#জ্বীনকন্যা
#পর্বঃ০২ এবং শেষ পর্ব
#লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
জ্বীনসর্দার আবার একটু থেমে বললেন, “আজ থেকে তোমার লড়াই শুরু। প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাও দক্ষিণের জঙলের দিকে। বিপদসঙ্কুল স্থান, সাবধান থাকব।
আমি তোমায় অন্য কোনো সাহায্য করতে না পারলেও পরামর্শ আর কিছুটা সহযোগিতা দিতে পারব। দরকার হলেই আমাকে স্মরণ করো, তবে আমি কিন্তু তোমায় দুইবারের বেশি সাহায্য করতে পারবনা।আল্লাহ তোমার সহায় হোক, ফি-আমানিল্লাহ।” বলেই দমকা হাওয়া আবার জানালা দিয়ে শব্দ করর বেরিয়ে গেল।হুজুর আমার দিকে ফিরে বললেন, “বুঝেছো তো?”
আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম।সারারাত আর ঘুম এলোনা।শুধু ছটফট করছি, কখন আমার মাম্মাকে দেখতে পাব! আমার প্রতিশোধ পূর্ণ করতে পারব।
সকাল হতেই আমি বেরিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু হুজুরদাদু আমাকে বাধা দিলেন এবং বললেন, “তাড়াহুড়োয় কাজ কখনোই ভালো ফল দেয়না। তোমার এখনো কিছু প্রস্তুতি নেওয়া বাকি।” হুজুরদাদু একটা ব্যাগ আমার হাতে দিয়ে বললেন, “এটা তোমার কাজে আসবে। সাথে রেখো এটা। তোমাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছেনা। কেননা, তুমি এমন এক বিপদজনক স্থানে যাচ্ছো, যেখানে তোমাকে একা যেতে দেওয়ার সাহস আমার নেই। তবুও যে তোমাকে যেতেই হবে।” হুজুর দোয়াকালাম পড়ে মাথায় ফু দিয়ে বললেন,
— আল্লাহ তোমার হেফাজত করবেন। সাবধানে যেও। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।তিনিই তোমায় সঠিক পথ দেখাবেন। ফি-আমানিল্লাহ।আমি উনাকে সালাম করলাম।খানিকটা এগিয়ে দিয়ে হুজুরদাদু বিদায় জানালেন। পিচের রাস্তা ছেড়ে আল্লাহর নাম নিয়ে দক্ষিনের সরুপথে চলতে লাগলাম। সিলেট শহরে এমনিতে জঙল আর পাহাড়ের অভাব নেই। চলতে চলতে পাহাড়ি রাস্তায় এসে পড়লাম। পথে আদিবাসীরা যাতায়াত করছে। বুঝলাম আমি শহর পেরিয়ে এসেছি। দু-একজন আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে, বোধহয় কিছু জিজ্ঞেস করার সুবিধে পাচ্ছেনা।
আমি তোয়াক্কা না করে নিজের পথে হাটতে লাগলাম। আস্তে আস্তে আদিবাসীদের ঘর-বাড়ি, চাষক্ষেত সব পিছনে পড়ে গেল। এমন একটা জায়গায় এসে পৌছালাম যেখানে চারিদিকে গাছপালা, জনমানবশূন্য।
তাহলে এটাই সে জঙল, যেটার কথা জ্বীনদাদু বলেছিলেন। কড়া রোদে হেটে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, তার উপর ভারী ব্যাগের বোঝা। বাচ্চা মানুষ আমি, কতটুকুই হাটতে পারি! মাটিতে ঘাসের উপর বসে পড়লাম।
পেটে মনে হয় নেংটি ইঁদুর দৌড়াচ্ছে, সাথে করে তো খাবার-দাবার কিচ্ছু আনিনি। এখন খাবোটা কি?
