জীবন মানে তুমি পর্ব:৯

জীবন মানে তুমি
লেখিকা:H.B.Irini Ori
পর্ব:৯
(৩৪)
-“ওদের তো আছে?আমারও লাগবে।”
-“ঘ্যান ঘ্যান না করে যা এখান থেকে।টাকা নেই আমার কাছে?”
-“কেন টাকা নেই?তুমি তো ওদের তিনজনকে কিনে দিয়েছো তাহলে আমার সময় টাকা শেষ হয়ে গেল।”
-“হ্যাঁ,তোর সময় শেষ হয়ে গেছে।এত ড্রেস দিয়ে কী করবি,আগে যেটা কিনেছিলি ওটাই পরবি।”
-“তাহলে ওদের দুইটা করে কেন কিনে দিলে?ওখান থেকে আমায় একটা কিনে দিতে।”
-“তোর কাছে কৈফিয়েত দিতে হবে।অপয়া মেয়ে যা ভাগ এখান থেকে। সাহস কত ওদের জিনিসে নজর দিচ্ছে,ছোটলোক কোথাকার।”
বলেই ওর মা ধাক্কা দিয়ে ইয়ারাবীকে ফেলে দিয়ে চলে যায় ওখান থেকে।ছয় বছর বয়সি ইয়ারাবী নিজের ছোট ছোট হাতে পরে যেয়ে অনেক ব্যাথা পায়।তিন দিন পরে ঈদ,এবার ঈদ ওরা মিসেস ইশানির বাবার বাড়িতে করার জন্য এসেছে।ঢাকা থেকে সবার শপিং করেছে শুধুমাত্র ইয়ারাবীকে ছাড়া।বলেছিলো রংপুরে যেয়ে ওরটা করবে।ছোট ইয়ারাবী খুশি মনে সেটা মেনে নেয়।কিন্তু এখানে এসে মিসেস ইশানি নিজের ভাই-বোনের ছেলে-মেয়েকে কাপড় কিনে দেন।
ইয়ারাবী নিজের ছোট হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে নেয়।ইয়ারাবী আগের কাপড় আনেনি ওর মা।তাহলে এবারের ঈদে ও কী পরবে?কান্না করতে করতে ওর বাসার ভিতর যাচ্ছিলো।এমন সময় মনে হলো কেউ ওকে কোলে তুলে নিয়েছে।ওর ভেবেছিলো ওর মা মনে হয় ওকে শপিং এ নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে।ওর মুখ মুছে ভালো করে তাকিয়ে দেখে এটা ইরাকের মা ওর মেজো খালা।ওর মেজো খালা ওর চোখের পানি নিজের হাতে মুছে দিয়ে এক হাত ওর মাথার চুলে চালিয়ে ওর চুলগুলো ঠিক করে দেন।তারপর ওকে ভালো করে কোলে নিয়ে বলেন,
-“আমার আম্মুটা কান্না করছে কেন?”
-“আচ্ছা খালামনি অপয়া কী?”
-“তোমাকে এসব কে বলেছে?”
-“কেন ?আম্মুনি বলেছে ।জানো আমার ঈদের জামা কিনে দেয়নি।আমি চেয়েছিলাম তাই বললো জারিকা,মিলিস্তা,নুতনপিকে দিয়ে টাকা নেই।আচ্ছা সবার ঈদে জামা পরবে আমি পরবোনা।”
-“কে বলেছে আমার আম্মু ঈদে জামা পরবেনা।আমার আম্মুটা এবার ওদের মতো নয় ওদের থেকে অনেক সুন্দর জামা পরবে।”
-“কিন্তু আম্মুনি তো জামা কিনে দেয়নি।”
-“আম্মুটা কী জানে তার ছেলে তার জন্য ফেরী ড্রেস এনেছে।”
-“সত্যি,”
-“হামমম,একদম ৩ সত্যি।”
ছোট ইয়ারাবী ওর খালার কথা শুনে তার ছোট ছোট হাতগুলো দিয়ে খুশিতে তালি বাজায়।সেইবার ওর খালার দেওয়া ড্রেসটা পরে ঈদ করেছিলো,কিন্তু পরেরদিন ড্রেসটা আর ওর কাছে ছিলোনা।জারিকার পছন্দ হয়েছিলো বলে ওর মা জারিকাকে দিয়ে দেয়।এটা নিয়ে ওর খালা খুব রাগ করেছিলো ইশানির সাথে।
-“মাঝে মাঝে তো মনে হয় মেয়েটা আমার না তোর।”
