জোনাকিরা ভীড় করেছে পর্ব ২০

0
1315

#জোনাকিরা ভীড় করেছে
#পর্ব-২০
#সিফাতী সাদিকা সিতু

৪৩.
পবিত্র ভালোবাসা এবং সম্পর্কের জোর যে সত্যি কতটা দৃঢ় তা প্রমান হয়েছে মেঘলার ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ায়।কয়েকটা মাস আদিবের অক্লান্ত পরিশ্রম, সাহস, শাসনে মেঘলা নিজের স্বপ্ন পূরণের ধাপে এগিয়ে গেছে। সবকিছু এত সহজ হতো না যদি না আদিব আজ মেঘলার পাশে ছায়ার মতো না থাকতো।মেঘলা দেখেছে তার নিজের যতটা না ইচ্ছে,আশা ছিলো তার থেকেও আদিবের বেশি তাকে নিয়ে।আদিব আবারও তাকে খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলো।তার আত্মসম্মানে আঘাত আদিব কখনো করেনি আর না ভবিষ্যতে করবে। বরং সেই আত্মসম্মানকে দৃঢ় করতেই আদিবের এ সকল প্রচেষ্টা। দুজনের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

মালিহা বেগম কিছুদিন পরপর এসে কয়েকদিন থেকে যান আদিবের জোরের কারণে।না আসতে চাইলেও আদিব বাধ্য করে আসতে।মাহিম তো সবসময় আপার সাথেই থাকে।তবে মেঘলা যখন পড়াশোনা করে তখন আমরিন সাথে নেয় মাহিমকে।

মেঘলার পড়া নিয়ে দিলারা বেগম আনোয়ার সাহেব দুজনেই খুব সিরিয়াস।মেঘলাকে রান্নাঘরে দেখলেই আনোয়ার সাহেব বকা দেন।সবার চেষ্টায়,ইচ্ছেয় মেঘলা তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপে অতিক্রম করতে পেরেছে।মেঘলা এ পরিবারের প্রতিটি মানুষকে অগাধ সম্মান করে।

তবে এসবকিছুর মাঝে আদিব মেঘলার স্বামী স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।মেঘলা ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ায় সব থেকে বেশি খুশি হয়েছে আদিব। তাই সে মনে মনে প্লান করেছে আজ তাদের সম্পর্কের নতুন দিক উন্মোচন হবে।মালিহা বেগম মেয়ের এত আনন্দের সংবাদে খুব খুশি হয়েছেন।তিনি এখন মোটামুটি সুস্থ থাকায় আদিবের পরিবারকে দাওয়াত করেছেন। নিজে রান্নাবান্না করতে না পারলেও মারুফের বউ আর প্রতিবেশী এক মহিলার সাহায্যে সব যোগার করেছেন।এইটুকুই সাম্যর্থ আছে তার।মেঘলা সবাইকে নিয়ে এসেছে মায়ের বাড়িতে।আদিব বলেছে তার কাজ আছে।সে সন্ধ্যার পর যাবে।মেঘলা তাই শ্বশুর শ্বাশুড়ি ননদ পাখি সবাইকে নিয়ে এসেছে।আনোয়ারাকে ডাকা হয়েছে।তিনি আনাফের সাথে আসবেন বলেছেন।

৪৪.
ঠিক দুমাস পর আমরিন আনাফের দেখা হলো।আনাফ কয়েকবার আমরিনের দিকে তাকালেও আমরিন একবারের জন্যও আনাফের দিকে তাকাচ্ছে না। বরং আমরিনের প্রচন্ড অসস্তি হচ্ছে সাথে গাঢ় অভিমান।সেদিনের আনাফের দেয়া চড়ের কথা এখনো ভুলেনি সে।হয়ত কখনো ভুলতে পারবেও না।

