জীবন সাথী💜 পর্ব-৩৪ শেষ পর্ব

0
2274

#জীবন_সাথী💜
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩৪.(অন্তিম পর্ব)
~
গাড়িটা আনোয়ার মঞ্জিলের কাছে এসে থেমে গেলো।আরাফ ব্রু কুঁচকে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে,
”কি ব্যাপার এখানে এসে থামলে কেন?আমি না তোমাকে বলেছি আমরা ডিরেক্ট আমার ফ্ল্যাটে যাবো।তাহলে তুমি এখানে কেন নিয়ে এসেছো?”

আরাফের গাড়ির ড্রাইভার মাথাটা কাত করে আরাফের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
”না মানে বড় স্যার বললো আপনাদের এখানে নিয়ে আসতে।”

আরাফের কুঞ্চিত ব্রু জোড়া আরো কিছুটা কুঞ্চিত হয়।সে রাগি কণ্ঠে বলে,
”না গাড়ি ব্যাক করো।আমি এখানে অনুকে নিয়ে নামবো না।”
.
আরাফের কথা শুনে অনু সোজা হয়ে বসে ।তার কথার দরুন অনু এইটুকু বুঝতে পারে আরাফের মনে এখনো তার বাবার উপর কিছু অভিমান রয়ে গেছে।কারো উপর রেগে থাকলে তাকে ক্ষমা করে দিয়ে সেই রাগ নিবারণ করা যায়;কিন্তু এই ছোট ছোট অভিমান গুলোই মানুষকে খুব জ্বালায়।যেমন এখনো আরাফেকে তার বাবার প্রতি অভিমান গুলো তাকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে।অনু আলতো করে আরাফের কাঁধে হাত রাখে।আরাফ তার শান্ত দৃষ্টি অনুর উপর নিক্ষেপ করে।অনু হালকা হেসে বলে,
”আমি এখানেই নামবো।আমার শশুর বাড়িতে।”

অনুর কথা শুনে অবাক হয় আরাফ।তবে কিছু একটা ভেবে সে অনুকে বলে,
”ঠিক আছে চলো।”
.
আরাফের সম্মতি পেয়ে অনুর চোখে মুখে খুশির ঝিলিক দিয়ে উঠে।আরাফ গাড়ি থেকে নেমে অনুর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।অনু কোমল দৃষ্টিতে একবার আরাফের দিকে তাকিয়ে আরাফের হাত ধরে সেও গাড়ি থেকে নেমে পরে।
আরাফ না চাইতেও অনুর কথা শুনেছে।এমনিতেই অনুর মন খারাপ তার উপর এখন যদি আরাফ ওকে এখন থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তাহলে হয়তো তার আরো মন খারাপ হতে পারে।অনু হয়তোবা এই বাড়িটাকেই তার শশুর বাড়ি হিসেবে মেনে নিয়েছে।আর অনু যেখানে ভালো থাকতে পারবে আরাফ ও সেখানে হাসি মুখে থাকতে পারবে।
.
অনু আর আরাফ গাড়ি থেকে নামতেই একে একে বাকি দুটো গাড়ি ও এসে তাদের বাড়ির সামনে থামে।একটা হুয়িল চেয়ারে করে আনোয়ার সাহেবকে নামানো হয়।যদিও তিনি এখন কিছুটা হাঁটা চলা করতে পারেন তাও ডাক্তার বলে দিয়েছে বেশি যেন আবার না হাঁটেন।আগুনের কারণে সব থেকে বেশি পুড়েছে উনার পা।তাই ডাক্তার উনাকে পায়ের ব্যাপারে খুব সেনসিটিভ থাকতে বলেছেন।অনু আর আরাফকে বড় গেইটটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে প্রশান্তির হাসি দেন আনোয়ার সাহেব।তিনি তার ছোট ভাইয়ের বউকে হাঁক দিয়ে বলেন,
”আমেনা যাও তাড়িতাড়ি;আমার অনু আর আরাফকে বরণ করার ব্যবস্থা করো।”