মাথা চুলকোতে চুলকোতে ব্যাগের দিকে চোখ পড়ল। ব্যাগে দাদু খাবার দিয়েছে কিনা একটু দেখি। ব্যাগ খুলতেই বড় পলিথিনে কিছু বিস্কিট,চিপস আর পানির বোতল পেলাম। সাথে একটা খিচুড়িভর্তি টিফিন বক্স ও ছিল। দেরী না করে খানিকটা খেয়ে নিলাম।হিসেব করে খাওয়া লাগবে, জানিনা তো আর কতটা গেলে মাম্মাকে পাবো! মাম্মার কথা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ পাশের ঝোপ থেকে মানুষের আর্তনাদের আওয়াজ আসতে লাগল।ভয় পেয়ে গেলাম, এই নির্জন জংগলে মানুষ এলো কোথা থেকে! কিছু ভাবার আগেই ৩-৪ জন বাজে চেহারার লোক আমার সামনে চলে এল। ফিসফিস করে দুই-একটা কথা বলেই একটা লোক আমাকে শক্ত করে ধরে ফেলে। পা ছুড়াছুঁড়ি করতে আমার নাকে রুমাল ধরল।
জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমাকে একটা ছাউনির খুটিতে বেধে রেখেছে, মুখে রুমাল গুজে দিয়েছে। চেষ্টা করলাম হাতের দড়িটা খোলার কিন্তু এত শক্ত দড়ি যে কিছুতেই খুলছেনা। ওপাশের তাবুর ভেতর থেকে কিছু কথা ভেসে আসছে। কোনো এক মোটাকন্ঠ কাউকে অর্ডার করছে, “আজ প্রায় বাচ্চা ছেলেমেয়েদের থেকে ৮টা কিডনী পেয়েছি, কিছুদিনের জন্য এটা যথেষ্ট। তবে বাচ্চা মেয়েটার জ্ঞান ফিরলে তার ও কিডনী নিয়ে নিতে হবে। বেশী দেরী করা ঠিক হবে।” গলা শুকিয়ে গেল এসব শুনে। না এভাবে হার মানলে তো চলবেনা, হে আল্লাহ! তুমি আমায় রক্ষা করো। জ্বীনদাদু তুমি কোথায়? এসোনা একবার।
এমনসময় কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে অজ্ঞানের ভান ধরলাম। কেউ এসে কিচ্ছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার চলে গেল।এখানেই কি আমার জীবনের ইতি হবে? তা কি করে হয়, আমি চলে গেলে আমার মাম্মার কি হবে ? প্রতিশোধ ই বা নিব কি করে? ভাবতে ভাবতে দেখি একটা বড় ইঁদুর আমার তাকিয়ে আছে। ওটা আমার হাতের বাধনের কাছে গিয়ে দাত দিয়ে দড়ি কেটে দিল। আশে-পাশের লোকগুলা আচমকা চিৎকার করে উঠল।পাশে পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন ব্যাগটা নিয়ে পালাতে গিয়ে দেখি ওদের সবার চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে, মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে দেরী না করে দৌড়ে ওখান থেকে বেরিয়ে গভীর জঙলের সরুপথটা ধরলাম।
পচা লোকগুলো ব্যাগটাকে ছিন্নভিন্ন করে রেখেছে, হয়তো ভেবেছে দামী কিছু আছে। বেশ শাস্তি হয়েছে তাদের, মানুষের ক্ষতি করার ঠেলা এখন বুঝো। বিকাল পেরিয়ে এদিকে সন্ধ্যা নামতে চলল। তখন তো কিছু দেখতেও পাবনা, হাটতে পারবোই না। কোথাও আশ্রয় নিতে হবে। কোথায় নেওয়া যায়? ভাবতে ভাবতে দেখি জঙলের ২টো রাস্তা দুদিকে বেকে গেছে। কোনটা দিয়ে গেলে আসল স্থানে পৌছাতে পারব তাও জানিনা। জ্বীনদাদুকে একবার জিজ্ঞেস করব? না থাক আরেকটা সাহায্য কখন দরকার পড়ে কে জানে। বুদ্ধি খাটিয়ে আসল পথ বের করতে হবে।
কিছুই ভেবে পাচ্ছিনা। পরে মাথায় আসল বরাবর দক্ষিণের যাওয়ার কথা আমার। কিন্তু কি করে বুঝবো দক্ষিণ কোনটা? এখানের গাছপালা এত ঘন যে ঠিকমত সূর্য দেখা যাচ্ছেনা।
চোখ পড়ল হাতে থাকা ঘড়ির দিকে। দেখি ঘড়ি দিয়ে বের করতে পারি কিনা? সোজা কাটা অনুসরণ করে সামনের পথে হাটতে থাকল। সূর্য প্রায় ডুবুডুবু অবস্থা। চারিদিকে ঝি ঝি পোকার ডাক শুরু হয়ে গেছে।
আর সামনে এগোনো যাচ্ছেনা। পথিমধ্যে ই ধপাস করে বসে পড়ল। এইখানেই রাতটা পার করা যায়, যদি বাঘ-শেয়ালের সামনে না পড়ি।
খানিকটা সময় কেটে যাওয়ার পর দেখলাম জ্বলজ্বল করে থাকা এক জোড়া চোখ আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
.
নূরজাহান ভীষণ ভয় পেয়ে গেল।ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে উঠে দৌড়তে লাগল অন্ধকার পথে। চোখগুলো ও যেন তার পিছু পিছু ছুটে আসছে। কিসের সাথে হোচট খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। চোখগুলো তার কাছাকাছি চলে এসেছে। পায়ে বড্ড চোট লেগেছে, উঠতে পারছিনা। আল্লাহর নাম জপতে লাগলাম। শেয়ালটা আমার একদম কাছে আসতেই একটা জমকালো আলো বিচ্চুরিত হলো তার শরীর থেকে, আমার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে গেল, “মাম্মা।” তারপর চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে এল।চোখ খুলতেই দেখি আমি একটা কুড়েঘরে শুয়ে আছি চারিদিকে পাখি ডাকছে, সকাল হয়ে গেছে। উঠে বসতেই লক্ষ করলাম আমি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছি । দাদু তো এটাই বলেছিল যে, মাম্মার সাথে দেখা হলেই আমার বয়স ১৮ বছর হয়ে যাব।
একটা বোরকাপড়া সুন্দরী মহিলা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, আমিও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম, “কেমন আছো মাম্মা?”