আনাফ মেঘলাকে বলে বেরিয়ে গেল।তাকে আদিব ডেকেছে।সে আদিবের সাথে সন্ধ্যায় আসবে।

মেঘলা লক্ষ্য করলো আমরিন আনাফ কেউ কারো সাথে কথা বললো।সে বেশ বুঝলো কিছু একটা হয়েছে দুজনের মাঝে।আসলে পড়াশোনার চাপে সে ঠিক মতো সবটা খেয়াল করেনি।ইদানীং আমরিন একটু বেশি শান্ত ভাব দেখাচ্ছে। আগের মতো হাসাহাসি, আদিবের সাথে খেতে বসে ঝগড়া এসব কোনোটাই করে না।মেঘলা ভেবেছিলো কলেজ,কোচিং এসবের চাপে আমরিন এরকম হয়ে গেছে।কিন্তু আজ একটু অন্য রকম লাগলো।সে জানে আমরিন পছন্দ করে আনাফকে।আনাফের আশেপাশে থাকলে আমরিনের মাঝে অন্য রকম একটা আভা দেখতে পায় সে।একদিন আমরিনকে চেপে ধরতেই সবটা বলেছে।আমরিনের চোখ দুটো কেমন ছলছল করছিলো কথা গুলো বলার সময়।মেঘলারও কষ্ট হয়েছিলো। ইশ!একতরফা ভালবাসা সত্যি খুব কষ্টের।
কিন্তু মেঘলার মনে মনে একটা গাঢ়ো বিশ্বাস আনাফ একদিন ঠিক বুঝবে আনরিনকে হয়ত বা তার মতোই মনে মনে গোপনে আমরিনকে ভালোবাসে?কারণ এদের দুই ভাই বোনকে সৃষ্টিকর্তা ভালোবাসার অগাধ ক্ষমতা দিয়েছে।এদের ভালোবাসার এত শক্তি যে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই।কিন্তু আজ দুজনকে দেখে অন্য রকম লাগলো।আচ্ছা, সেকি আদিবের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবে?এখনো আদিব কিছু জানে না।শুধু আদিব কেন কেউই কিছু জানে না।তার আগে আমরিনের কাছ থেকে জানতে হবে আসলে কি হয়েছে।

পুরো ঘর সাজানো শেষ করে আদিবের পিঠে চাপড় দিলো আনাফ।

আজ তাহলে ভাবীকে সারপ্রাইজ দিবি?

হুম,সেই জন্যই তো এতকিছুর আয়োজন করলাম কষ্ট করে।

কষ্ট তো করেছিস নিজের জন্য। এতে তো তোরই লাভটা বেশি।

আদিব আনাফের পেটে একটা হালকা ঘুসি বসিয়ে দিয়ে বললো,

ফালতু কথা বলবি না। আমার কোনো লাভ টাভ নাই।এটা তোর ভাবীকে একটু খুশি করার জন্য।

হুম,আমি ছোট বাচ্চা নই।আমায় বোঝাতে আসিস না।তুমি তো আর কম সেয়ানা নও বাপু!

দাঁড়া তোর মুখটাই আমি আজ ভেঙে দেব।

আদিব আনাফ কে ধরতে গেলে আনাফ দৌড়ে পালালো ঘর থেকে।সে এক ছুটে গিয়ে আমরিনের ঘরে ঢুকলো।আদিব হাসতে হাসতে নিজের ঘরে এসে ভালো ভাবে ঘরটা আর একবার দেখলো।সাজানোটা তার মনের মতোই হয়েছে।অনেক খেটেছে এখন সে গোসল সেড়ে শ্বশুর বাড়ি যাবে বউকে আনতে।না হলে দেখা যাবে বউ তার এসব সমস্ত কষ্টকে ব্যর্থ করে দিয়ে মায়ের সাথে থাকার বায়না ধরবে।

আমরিনের ঘরে ঢোকার পর আনাফ থমকে দাঁড়িয়েছে।বিছানার পাশের দেয়ালে আমরিনের হাস্যরত স্নিগ্ধ মিষ্টি একটা ছবি আছে।আনাফ সে দিকেই তাকিয়ে আছে।ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার বুকের ভেতর কষ্ট গুলো খুব বেশি ভীড় করছে।দুমাস আগে ভুলটা তারই বেশি ছিলো বোধহয়।