আমেনা সম্মতি জানিয়ে বাসার ভেতর গেলেন।তারপর একে একে সবাই আনোয়ার মঞ্জিলের বিশাল বাড়িটার মেইন ফটকের সামনে এসে দাঁড়ায়।বিশাল বড় বাড়িটা মেইন গেইট থেকে এই পর্যন্ত সিমেন্টের সরু পাকা রাস্তা।আর তার দুপাশে সবুজ ঘাসের ছড়াছড়ি।বাড়িটার একপাশে বিশাল একটা বাগান আছে।যেটা গেইটের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পরে অনুর।দূর থেকে দেখেই সে বুঝতে পারছিলো সেখানে হরেক রকম ফুল আর শাকসবজির আবাদ।বাড়ির মেইন ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে বাড়ির ভেতরটা দেখে খুব অবাক হয় অনু।এতদিনতো এই বাড়িতে কেউ ছিল না।তাও বাড়ির সব কিছু এতটা চকচকে দেখাচ্ছে কি করে?অনু ভাবে; হয়তো ওরা আসার আগেই তার শশুর মশাই কাজের লোকদের দিয়ে এইসব কিছু পরিষ্কার করিয়ে রেখেছেন।
.
অনু আর আরাফকে নিয়ম মোতাবেক বরণ করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করানো হলো। অনু চোখ বুলিয়ে একবার চারপাশটা চোখ দেখে নিচ্ছে।বেশ গুছানো সব কিছু।অনু আর আরাফকে সোফায় বসানো হলে একে একে আরাফের কাজিনরা তাদের ঘিরে সোফায় বসে পরে।
.
আড্ডা মজাই মুখরিত হয়ে উঠছে আজ আনোয়ার মঞ্জিল।গত ২০ বছরে এতোটা আনন্দকর পরিবেশ কখনো তৈরী হয়নি এখানে।অনুও এই আনন্দকর মুহূর্ত গুলোর সাথে নিজেকে খুব সুন্দর মানিয়ে নিচ্ছে।হাতে কিছু একটা বক্স নিয়ে আনোয়ার সাহেব তার হুয়িল চেয়ারটা টেনে আরাফ আর অনুর কাছে এলেন।অনুর দিকে সেই বক্সটা এগিয়ে দিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলেন,
”নাও মা এগুলো তোমার।তোমার শাশুড়ি মায়ের হাতের বালা।তার ছেলের বউয়ের জন্য রেখে গিয়েছে।তুমি এগুলো গ্রহণ করলে আমি খুশি হবো মা।”

অনু একবার আরাফের দিকে তাকালো।আরাফ কিছু না বলে শুধু হালকা একটু হাসে।অনু বুঝতে পারে আরাফ সম্মতি জানিয়েছে।অনুও হাসি মুখে সেটা গ্রহণ করে নেয়।তারপর বসা থেকে উঠে সে তার শশুর মশাইকে সালাম করে।পারভেজ সাহেবও খুশি মনে তার বৌমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেন।
.
.
রাতের খাবার শেষে অনুকে নিয়ে তার বাসর ঘরে রেখে আসা হলো।অনু তার বাসর ঘর দেখে আরেক দফা অবাক হয়;খুব সুন্দর ভাবে রুমটা সাজানো।এইসব কিছুই আনোয়ার সাহেব আগে থেকেই লোক দিয়ে করিয়েছেন তা বেশ বুঝতে পারছে অনু।খাটের উপর গুটিশুটি মেরে বসে আরাফের রুমটা খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করছে সে।বেশ বড় আরাফের রুমটা।রুমের প্রায় জিনিসই সাদা রঙের।আরাফের কি তবে সাদা রংটা প্রিয়?ভাবতে থাকে অনু।আরাফের বেডের উপরে দেয়াল জুড়ে আরাফের বিশাল একটা ছবি লাগানো।অনু খুব মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখছে।ছবিতে ব্ল্যাক কালারের একটা শার্ট পড়া আরাফ;চোখে ব্ল্যাক কালারের সানগ্লাস।তার সাথে তো রয়েছে তার এক গাল মিষ্টি হাসি।এই হাসিতেই অনু পুরো পাগল।ইশ!ছেলেটা এত কিউট কেন?মাঝে মাঝে আরাফকে ভীষণ হিংসে হয় অনুর।তার ধারণা আরাফের সৌন্দর্যের কাছে তার নিজের সৌন্দর্যটা কিছুই না।অনুর ভাবনার মাঝেই দরজা ঠেলে আরাফ রুমের ভেতরে আসে।আরাফকে দেখে অনু উঠে আরাফকে সালাম করতে যায়;আরাফ অনুর বাহু ধরে বলে,
”মুখে সালাম দাও।”

