#জীবন_সাথী💜
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১১.
~
আরাফের মাথার একপাশে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে আনোয়ার সাহেব।মুখে তার পৈশাচিক হাসি।আরাফ অবাক চোখে তার বাবাকে দেখছে।এই মুহূর্তে তার কাছে তার বাবাকে বড্ডো অপরিচিত লাগছে।লাগবে নাইবা কেন তার বাবা তার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সে যে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।বুকের মধ্যে কেন জানি ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।১০ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে এই বাবার হাতেই তো বড় হয়েছে সে কখনোতো তাকে সামান্য অবহেলাও করেননি আনোয়ার সাহেব তবে আজ কেন তিনি তার সাথে এমন ব্যবহার করছেন।এই জটিল ধাঁধা আরাফ কোনোভাবেই মিলাতে পারছে না।এত ভাবার দরুন তার মাথাটাও এখন প্রচুর ব্যাথা করছে।দম বন্ধ হয়ে আসছে তার।সে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে তার সামনে থাকা মানুষটির দিকে করুন চোখে তাকায়।আরাফের ঠিক সামনেই হাত পা বেঁধে একটা চেয়ারে পারভেজ সাহেবকে রাখা হয়েছে।তার পাশেই আনোয়ার সাহেবের দুজন চেলা বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে।আরাফকে এইভাবে দেখার পর থেকেই পারভেজ সাহেব ছটফট করছেন।কিন্তু মুখ বেঁধে রাখার কারণে কিছু বলতে পারছেন না।আরাফ তার পি.এর এমন করুন দশা দেখে তার বাবার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বলে ,
”পি.একে কেন আটকে রেখেছো বাবা?পি.এ তোমার কি ক্ষতি করেছে?”
.
আরাফের কথায় আনোয়ার সাহেব জোরে জোরে হাসতে আরাম্ভ করেন।এমন ভাবে হাসছেন যেন আরাফ কোনো মজার কথা বলেছে।তারপর হাসি থামিয়ে তিনি আরাফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে বলেন ,
”আমি জানি আরাফ এই মুহূর্তে তোমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে।বাট মাই ডেয়ার সন তুমি কোনো চিন্তা করো না আমি একে একে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিবো”
.
কথাটা বলে তিনি আবার সেই পৈশাচিক হাসি দেয়।আরাফ তার বাবার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।এ যেন এক অন্য মানুষকে দেখছে সে।এই লোকটা কি আদৌ তার বাবা!কোনো বাবা কি পারে তার সন্তানের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে মারার হুমকি দিতে।আরাফের এই অবাক চাহনি দেখে আনোয়ার সাহেব শক্ত গলায় বলেন ,
”এত অবাক হওয়ার মতো কিছুই এখনো অবধি হয়নি।এখন এমন অনেক কিছু তুমি শুনবে যা শুনে তুমি অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে যাবে।নাও এবার বস এখানে।”
.
কথাটা বলে আনোয়ার সাহেব আরাফের দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দেয়।আরাফ সেখানে বসতেই আনোয়ার সাহেবও একটা চেয়ার টেনে তার মুখোমুখি বসে পড়ে।তারপর আরাফের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে ,
”তো আরাফ মোহাম্মদ!খুব অবাক হচ্ছ তাই না।ভাবছো তোমার বাবা হয়ে আমি কি করে তোমার মাথায় বন্দুক ঠেকাতে পারলাম।(বাঁকা হেসে বলে)এখন যদি আমি বলি আমি তোমার বাবা না তাহলে কি বিশ্বাস করবে তুমি ?”
.