— তোকে পেয়ে খুব ভালো আছি মা। কখনো ভাবতে পারিনি তোকে আবার আমি ফিরে পাব। এই জঙলে পশু-পাখির রুপ নিয়েই শেষ জীবন কাটাচ্ছিলাম।
— এসব বলোনা মাম্মা। দেখবে আমি পাপাকেও ফিরিয়ে নিয়ে আসব। আবার তোমরা খুব ভালো জীবন কাটাবে।
— উনাকে কখনো ফিরে পাব কিনা জানিনা। তবে তার বড় একটা আমানত আমি নিজের কাছে ফিরে পেয়েছি এতেই আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া। তোকে আর হারাতে দিবনা মা। চল, আমরা নিজের জগতে ফিরে যাই।
— না মাম্মা, ওই বাজে মহিলাটাকে শেষ না করে আমি কোথাও যাবনা। জ্বীনজাতির প্রত্যেকে আমার দিকে চেয়ে আছে, কবে আমি তাকে শেষ করে তাদের জীবনে শান্তি ফিরিয়ে দিব।আমি যে জ্বীনদাদুকে কথা দিয়ে এসেছি , আমি কি করে কথার খেলাপ করব মাম্মা?
— কিন্তু এসবের মধ্যে যদি আমি আবার তোকে হারিয়ে ফেলি? খুব ভয় হয়রে মা।
— ভয় পেয়োনা আমার কিছু হবেনা। আমি সাহসী জ্বীন মুস্তফার মেয়ে নূরজাহান, এত তাড়াতাড়ি হার মানবনা মাম্মা।
— নূরজাহান নয় আজ থেকে তোর নাম মুনতাহা। তোর বাবার এই নামটা রাখার খুব শখ ছিল। মানুষটা তো আর নেই। বলেই মুশায়রা কাদতে লাগল। মাম্মাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই, তাও মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
— ভেবোনা মাম্মা, আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। আমার গায়ে বোরকা আর নিকাব এলো কোথা থেকে? মুশায়রা কান্না মুছে মুচকি হেসে বলল,
— উপযুক্ত মেয়েদের পর্দা করা ফরজ। তোর ব্যাগে এসব ছিল, তাই পরিয়ে দিয়েছি।
— মাম্মা, তুমি আর এইখানে থেকোনা। শহরের দিকে ফিরে যাও, সেখানে এক হুজুরদাদু আছে।তার কাছেই আশ্রয় নাও আপাতত।
— আর তুই?
— আমি কালপাহাড়ে যাব, যেখানে বাজে মহিলাটা ছিল। জানিনা এখনো সেখানে পাব কিনা!
— যাস না। ও বড্ড ভয়ানক, তোকেও মেরে ফেলবে।
— আল্লাহর উপর ভরসা আছে তো তোমার? উনি আমাকে হেফাজত করবে। তুমি চলে যাও মাম্মা। আমাকে শুধু বলে দাও সেখানে যাওয়ার পথটা কোনদিকে?
— কিছুটা পার হলেই এই জঙলের শেষে একটা গ্রাম পড়বে, তার শেষসীমান্তেই সব চেয়ে বড় পাহাড়টাই কালপাহাড়। ওই পাহাড়ের নিচের গুহায় ওই মহিলা নিজের তন্ত্র-মন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমিও তোর সাথে যাব, চল।
— না মাম্মা। তুমি ফিরে যাও, এই যুদ্ধ শুধু আমার একা। আমাকে আল্লাহর ভরসায় ছেড়ে দাও। মাম্মা ব্যাগে কিছু ফল-পানি দিয়ে খানিকটা এগিয়ে দিল। তারপর আমার অনুরোধে অদৃশ্য হয়ে চলে গেল শহরে।আমি মাম্মার কথামত হাটতে থাকলাম।
হাটতে হাটতে জঙলের শেষে চলে এলাম। এইখান থেকে গ্রামটা দেখা যাচ্ছে, জনমানব ও আছে অনেক। একটু জিরিয়ে নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করলাম। এর মধ্যেই নতুন সমস্যার মুখোমুখি হলাম। কিছু মানুষ আমাকে ঘিরে ধরল। তারা আমাকে জঙ্গী ভেবে মারতে তেড়ে আসল। বহু বলার ও শুনলোনা, শুরু করল ইট ছোড়া। তখনি এক ২০ বছর বয়সী যুবক এগিয়ে আসল আমাকে বাচাতে। সে তার হাত বাড়িয়ে দিল আমি উঠার জন্য। আমি শান্তগলায় বললাম,
— বেগানা পুরুষকে স্পর্শ করা হারাম। তারপর আমি নিজেই মাটি থেকে উঠে দাড়ালাম। লোকজন আবার আমার দিকে তেড়ে আসতে চাইল। যুবকটি ওদের থামিয়ে বলল, “উনি জঙ্গী নন, আমার বিবাহিত স্ত্রী।”
শুনে আমি চমকে উঠলাম। এসব কি বলছে ছেলেটা? একজন লোক বলল,
— তুই আবার কবে বিয়ে করলি?
— আমাদের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল অনেকদিন। কিছুদিন আগে ওকে বিয়ে করলাম, ও শহরেই থাকে। আমি ভেবেছি ঘরবাড়ি বড় করে তুললে ওকে নিয়ে আসব। ও তা না মেনে নিজেই চলে এসেছে।
সবার মুখে হাসি দেখা গেল। তাদের একজন বলল, “ভালো কাজ করলি। যা বউমাকে ঘরে নিয়ে যা। কাল তোর বিয়ের দাওয়াত খেতে আসব। রান্নাটা কিন্তু বউমা করবে!”
