জীবন সাথী💜 পর্ব-৪

0
1885

#জীবন_সাথী💜
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৪.
~
চুপচাপ সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে অনু।তিহা আর রুমিও চুপ।অনু মাথার নিচে একটা হাত রেখে এক দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে কেন আরাফ এমন করলো।কি এমন করেছে রিহান যার জন্য ওকে ভয় দেখানোর প্রয়োজন!অনু কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না রিহানের অন্যায়টা কি হতে পারে ।রিহান তো বেশ ভালো ছেলে;সব টিচারদেরও খুব সম্মান করে;সব সময় তো সবার সাথে ভদ্র ভাবে ব্যবহার করে;তাহলে কি হতে পারে অনু মনে মনে ভেবেই যাচ্ছে।

তিহা আর রুমি তখন থেকেই খেয়াল করছে অনু যেন কি নিয়ে ভাবছে।কিন্তু সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারছে না।কফি নিয়ে আসার পর থেকেই সে এমন চুপচাপ কিছু একটা নিয়ে ভেবেই চলছে।কিন্তু কি সেটা?দ্বন্দ্ব কাটিয়ে আমতা আমতা করে তিহা অনুকে জিজ্ঞেস করে ,
”কি হয়েছে অনু?কফি নিয়ে আসার পর থেকেই দেখছি তুই কি যেন ভাবছিস! কি নিয়ে এত ভাবছিস?”

তিহার কথা শুনে অনু মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে।তারপর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তিহাকে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই রুমি চেঁচিয়ে উঠে বলে ,
”অনু দেখ রিহানের ডান হাতের আঙ্গুল গুলো নড়ছে।তারমানে ওর জ্ঞান ফিরেছে।”

রুমির কথায় অনুও রিহানের দিকে তাকায় ।ও দেখে সত্যি রিহান ডান হাতের আঙ্গুল গুলো হালকা করে নাড়াচ্ছে।সেটা দেখে অনুর মুখে হাসি ফুটে উঠে।অনু সোফা থেকে উঠে রিহানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।তারপর তিহাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
”দোস্ত সামনেই দেখ ডাক্তারের কেবিন;রুহান ভাইয়া সেখানেই আছে।তুই একটু উনাকে গিয়ে বলে আয় যে রিহানের জ্ঞান ফিরেছে।”

তিহা মাথা নেড়ে বলে,
”ঠিক আছে যাচ্ছি।”

রিহান ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়।চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে সে এখন কোথায় আছে।ডান দিকে ফিরে অনুকে দেখতেই রিহানের মুখে হাসি ফুটে উঠে;রিহানের হাসি দেখে অনুও মৃদু হাসলো।তারপর রিহানের ডান হাতটার উপর আলতো করে হাত রেখে বললো,
”এখন কেমন আছিস তুই ?”

রিহান হাসার চেষ্টা করে বলে ,
”চিন্তা করিস না মরিনি বেঁচে আছি।”

রিহানের কথায় অনু রেগে ব্রু কুঁচকে বলে ,
”তুই আর মানুষ হবি না; এই সময় ও তোর মুখ দিয়ে ত্যারা ত্যারা কথা বের হবেই তাই না।”

অনুর কথায় রিহান হালকা হাসে।ততক্ষনে রুহান আর ডাক্তারও রিহানের কেবিনে চলে আসে।রিহানকে দেখে রুহান নিচু হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ভেজা কন্ঠে বলে ,
”কেমন আছিস ভাই ?”

রিহান আলতো হাতে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলে ,
”তোর ভাই অলওয়েজ ভালো থাকে।এইরকম ছোট খাটো ব্যাপার তোর ভাইকে এতো সহজে কাবু করতে পারবে না বুঝেছিস?”

রিহানের কথায় মুচকি হেসে মাথা তুলে রুহান।তারপর ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বলে,
”ডাক্তার সাহেব এখন আমার ভাই একদম সুস্থ আছেতো?আর কোনো সম্যসা নেয় তো?”