অনু মুচকি হেসে বলে,
”আসসালামু আলাইকুম”

”ওয়ালাইকুম আসসালাম;যাও এবার ফ্রেশ হয়ে ওযু করে এসো।আমরা নামাজ পড়বো।”

আরাফের কথা মতো অনু তার ট্রলি খুলে একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে যায়।আর আরাফ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে তার রুমটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।তার রুমের সাজগোজ দেখে আরাফও বুঝতে পারে সব কিছু তার বাবা আনোয়ার মোহাম্মদ করেছে।সব কিছু দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরাফ তার বিছানার এক কোণে বসে পরে;
.
বেশ কিছুক্ষন বাদে ওয়াশরুম থেকে অনু বেরিয়ে আসে।ভারী লেহেঙ্গা আর গয়নার ভারে এতক্ষন বেচারি নুয়ে পড়ছিলো।এখন ফ্রেশ হয়ে এসে অনুর শরীরটা অনেক হালকা লাগছে।যদিও ভালোভাবে শাড়ি পড়তে পারে না তবুও কোনোরকম চলে আরকি।হাতের গয়নাগুলো আলমারির ভেতর রেখে অনু তার হাতের ভারী লেহেঙ্গাটা ডিভাইনের উপর ছড়িয়ে রাখে।অনু লেহেঙ্গা রেখে আরাফের দিকে তাকাতেই দেখে আরাফ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।অনু চোখ নামিয়ে হালকা কাশি দিয়ে বলে,
”স্যার আপনিও এবার ফ্রেশ হয়ে নিন।”

অনুর কথা শুনে ব্রু কুঁচকে আসে আরাফের;আরাফ বিরক্ত নিয়ে বলে,
”কে স্যার?”

অনু আমতা আমতা করে বলে,
”ক-কেনো আপনি!”

”বিয়ের পরও আমি তোমার স্যার?শুনো স্যার শুধু ভার্সিটিতেই।বাসায় তোমার হাসবেন্ট;সো বাসায় যদি তুমি আমাকে আর একবার স্যার ডেকেছো তো আমি তোমার মুখে স্কস্টেপ লাগিয়ে বসিয়ে রাখবো।এখন থেকে আমাকে আরাফ বলে ডাকবে।অনলি আরাফ,বুঝেছো?”

অনু মাথা নিচু করে মৃদু কণ্ঠে বলে,
”আচ্ছা।”

”হুম তো এবার বলো ফ্রেশ হয়ে আসার কথা।”

অনু আমতা আমতা করে বলে,
”আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন স্যা না মানে আ-আরাফ!”

আরাফ হেসে বলে,
”দেটস লাইক এ্যা গুড গার্ল।”

প্রতিউত্তরে অনু শুধু মুচকি হাসে।আরাফ ওয়াশ রুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
.
আরাফ ফ্রেশ হয়ে আসার পর অনু আর আরাফ মিলে দুরাকাত নফল নামাজ পড়ে।নামাজ শেষে অনু তার জায়নামাজটা ভাঁজ করে রাখে।তখনি বেলকনি থেকে আরাফ অনুকে ডাকে।অনুও বেলকনিতে আরাফের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়;অনুর উপস্থিতি টের পেয়ে আরাফ উৎফুল্ল মনে বলে উঠে;
”অনু আমি আজ তোমাকে কিছু বলতে চাই।”

অনু কৌতুহলী দৃষ্টিতে আরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
”জ্বি বলুন।”

আরাফ কোমল দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকায়।আরাফের চোখে মুখে আজ অন্যরকম স্নিগ্ধতা দেখতে পাচ্ছে অনু।আরাফের ঐ হালকা বাদামী চোখগুলোতে যেন আজ অনুর জন্য উপচে পড়া ভালোবাসা প্রকাশ পাচ্ছে।আরাফ তার ডান হাতটা আলতো করে অনুর গালে ছুইয়ে বলে,
”জানো অনু তোমাকে আমি আরো ৫ বছর আগে থেকে ভালোবেসে আসছি।”

আরাফের কথা শুনে অনু বড় বড় চোখ করে বলে,
”মানে?”