আরাফের বাবার এমন ভয়ংকর প্রশ্নের প্রতিউত্তরে আরাফ শুধুমাত্র ছোট্ট একটা ঢোক গিলে তার দিকে আগের মতোই শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।আরাফকে চুপচাপ দেখে আনোয়ার সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন,
”আজ তোমার মনের সমস্ত সন্দেহ দূর করবো।যে দিনটার জন্য আমি এতো দিন যাবৎ অপেক্ষা করে গেছি আজ সেই দিনটা আগত।আমি জানতাম একদিন আমার আসল রূপ তোমার কাছে ধরা পড়বে।সে জন্য আগে থেকেই এই সিচুয়েশন মোকাবেলার মতো প্রুস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম।”
.
এইটুকু বলে তিনি ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন;তারপর আরাফের চেয়ারের দুহাতল ধরে শক্ত কন্ঠে বলে,
”আমি তোমার বাবা না আরাফ।না তুমি আমার ছেলে।আমার ওয়াইফ রোকেয়া যখন প্রথম প্রেগনেন্ট হয় তখন কোনো এক অজানা কারণে জন্মের পর আমাদের বাচ্চাটা মারা যায়।কিন্তু এই দুর্ঘটনাটা রোকেয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলো না।ডাক্তার এটাও বলেছিলো যে ও আর কোনোদিনও মা হতে পারবে না।বাচ্চাকে হারিয়ে রোকেয়া পুরো পাগল হয়ে উঠছিলো।তখন সবে মাত্র আমি বিজনেস শুরু করি।রোকেয়াকে অনেক চিকিৎসা আর মেডিসিন দিয়েও যখন কোনো লাভ হচ্ছিলো না তখন ডাক্তার আমাকে বলেন অনাথ আশ্রম থেকে রোকেয়ার জন্য একটা বাচ্চা এডপ্ট নিতে।আমি প্রথমে রাজি না হলেও রোকেয়ার অবস্থার কথা ভেবে পরে রাজি হয়ে যায়।অনাথ আশ্রমের সেই ছেলেটিকে রোকেয়া নিজের হারিয়ে যাওয়া বাচ্চা ভাবতে শুরু করে।আর ওই ছেলেটা আর কেউ ছিল না সেটা ছিলে তুমি।মাত্র ২ বছর বয়সে আমরা তোমাকে অনাথ আশ্রম থেকে আমাদের কাছে নিয়ে আসি তারপর আমাদের পরিচয়েই বড় করি।আমার নামটাই তোমার বাবার নাম হিসেবে পরিচিত পায়।সন্তান পাওয়ার পর রোকেয়া পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠে।আর আমিও তখন আমার বিজনেসে পুরো মনোযোগ দিতে পারি।আর তখনি আমার বিজনেসের প্রথম পার্টনার হয় এই পারভেজ আহমেদ।প্রথম প্রথম বেশ ভালোই চলছিল আমাদের কাজ।৪ বছর পর্যন্ত রাত দিন এক করে খেটে খেটে নিজের ব্যবসাকে দাঁড় করিয়েছিলাম।এরি মধ্যেই হঠাৎই একদিন এক কোম্পানির থেকে অফার আসে আমি যদি পারভেজের সাথে কাজ করা বন্ধ করে ওদের সাথে কাজ করি তাহলে ওরা আমাকে অনেক টাকা দিবে।সে মুহূর্তে কোম্পানিকে দাঁড় করানোর জন্য আমার অনেক টাকার প্রয়োজন ছিল তাই আর এই অফারটা ফেলে দিতে পারেনি।রাজি হয়ে যাই ওদের কথায়।ওদের কথা মতো পারভেজের সাথেও সমস্ত পার্টনারশিপ শেষ করে দেই।ধীরে ধীরে ওই কোম্পানির সাথে কাজ করতে করতে বুঝতে পারি ওরা হলো ড্রাগস সাপ্লাইয়ার।ওদের ব্যবসার এত লাভ মূলত এই ড্র্যাগ সাপ্লাইয়ের মাধ্যমেই ।আমি তো তখন অনেক অবাক হয় সামান্য ড্র্যাগ সাপ্লাই করে তারা এতো এতো টাকার মালিক।আমিও তখন ধনি হওয়ার স্বপ্নে ওদের সাথে যোগ দেই।পারভেজ কোনোভাবে বুঝে যায় যে আমি একটা কালো বাজারি চক্রের সঙ্গে নিকেকে জড়িয়ে ফেলিছি তাই সে আমাকে সাবধান করতে আসে।