় না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪৬)
কিছু মিথ্যাকে নির্দোষ প্রমাণে বিশেষভাবে একটি হাদিস উদ্ধৃত হয়। তা হলো রাসুল (সা.) বলেন, ‘তিনটি ব্যাপার ব্যতীত মিথ্যা বলা বৈধ নয়। তা হলো, স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে স্বামীর বলা। যুদ্ধের ময়দানে মিথ্যা বলা। মানুষের মাঝে সম্প্রীতি তৈরি করতে মিথ্যা বলা।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৯৩৯)
তুমি তো মিথ্যা বলোনা ইয়ারাবী,তাহলে এখন কেন বললে?”
ইয়ারাবী কথাটা ঘুরানোর জন্য ওকে বলে,
-“আজ যে আপনি নামায পড়লেননা।”
-“পড়েছিতো,মসজিদে যেয়ে।”
-“ওহ্ তাহলে ঘুমিয়ে পড়ুন।”
-“ঘুমাতে তো হবেই কাল ল্যাবে প্রচুর কাজ আছে,আবার হাসপাতালেও যেতে হবে।”
-“আচ্ছা,বড় ফুপি ওটা বলেছিলো কেন,আপনি লন্ডনে চলে যাবেন।”
-“আমিতো লন্ডনেই থাকতাম,তবে এটা আমার দেশ তাই একটা টানে চলে আসি।তাছাড়া এখানে আমার পরিবারও আছে।তবে লন্ডনে যেতে হবে।”
-“ওহ্হ্”
-“মন খারাপ করোনা,এখনো অনেকটা সময় আছে।তাই এসব চিন্তা এখন মাথা থেকে বাদ দিয়ে দাও।”
আবরার কথাটা বলে শুয়ে পড়ে।ইয়ারাবী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
-“আবরার,আপনাকে আমি স্বামীর অধিকার দেয়নি বলে কী আমার উপর রেগে আছেন?”
আবরার কথাটা শুনে ওর দিকে ঘুরে এক হাত উপর ভর করে উঁচু হয়ে বলে,
-“তোমার বয়স কতো?”
-“আ আঠারো,কেন?”
-“আমি একজন ডাক্তার ইয়ারাবী,তুমি মেন্টালি এন্ড ফিজিক্যালি এখনো ফিট নও।বিশ বছরের আগে কিছু হবেনা।আর বেবি প্লানিং যদি হয় সেটা তোমার স্ট্যাডি কমপ্লিটের পর।”
-“ওহ্ আর কালকের ওই ঘটনা।”
-“ঘুমাও,বারোটা বাজে আর একমাস পরে এক্সাম।”
অনেকটা গম্ভীর কন্ঠে কথাটা বলে উঠে আবরার।ইয়ারাবী কন্ঠস্বরটা শুনে চুপ হয়ে যায়।কাল রেগে যে চড়টা দিয়েছে মনে পড়লে গায়ে কাঁটা উঠে যায়।ওর বাবা-মা ওকে মেরেছে তবে এমন জোড়ে কোনোদিন চড় খায়নি।তাই ও আর কোনো প্রশ্ন করে ওর রাগ তুলতে চাইনা।
(৬৫)
সময় যে কখন কোনদিক থেকে ফুরিয়ে যায় তার হিসাব থাকেনা।মানুষ থেমে থাকলেও সময় থেমে থাকেনা।সে তার নিজের মতো প্রবাহমান।সে তার নিয়ম মতো চলতেই থাকে।তবে কিছু মানুষ আছে যারা সময়ের সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারে।
দেখতে দেখতে দু’সপ্তাহ কেটে যায়।আর এই দু’সপ্তাহে আবরার একটা বারও কোনো খারাপ আচারন করেনি ইয়ারাবীর সাথে।ইয়ারাবী সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে।তাই আবরার ওর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচারন করে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক করতে চাইছে।ইয়ারাবী কিছুটা হলেও ওকে সাই দেয়।ওর পরীক্ষা নিয়ে যতটা না চিন্তা করে তার থেকে বেশি আবরারকে নিয়ে করে।কেননা ওর জীবনের পরোটা সময় ভয়ে ভয়ে কেটেছে।তাই আবরারকে নিয়েও ভয় পায়,কোনো সময় কোনো ভুল করে ফেললে,যদি সেটাই জন্য আবরার রেগে যায়।
“ফিরে আয় শেষবার
চারিদিক আজ অন্ধকার
ঘুরে আসি বারবার
তোর স্মৃতির কাটাটায় ||
যত চাই ভুলে যেতে
জানি বাকী ব্যাথা পেতে
চল ফিরি তোর আমায়
সেই আলোর শহরে…
🎶🎶🎶🎶
শাওয়ার নিয়ে বাইরে এসে চুল মুছতে মুছতে গানটা গায়ছে ইয়ারাবী।বলতে গেলে অনেকদিন পর গলায় কোনো সুর তুললো।গান পারে তবে কোনোদিন গায়না।আজ মনটা খুব ফুরফুরে হয়ে আছে,ও কেন যে এত খুশি সেটা নিজেই জানেনা।আজ শুক্রবার,বেচারীর খেয়াল নেই আবরার এখনো রুমে ঘুমাচ্ছে।হঠাৎ একটা আওয়াজে ওর কথা বন্ধ হয়ে যায়।পিছনে তাকিয়ে দেখে আবরার একটা বক্সার গেন্জি আর থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট পরে বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ইয়ারাবীকে দেখছে।
-“আরে বাহ্ আমার বৌটার যে এতো ট্যালেন্ট তা আগে জানতামনা।”
-“আ আপনি উঠে পরেছেন?”
