জীবন সাথী💜 পর্ব-৩৩

0
1755

#জীবন_সাথী💜
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩৩.
~
অনুকে স্টেজের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।আরাফ রিহানের সাথে কথা বলছিলো;হঠাৎই তার অনুর দিকে চোখ পড়তেই স্তব্ধ হয়ে যায় সে।আরাফ ধীরে ধীরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।আরাফের চোখের পলক যেন পড়ছে।অনুকে আরাফের কল্পনার থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে।অনুও একপলক আরাফের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে।কিন্তু এই এক পলকের দৃষ্টিতেই অনুর মনে বড় সড় একটা ঢেউ এলো।আরাফকে আজকে কোনো রাজপুত্রের চেয়ে কম লাগছে।অনুর দিকে তাকিয়ে আরাফ যে মিষ্টি হাসিটা দিয়েছেনা অনুতো তাতেই ফিদা।অনুকে তিহা আর রুমি মিলে আরাফের পাশে দাঁড় করায়।অনু পাশে এসে দাঁড়াতেই আরাফ অনুর কিছুটা কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
”হায় মে মারজাভা।ইশ!এই লাল পরীটাকে আরো এক বছর আগে কেন বিয়ে করলাম না।উফফ একটা বছর অযতা নষ্ট করলাম।”

আরাফের দুষ্ট মাখা কথার প্রতিউত্তরে অনু কিছু বলেনি।শুধু লজ্জায় চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো।একে একে সব মেহমানরা আরাফ আর অনুর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললো।অনেক সুন্দর সুন্দর ফটোগ্রাফি হয়েছে।ফটোগ্রাফার যখন আরাফকে আর অনুকে কাছাকাছি এসে বিভিন্ন পোস দিতে বলছিলো অনু বেচারিত তো তখন লজ্জায় একেবারে মিশে যাচ্ছিলো।আর তার সাথে তো আছেই তার বান্দবীদের জ্বালানো।অনু শুধু পারছেনা সব গুলোকে মাথায় তুলে আছাড় দিতে।এইদিকে রিহানও তিহাকে প্রচুর জ্বালাচ্ছে।সে নাকি আজ তিহার সাজ দেখে পাগল হয়ে গিয়েছে তাই তার পিছনই ছাড়ছে না।তিহাও বেশ বিরক্ত হয়ে অনেক বার রিহানের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়েছে কিন্তু তার কোনো হেলদোল নেয়।রিহান তার মতো করে তিহাকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে।যেন তার জন্মই হয়েছে তিহাকে জ্বালানোর জন্য।
.
বিশাল আয়োজনের মধ্যে দিয়ে শেষ হলো বিয়ের সমস্ত নিয়ম।এবার শুধু বিদায়ের পালা।পারভেজ সাহেব মলিন মুখে কাঁপাকাঁপা হাতে অনুর হাতটা আরাফের হাতে তুলে দিয়ে বলে,
”আরাফ তুই আমার ছেলে।সেই ছোট্ট বেলা থেকে তোকে আমি আমার ছেলের মতোই ভালোবেসে এসেছি।আর এখন এই বিয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের সম্পর্কটা আরো পাকাপোক্ত হয়েছে।বাবারে আমার মেয়েটা খুব সহজ সরল।ওকে তুই সবসময় আগলে রাখিস।ও একটু বেশি অভিমানী;ওর সাথে নিজেকে একটু মানিয়ে নিস বাবা।আমি অনুকে যতটা বিশ্বাস করি তোকেও ঠিক ততোটাই বিশ্বাস করি;আর এই বিশ্বাসের জোরেই আমি আমার কলিজাকে সারাজীবনের জন্য তোর হাতে তুলে দিলাম বাবা।আমি জানি তুই আমার এই বিশ্বাসটা কখনো ভাঙবি না।”

কথাটা বলে উনি অনু আর আরাফকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।অনু আর নিজেকে সামলাতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।পারভেজ সাহেব অনুকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
”কাঁদছিস কেন মা?তোর তো খুশি হওয়ার কথা।তুই আরাফের মতো একজনকে তোর জীবন সাথী হিসেবে পেয়েছিস।দেখিস মা আরাফের কাছে তুই অনেক ভালো থাকবি।আর,,,”

পারভেজ সাহেব আর বাকি কথা শেষ করতে পারেনি তার আগেই অনু তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে,
”বাবা আমি তোমাকে ছাড়া কি করে থাকবো।তুমি যখন একটা বছর আমার কাছে ছিলে না তখন আমি জানি আমি কিভাবে ছিলাম।আর এখন তো সারাজীবনের জন্য তোমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি;এখন আমি কিভাবে থাকবো বলো।আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বাবা।”

অনুর কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়।মেয়ের এমন কান্না দেখে পারভেজ সাহেবও নিজেকে আর আটকাতে পারেননি তিনিও অনুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন।এই মেয়েটাই তো তার সব।কি করে থাকবে তাকে ছেড়ে।বাবা মেয়ের কান্নার শব্দে পুরো পরিবেশটা থমথমে হয়ে গিয়েছে।রুমি আর তিহাও এক কোণে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছে।বেশ কিছুক্ষন পর অনু তার বাবার কাঁধ থেকে মাথা তুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,
”মা কোথায় বাবা?”