ছেলেটা লাজুক হয়ে বলল, “হ, চাচা। অবশ্যই।” আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— আসুন আমার সাথে। ভরসা পেলাম না তাও ছেলেটার পিছু পিছু তার বাসায় চলে এলাম। গ্রামের অন্যান্য ঘর থেকে উনার ঘর অনেক সুন্দর, কিছুটা শহুরে স্টাইলের। আমাকে একটা রুমে বসিয়ে বললেন, “আপনি বিশ্রাম করুন, আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করছি।”
— আপনি আমাকে এইখানে কেন আনলেন?
— না আনলে গ্রামবাসীর হাতে মার খেয়ে মরতেন। এভাবে হাতপায়ে মোজা,বোরকা কেউ পরে? চোখটা ও ঠিক মত দেখা যাচ্ছেনা। সবাই তো জঙ্গি ভাববেই।
— আপনি আমাকে এভাবে বকছেন কেন?
— বকছিনা, আপনাকে বুঝানোর চেষ্টা করছি। আপনি বিশ্রাম নিন, কপাল থেকে তো রক্ত ও বের হচ্ছে ইটের বাড়ি খেয়ে।আমি ওষুধ আনছি।
উনি হুড়মুড় করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি বিছানায় ক্লান্ত হয়ে বসলাম। কপালের কাটা জায়গায় জ্বালা করছে,রক্তে নিকাব টা ভেজা ভেজা হয়ে গেছে।
ছেলেটাকে সুবিধার লাগছেনা, একটু বেশিই বিনয়ী। তাও উনার নিকট আমি কৃতজ্ঞ, আজ যেভাবে বাচালেন আমায়। নিকাব খুলতে যাব দেখি উনি রুমে ঢুকলেন। তাড়াতাড়ি আবার পড়ে নিলাম।
— ভয় পাচ্ছেন নাকি?
— ভয় পাবো কেন?
— মনে হল। এই নিন ওষুধ, কাটা জায়গায় লাগিয়ে নিন। পারবেন তো? নাকি আমি সাহায্য করব আপনাকে? ওষুধটা কেড়ে নিয়ে বললাম,
— আমি পারবো।ধন্যবাদ।
— আচ্ছা। আপনার বোরকা আর নিকাব তো রক্তে ভিজে গেছে। এই নিন এসব ছেড়ে শাড়িটা পড়ে নিন। পরে অইগুলো শুকোলে আবার পড়ে নিবেন।
— শাড়ি পরলে সবাই আমার মুখ দেখে যাবে।
— আপনি এই যুগেও এমন কেন? শুনুন একটু সমস্যায় পড়েছেন, উদ্ধার পাওয়ার জন্য আপনাকে একটু অভিনয় করতে হবে। আমার স্ত্রী হওয়ার অভিনয়।
— অসম্ভব। আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।
— আচ্ছা যান, পরে গ্রামবাসীরা আবার পিটুনি দিলে আমি কিন্তু কিছু জানিনা।
— ভয় দেখাচ্ছেন?
— ভয় পাচ্ছেন বুঝি?
— মোটেও না। আমি বেশীদিন অভিনয় করতে পারবনা।
— করা লাগবেনা। শুধু ২-৩দিন করলেই চলবে ওদের বিশ্বাস করার জন্য। তবেই এই গ্রামের সীমানা পার হতে পারবেন নতুবা ওরা আপনাকে গ্রাম থেকে বের হতে দিবেনা। আমাদের গ্রামের মানুষ এমনিতে শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিছুদিন আগে একটা দাঙ্গা হয়েছিল। তারপর থেকে সবাই একটু সর্তক থাকে আর কি! অপরিচিত কাউকে দেখলেই তেড়ে আসে। যাই হোক, আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। দরকার হলে ডাকবেন।
বলেই চলে গেল। বড্ড অদ্ভুত লোক দেখছি! কাটা জায়গায় ওষুধ লাগিয়ে ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পরে নিলাম। আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক লাগছে এই প্রথম নিজের অন্যরুপ দেখছি। ঠিক মায়ের মত মুখটা লাগছে। মাম্মা কি দাদুর কাছে যেতে পারলো, জানতে ও তো পারলামনা।
দরজায় আবার কড়া পড়ল, নিশ্চয়ই ছেলেটা আবার এসেছে। এত্ত ছ্যাচড়া কেন ছেলেটা? বিপদে না পড়লে এর ছায়া ও মাড়াতামনা। বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই দেখি…..
.