ডাক্তার রিহানের হাতের পালস চেক করতে করতে বলে ,
”আলহাদুলিলাহ এখন আগের থেকে অনেকটাই বেটার।তবে হ্যাঁ পেশেন্টকে এখনি কোনো কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।উনার মাত্রই জ্ঞান ফিরেছে;এখনি যদি আপনারা উনাকে প্রশ্ন করা শুরু করেন তাহলে উনার ব্রেইনে এর এফেক্ট পড়তে পারে;আর তাতে করে পেশেন্টেরও ক্ষতি হতে পারে।”

রুহান ডাক্তারকে আশ্বস্ত করে বলে ,
”না ডাক্তার চিন্তা করবেন না ।রিহানের প্রব্লেম হবে এমন কোনো কাজই আমরা করবো না।”

ডাক্তার স্টেথোস্কোপটা গলায় রাখতে রাখতে বলে ,
”ঠিক আছে।আপনারা উনার কাছে থাকুন।আর এখনি আমরা উনাকে কোনো মেডিসিন দিচ্ছি না।বিকেলের পর উনার মেডিসিন দেয়া হবে;তার আগে উনাকে একটা সুপ্ খাওয়ানো হবে যেটা আমাদের ক্লিনিক থেকেই দেয়া হয়।সুপ্ খাওয়ানোর পরই উনাকে মেডিসিন দিয়া হবে।আমি আমার কেবিনে আছি;কোনো প্রয়োজন হলে ডাকবেন;আর উনাকে বেশি ডিস্টার্ব করবেন না।”

রুহান রিহানের পাশে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে ,
”ওকে ডক্টর”

ডাক্তার সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে গেলে রুহান রিহানের মাথায় হাত রেখে বলে ,
”জানিস ভাই আমি তোকে এইভাবে দেখে কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।কিছুক্ষনের জন্য মনে হচ্ছিলো আমার পুরো পৃথিবী বুঝি অন্ধকার হয়ে এসেছে;তোর কিছু হলে যে আমিও মরে যেতামরে ভাই ”

ভাইয়ের কথা শুনে রিহান মৃদু হেসে বলে ,
”তোর ভাইয়ে প্রাণ হলো কৈ মাছের প্রাণ;সহজে মরবে না।তাই এত চিন্তা করিস না।তোকে জ্বালানো তো এখনো শেষ হয়নি;তোকে আগে প্রচুর জ্বালিয়ে নেই;তারপর একটা শাকচুন্নি মার্কা বউ খুঁজে তোর বিয়ে দিয়ে তবে গিয়েই আমি শান্তিতে মরতে পারবো এর আগে না।বুঝেছিস ভাইয়া?”

রিহানের কথা রুহানের মোটেও পছন্দ হয়নি।তাই সে রেগে গিয়ে বলে ,
”তুই কিন্তু এখনি আমার হাতে মার খাবি বলে রাখলাম আর একটাও উল্টা পাল্টা কথা বললে।”

রুহানের কথা শেষ হতেই অনু বলে উঠে ,
”জি ভাইয়া ওকে মারারই প্রয়োজন।দেখুন না জ্ঞান ফিরার পর থেকেই এমন উল্টা পাল্টা বকে যাচ্ছে।মাথার স্ক্রু তো আগে থেকে ঢিলা ছিলই এখন মেবি ওই ঢিলা স্ক্রু খুলে গিয়েছে তাই এই আজাইরা প্রলাপ শুরু করেছে।”

অনুর কথায় রিহান ওর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে ,
”কি করবো বল তোকে দেখলেই তো আমার মাথার সব স্ক্রু ঢিলা হয়ে যায়।এতে আমার কি দোষ”

রুহান সামনে না থাকলে বোধ হয় অনু রিহানের এমন কথায় ওর সাথে রাগ দেখাতো কিন্তু রুহানের সামনে অনুর রাগটা লজ্জায় পরিনিত হয়েছে।আর রুহান গলা খাকরি দিয়ে বলে,
”ভাই এখানে তোর বড় ভাইও আছে।তাই একটু সাবধানে কথা বলিস।”

রিহান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
”আরে ভাই এত চাপ নিয়ো না;যা শুনেছ তা ভুলে যাও;ওকে!”