কিন্তু তখন আমি ওর কথা না শুনে বরং ওর সাথে সব প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দেই।যারফলে তোমার সাথেও তার যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।আর আজ আমি একজন সফল ড্র্যাগ ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছি।জানতো আরাফ আমার কিন্তু অনেক অবৈধ সম্পদ আছে কিন্তু এইসব কেউ জানে না।কিন্তু জেনে গিয়েছিলো এই পারভেজ।আর তারপর থেকেই সে আমাকে ব্লেকমেইল করা শুরু করে যে আমি যদি আমার এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধ না করি তাহলে ও নাকি আমার সম্পর্কে সব কিছু পুলিশকে বলে দিবে ।কত বড় সাহস ওর!তাই তখন আমি প্লেনিং করে তোমার রাত দিন পরিশ্রমের বিনিময়ে তৈরী করা সেই ফাইল আর পেনড্রাইভটা আমার কাছে সরিয়ে রাখি আর সব দোষ দেয় এই পারভেজের ঘাড়ে।ভেবেছিলাম রাগের চোটে তুমি বোধ হয় ওকে মেরে ফেলবে কিন্তু তা না করে তুমি এক বছর যাবৎ ধরে ওকে আটকে রেখেছো তারপর যখন জানতে পেরেছো ও তোমার সেই ছোট্টবেলার পি.এ তখন আবার তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ বাড়িতে নিয়ে রেখে এসেছো;সেটা তো আমি মেনে নিতে পারবো না আরাফ।তাই আমি আবার আমার লোক পাঠিয়ে ওকে ধরে আনি।এবার ওকে আমি মারবো।সাথে তুমিও মরবে কারণ আমি জানি তুমি বেঁচে থাকলে আমার সকল রহস্য তুমি পুলিশকে বলে দিবে তাতে করে আমার আমার এতো জীবনের সমস্ত পরিশ্রম মাটিতে মিশে যাবে।তাই সরি মাই ডেয়ার সন না চাইতেও আজ তোমাকে আমার হাতে মারতে হবে।”
.
কথাটা বলে আনোয়ার তার বন্দুকটা আবার আরাফের কপাল বরাবর তাক করে।
.
এত কিছু শোনার পরও আরাফ নিশ্চুপ।ঐযে বলে না অতি শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়।আরাফেরও এখন সেই অবস্থা।মস্তিষ্ক তার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে ।সে শুধু একটা কথায় ভাবছে এতোদিন যাকে সে বাবা বলে এসেছে আসলে সে তার বাবা না।এত দিন সে এক মিথ্যে জগতে ছিল।তার কাছের মানুষরা তাকে এইভাবে ঠকিয়েছে অথচ সে টেরও পাইনি ।কি অদ্ভুত!আরাফ কয়েকবার ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে।হয়তো চোখের কিনারার পানিটাকে গড়িতে পড়তে বাধা দিচ্ছে।আরাফের কাছে নিজেকে আজ বড্ডো অসহায় লাগছে।
.
রেস্টুরেন্ট থেকে তার বাবাই তাকে এই জায়গায় নিয়ে আসে।বলেছিলো তিনি নাকি আরাফকে কিছু একটা দেখাবেন যাতে করে সে চমকে উঠবে এই কথা শুনে আরাফও ভাবে আনোয়ার বোধ হয় সব সত্যিটা প্রকাশ করতে তাকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু সিটি শপিংমলের পেছনের এই ভাঙা চূড়া পরিত্যাক্ত বিলন্ডিংটার ভেতরে প্রবেশ করে সে সত্যিই বেশ অবাক হয়।এই ভাঙা বিল্ডিংটার কোনায় কোনায় আনোয়ারের লোকেরা বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে।এটাই আনোয়ারে ছোট খাটো একটা আস্তানা।আরাফকেও মারার জন্য এর থেকে সেইফ জায়গা তার চোখে আর নেয়।তাই সে পারভেজের মতো তাকেও এখানেই নিয়ে আসে।
.