আমার সমবয়সী কয়েকটা মেয়ে হুড় করে রুমে ঢুকে গেল। বিছানার উপর বসে পা দোলাতে দোলাতে সবার মধ্যে একজন তার পাশের সামান্য জায়গা দেখিয়ে বলল,
— ভাবী বসুননা। আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, না, আপনারা বসুন। সে আবার বলল,
— ভাবী আপনাকে হলুদ শাড়ীতে খুব সুন্দর লাগছে, আপনি তো দেখতে পরীর মত। এইজন্য ভাইয়া এতদিন আপনার প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে গোপনে বিয়েও করে ফেলল। অন্য একটা মেয়ে মুখ ভেঙ্গচিয়ে বলল,
— সুন্দর তো আমিও কম না, শুধু নাকটা একটু বোচা বলে ভাইয়া পছন্দ করলনা। নতুবা আমার জায়গাটা এই মেয়েটা কখনোই নিতে পারতনা।
আমার হাসি পেলেও চেপে বললাম, বোন দুঃখ করোনা।আমি যদি কখনো চলে যাই তখন আপনি উনাকে বিয়ে করে নিবেন কেমন! মেয়েটা আমার সমবেদনার ভাষাটা হয়তো পছন্দ করলনা, কথার উত্তরে মুখ বাকালো।
মেয়েগুলো কথা শুরু করেছে যে এখনো থামার নাম নেই।চাপার খুব জোর আছে বলতে হয়। মি. ছ্যাঁচড়াটা কোথায়! এত্তক্ষণ তো বেশ রুমের সামনে ঘুরঘুর করছিল, এখন কোথায় এসে মেয়েগুলো সরিয়ে নিয়ে আমাকে একটু শান্তি দিবে সেটাই উনি লাপাত্তা। প্রায় ঘন্টাখানেক আমার কান দুটো ঝালাপালা করার পর তারা বিদায় হলো।যাওয়ার সময় বলে গেল, “ভাবী পরে আবার আসব!” সত্যিই যদি কিচ্ছুক্ষণ পর আবার আসে সেই ভয়ে দরজা লক করে দিলাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, একটু ঘুমিয়ে নিলে ভালো হত। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম চলে এল।
দরজা নক করার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দরজা খুলতে দেখি উনি দরজার সামনে হাতে খাবারভর্তি ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।আমি সরে আসতে উনি রুমে ঢুকে টেবিলে ট্রে রেখে বললেন, “এই সন্ধ্যাবেলায় ঘুমাচ্ছিলেন?”
রুমের জানালা দিয়ে বাহিরে উঁকি দিয়ে দেখি আসলেই সন্ধ্যা নেমে এসেছে। উনার কথায় সায় দিয়ে বললাম, “বুঝতে পারিনি!”
— ফ্রেশ হয়ে খেতে বসুন। ওয়াশরুম টা এইদিকে।
— ধন্যবাদ। ফ্রেশ হয়ে এসে বসলাম। লজ্জা লাগছে খেতে, উনি ছানাবড়া চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি কি এখানে এভাবে দাড়িয়ে থাকবেন?
— কেন বসবো? কপালটা রাগে কুচকালাম। উনি মুখ টিপে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। খুব ক্ষিদে পেয়েছে তাই দেরী না করে খেয়ে নিলাম।
অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও মি. ছ্যাঁচড়া এলেননা। তাই আমি ট্রে টা কিচেনে রেখে আসার জন্য রুম থেকে বের হলাম। শাড়ি পরায় একটুও ঠিকমত হাটতে পারছিনা, মনে হচ্ছে হিজিবিজি করে কাপড় জড়িয়ে রেখেছি। অনেক বড় বাসা,তাতে রুমের সংখ্যা কম নয় বৈকি । কিচেনের হদীস পাচ্ছিনা, উকি দিয়ে রুম চেক করে পরে কিচেন পেলাম। কিচেনে ট্রে টা রেখে রুমে চলে আসব দেখি ছাদের দরজা খোলা। খোলা পরিবেশে বাতাস অনুভব করতে ইচ্ছে হলো একটু। তাই ছাদে উঠলাম। হালকা চাঁদের আলোয় ছাদটা বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে, গিয়ে এক ধারে পাতা বেঞ্চিতে বসলাম। “হাওয়া খাচ্ছেন বুঝি?” শুনে ঘুরে তাকালাম। মি. ছ্যাঁচড়া এখানেও চলে এসেছে, আচ্ছা লোক তো! আমি অবাক হয়ে বললাম,
— আপনি কখন এলেন? আমার পাশের খালি জায়গায় দূরত্ব রেখে বসে বলল,
— ছাদেই ছিলাম, আপনি খেয়াল করেননি।
— ওহহ আচ্ছা।
— আপনার সম্পর্কে তো কিছুই জানা হল না। কে আপনি? থাকেন কোথায়? আর জঙ্গল পেরিয়ে এই গন্ডগ্রামেই বা এলেন কেন? ছেলেটার প্রশ্ন শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম, আমার আসল পরিচয় জানতে পারলে হয়ত এরা আমাকে এইখানে শেষ করে দিবে। জঙ্গী ভেবে যা করল, জ্বীন জানলে তো বন্ধি করে শূলে ছড়াবে। একে আসল পরিচয় বা উদ্দেশ্যের কথা বলা যাবেনা।
— আমি মুনতাহা, মাম্মার সাথে সিলেটের এক অভিজাত শহরে থাকি। শুনেছি এই গ্রামের শেষ সীমানায় অনেক সুন্দর পাহাড় আছে, ঘুরার জন্য পারফেক্ট। তাই ঘুরতে এলাম। ছেলেটা হকচকিয়ে তাকিয়ে বলল, “শুধুমাত্র ঘুরার জন্য এতদূর এলেন? পাহাড়গুলোর সম্পর্কে ধারণা আছে আপনার?”