-“হ্যাঁ,মেয়েটা আমার।নিজের মা হতি তাহলে জারিকাকে ওটা দিতিস না।তোর যদি এতই সমস্যা হয় তাহলে আমি লিগ্যালি এডোপ্ট নিবো একে।”
-“আমি কী ইচ্ছা করে দিয়েছি।ছোট বাচ্চা মেয়ে হাত পেতে চাইলো বলে দিলাম।আর হ্যাঁ,নিয়ে নে,আমি বাঁচি।যখন এক এক করে শেষ হবে তখন বুঝতে পারবি আমি কেন অপয়া বলি।”
-“খবরদার ইশানি,আর একটা বাজে কথা বললে তোর জিব টেনে আমি ছিড়ে ফেলবো।”
ইশানি আর কোনো কথা না বলে ওখান থেকে চলে যায়।মিসেস রহমান সেই বার ইয়ারাবীর জন্য এপ্লাই করেন।কিন্তু মি.ফুয়াদ পরে যেয়ে অনেক রিকুয়েস্ট করে যেনো তারা এটা না করে।
হঠাৎ ওকে পিছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরে।ঘুরে না তাকিয়ে বুঝতে পারে এটা তারা।
-“আমার পুতুলটার ঘুম ভেঙ্গে গেছে।”
-“নামায পড়ে আর ঘুম আসছিলনা তাই।সবাই তো মনে হয় উঠে পরেছে।”
-“তো,চুপচাপ বেডে যেয়ে শুয়ে পর।তোর জন্য গায়ে হঁলুদ সন্ধ্যার পর করা হয়েছে।তাই লক্ষ্মী মেয়ের মতো রেস্ট নে।অসুস্থ তুই, একটু তো খেয়াল রাখ।নাকী আবরারের কাছে যাবি বলে ঘুমই আসছেনা।”
-“মনিকে বলবো, তোমাকে বাড়ি থেকে বিদায় করতে।”
-“নিচে চল,ব্রেকফাস্ট করে রেস্ট নিবি।আর এরা উঠবেনা।”
-“উঠবে, অনুর উঠতে লেট হবে।”
তারা আর ইয়ারাবী গল্প করতে করতে সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে খেয়াল করে বাপ্পির হাতে,মাথায় ব্যান্ডেজ করা,মুখের একপাশ লাল হয়ে ফুলে আছে।খুব চাপচাপ বসে আছে এক কোনে।ইরাক সোফায় বসে কফি খাচ্ছে,আর ইফাজ পেপার পড়ছে।ওর বাকী চাচতো ভাইগুলো মনে হয় বাইরে বের হয়েছে আর বাকীরা কাজ করছে।
ওরা সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বাপ্পির দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী হয়েছে তোর?রাত অব্দি তো ঠিকই ছিলি।”
ওর মেজো চাচী পাশ থেকে বলে,
-“বলছে তো কাল রাতে ছাদ থেকে পরে যেয়ে হয়েছে।”
-“মনে হচ্ছে বেচারা একটু বেখেয়ালি হয়ে ছিলো।”
কথাটা বলে ইরাক আবার কফি খেতে থাকে।ইরাকের কথা শুনে তারা আর ইফাজ মিটমিট করে হাসে।ইয়ারাবীর মনে হচ্ছে কোথাও গন্ডোগোল আছে কিন্তু কী সেটা ধরতে পারছেনা।ইয়ারাবী যেয়ে সোফায় বসতেই মিনা এসে কফি দিয়ে যায়।ইফাজ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এত সকালে উঠলি কেনো?আরেকটু ঘুমাতি,প্রোগ্রাম তো রাতের দিকে।”
-“ঘুম ভেঙে গিয়ে তাই।”
-“ব্রেকফাস্ট করে ঘুমাবি।”
-“কত রাতে জেগে থাকলাম,আগে কিছু হয়নি এখনো হবেনা।”
-“একটা থাপ্পর দিবো বেয়াদব মেয়ে,নিজেকে কী ভাবিস?এসব ডায়লগ তোর অন্য কারো সামনে দিস, আমাদের সামনে দিতে আসবিনা।”
-“সত্য কথাই তো বললাম।”
-“ভাইয়া আমার কিন্তু ইচ্ছা করছে এর দু’গালে দু’টা দি।বিয়ে বলে কিছু বলছিনা?”