আরাফ আলতো করে হেসে তার গভীর দৃষ্টি আকাশের দিকে নিক্ষেপ করে বলে,
”হুম।তখন মেবি তুমি নাইনে কি টেনে পড়ো।আর আমি ভার্সিটির ৪র্থ বর্ষে ছিলাম।সেই সময়টা আমি হোস্টেলে থেকেই পড়াশুনা করতাম।তো রোজকার মতো ভার্সিটি শেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বিকেলের দিকে বাইক নিয়ে হোস্টেলের দিকে যাচ্ছিলাম।যাওয়ার পথেই হঠাৎ রাস্তার একপাশের ছোট্ট উদ্যানটার দিকে চোখ পড়ে;আর ভাগ্যক্রমে আমার নজর সেখানেই আটকে যায়।চলন্ত বাইকে একটা হার্ড ব্রেক কষে আমি সেখানেই আমার বাইকটা দাঁড় করায়।আমার চোখের সামনে তখন কোনো এক মায়াবিনী ছিল।লাল টপ্স পরনে একটা কিশোরী তার খোলা চুলগুলো নিয়ে পুরো উদ্যান ছুটে বেড়াচ্ছে।আর তার পেছনে কিছু বাচ্চাও ছুটছিল।সেদিনের সেই পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম সূর্যের আলোটা যখন সেই মায়াবিনীর ফর্সা মুখটাতে পড়ছিলো তখন তার সেই ফর্সা মুখটা সেই রক্তিম আলোতে জ্বলজ্বল করছিলো।আর দূর থেকে তাকে দেখে আমার সমস্ত অনুভূতি কেমন যেন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলো।যেন আমি আমার মধ্যেই নেয় হারিয়ে গেছি কোনো অজানা রাজ্যে।যে ছেলেকে তার ভার্সিটির এতো মেয়ে প্রপোস করার পরও কারো প্রপোস একসেপ্ট করেনি সে কিনা এমন একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখে থমকে গিয়েছে।ভাবা যায় বলো ব্যাপারটা?কিন্তু কি করার বলো ঐ বাচ্চা মেয়েটার তো অনেক ক্ষমতা ছিল।সে তার মায়া দিয়ে আমাকে সম্পূর্ণ জড়িয়ে ফেলেছিলো।তার খিলখিল করে হেসে উঠা।ছোট বাচ্চাসের সাথে আনন্দে মেতে উঠা;হাসি খুশিতে সবসময় নিজেকে মাতিয়ে রাখা এই সব কিছুই যে আমার মনে ওর প্রতি এক অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দিচ্ছিলো।প্রতিদিন ভার্সিটি শেষে হোস্টেলে ফেরার পথে ওই উদ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটা আমার অভ্যাস হয়ে পড়েছিল।সেই মেয়েটাও প্রতিদিন বিকেলে এসে ওই বাচ্চা গুলোর সাথে খেলেতো।আর আমিও প্রতিদিন ঐভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে দেখে যেতাম।জানো ওকে দেখার সময় আমি এতটাই ওর মাঝে বিভোর হয়ে যেতাম যে আমি ওর নাম পরিচয় জানতে চাওয়াটাও নিদারুন ভুলে গিয়েছিলাম।কিন্তু একদিন যখন ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে সেজায়গায়টাই গিয়ে দাঁড়ালাম তখন দেখলাম ওই মেয়েটা সেখানে নেয়।আর সেখানে এই বাচ্চা গুলো ও ছিল না।সন্ধ্যা অবধি অপেক্ষা করেছিলাম তার জন্য কিন্তু সে আসেনি।এক বুক হতাশা নিয়ে হোস্টেলে ফিরে গিয়েছিলাম।ওকে রোজ দেখাটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল তাই একদিন ওকে না দেখতে পেয়ে সারাটা রাত আমি অস্থিরতায় কাটিয়েছি।বার বার মনে হচ্ছিলো কি হলো মেয়েটার?কেন আজ সে আসেনি।তারপর দিনও আগের মতোই তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।কিন্তু আজও সে আসেনি তবে সেই বাচ্চা গুলো এসেছিলো।বাচ্চাগুলো ঘাসের উপর মন খারাপ করে বসেছিল;আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে তাদের সামনে বসি।গভীর ভাবে তাদের দেখছিলাম।দেখেই মনে হচ্ছিলো দরিদ্র ঘরের সন্তান তারা;তবে এত দিন তাদের মুখে যে হাস্যজ্জল ভাবটা ছিল আজ আর সেটা নেয়।মলিন মুখে সবাই মাথা নিচু করে বসে আছে।আমি ধীর কণ্ঠে তাদের মন খারাপের কারণ জানতে চাই;তখন তাদের মধ্যে থেকে একজন বিষন্ন সুরে বলে উঠে,
”আমাদের আপুমনি চলে গেছে তাই আমাদের সবার মন খারাপ”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি,
”কোন আপুমনি”