অনু এবার কড়া গলায় বলে,
”এই তুই চুপ করবি ;ডক্টর তোকে রেস্ট নিতে বলেছে।তুই এতো কথা বলছিস কেন?”

রিহান বাঁকা চোখে অনুর দিকে তাকিয়ে বলে ,
”ঠিক আছে তুই বলছিস যখন তখন না হয় চুপই থাকলাম ।”

অনু আর রিহানকে কিছু না বলে রূহানকে বললো ,
”ভাইয়া ভার্সিটিতে একবার জানিয়ে দেয়ার প্রয়োজন যে রিহানের জ্ঞান ফিরেছে।”

অনুর কথা শুনে রুহান বলে ,
”ওহ হ্যাঁ।আমি এক্ষনি প্রিন্সিপাল স্যারকে কল করে বলে দিচ্ছি।”
.
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই অনু তিহা আর রুমি নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।যদিও অনুর আরো কিছুক্ষন থাকার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াই স্যাররা ওদের সেখানে থাকতে না দিয়ে নিজ নিজ বাড়িতে চলে যেতে বলে।আজ আর হসপিটালে পুলিশ যাবে না রিহানের স্টেটমেন্ট নিতে; রুহান না করেছে।ডাক্তার বারণ করেছে বিধায় সে ও চায় না তার ভাইয়ের কোনোপ্রকার অসুবিধা হোক।তাই কাল থেকে রিহানের মামলার তদন্ত শুরু হবে;আর অনুও মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে কাল রিহানের স্টেটমেন্ট নেয়ার সময় অনুও হসপিটালে থাকবে আর ও যা জানে সবটা পুলিশকে বলবে।তারপর বাকিটা কালই বুঝা যাবে।
.
অন্ধকারে আচ্ছন্ন করা পুরো রুমটাতে দরজার ফাক দিয়ে কিছু আলোর রশ্মি প্রবেশ করছে।আর সে রুমে অন্ধকারের মধ্যে ছটফট করছে হাত পা বাধা একটি লোক।থেকে থেকে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে।এতটাই ক্লান্ত আর ক্ষুদার্ত যে মুখ থেকে একটা শব্দও বের হচ্ছে না তার।শুধু চোখের কিনারা বেয়ে পানি পরে যাচ্ছে।কিছুক্ষন বাদেই দরজা ঠেলে সেই অন্ধকার রুমে কেউ একজন প্রবেশ করে।হাতে একটা খাবারের থালা নিয়ে লোকটির সামনে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে;তারপর লোকটিকে টেনে তুলে বসিয়ে বলে ,
”এখনো তুই সত্যিটা বললি না।এত আঘাত করার পরও তুই মুখ খুলছিস না কেন বলতো?জানের মায়া নেয় নাকি তোর?”

লোকটি অস্পষ্ট স্বরে বলে,
”আমি কিছু জানি না।আমি কিছু করেনি !”

সামনের লোকটি খাবারের প্লেটটা ওই লোকটার সামনে রেখে তার হাত পার বাঁধন খুলে দেয়।তারপর কিছুটা ঝুঁকে পরে বলে,
”খেয়েনে;আর মনে মনে ঠিক করেনে কাল আবার কি মিথ্যে কথা বলবি কারণ স্যার কাল আসছে সাথে তোর জন্য নতুন শাস্তির ব্যাবস্থাও করছে।যদি প্রাণে বাঁচতে চাস তো কাল স্যারকে সব সত্যিটা বলে দিস।”