-“হ্যাঁ,এখন তো তোমরাই বাকী আছো?নাও তোমরাও ইচ্ছা পুরন করো।”
-“ধ্যাত,থাকবো না আর এখানে.”
বলেই ইফাজ উঠে দাঁড়াতেই ইয়ারাবী হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয়।
-“এই ভাইয়া কই যাও?”
-“হাত ছাড়,বাসায় যাবো।”
-“আমি তো মজা করে বলেছি,ইরাক ভাইয়া বলোনা ভাইয়াকে।”
-“ইফাজ…পিচ্চির বিয়ের আগে যাওয়া ঠিক হবেনা।শকুনের তো আর অভাব নেই যা কিছু করতে পারে।”
ইফাজ ওর ভাইয়ের কথা শুনে হেসে দিয়ে ইয়ারাবীকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে।আর ও ভাইয়ের কাধের উপর মাথা রেখে কফি খেতে থাকে।এর ভিতর বাপ্পি ওর মায়ের কাছে যেয়ে বলে,
-“মা আমি থাকবোনা,বাড়ি যাবো।”
-“ক্যান?কী হয়েছে,বলবি তো?”
-“না এমনি,ভালো লাগেনা।”
কথাটা বলেই রুমের দিকে হাঁটা দেয়।আসলে বাপ্পির ছাদ থেকে পরে যেয়ে এমন হয়নি,হয়েছে ইরাকের মারের কারনে।
কাল রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে যায় তখন বাপ্পি চুপচাপ ইয়ারাবীর রুমের দিকে যায়।ওর ধারনা ছিলো ইয়ারাবী আজও একা ঘুমিয়েছে।ইয়ারাবীর দরজায় লকে একটু সমস্যা।ভিতর থেক লক করলেও বাইরের থেকে লকের মধ্যে পিন বা কিছু দিয়ে গুতা দিলে খুলে যাবে।আর বাপ্পি চোর টাইপের ছেলে।রাত যখন ২টা বাজে সবাই ক্লান্ত হয়ে আছে তখন বাপ্পি যেয়ে ওর রুমের দরজা খুলে ঢুকে দেখে বেডে ৪ জন ঘুমিয়ে আছে।বাপ্পি পা টিপেটিপে যেই ইয়ারাবীর গায়ে হাত দিতে যাবে ওমনি পিছন থেকে কেউ ওর হাত চেপে ধরে।বিরক্তি নিয়ে ঘুরে দেখে ইরাক।ইরাক সাথে সাথে ওর হাত মুচড়ে ধরে।চোখ দু’টো লাল হয়ে আছে।
ইরাক যেহেতু আর্মির চাকরি করে সেহেতু ওর ঘুম একটু কম হয়,ওপরে আরো বেশি কফি খায়।তাই রাতে ছাদে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হয়ে দেখে বাপ্পির এসব কান্ড করছে।বাপ্পির আওয়াজে তারার ঘুম ভেঙে যায়।ওর ঘুম খুব পাতলা।ও প্রথমে ভয় পেয়ে যায় ওদের দেখে।পরে ইরাক ইশারা করে রুমের দরজা দিয়ে দিতে আর কাউকে কিছু না বলতে।তারপর ছাদে নিয়ে যেয়ে আচ্ছামত মার দেয়।এমন মার মনে হয় বাপ্পি জিবনে খায়নি।
আসলে ইয়ারাবীর বিয়েতে ওর চাচার পরিবারের কেউ খুশি না।কেননা ইয়ারাবীর জন্মের পর ওর দাদু বেঁচে থাকতে গ্রামের অর্ধেক সম্পত্তি ওর নামে লিখে দেয়।তাছাড়া মি.ফুয়াদের ভাগের কিছু অংশ ওর নামে আছে।ওর চাচারা নিজেদের ভাগেরটা খেয়ে ওদের ওপর চোখ দেয়।আর সম্পত্তি হাতানোর একটা সহজ উপায় ইয়ারাবী। তাই ওনারা বুদ্ধি করে বিপ্লব,হৃদয় বা বাপ্পির সাথে ইয়ারাবীর বিয়ে দিতে।কিন্তু মি.ফুয়াদ তাদের কুলাঙ্গার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে রাজী নন।তাই কাল রাতে বাপ্পি কিছু অঘটন ঘটাতে চেয়েছিলো।কিন্তু ফলস্বরুপ ইরাকের মার খেতে হলো।এমনটা নয় যে বাপ্পির বাবা-মা কিছু জানেন না।তারা সবটাই জানে,কিন্তু চুপ করে আছে।
আসলে মানুষ জন্ম নেওয়ার পরই মানুষ হয়ে যায় না।মানুষ হতে হলে ভালো আচারন শিখতে হয়,জানতে হয় ভদ্রতা।আর বাবা-মা শুধু সন্তান জন্ম দিয়েই মহৎ কাজ করেছে বলতে পারেনা,তাদের কেউ সঠিক শিক্ষা দিতে হয়।কেননা বাবা-মা যা করবে সন্তানও ঠিক সেটাই শিখবে।
(৩৫)
-“তুমি কী এখন যাবে?না মানে বলছি রাতে গেলে হয়না।বাসায় এত কাজ আরকী?”