তখন সেই ছেলেটা আবারো কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
”প্রতিদিন বিকালে একটা আপুমনি এসে আমাদের সাথে খেলতো।আমাদেরকে অনেক আদর করতো।অনেক চকলেট কিনে দিতো।আমরা ময়লা কাপড় চোপড় পড়ি বলে সবাই আমাদের ঘেন্না করে দূর করে দিলেও ওই আপুমনিটা আমাদের অনেক ভালোবাসে।আর আমরাও আপুমনিকে অনেক ভালোবাসি।কিন্তু ওই আপুমনিটা কাল আমাদের ছেড়ে এই জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে।তাই ওই আপনামনির কথা আমাদের অনেক মনে পড়ছে।”

এইটুকু বলে ছেলেটা একটা হেঁচকি তুলে।বুঝতে পারছি তার কান্না পাচ্ছে।তাই আমি ওদের জন্য কিছু চকলেট কিনে দিয়ে ওদের জিজ্ঞেস করলাম,
”তোমরা কি জানো তোমাদের আপুমনি এখন কোথায় গিয়েছে?”
.
ওরা কেউই জানতো না।তাই হতাশ হয়ে তার নাম পরিচয় জানতে চেয়েছিলাম।কিন্তু তাও ওরা কেউ জানে না।জানো তো সেই মুহূর্তে নিজেকে বড্ডো অসহায় লাগছিলো।এত দিন ধরে মেয়েটাকে দেখে যাচ্ছি অথচ তার নাম পরিচয় কিছুই জানতে পারিনি।ভীষণ রাগ হচ্ছিলো তখন নিজের উপর।সেদিনের পর আমার কিছু বন্ধুদের নিয়ে অনেক খুঁজেছিলাম সেই মেয়েটাকে।কিন্তু আফসোস!পাইনি।আমার হতাশা আর কষ্ট আমাকে বলে দিয়েছিলো আমি ওই মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছি।তার মধ্যেই আমি ৪র্থ বর্ষ শেষ করে দেশের বাইরে চলে যাই।সেখান থেকেই পড়াশুনা কমপ্লিট করে দেশে ফেরার পর বাবা আমাকে তার ভার্সিটিতে জয়েন করতে বলে।আমিও তখন ছোট্ট একটা বিজনেস শুরু করি সাথে এই ভার্সিটিতে জয়েন করি।আর ফাইনালি সেইদিনটা আসে; আমার ভার্সিটির প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকার কিছুক্ষন বাদেই কেউ একজন পেছন থেকে বলে ‘আসবো স্যার!’সেদিন পেছন ঘুরে তাকে দেখে আবারো আমি থমকে যায়।যেমনটা গিয়েছিলাম সেই ৫ বছর আগে।আমার সামনে আমার সেই মায়াবিনী কিশোরীটি দাঁড়িয়ে আছে।তবে আজ আর সে কিশোরী নই;তার চোখে মুখে উপচে পড়ছে তারুণ্যের গাম্ভীর্যতা।আমার ধারণাই ছিল না যে আল্লাহ কোনোদিন এইভাবে তার সাথে আবার আমার দেখা করিয়ে দিবে।বিশ্বাস করো সেদিন খুব ইচ্ছে করছিলো তাকে ঝাপ্টে আমার বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরি।কিন্তু এতো সব ছাত্র ছাত্রীর মাঝে নিজের সেই অধম ইচ্ছেটাকে বুকের মাঝেই নিবদ্ধ রাখি।জানো সেই মেয়েটা কে ছিল?”