আমরিনের কলেজের পাশে জেরিনের কাজিনের বাসা।আনাফকে ঠেলে ঠুলে নিয়ে গিয়েছিলো জেরিন। আনাফ জানে এবং বুঝে জেরিন আসলে তাকে পছন্দ করে। শুধু পছন্দ নয় হয়ত ভালোও বাসে।আনাফকে অবশ্য কিছু সরাসরি বলেনি জেরিন।যদি বলত তবেই সে জেরিনকে সেভাবে বুঝিয়ে বলতে পারতো আনাফের হৃদয়ে কোথাও জেরিনের জন্য ভালোবাসা নামক অনুভূতি নেই।অনুভূতি গুলো তো সব অন্য একজনের জন্য সীল করে রাখা।হ্যাঁ সে জেরিনকে বন্ধুর চোখে দেখে।কখনোই সে এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট করতে পারবে না।একবার আনাফ বন্ধু বান্ধব সাথে নিয়ে বান্দরবান ঘুরতে গিয়েছিলো।সেখানে তার ছোট খাটো একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিলো।জেরিন তাকে রক্ত দিয়েছিলো! আনাফ সেই থেকেই জেরিনের প্রতি মানবিকতা বোধ থেকে ঋণী হয়ে আছে।আনোয়ারা বেগম এসব কিছু জানে না।সে ফোন করে বলেছিলো ট্যুরের সময় বাড়ানো হয়েছে।ফিরতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে।সে মোটামুটি সুস্থ হয়ে তবেই ঢাকায় ফিরেছিলো।তাই তো জেরিনকে কিছু বলতে পারে না।জেরিনের আচরণে যতই বিরক্ত হোক না কেন সে কখনো জেরিনকে আঘাত দিয়ে কথা বলে না।

ঘটনা ক্রমে সেদিন আমরিনের সাথে ওদের দেখা হওয়ায় জেরিন আমরিনকে ওর কাজিনের বাসায় ডেকেছিলো।আমরিন সেখানে গিয়ে সিনক্রিয়েট করেছে।জেরিনের সাথে আমরিনের কি হয়েছিলো আসলে সে কিছুই জানে না।শুধু জেরিন কাঁদতে কাঁদতে এসে বলেছিলো তাকে,

আমরিন জেরিনের চুল টেনেছে এবং জেরিনকে অনেক গালি দিয়েছে।আনাফ লজ্জায় পরে গিয়েছিলো। পরে আমরিনকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করায় আমরিন জোর গলায় বলেছিলো,

যা করেছি বেশ করেছি।

আনাফ রাগ সামলাতে না পেরে চড় মেরে বসেছিলো আমরিনকে।সেই থেকে সবকিছু অন্য রকম হয়ে গেছে।আমরিন আর তার মাঝে দেখা হলেও কথা হয়না।আমরিন তাকে এড়িয়ে চলে।এ দুটো মাস যে কি নিদারুণ কষ্টে সে ছিলো বলে বোঝাতে পারবে না।মাঝে মাঝে নিজেকে খুব খারাপ মনে হয়।সে কি করে পেরেছিলো আমরিনকে আঘাত করতে?যাকে সেই ছোট্ট থেকে হৃদয়ে ধারণ করে এসেছে সেই নিষ্পাপ মিষ্টি পুতুলটাকে নিজের অজান্তেই আঘাত করেছে সে।

আনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে এলো ছবিটার কাছে।সে জানে আমরিন আর তার মাঝে এই দূরত্ব হয়ত কখনো ঘুচবে না।আনাফ চোখবন্ধ করে আমরিনের ছবিতে অধরের স্পর্শ দিলো।সাথে সাথে তার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। বাস্তবে হয়ত এই সুযোগ,সাহস কোনোদিনও হবে না তার।আনাফ ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরতেই আবার থমকে দাঁড়ালো।