-“মানে?আমার বোনের বিয়ে আর আমি যাবোনা।”
-“আমি সেটা বলিনি পল্লবী,তুমি তো জানো বাবা গ্রাম থেকে সকাল কয়েকজন লোককে আসতে বলেছে তাই তাদের জন্য রান্নাটা যদি করতে….তাছাড়া দেখো বাড়িতে লোক রেখে তো যাওয়া যায়না।”
-“কী বলতে চাও তুমি সায়ন?মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে সব শখ বির্সজন দিবো।আর তোমার বাবা-মা তো এমনি করে।যখনি শোনে আমি কোথাও যাবো ব্যাস শুরু হয়ে যায় তোমাদের মেলো ড্রামা।”
-“পল্লবী!উনি বুঝতে পারেনি তাই”
-“বুঝতে পারেনি মানে?আমি আজ সকালেও তাদের বলেছি তাহলে কী ভাবে বুঝতে পারেনা।”
-“তোমার যা করার তুমি করো।”
বলেই সায়ন রুম থেকে বের হয়ে যায়।এটা হচ্ছে সায়নের পরিবারের বড় সমস্যা,তারা পল্লবীর শান্তি দেখতে পারেন না।সারাদিন পল্লবী ভুতের মতো খাটলেও তাদের ভরেনা।যখনি সে কোথাও যেতে চায় তখনি তারা কোনো না কোনো বাহানা দেয়।পল্লবীর মেয়ে এসে আধো আধো বুলিতে মা কে বলে,
-“মাম্মা,দাবেনা।”
পল্লবী মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে অনেক তো হলো,এবার নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে হবে।এর মধ্যে জারা আসে ওদের বাড়িতে।পল্লবীর শ্বশুড়-শ্বাশুড়ির সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে পল্লবীর রুমে চলে যায়।
-“আপু,একী এখনো রেডি হওনি কেন?”
-“এইতো হবো।”
-“দুলাভাই কোথায়?যাবেনা,”
-“ওদের যেতে ইচ্ছা হলে যাবে নয়তো যাবেনা।আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।”
-“কিছু হয়েছে নাকী?”
-“যা সব সময় হয় তাই আজও হচ্ছে।বাদ দে এসব,পরীকে দেখ আমি আসছি।”
জারা পরীকে নিয়ে বসে খেলা করছে,পল্লবীর গোছানে প্রায় শেষের দিকে দেখে ইমনকে একটা কল করে।
-“ওই কই তুমি?”
-“এইতো রাস্তায়,কেন?”
-“পল্লবী আপুদের বাড়িতে চলে এসো।”
-“আচ্ছা,তোমরা ১০ মিনিট অপেক্ষা করো আমি ১ ঘন্টায় আসছি।”
বলেই ফোনটা কেটে দেয়।পল্লবী ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
-“বিজ্ঞানের তো সব কিছু করা হয়েছে,বিয়েটা কবে করবে?”
-“আগে নিজের পায়ে দাঁড়াবো তারপর।”
-“ইয়ারাবীও এমন বলতো।কিন্তু কী হলো সেই বিয়েটা তো হয়ে যাচ্ছে।”
-“পল্লবী আপু আপিপুর বিয়ের সাথে তার পড়ার সম্পর্ক অনেক গভীর।”
-“বুঝলাম না”
-“বুঝবে না তুমি,তবে তুমি যদি আপিপুর যায়গায় থাকতে তাহলে বুঝতে।আর বিয়ের জন্য কেউ আপিপুকে জোর করেনি,সে নিজের ইচ্ছাতেই করছে।”
-“তুমিও থেকে থেকে ইয়ারাবীর মতো কথা বলো।যাইহোক দোয়া করি যেনো সুখি হয়,আমার মতো যেন না হয়।”
-“হামম,আমি গ্রান্টি দিয়ে বলতে পারি আপিপু খুব সুখী হবে।”
-“তুমি এত সিউর কীভাবে বলোতো?”