কিছুটা থেমে আরাফ আবারো বলে উঠে,

”সেই মেয়েটা তুমি ছিলে অনু।যাকে আমি প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছিলাম।যাকে ৫ বছর ধরে আমি ভালোবেসে আসছি।সেই মেয়েটাই তুমি।”
.
অনু গোলগোল চোখে আরাফের দিকে তাকিয়ে আছে।এত কিছু হয়ে গিয়েছে আর অনু কিছুই বুঝতে পারেনি।আরাফ তাকে ৫ বছর আগ থেকে ভালোবেসে আসছে এটা যেন অনুর বিশ্বাসই হচ্ছেনা।অনু এবার কিছু একটা ভেবে অভিমানী সুরে বলে,
”আপনি যদি আমায় এতোই ভালোবাসেন তাহলে সব সময় আপনি আমার সাথে অমন রুড বিহেইভ কেন করতেন?আর আমি যখন আপনাকে প্রপোস করি তখন কেন আপনি আমাকে কান ধরে দাঁড় করিয়েছিলেন?”

অনুর প্রশ্নে আরাফ এলাকা হেসে জবাব দেয়,
”তোমার সাথে রুড বিহেইভ করতাম কারণ তোমার উপর আমি বিরক্ত ছিলাম।তোমার রিহানের সাথে কথা বলাটা আমি পছন্দ করতাম না তাই তোমার আর রিহানের উপর রাগ হতো।আর বাকি রইলো তোমার কান ধরার কথা;তুমি যে আমাকে ডেয়ারের জন্য প্রপোস করেছো সেটা আমি তোমার কথার ধরণেই বুঝেছি।যেখানে আমি তোমার জন্য পাগল সেখানে তুমি মজা করে আমাকে প্রপোস করছো; তাই রাগ হলো।তাই একটু পানিশমেন্ট দিলাম আরকি।বেশি কিছু তো আর করিনি শুধু তো একটু কান ধরে দাঁড়াতে বলেছিলাম।”

অনু মুখ ফুলিয়ে বলে,
”এত গুলো মানুষের সামনে কান ধরে দাঁড়ানোটা বুঝি বেশি কিছু না?”

অনুর প্রশ্নের প্রতিউত্তরে আরাফ কিছুনা বলে অনুর হাত ধরে একটানে তার খুব কাছে নিয়ে আসে।হুট্ করে আরাফ এইভাবে টান দেওয়াই অনু ঘাবড়ে আরাফের টি শার্টের কলারটা শক্ত করে চেপে ধরে।আরাফও শক্ত করে অনুর কোমর জড়িয়ে ধরে।অনুর কানের কাছে মুখ নিয়ে আরাফ মিহি কণ্ঠে বলে উঠে,
”ভালোবাসি অনু।তোমার অনুমতি থাকলে আমাদের ভালোবাসা কি আজ পূর্ণতা পেতে পারে?”
.
আরাফের মিহি কণ্ঠে কিছুটা কেঁপে উঠে অনু।নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে তার।এক ভয়ংকর অনুভূতি ধীরে ধীরে তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে নিচ্ছে।অনুকে চুপ থাকতে দেখে আরাফ আবারো বলে উঠে,
”তবে কি মৌনতাই সম্মতির লক্ষন?”

অনু লজ্জা পেয়ে আরাফের বুকের সাথে একদম মিশে যায়।আরাফ আলতো করে অনুর থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলে।অনু চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে।তা দেখে মুচকি হেসে অনুর ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয় আরাফ।আরাফের ভালোবাসার আবেশে অনু তার টি শার্টটা পেছন থেকে শক্ত ওরে আঁকড়ে ধরে।দুজনেই তাদের ভালোবাসায় তলিয়ে যাচ্ছে।হারিয়ে যাচ্ছে অনুরাফের নিজস্ব পৃথিবীতে….

_________সমাপ্ত_________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here