-“জগিং করে এসে তো আর ঘুমায়নি,তাই ওঠার তো কোনো প্রশ্নই আসেনা।থামলে কেন,অনেক ভালো লাগছিলো।”
-“আ আসলে মানে..”
আবরার ওর কথা শুনে একটু সিরিয়াস হয়ে ওর দিকে একপা, দুইপা করে এগিয়ে যাচ্ছে আর বলছে,
-“আচ্ছা আমার চেহারা কী খুব ভয়ানক?নাকী তুমি এমন কোনো পন করে রেখেছো যে আমার সাথে কথা বলতে আসলে ভয়ে তুতলাবে।”
ইয়ারাবী কোনো কথা না বলে পিছাতে থাকে।হঠাৎ বিছানার বেঁধে পরে যেতে গেলে আবরার ওকে ধরে ফেলে আর বলে,
-“তোমাকে বলে কোনো লাভ নেই,এখনি তো পরে যেতে।আর শীতের মধ্যে এত সকালে শাওয়ার কেন নিলে?”
-“নয়টা বাজে,”
-“তো?আচ্ছা,একবারে রেডি হয়ে নাও আমরা বাইরে লান্চ করবো আজ।”
-“বাইরে কেন করবো?”
-“দেখ বাসায় কেউ নেই?সবাই নানুবাড়ি গেছে,মেঘ তোমাদের কী কাজ আছে ওটার জন্য কোন গ্রামে গেছে।তাই এই কয়টা দিন বাসায় শুধু আমরা দু’জন আছি।আজ ফ্রাইডে,তাই ভাবছি বাইরে একটু ঘুরবো।আর কিছু?”
ইয়ারাবী দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে বলে না।আবরার হেসে ওয়াশরুমে চলে যেতেই ইয়ারাবী কাবার্ড খুলে বোরখা বের করে।আবরারের পুরোপুরি কড়া নির্দেশ ও সাথে থাকুক বা না থাকুক পর্দা করতে হবে।ইয়ারাবী হাত মোজা বেড় করার সময় হঠাৎ কিছু একটা ইয়ারাবীর পায়ের কাছে পরে।ও নিচু হয়ে দেখে কিছু ছবি আছে।কিন্তু ছবিগুলো দেখে ও খুব অবাক হয়ে যায়।
ছবিগুলোতে আবরার,ইফাজ,ইরাক আর কিছু ছেলেমেয়ে আছে।বাংলাদেশ বাদেও বাইরের দেশের বিভিন্ন জায়গায় তোলা।এগুলো দেখে বুঝা যাচ্ছে এগুলো স্টুডেন্ট লাইফের ছবি।আর যদি হয়ে থাকে তাহলে ওর ভাইয়াদের কী আগে থেকেই চিন্তো?আর যদি এরা একে অপরকে চেনে তাহলে ওকে কেন বলেনি?ওর সামনে আবরার কেন সব সময় ইরাক,ইফাজকে ভাইয়া বলে ডাকে?এছাড়াও নানা প্রশ্ন ওর মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে।
ওয়াশরুমের দরজার আওয়াজে ও ছবিগুলো জায়গায় রেখে দেয়।কেননা ও আগে কিছু আবরারকে বলতে চাইনা।দেখতে চাই এদের ওকে না জানানোর কারনটা কী?আবরার বের হয়ে বলে,
-“কী ব্যাপার এখনো রেডি হওনি।”
-“হচ্ছি,”
-“চাদর বাদে জ্যাকেটটা পরে নাও,বাইরের বাতাসে সমস্যা হবে।”
ইয়ারাবী একটা কালো কালারের বোরখা পড়ে নেকাব বেঁধে হাত-মোজা,পা-মোজা পরে নেয়।তারপর একটা জিন্সের লেডিস জ্যাকেট পরে দু’জনে একসাথে নিচে নেমে ব্রেকফাস্ট করে নিয়ে বেড়িয়ে পরে।