আরাফকে চুপ থাকতে দেখে আনোয়ার বলে ,
”তো মাই লাভিং সন তুমি কি মরার জন্য প্রস্তুত?”
.
আরাফের দৃষ্টি এখনো শান্ত।অনুভূতিহীন ভাবে সে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।কিন্তু আনোয়ারের এই ভয়ানক কথা শুনে পেছন থেকে পারভেজ সাহেব মাথা নাড়িয়ে না করছে।পারলে এক্ষনি তিনি তার সমস্ত বাঁধন খুলে আরাফকে নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যেত।কিন্তু সেটা এখন সম্ভব নয়।না চাইতেও এখন তাকে আনোয়ারের এই ভয়ংকর খেলা দেখে যেতে হবে।কথাটা ভেবেই পারভেজ সাহেবের চোখের কিনারা দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরে।
.
এইদিকে আরাফ স্তম্ভিত।সে যেন একটা মোমের পুতুল।না নড়ছে না কোনো কথা বলছে।আরাফের এমন শান্ত ব্যবহারে আনোয়ার কিছুটা অবাক হয়ে তার দিকে ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে ,
”মৃত্যুর আগে তোমার কোনো শেষ ইচ্ছে আছে?”
আরাফ এবার চোখ তুলে তাকায়।তারপর মৃদু সুরে বলে
”হুম”
আনোয়ার বাঁকা হেসে বলে ,
”কি?”
আরাফ শান্ত গন্ঠে বলে ,
”আমি এই বিল্ডিংয়ের বাইরের খোলা আকাশটা শেষবারের মতো দেখে আসতে চাই।আরাফের কথা শুনে আনোয়ার কিছুক্ষন তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারপর কিছু একটা ভেবে বলে ,
”ঠিক আছে।যাও”
.
আরাফও উঠে ধীর পায়ে বাইরে যায়।আনোয়ার সাহেব আরাফকে একাই যেতে দিয়েছে কারণ তিনি জানেন আরাফ কখনো পালিয়ে যাবে না।আর কাউকে কলও দিতে পারবেনা কারণ আরাফের ফোনও তার কাছেই আছে। অন্তত তার পি.একে এখানে রেখে সে কখনোই যাবে না।আরাফ যে পালিয়ে যাওয়ার ছেলে না তা আনোয়ার সাহেব খুব ভাল করেই জানেন।
.
বেশ কিছুক্ষন বাদে আরাফ আবার ফিরে আসে।সে তার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার বাবার হাত সহ বন্দুকটা তার নিজের মাথায় ঠেকিয়ে বলে ,
”নাও শুট মি।”
আনোয়ার সাহেব বাঁকা হেসে বলে ,
”বাবা তোমার তো মরার খুব শখ।সমস্যা নেয় আমি তোমার শখটা এক্ষনি পূরণ করে দিবো।”
.
কথাটা বলে উনি যেই না ট্রিগালে চাপ দিতে যাবে অমনি কয়েকজন চেলা দৌড়ে এসে আনোয়ারকে বলে ,
”স্যার বিলন্ডিংয়ে ভয়াবহ আগুন লেগেছে।এক্ষনি যদি এখান থেকে না বের হয় তাহলে আমরা সবাই পুড়ে ছাই হয়ে যাবো।”
.
কথাটা শুনেই আনোয়ার আরাফের দিকে তাকিয়ে দেখে আরাফ মুখে রহস্যময় হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার আর বুঝতে বাকি থাকেনা যে এটা আরাফের কাজ।
চলবে..
(আল্লাহকে ভয় করো,পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়)