— আপনারো কি আমাকে জঙ্গী মনে হয়? ধারণা নেওয়ার জন্য ই তো এসেছে। এইবার আপনার পরিচয়টা জেনে নিই।
— আমি হাসনাত, এখানের গ্রামপ্রধানের ছেলে। মা-বাবা অবশ্য ২বছর আগেই গত হয়েছেন। তাই একাই থাকি, ইন্টারন্যাশনাল সফটওয়্যার কোম্পানীতে জব করি। বাবা এই গ্রামের সবার প্রিয়জন ছিলেন।তাই গ্রামবাসীরা খুব ভালোবাসে আমাকে।ইদানীং গ্রামে খুব দাঙ্গা এবং খারাপ শক্তির উৎপাত হয়েছে।তাই গ্রামটার চারিপাশে বন দেওয়া হয়েছে, যাতে গ্রামের মধ্যে কেউ প্রবেশ করলেও কোনো অলৌকিক শক্তি ব্যবহার করতে না পারে। আপনার বেশ দেখে তাদের সন্দেহ হয়েছিল তাই ওরা এমন করেছে।তাদের হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।
— আমি কিছু মনে করিনি, আপনি ক্ষমা চাইবেননা। আমি তো আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।
— ওসব ছাড়ুন। ২দিন এইখানে কাটিয়ে শহরে ফিরে যান। আমি আপনাকে দিয়ে আসব।
— আমি আমার কাজ শেষ না করে যেতে পারব না। আমাকে সেখানে যেতেই হবে
— জায়গাটা নিরাপদ নই বুঝার চেষ্টা করুন।
— আশা করি আপনি আমাকে বাধা দিবেননা। যদি একান্তই দিতে চান, তবে আমি এক্ষুণি এই স্থান ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হব ।
— আচ্ছা দিবনা। একটা কথা ছিল?
— জ্বি বলুন।
— আপনাকে এত আলাদা লাগে কেন? চোখ দুটো এত ঘন নীল ,চুলের রঙটা
অন্যরকম, গায়ের রঙ সবমিলিয়ে আপনাকে আলাদা জগতের মানুষ মনে হয়।
— আল্লাহর সৃষ্টির উপর কারো হাত থাকেনা। উনি আমাকে যেমন বানিয়েছেন আমি ঠিক তেমনি। আর এতবার আমার দিকে তাকাবেননা, কেননা আমি বেগানা নারী।
— আচ্ছা। অনেক রাত হলো। চলুন কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন।
— আমি আর কিছু খাবনা। বলে উঠলাম, হাটতে গিয়ে শাড়িতে পা জড়িয়ে গেল। পড়তে পড়তেও পরলামনা। উনি আমার হাত শক্ত করে ধরে আছেন।তাড়াতাড়ি উঠে বললাম,
— হাতটা ছেড়ে দিন।
— দুঃখিত, আসলে আপনি পড়ে যাচ্ছিলেন ।
— এভাবে বেগানা মেয়েদের স্পর্শ করা যায়না। আর স্পর্শ করবেন না আমায়। বলেই উনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিচে নেমে এলাম। ছেলেটা আসলেই মি. ছ্যাঁচড়া ।
সকালে উঠেই দেখি পুরো বাড়ী গমগম করছে। কালকের মেয়েগুলো, ইট ছোড়া সেই লোকসহ আরো অনেক অপরিচিত মহিলা আশে পাশে ঘুরঘুর করছে। মেয়েগুলা আমাকে দেখে বলল, ভাবী তোমার হাতের রান্না খাওয়ার জন্য গোটা গ্রাম চলে এসেছে। চল রান্নাঘরে চল। কি বলে মেয়েগুলো? আমাকে এত মানুষের রান্না করতে হবে? আমি তো রান্নাই জানিনা।এইবার কি হবে? মি. ছ্যাঁচড়া টা কোথায়? অতি বিনয় দেখানোর নাম করে আমাকে এভাবে বাশ দেওয়া। একবার শুধু হাতের কাছে পাই ব্যাটাকে। কিন্তু এখন এদিক সামলাব কেমন করে?
মেয়েগুলো আমাকে রান্নার জিনিসপত্র বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটু হেল্প করার জন্যও দাড়ালোনা। কি করে রান্না করব কিছুই বুঝতে পারছিনা।
এমনসময় উনি এলেন এবং কিচেনের ডোর লক করে দিলেন। ভয় পেয়ে গেলার উনার আচরণে। উনি আমার কাছে আসতেই আমি জোরে চিৎকার দেওয়ার আগেই উনি মুখ চেপে ধরলেন।
— চেচাচ্ছেন কেন? আমি আপনাকে হেল্প করার জন্য এসেছি। না চেচিয়ে চুপ করে আমার কথামত কাজ করে যান। বুঝচ্ছেন?
— হুম। সব রান্না ,কাটাকুটি উনিই করলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম একটা ছেলে কি করে মেয়েদের কাজে এত পটু হয়?
.