প্রথমে ওরা রোজ গার্ডেনে যায়,জায়গাটা ইয়ারাবীর খুব পছন্দের।তারপর ওরা যমুনা ফিউচার পার্কে যায়।তারপর ওরা দুপুরের খাবারের জন্য একটা রেস্টুরেন্টে আসে।আবরার জানে ইয়ারাবী বেশি মানুষের মধ্যে খেতে অভ্যস্ত নয়।তাই ও আগে থেকেই একটা কর্নারের পুরোটা বুক করে রেখেছিলো।ইয়ারাবী বসলে ওর সামনে আবরার এমনভাবে বসে যাতে ও পরোটা কভার হয়ে থাকে।প্রথমে আবরার ড্রিংকস্ অর্ডার করে।যেহেতু আশেপাশে কেউ নেই তাই ইয়ারাবী নেকাবটা খুলে ফেলে।পুরো ঘেমে গেছে মেয়েটা,মুখে কোনো মেকাপ নেই।তারপরও এক মায়া জড়িয়ে আছে মুখে।আবরার ইয়ারাবীর পছন্দের সিলান্ট্রো লাইম তেলাপিয়া,কোকোনাট লাইম চিকেন,ডিপ ফ্রাইড প্রন,কাচ্চি বিরিয়ানি,মিট চপ এন্ড ক্যাবেজ-ক্যারোট সালাদ অর্ডার করে।ইয়ারাবী এগুলো দেখে আবরারের দিকে তাকায়।আবার হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমার দিকে না তাকিয়ে শুরু করো,সকালে তো ঠিকমতো ব্রেকফাস্ট ও করোনি।”
ইয়ারাবী চামচ দিয়ে খেতে শুরু করে।আবরার কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেও শুরু করে।এর মধ্যে ল্যাব থেকে কল আসে,ও ইয়ারাবীকে খেতে বলে লনের দিকে যেয়ে ফোনে কথা বলতে থাকে।
এতক্ষণ আবরার ওকে আড়াল করে বসে ছিলো বলে খেতে পারছিলো কিন্তু ও উঠে যাওয়াতে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে।মনে হচ্ছে কেউ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ও চামচ দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছিলো এমন সময় একটা ২৭-২৮ বছরের ছেলে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে হাই বলে।ও লোকটার দিকে তাকিয়ে সালাম দিয়ে বলে,
-“কে আপনি?”
-“সিরিয়াসলি ইয়ারাবী,তুমি আমাকে চিনতে পারছোনা।আমি শাওন..”
-“কোন শাওন?সরি আমি এমন কাউকে চিনিনা।”
-“আই থিন্ক তুমি আমার নামটা ভুলে গেছো।কোনো সমস্যা নেই,মনে করিয়েদি।তোমার মিলিস্তা আপুর ছোট দেবর,যার সাথে এক সময় তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।”
-“সরি টু সে মি.শাওন,কথাটা ভুল বললেন।আমাদের কোনো বিয়ে ঠিক হয়েছিলোনা,আপনি এবং আপনার মা বিয়ের দিন থেকে পিছনে লেগে ছিলেন।”
-“ওকে,বাট্ সেই বিয়েতো করতেই হলো।তো আমাকে করলে কী হতো?”
-“দেখুন আমার হাসবেন্ড কোনো পুরুষের সাথে কথা বলা তেমন পছন্দ করেনা।তাই প্লীজ আপনি চলে গেলে খুশি হবো।”
শাওন কিছুটা বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে,
-“ফ্রিডম গার্ল এখন বন্দী কারাগারে”
-“মানে?”