আদিব দুচোখ ভর্তি বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে তারই পানে।

৪৫..
সন্ধ্যার পর সবাই চলে এসেছে ও বাড়ি থেকে।মেঘলা মাহিমকে ঘুম পারিয়ে রেখে এসেছে আদিবের কথায়।এই নিয়ে মেঘলার মনটা একটু খারাপ হয়েছে।আদিব তো কখনো মানা করে না মাহিমকে তাদের বাসায় আসতে তাহলে আজ কেন বললো,

মাহিমকে সাথে না নিয়ে ঘুম পারিয়ে রেখে যেতে!

মেঘলা মুখ ভার করা দেখে আদিবের হাসি পাচ্ছে সাথে রাগও হচ্ছে। এই মেয়েটা তাকে কখনো বুঝতে পারেনা।আদিবকে বোঝার চেষ্টা কখনো করে না।সবসময় উল্টো বুঝে বসে থাকে।আজ মেঘলাকে সে ইচ্ছে মতো শাস্তি দেবে।সব রাগ, ভালোবাসা, অভিমান গুলো ঢেলে দেবে দেখবে মেঘলা কি করে সামলায়,হু।

মেঘলা কিছুক্ষণ আনোয়ারা আর দিলারা বেগমের সাথে গল্প করলো।চা বানিয়ে শ্বশুরকে দিলো।এরপর আমরিনের সাথে কথা শেষ করে নিজের ঘরের দিকে এগোলো।ঘরে ঢুকে অন্ধকার দেখে লাইট জ্বালাতে গেল।তার আগেই আদিব কোথা থেকে এসে মেঘলাকে পাঁজা কোলা করে নিয়ে বারান্দায় এলো।ভয়ে মেঘলার কলজে কেঁপে উঠেছিলো।এমন অবস্থা যে চিৎকার করার কথাও ভুলে গেছে।এরকম কেউ করে?আদিবের কান্ড কারখানা সে মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারে না।সে গাল ফুলালো।আদিব আধো আলো ছায়াতে তা দেখে হাসলো।মেঘলাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে সে গিটার টুংটাং সুর তুললো,

“কিছু কথার পিঠে কথা
তুমি ছুঁয়ে দিলেই মুখরতা,
হাসি বিনিময় চোখে চোখে,
মনে মনে রয় ব্যকুলতা।

আমায় ডেকো একা বিকেলে
কখনো কোনো ব্যাথা পেলে,
আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে
যখনই মন কেমন করে।

মেঘলার অভিমান ধীরে ধীরে মুছে গিয়ে একরাশ মুগ্ধতা ফুঁটে উঠলো।আদিবকে সে কখনোই বুঝতে পারেনা।সত্যি সে ভেবেছিলো মাহিমকে নিয়ে হয়ত আদিব বিরক্ত।কিন্তু সে ধারণা যে কতটুকু ভুল তা ভেবে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল।ইশ!সে তো কখনো আদিবকে নিয়ে ভাবে না এমন করে?আদিবের মন বোঝার চেষ্টা করে।শুধু ভালোবেসে গেলেই কি সব হয়।প্রকাশ ভঙ্গি ভিন্ন হলেও ভালোবাসার মানুষ কে খুশি করতে জানতে হয়।মেঘলা মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলো গানটা।তার খুব প্রিয় একটা গান।

তুমি আমার গল্প জোনাকি
তোমারই আশায় আশায় থাকি।

কোনো এক রূপকথার জগতে,
তুমি তো এসেছো আমারই হতে।
তুমি চির সাথী আমার জীবনের এই পথে।

আদিব গাইতে গাইতে আবার কোলে তুলে নিলো মেঘলাকে।ঘরে এসে লাইট জ্বালিয়ে দিলো।মেঘলা আর-একবার নতুন করে অবাক হলো সাথে ভালো লাগার এক বিশেষ রাজ্যে পৌঁছে গেল।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here