”এই তো মা আমি এখানে”

পেছন থেকে দাঁড়িয়ে এতক্ষন বাবা আর মেয়ের কান্না কাটি দেখে রাহেলা বেগমও চোখের পানি ফেলছিলেন।অনু মাকে দেখা মাত্রই তাকে ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরে।রাহেলা বেগমও মেয়েকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেন।দুজনের চোখের জলে যেন সব কিছু আজ ভেসে যাবে।অনুর এই মুহূর্তে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে;সে কি করে তার মা বাবাকে ছেড়ে থাকবে তা তার জানা নেয়।অনুর কান্না যেন থামছেই না।রাহেলা বেগম চেষ্টা করেও নিজের থেকে অনুকে ছাড়াতে পারছে না। এইদিকে লেইট হয়ে যাচ্ছে দেখে পারভেজ সাহেব অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
”মারে আর এইভাবে কাঁদিস না।এইবার যে তোদের বেরিয়ে পড়তে হবে।চল মা।”

অনু মাকে ছেড়ে বাবাকে আবার জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,
”আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না বাবা।আমি তোমাদের সাথেই থাকবো।”

মেয়ের এমন বাচ্চামো কথা শুনে পারভেজ সাহেব হেসে বলেন,
”তাই নাকি মামুনি!তুমি আমাদের সাথে থাকবে।কিন্তু এখন তো তোমার বিয়ে হয়ে গেছে তাই এখন যদি তোমার বরের অনুমতি ছাড়া তোমাকে আমরা আমাদের কাছেই রেখে দেই তাহলে তো তোমার বর আমাদের পুলিশে দিবে তাই না।”

অনু বাবার কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
”বাবা!”

পারভেজ সাহেব মৃদু হাসলেন।তারপর আবেগ মাখা কন্ঠে বলেন,
”মারে সব মেয়েদেরই বিয়ের পর বাবা মাকে ছেড়ে শশুর বাড়িতে যেতে হয়।যেমন তোমার মাকেও তো তোমার নানু নানাকে ছেড়ে আমার সাথে আমার বাড়িতে যেতে হয়েছিল।এটাই প্রকৃতির নিয়ম মা।আমরা বাবার বড্ডো অসহায় এই ক্ষেত্রে।কোনো বাবাই যে তার রাজকন্যাকে সারাজীবন তার কাছে রাখতে পারে না।একবার না একবার তাদের বাবার রাজ্য থেকে স্বামীর রাজ্যে পাঠাতেই হয়।এটাই বাস্তব।কষ্ট হলেও এটাকে তোমার মেনে নিতে হবে মা।”

বাবার কথার প্রতিউত্তরে অনু কিছু বললো না।শুধু চোখের জল ফেললো।
.
আরাফ আর অনু একে একে সকল গুরুজনদের সালাম করে।সালাম শেষেই তিহা রুমি সহ অনুর সব কাজিনরা অনুকে জড়িয়ে ধরে।আবারো ছোট খাটো একটা কান্নার রোল পড়ে যায়।সিক্ত নয়নে সকলে মিলে অনুকে আরাফের গাড়িতে উঠিয়ে দিলো।আরাফ সকলের সাথে প্রাসঙ্গিক কথা বার্তা বলে অনুর পাশে গাড়িতে উঠে বসতেই তাদের গাড়ি চলতে আরাম্ভ করে।আনোয়ার সাহেব সহ আরাফের বাকি আত্মীয়স্বজনরা অন্য গাড়িতে উঠছে।
.
জানলার পাশে মাথা ঠেকিয়ে এখনো কেঁদে যাচ্ছে অনু।আরাফ কোমল দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকালো।অনুর চোখের পানি দেখে আরাফেরও ভীষণ কষ্ট লাগছে।আলতো করে অনুর হাতটা তুলে তার হাতে পিঠে একটা ছোট্ট চুমু দেয় আরাফ।অনু চমকে আরাফের দিকে তাকায়।আরাফ তখন অনুর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,
”আর কেঁদো না প্লিজ অনু।বেশি কাঁদলে মাথা ব্যাথা করবে।তুমি যখন বলবে আমি তখনি তোমাকে তোমার বাবা মার কাছে নিয়ে আসবো।প্লিজ এবার কান্না থামাও।তোমার চোখের পানি আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”
.
কথাটা বলে আরাফ আলতো করে অনুর কপালে চুমু দেয়।অনু নিঃসঙ্কোচে নিজের মাথাটা আরাফের বুকের উপর রাখে।আরাফও এক হাতে অনুকে জড়িয়ে ধরে।দুজনের মনেই এক অজানা শান্তির হাওয়া বয়ে যায়।
গাড়িটা এগিয়ে চলছে নতুন কোনো উদ্দেশে।হয়তো নতুন এক পৃথিবীর সন্ধানে;যেখানে শুধু ‘অনুরাফের’ বিচরণ থাকবে।তাদের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকবে সেই পৃথিবীটা

চলবে,,,
(আল্লাহকে ভয় করো;পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here