-“পুরো প্যাকেট হয়ে আছো,ইউ নো এইভাবে তোমাকে বৃদ্ধা ছাড়া আর কিছুই লাগছেনা।তোমার মতো স্মার্ট মেয়ে এমন গায়ো টাইপ সাজলে ভালো লাগেনা।ইউ নো ইউ্ আর এ্যা হট গার্ল।বাট্ তোমার হাসবেন্ড নিঃশ্চয় কোনো গায়ো বা বৃদ্ধ টাইপের হবে,নয়তো এমন রাখবে কেন?”
ইয়ারাবীর এবার ধৈর্য্যের বাদ ভেঙে যাক।ভালো নাই বাসুক কিন্তু কোনো নারী নিজের স্বামীর সম্পর্কে উল্টো-পাল্টা কথা শুনতে পারেনা।ও কিছু বলতে যাবে তার আগেই কেউ একজন শাওনের গালে চড় মারে।ইয়ারাবী পাশে তাকিয়ে দেখে আবরার প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।শাওন রেগে তাকিয়ে ওকে দেখে বলে,
-“আ আবরার চৌধুরি ফুয়াদ আপনি এখানে?”
-“অবশ্যই,আমার স্ত্রী যেখানে থাকবে আমিও তো সেখানে থাকবো রাইট।”
-“আপনার স্ত্রী মানে?কোথায় উনি?”
-“এইতো দেখচ্ছেনা আপনার সামনেই,ওয়েট আপনার ভাষায় যে কীনা বোরখা পরে প্যাকেট হয়ে একদম গায়ো হয়ে গেছে।আরেকটা যেনো কী বললেন… হট গার্ল রাইট।”
-“ইয়ারাবী ইনি তোমার হাসবেন্ড?”
ইয়ারাবী শাওনের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“যতদূর জানি এনিই আমার স্বামী এন্ড সরি আঙ্কেল, আপনার সেই ইচ্ছাটা পুরন হলোনা যে আমার স্বামী একজন বৃদ্ধ হবে।”
শাওন রেগে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কাজটা তুমি ভালো করনি ইয়ারাবী,এর মাসুল তোমার দিতে হবে।তোমার বাবা,ভাইয়েরা আমাকে,মাকে অনেক অপমান করেছে এর শোধ তো আমি তুলবোই।আর এবার তোমার স্বামী…”
আবরার এবার শাওনের শার্টের কলার ধরে দু’টা পরপর থাপ্পড় মেরে বলে,
-“কথাটা বলতেও তো লজ্জা হওয়া উচিত,মাত্র চৌদ্দ বছরের মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলি।তোর মা একজন মেয়ে হয়ে অন্য মেয়েকে সম্মান দিতে পারেনা আবার বড় বড় কথা বলিস।তোকে এখনি মেরে ফেলিনি এটা অনেক,আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার স্ত্রীকে হুমকি দিস,এতো সাহস কোথায় পেয়েছিস।”
আবরার ওকে চড়-থাপ্পড় দিতে লাগলো, ইয়ারাবী অনেক কষ্টে আটকায় ওকে।পরে আবরার সিকিউরিটি গার্ডকে ডেকে ওকে বাইরে বের করে শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে চেয়ারে বসে পানি খেয়ে নরমাল হয়ে খাবার খেতে শুরু করে।ইয়ারাবী দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে,
-“এটা মানুষ না অন্যকিছু,এই ভালো এই খারাপ।ভাইয়ারা বলে মুড সুইং আমার যেভাবে হয় সেভাবে বলে আর কারো হয়না।কিন্তু এই ব্যাক্তিতো দেখছি আমার উপরের ক্লাসের।কিন্তু ইনি কীভাবে জানলো এতকিছু,সত্যিই আমার পাবনায় যেতে আর বেশিদিন লাগবেনা।”
-“সমস্যা নেই,পাগল হলেও পাবনাতে রাখবোনা।এখন ফালতু চিন্তা বাদ দিয়ে খাওয়া শুরু করো।”
ইয়ারাবী আবরারের যেভাবে মারতে দেখলো তাতে ওর অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।এতো জোরে কেউ মারতে পারে।যাই হোক,আবরার যেনো ওকে ভুল না বোঝে মনে প্রানে সেই দোয়া করতে করতে খেতে থাকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here