-“পরে বলবো তোমাকে।”
পল্লবী মুচকি হেসে জারার জন্য নাস্তা আনতে চায়।ওর শ্বাশুড়ি ওর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।ওর ননদ পাশ থেকে বলে,
-“দেখো পল্লবী বিকালের দিকে গ্রাম থেকে কিছু লোক আসবে,রান্না করে তারপর যাবে।”
-” আপু ,আজ না হয় নিজে রান্না করবেন।এমনিতেও আপনার মা সব সময় বলে আমার থেকে হাজারগুন ভালো রান্না করতে পারেন আপনি।”
কথাটা শুনে ওর ননদ তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে,
-“তোমার তো সাহস মন্দ নয় তুমি আমাকে রান্না করতে বলো।”
-“হ্যাঁ,বলছি কেননা আমি এই বাড়ির বৌ হয়ে এসেছি চাকর নই।এবার থেকে যখনি বাবার বাড়ি আসবেন রান্না-বান্না করেই খাবেন।বাসায় জারা আছে তাই কোনো নাটক দেখতে চায়না।”
বলেই নাস্তাগুলো নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।আজ প্রথম ও এই বাড়িতে জোর কন্ঠে কোনো কথা বললো।মনে হচ্ছে ওর ভিতরের ঘুমন্ত নারী জেগে ওঠেছে নিজের অধিকার আদায় করার জন্য।ও যদি প্রথম থেকে এমন করতো তাহলে এতটা অবহেলা পেতে হতোনা।বিয়ের সময় বলে মেয়ের মতো রাখবে আর বিয়ের পর ঝি এর থেকেও বেশি অবহেলা করে।সত্যিই মানুষের চেনা মুখোশের আড়ালে অচেনা মানুষ লুকিয়ে থাকে।
(৩৬)
বিকালের দিকে বাড়ির চারপাশটা খুব সুন্দর করে লাইটিং করা হয়েছে,খুব সুন্দর করে সাজানো।সবাই সবার কাজে ব্যাস্ত।আবরাররা সন্ধ্যার পর পরই চলে আসবে।অনু,তারা,জারা,জারিকা,টিকলি এরা ইয়ারাবীর রুমে বসে আছে।পাল্লার থেকে লোক আনতে চেয়েছিলো কিন্তু তারা এসব কাজ পারে বলে আর কাউকে আনতে দেয়নি।ইয়ারাবী অন্যকে সাজাতে পারে কিন্তু নিজে সাজতে পছন্দ করেনা।কিন্তু আজ সেটা করতেই হচ্ছে।
ইয়ারাবী ওয়াশরুম থেকে হলুদ লেহেঙ্গা পরে বেড়িয়েছে।শ্যামলা চেহারায় অনেকটা ফুটে উঠেছে।মানতে হবে আবরারের পছন্দ আছে।জারিকা ওড়নাটা ধরে বলে,
-“গায়ে হলুদে ৫০ হাজার টাকার লেহেঙ্গা কিনেছিস।”
-“আপি,আমি তো নিতে চাইনি কিন্তু তোমার ফুপি এটা নিয়েছে।”
-“ওহ্,ওরা কিছু দেয়নি।”
-“হ্যাঁ,দিয়েছে।মেহেন্দি আর বিয়ের ড্রেসটা,তাছাড়া তত্ত্বর সাথে বাকী জিনিস।”
-“সেগুলোই কত দাম পড়লো?নিঃশ্চয় বেশি দামের কিছু দেয়নি যদি দিতো,তাহলে গাঁয়ে হলুদেরটাও দিতো।”
অনু জারিকার কথা শুনে বলে উঠে,
-“আসলে জারিকা কী বলতো,ওরা যে দুটা ড্রেস দিয়েছে তা এর থেকেও দামী।আর তাছাড়া বাকী জিনিসগুলোও খুব দামী যা আমাদের সাধ্যের বাইরে।সেটা সময় হলে দেখো।আর কী বলতো,দাম দেখে কিন্তু মানুষের মন বুঝা যায়না।যাই হোক তুমি আবার এসব বুঝবেনা।”
-“ইয়ারাবী তোর ফ্রেন্ড কিন্তু আমাকে অপমান করছে।”
-“কোথায়? আমি তো দেখছিনা।”
কথাটা শুনে রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বেড়িয়ে চলে যায়।তারা ইয়ারাবীর চুলটা বেধে মাথা কভার করে হেজাব বেধে দেয়।তারপর হালকা সাজ দিয়ে একে একে ফুলের গয়নাগুলো পরিয়ে দেয়।হাতে চুরি পরানোর সময় ব্যাসলেটটা খুলতে গেলে বলে,
-“স্টারপু প্লীজ এটা খুলোনা।এটার সাথেই পরাও।”
তারা একটা মুচকি হাসি দিয়ে ওটার সাথেই পরায়।বলতে গেলে অনেকটা সুন্দর লাগছে ইয়ারাবীকে।জারা তারা দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপু আপনি আপিপুকে টিকা লাগিয়ে দিন,নয়তো নজর লেগে যাবে।”
-“এজন্যই তো কাজলটা গারো করে দিয়েছি।সহজে কারোর নজর লাগবেনা।তাছাড়া আবরার তো আজ আসছেনা টেনশন নেই।”
-“আমি তো শুনলাম আসবে।”
-“কে বললো তোমাকে জারা?”