এই লোকটার কথা তার কানে গেলো কিনা কে জানে ।সে তো তার সামনে রাখা খাবারটা খেতে ব্যাস্ত;ক্ষুদায় তার মাথায় আর অন্য কিছু ঢুকছে না সে বড় বড় ভাতের লোকমা মুখে পুরে যাচ্ছে।সামনে থাকা লোকটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তার খাওয়া দেখে দরজা লক করে সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে কাকে যেন কল দেয় ;ওপাশ থেকে কেউ কল রিসিভ করতে সে বলে উঠে,
”স্যার আজও কিছু বলেনি।”

ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠে,
”সমস্যা নেয় আমি কাল আসছি।একে এখন নতুন শাস্তি দিতে হবে যাতে ও বাধ্য হয় আমাকে সবটা সত্যি বলতে।”

লোকটি বলে ,
”ঠিক আছে স্যার।আমরা তাহলে আর কিছু করবো না আপনি এসেই যা করার করবেন।”

ওপাশের মানুষটি বলে ,
”হুম ঠিক আছে।”

বলেই কলটা কেটে দেয়।
.
রাতের নিস্তব্ধতা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে পুরো পরিবেশকে।বিশাল অন্ধকারের মাঝেও চাঁদের মৃদু আলো অমায়িক করে তুলছে এই নিস্তব্ধ পরিবেশকে;মাঝে মাঝে মৃদু বাতাস জানান দিয়ে যাচ্ছে আমরাও আছি কিন্তু এই বিলাসিতার অংশ হিসেবে।রাস্তার দু ধারে সোডিয়ামের আলো গুলোকে মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত লাগে অনুর।কেন একগুলোকে জ্বালিয়ে রাখা হয়!আজ যদি এই সোডিয়ামের আলো গুলো না থাকতো তাহলে নিশ্চয় এই প্রকৃতির মতো রাস্তাটা ও জোৎস্না স্নান করতো।পরিবেশ তখন আরো বেশি স্নিগ্ধ হয়ে উঠতো।বারান্দার দেয়ালটার সাথে হেলান দিয়ে এইসব কিছুই ভাবছে অনু।সারাদিন যেমন তেমন ভাবে কেটে গেলেও রাত হলেই এক বিশাল মনখারাপ গ্রাস করে তাকে।এই সময়টা বার বার তাকে তার বাবার কথা মনে করিয়ে দেয়;কোথায় আছেন তিনি?কোন অবস্থায় বা আছেন সেটাও জানা নেয় অনুর!প্রতিরাতেই বারান্দায় এইভাবে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে তার বাবা কোথায় ?কেন হারিয়ে গেলো তাদের কাছ থেকে ?আজ ১ বছর হয়ে গিয়েছে তবুও কেন সে তার বাবার কোনো খোঁজ পাচ্ছেনা?প্রশ্ন করতে করতে একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে কেঁদে ফেলে সে!বাবাকে যে ভীষণ মিস করে অনু, প্রতিরাতের চোখের পানিটায় তার প্রমান।কখনো কি খুঁজে পাবে না সে তার বাবাকে?কথাটা ভাবতেই এক অজানা ভয় তার পুরো শরীরে ভর করে।
.
ও দিকে কেউ একজন অন্ধকারের মাঝে আধমরা হয়ে পড়ে থেকে মাঝে মাঝে শব্দ করে ডেকে উঠে”অনু;তোর বাবাও যে তার প্রিন্সেসকে ভীষণ মিস করছে।”

চলবে..
(আল্লাহকে ভয় করো.পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়)

{তোমরা যারা বড় বড় বলো তাদের জন্য আগের তুলনায় আজকের পর্বটা বড় করেই দিয়েছি;তারপরও যদি তোমরা গঠনমূলক কমেন্ট না করো তাহলে আমি আর বড় করে লিখবো না!হু😥আর যদি করো তাহলে পরের পর্ব গুলো আর বড় করে দেয়ার চেষ্টা করবো।☺}

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here