২দিন টা খুব ভালোই কাটলো। মি.ছ্যাঁচড়া অনেক হাসাতে জানে, খুব ভালোই লেগেছে ওর আর গ্রামের মানুষের সাথে কাটানো সময়গুলো। এখন আমাকে আমার পথেই ফিরতে হবে। বোরকা পড়ে,ব্যাগ গুছিয়ে নেওয়া মাত্রই মি. হাসনাত আমার সামনে চলে এলেন। গম্ভীরকন্ঠে বললেন, “চলে যাবেন?”
— জ্বী, ফেরার সময় হয়ে এল। নিজের কাজে এমনিতে অনেকটা বিঘ্ন ঘটেছে।
— আপনাকে আমার কিছু কথা বলার ছিল, যেটা এই মূহুর্তে বলা জরুরীবোধ করছি।
— জ্বী বলুন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,
— জানিনা ব্যাপারটা আপনি কেমনভাবে নিবেন। তবে আমি সরাসরি বলে দিচ্ছি আমাদের এই অভিনয়ের স্বামী-স্ত্রী চরিত্র বাস্তবতায় রুপান্তর করা যায়না? আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
— এসব আপনি কি বলছেন? হুট করে চিনেন না জানেন না একটা মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছেন। বিপদে পড়েছিলাম আপনি আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন তার জন্য আমি আপনার কাছে যথেষ্ট কৃতজ্ঞ।কিন্তু তার মানে এই না যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাব। এমন বাজে আচরণ আপনার থেকে আশা করিনি। ভালো থাকবেন, আসি। ব্যাগটা নিয়ে তাড়াতাড়ি করে উনার বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। গ্রামটা পার হয়ে শেষসীমানায় যেতে আরো আধঘন্টার মত প্রায় লাগবে। বিকালের পড়ন্ত রোদে প্রচুর গরম লাগছে। ১৮বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর তো আমার শক্তি ফিরে আসার কথা। এটার কথা একদমি ভুলে গেছি।সেটা মনে থাকলে এত ঝামেলা পোহাতে হত না। যাই হোক, অদৃশ্য হওয়ার চেষ্টা করলাম পারলামনা।
বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও বিফল হলাম। হঠাৎ হাসনাতের কথা মনে পড়ল এই গ্রামে কোনো অলৌকিক শক্তি দ্বারা কিছু করা যাবেনা।
নিরুপায় হয়ে পথ চলতে লাগলাম। শেষসীমানায় পৌছে গেছি, এখানে মাম্মার বলামতই পাহাড় আছে। সবচেয়ে বড় পাহাড়টাই কালপাহাড়। কালপাহাড়ের নিচেই গুহাটা আছে। দেখে মনে হল না কেউ আছে। পিছন থেকে ডাক এলো নূরজাহান, এটা তো নিষ্পাপ মাম্মার কন্ঠস্বর। পিছনের পথটায় এগিয়ে কাউকে পেলামনা, একিভাবে ডান এবং বামপাশের পথ থেকে ছ্যাঁচড়া এবং মায়ের গলাস্বরে কেউ আমাকে ডাকলো। মনে হচ্ছে আমার চারপাশটা ঘুরছে। গুহার পথটা আমি হারিয়ে ফেলছি। বুঝলাম এভাবে আমাকে আটকাতে চাইছে ওই শয়তানি। আমাকেও তো চিনোনা তুমি। ভেবেছো তোমার এমন ফাদে পা দিয়ে আমি হার মানব। তা তো হবেনা, আল্লাহ বলে মনে মনে আসল গুহার পথ খুজার চেষ্টা করলাম।
ব্যস! চারপাশটা স্থির হয়ে গেল। গুহাটা আগের জায়গায় ই আছে। গুহার ভেতরে ঢুকলাম, কিসের একটা চোখ ধাধানো আলো গুহাটাকে আলোকিত করে রেখেছে।
এক মহিলার উচ্চস্বরে হাসি শুনলাম এবং সে আমায় বলল, স্বাগতম নুরজাহান ওরফে মুনতাহা। সামনে তাকিয়ে দেখি অসম্ভব বাজে দেখতে একটা মহিলা বিরাট সিংহাসনে বসে আমাকে দেখে কুৎসিতভাবে হাসছে।
— এসো। তোমার আসার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। খুব নাম শুনেছি তোমার, অনেক আগে থেকেই। তুমি আসবে আমাকে ধবংস করতে, জ্বীন আর মানুষজাতিকে শান্তি ফিরিয়ে দিতে। শুনতে শুনতে কানে তালা লেগে গিয়েছিল, চেয়েছিলাম তোমার মা আর বাবাকে শেষ করে তোমার নামটাই মুছে দিতে।
কিন্তু না তুমি অত সহজে হার মানলেনা।কায়দা করে ঠিক আমাকে মারার জন্য জন্ম নিলে। চাইলাম গ্রামবাসীদের দিয়ে তোমাকে আঘাতে আঘাতে শেষ করতে তাতেও তুমি পার পেয়ে গেলে। পথ ভুলিয়ে তোমাকে অন্ধকার জগতে পাঠাতে চেয়েছিলাম তাতেও তুমি জিতে গেল।কিন্তু দুঃখের বিষয় কি জানো? ভাগ্য সবসময় সবার সহায় হয়না।যেমন এখন তোমার সহায় থাকবেনা। আজই তোমার খেলা শেষ।