-“আপিপু ইফাজ ভাইয়াকে বলতে শুনলাম..”
-“আমার কী?”
-“প্লীজ পুতুল আজকের দিনে মন খারাপ করিসনা।”
-“তোর আপু ঠিকই বলছে,দেখ ইয়া যা হয় ভালোর জন্যই হয়।”
-“হুমম।”
ও মনে না করতে চাইলে স্মৃতির দরজায় এসে সবকিছু যে আপনা-আপনি কড়া নেরে জানিয়ে দেয়।সবার জীবনে কিছু কিছু মুহুর্ত খুবই দুঃস্বপ্নের হয়,যার স্মৃতি থেকে যায়।কিন্তু ইয়ারাবীর জীবনে সবটা জুড়ের দুঃস্বপ্নের মতো।যার শুরু তো আছে কিন্তু শেষ কোথায় সেটা বলা মুসকিল।সবাই আজ নীল পরেছে শুধুমাত্র অনু বাদে।ওর বারাবরই নীল রঙে এলার্জি।
ওরা সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে দেখে মিসেস জামানের পরিবার এসে।মিসেস জামান ইশানির দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“এখন তো দেখছি তোর সোনায় সোহাগা।জামাই বড়লোক আছে,দেখ তোর মেয়ের কপালে সুখ সহ্য হয় নাকী।”
-“মানে?কী বলতে চাস তুই?”
-“আরে বাবা রাগছিস কেন?আমি আসলে বলতে চেয়েছি যে সবার কপালে তো অতি সুখ সহ্য হয়না তাই।”
মিসেস ইশানি কিছু বলতেই যাবেন তখনি তার মেয়ের দিকে চোখ পরে।মেয়েটাকে আজ সত্যিই অনেক সুন্দর লাগছে।ইয়ারাবী ওর মায়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।মিসেস রহমান এসে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর আঙ্গুলে হালকা করে কামড় দেন।
-“বাহ্ আমার আম্মুটাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে।”
-“কেননা আমার মা তো কোটিতে একটা।”
বলে ওর খালু ওর হাতে 5000টাকা দেন।ইয়ারাবী নিতে চাইনা তবে জোর করাতে নিতে হয়।ওর খালু বাইরে চলে গেলে মিসেস ইশানি বলে,
-“সত্যিই একটা কপাল তোর,তবে কী জানিস?তোর এই বিয়েটা নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা কানাঘুষা তৈরি হবে।”
-“আপু কী বলছিস এসব?”
-“আহ্ খালামনি থামোনা,আমিতো শুনছি।তুমি যেয়ে দেখো ভাইয়ারা কোথায়।দুপুর থেকে কাউকে পাচ্ছিনা।”
-“রুমে রেডি হচ্ছে,আমি যেয়ে ডেকে আসছি।”
মিসেস রহমান উপরে যেতেই ইয়ারাবী ওর খালার সামনে যেয়ে বলে,
-“খালা কী যেনো বলছিলেন?না মানে আরেকটু ক্লিয়ার করে বললে বুঝতাম আরকী।”
-“না মানে দেখ,তোর বড় তো আদিবা ওর এখনো বিয়ে হয়নি।তাছাড়া তোর ওই ফুফাতো বোন এদেরকে দেখ।”
-“খালা আমার ফুফাতো বোনকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবেনা।তাছাড়া আপনার মেয়ের সাথে তো আমার সাথী নেয়।আর..”
ইয়ারাবী আর কিছু বলতে পারলোনা।তার আগেই অনু আর তারা এসে ওকে নিয়ে যায়।আবরারের পরিবারও চলে এসেছে।তবে আশ্চর্যের ব্যাপার সাথে আবরারও এসেছে।হলুদ ডিজাইনার পান্জাবি,সাথে ব্লাক প্যান্ট,ব্লাক সু,ব্লাক ঘড়ি, চুলগুলো স্পাইক করা,মুখে চাপ দাড়ি আর সবুজ চোখগুলোতে অনেক সুন্দর লাগছে।প্রথমে মিসেস ইশানি আর মি.ফুয়াদ হলুদ লাগিয়ে দেন।হলুদ লাগিয়েছে ঠিকই কিন্তু ও কারোর দিকে তাকাই নি।ইয়ামিলা ওর পাশে খরগোশ নিয়ে বসে আছে।আর ওর ডান সাইডে অনু।সবাই ওকে হলুদ লাগাছে। হঠাৎ ওর চোখ যায় আবরার দিকে।ও ইরাকের সাথে কিছুটা সাইডে যেয়ে কথা বলছে।কী বলছে সেটা শুনতে পারছেনা কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছে তাদের অনেকদিনের পরিচয় মনে হয়।
গায়ে হলুদের মিস্টি আইটেমই বেশি থাকে।আর ইয়ারাবী একদমই মিষ্টি খেতে পারেনা।হঠাৎ করে ওর প্রচন্ড আকারে পেটে ব্যাথা শুরু হয়।তারপরও চুপচাপ বসে থাকে,আবরারদের বাড়ির সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলছে।এদিকে জারবা ,অনু, জারা,ইয়ামিলা একের পর এক সেলফি তুলেই যাচ্ছে।একপর্যায়ে ও বসে থাকতে না পেরে অনুকে কথাটা বলে।
অনু তাড়াতাড়ি ওখান থেকে যেয়ে মিসেস ইশানিকে বলে কিন্তু ইশানি বলে,
-“আর কিছুক্ষণ মাত্র, বসে থাকতে বলো।”
-“ভাবী আসার পর থেকেই দেখছি, আপনার মেয়ের এত পেটে ব্যাথা কেন করো,মোটেও ব্যাপার ভালোনা।”
যে কথাটা অনুর একদম পছন্দ হয়না।ও ফিরে যেয়ে ইফাজকে খুঁজতে থাকে।দেখে ইফাজ, ইরাক,আবীর,
আবরার কথা বলছে।ওকে এখানে দেখে ইফাজ খুব অবাক হয় কেননা ওকে সব সময় ইয়ারাবীর সাথে থাকতে বলেছে।
-“কী হয়েছে অনু?তোমাকে না ইয়ারাবীর কাছে থাকতে বলেছি।”
-“দাভাই,একটু এদিকে আসবেন।”
-“কেন?তুমি এখানেই বলো সমস্যা নাই।”
-“দাভাই,ইয়ারাবীর খুব পেটে ব্যাথা করছে।”
-“হুয়াট্? কখন থেকে….”