বলে আমাকে দূরে ছুড়ে ফেলল,গুহার বাহিরে। নিচে পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা পেলাম।
আবার উঠে দাঁড়িয়ে আল্লাহর নাম নিলাম। ততক্ষনে সেও গুহার বাহিরে এসে পড়েছে। আমি হেসে বললাম,
— সব সময় খারাপ রা জিতবে সেটা কোথায় লেখা আছে নানুজান। অনেকদিন তো রাজত্ব করলেন, ইচ্ছেমতো নিজের শক্তির অপচয় করলেন। এখন না হয় মরার আগে কালেমাটা পড়ে নিন। কেননা, এটাই আপনার শেষমুহুর্ত।
— আমাকে ভয় দেখাস? এত সাহস তোর! দেখ তোর কি হাল করি। বলেই অনেকগুলো আগুন গোলা ছুড়ে মারল। নিজের শক্তি তা ওর দিকেই ফিরিয়ে দিতে চাইলাম। আগুনের গোলাগুলো তার দিকে চলে গেল। তার মানে আমার শক্তি কাজ করছে। মহিলা উড়ে পাহাড়ের উপরের অংশে উঠে হাসতে লাগল।
নিজের শক্তি দিয়ে ওকে আঘাত করতে চাইলাম, কিন্তু কিছুই হচ্ছেনা। তার এতবছরের শক্তিশালী শক্তির কাছে আমার শক্তি খুব সামান্য। সে এইবার আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি আল্লাহর নাম জপ করতে লাগলাম। জ্বীনদাদুর কন্ঠস্বর আমার কানে ভেসে আসলো।
“দাদু এভাবে ও শেষ হবেনা। তোর ব্যাগে একটা আল্লাহর কালামযুক্ত তলোয়ার আছে সেটা তুমি আল্লাহর কালাম পড়ে তাকে আঘাত করো। এই তলোয়ার কেবল তোমার হাতেই কাজ করবে।” দাদুর কথায় জোর পেলাম। ব্যাগের তলা থেকে সযত্নে কাপড়ে মুড়ানো তলোয়ারটা বের করলাম।ডাইনীটা এখনো হাসতে হাসতে আমার দিকে আসছে।
আল্লাহর কালাম মনে মনে জপতে জপতে লাফিয়ে ডাইনীর বুকে বসিয়ে দিলাম। শক্তি ব্যবহার করে। পাহাড়ের উপর তুলে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলাম। শান্তি লাগছে প্রতিশোধ নিতে পেরে। মাম্মা আমার পাশে কান্নাভেজা চোখে দাঁড়িয়ে আছে। পাপার কথা ভেবেই কান্না পাচ্ছে। সবি হলো ,কিন্তু পাপাকে ফিরে পাওয়া হলোনা। কান্না করতে করতে মাম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম। একটা মিষ্টি কন্ঠস্বর বলল,
— মুনতাহা মা! চমকে উঠলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি একজন সুশ্রী পুরুষ হাত বাড়িয়ে আমাকে ডাকছে। মাম্মা কাপা গলায় বলল, তোর বাবা!
পাপাকে জড়িয়ে ধরে কেদে কেদে বললাম, আমি তো ভেবেছি তোমাকে আর ফিরে পাবোনা।
— তোমাদের জন্য ই তো বেচে ছিলাম। ডাইনীটা আমাকে নিজের প্রতিপত্তি বৃদ্ধির প্রয়োজনে বাচিয়ে রেখেছিল ।সেদিন তোমার মাকে ভয় দেখানোর জন্য আমার বুকে সামান্য তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করেছিল।চল মা আমরা জ্বীনজগতে ফিরে যাই।
এই জগত আমাদের জন্য নয়।
হঠাৎ দেখি মি. ছ্যাঁচড়া দাঁড়িয়ে আমার দিকে কান্নাভেজা চোখে তাকিয়ে আছে। তার কাছে তার হাত স্পর্শ করে বললাম, “খারাপ ব্যবহারের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আসলে আমিও আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার শর্ত ছিল আমার লড়াই চলাকালীন কোনো প্রকার প্রণয়ে আমি জড়াতে পারবনা। তাহলে আমি আর জ্বীনকন্যা থাকবনা। কিন্তু আপনি এখানে এলেন কি করে?”
— আপনার পিছু নিয়ে চলে এসেছি। এখন তো আপনার লড়াই শেষ। এখনো কি আমাকে ফিরিয়ে দিবেন?
— আমাকে ক্ষমা করুন আমি আপনার প্রস্তাব কখনোই গ্রহণ করতে পারবনা। আমার কর্তব্য শেষ, এখন আমাকে আমার জগতে ফিরে যেতে হবে। আমার মাম্মা-পাপা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।তবে সবসময় আপনি অনুভব করবেন আপনার ভালবাসা আপনার আশে পাশে কোথাও আছে। বিদায়!
ফি-আমানিল্লাহ।
হাসনাতের চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। ঝাপসা দৃষ্টি তে দেখছে মুনতাহা তার বাবা-মায়ের হাত ধরে ঘন ধোয়ায় মিলিয়ে গেল।
হয়তো আর দেখা হবে না কিন্তু অনুভব করতে তো পারব জ্বীনকন্যাটাকে।
(সমাপ্ত…..)