-“বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই।আমি আন্টিকে বলেছি কিন্তু আন্টি বললো বসে থাকতে।”
-“আচ্ছা তুমি ওর কাছে যাও আমি মেডিসিন নিয়ে আসছি।”
অনু মাথা নাড়িয়ে ইয়ারাবীর কাছে চলে যায়।ইরাক ইফাজকে বলে,
-“ওকে এখন উঠাসনা।ওর কয়েকটা আত্মীয় আছে তিলকে তাল বানিয়ে দিবে।”
-“বাট্…”
-“আমার মতে ইরাক ঠিক বলছে,তুমি মেডিসিন দিয়ে দাও।দেখো এখানে অনেকেই আছে বিষয়টাকে অন্যকিছু ভাবতে পারে,যদি বেশি সিরিয়াস হয়ে যায় তবে রুমে নিয়ে যেয়ো।”
ইফাজ রুমে যেয়ে মেডিসিনটা নিয়ে আসার পথে কারোর কথার আওয়াজ শুনতে পায়।যেহেতু হলরুমে প্রোগ্রাম হচ্ছে সেহেতু ভীতরে বেশি মানুষের থাকা কথা নয়।ওর আওয়াজের উৎসের পিছু যেয়ে দেখে ইয়ারাবীর দুই চাচা কথা বলছে।
-“কাল যদি বাপ্পি কিছু করতে পারতো তাহলে হতো।কিন্তু ওই বেকুব কেন যে ছাদে গেলো তাই বুঝলাম না।”
-“কিন্তু ইয়ারাবীর বিয়ে হয়ে গেলো সম্পত্তি সব শেষ হয়ে যাবে।”
-“তো এখন কী করবি তুই?আমাদের তো আর কিছুই করার নেই।”
-“কালকের দিনটা আছে,দেখি কী করা যায়।”
-“করতে তো পারছিনা ওর দু’ভাইয়ের জন্য,এক একটার নজর বাজ পাখির মতো।যা করার আজ রাতেই করতে হবে।এখন বাইরে চল নয়তো সমস্যা হবে।”
-“হামম চল তুই।”
ইফাজ তাড়াতাড়ি মেডিসিনগুলো নিয়ে ইয়ারাবীর কাছে যেয়ে ওকে খাইয়ে দেয়।তারপর ওর পাশেই একটা সোফায় বসে থাকে।কিন্তু ওর চোখ দু’টো ওর দুই চাচার দিকে।অনেকক্ষণ ধরে প্রোগ্রাম চলে।যারা যারা বাইরে থেকে এসেছিলো তারা সবাই চলে যায়।আবরাররাও চলে যায়।
ইয়ারাবী রুমে যেয়ে ফ্রেস হয়ে এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নেয়।হঠাৎ ও মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পায়।চোখ খুলে দেখে ওর ফুপি।ও উঠতে গেলে ওর ফুপি নিষেধ করে।
-“এখন ভালো লাগছে সোনা?”
-“হামম,কিছুটা তবে বুঝছিনা খুব ঘুম পাচ্ছে।”
-“আচ্ছা ঘুমাস তার আগে কিছু খেয়েনে।”
-“কিছু খাবোনা মনি,খেলে ব্যাথা করবে।”
-“না খেয়ে ঘুমানো চলবেনা।”
দেখে ইরাক খাবার নিয়ে এসেছে।ও করুন চোখে ওর ফুপির দিকে তাকাই।ওর ফুপি হেসে বলে,
-“নে বল এবার খাবিনা….”
-“হাসো হাসো,কী আর করার।আমার দুঃখে সবাই হাসে।”
-“তোর জ্ঞান দেওয়া বন্ধ হলে এবার খেয়েনে।বেশি না হালকা এনেছি।”
-“ভাইয়া প্লীজ…”
-“ইফাজ মেডিসিন দিয়ে দিবে,”
-“এই বাড়িতে শুধু তোমাদেরই চিন্তা,কিন্তু দেখে যাদের সব থেকে বেশি হবার কথা ছিলো তারা ঢং বলে চলে গেলো।”
কেউ ওর কথায় কিছু বলেনা।আর বলবেই বা কী?প্রায় ঘন্টাখানিক আগে ইয়ামিলা ডাকতে এসেছিলো।ও খাবেনা শুনে ওর মা বলে এসব ঢং।অনু অনেক সেধেছিলো কিন্তু ও ব্যাথায় ভয়ে খেতে চায়নি।ইরাক অল্প অল্প করে কিছু খাইয়ে দিয়ে চলে যায়।তারপর একবারে নাইট ড্রেস পরে বেডে ঘুমাতে যাবে তখন ওর হাত বালিশের তলে দিয়ে দেখে একটা তাবিজ।খুব অবাক হলো।কেননা ওর বাড়িতে কেউ তাবিজ ব্যবহার করেনা।এর মাঝে ইফাজ মেডিসিন দিতে এসে দেখে ওর হাতে তাবিজ।
-“কীরে,আজকাল তাবিজের ব্যবসা শুরু করলি নাকী?”
-“ভাইয়া এটা বালিশের নিচে পেলাম।”
-“হয়তো কারো হবে,আলাদা করে রেখে…এক মিনিট মনে হয় এটা আদিবার। ওর হাতে গলায় এমন তাবিজই দেখেছি।ওরাতো মনে হয় এখনো যায়নি,আমাকে দে আমি দিয়ে আসি।”
ইফাজ তাবিজটা নিয়ে নিচে চলে যায়।সোফায় যেখানে আদিবা বসে ছিলো ওখানে ওর ব্যাগ পরে আছে।আশেপাশে ওকে দেখা যাচ্ছেনা।তাই ইফাজ তাবিজটা ওর ব্যাগে রেখে দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here