জ্বীনের কন্যা পর্ব-১

0
2212

#জ্বীনকন্যা #পর্বঃ০১ #লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা জানালার পাশে বসে সকালের সৌন্দর্য দেখছিলেন মিসেস নিষ্পাপ আহমেদ।সিলেট শহরটা তার কাছে অপার ভালোলাগার একটা জায়গা। গত ৬বছর ধরে এখানেই তার স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস। কাজের মেয়ে মালিহার গলা শুনে তার ধ্যান ভাঙল। — কি হয়েছে মালিহা? — ছোট্টমণি খাচ্ছেনা। কত চেষ্টা করছি একটু কিছুও মুখে দিচ্ছেনা। — তুমি খাবারটা আমায় দাও। চায়ের কাপটাও নিয়ে যাও। মালিহার কাছ থেকে খাবারের ট্রে টা নিয়ে নিজের মেয়ের রুমের দিকে গেলেন নিষ্পাপ। “মেয়েটা কে নিয়ে আর পারা যায়না, যত বড় হচ্ছে তত এর বায়না বাড়ছে। কোন রাজকার্য করছে যে একটু কিছু খাওয়া যায়না।” বিড়বিড় করতে করতে মেয়ের রুমে ঢুকলেন। ঢুকেই চক্ষু ছানাবড়া।তার মেয়ে হাদিস শিক্ষার বই ঘাটাঘাটি করছে। বিস্মিত হয়ে বললেন, — নূরজাহান তুমি এখন এসব নিয়ে বসেছো কেন? — মাম্মা, আজ তো হলিডে। তাই একটু এইগুলো পড়ছি। — কিন্তু ব্রেকফাস্ট না করে এসব পড়লে তো হবেনা। নাও ব্রেকফাস্ট করে স্কুলের হোমওয়ার্ক শেষ করো। বিকালে অবসর মোমেন্টে এসব পড়ো কেমন সোনা! — আচ্ছা মাম্মা। ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিয়ে নিষ্পাপ রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। এমনসময় তার স্বামী সায়েম আহমেদের ডাক এলো। নিজের রুমে ঢুকে বললেন, — ডাকছিলে কেন? — টাই টা পড়িয়ে দাও। নিষ্পাপ সায়েমের টাই বেধে দিতে দিতে বলে, — ৬বছরের মেয়ের বাবা হয়ে গেছো এখনো টাই বউকে পড়িয়ে দিতে হয়? — হুম হয়। আমার মামণি কই? — রুমে বসে বসে হাদিসের বই ঘাটাঘাটি করছিল। বকে খাইয়ে দিয়ে এলাম। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে সকাল সকাল অইসব নিয়ে বসেছে। — এমন করো কেন? এটা তো ভালো গুন ই। এমন মেয়ে লাখে একটা পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। — এত অল্প বয়সে এসব দিকে এত আগ্রহ আমি কোনো বেবির দেখিনি। আমার মনটা কেমন খুতখুত করে। সায়েম নিষ্পাপের হাত দুটো জড়িয়ে বলল, জানোই তো আমাদের মেয়েটা একদম আলাদা। ডা. রা তো বললেন, ও একটু অস্বাভাবিক। ওর বুদ্ধিদীপ্ত সবদিক দিয়ে সবার থেকে বেশি। — তাও আমার ভয় হয় গো। — ভয় পেয়োনা তো। শুধু শুধু ভয় পাওয়া আমার বউয়ের একটা বদগুন। আমার মামণির মত সাহসী হও বুঝচ্ছো। — হয়েছে হয়েছে। যাও অফিসে যাও। আমি তোমার গুনবতী মেয়েটাকে দেখে আসি। হোমওয়ার্ক গুলা শেষ করল কিনা! বলেই নিষ্পাপ নিজের মেয়ের রুমে চলে এলেন। এসে দেখেন তার মেয়ে জানালার ধারে বসে আনমনে কি যেন ভাবছে। নিষ্পাপ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কি ভাবছো নূরজাহান? — মাম্মা দিন এত সুন্দর কেন? দেখো সূর্যমামা তার সময়মত উঠে পড়ে আবার ডুবে যায়। সবকিছুতেই একটা রুটিন আছে আমার পড়ার রুটিনের মত। — ওরা ওদের রুটিনের হেরফের করেনা। আল্লাহ তাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে দিয়েছেন। কিন্তু তুমি তো তোমার রুটিনের নিয়ম মেনে চলোনা। হোমওয়ার্ক করেছো? — জ্বি মাম্মা। সব ফিনিশ। নিষ্পাপ অবাকতুর হয়ে বলল, — এত তাড়াতাড়ি? কই আমাকে দেখাও তো। সত্যিই তো সবগুলাই শেষ। এত তাড়াতাড়ি কি করে করলে? আচ্ছা চল মাম্মার সাথে একটু ঘুরে আসবে। — পরে যাই মাম্মা? বইগুলো পড়া হয়নি! — আচ্ছা পড়ো। মিসেস নিষ্পাপের মনটা কেমন জানি বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। তার মেয়েটা কেন এমন!আচ্ছা তার মেয়ের কোনো ক্ষতি হবেনা তো? নূরজাহান যে তার দুনিয়া, তাকে ছাড়া সব অচল।নিজের মেয়ের চোখের দিকে তাকালে তার সব কষ্ট, ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। নুরজাহান টকটকে ফর্সা, ডাগর ডাগর নীল চোখ, লম্বা খাড়া নাক, চুলটা হালকা সোনালী রঙের। সব মিলিয়ে মনে হয় ছোটখাট পরীর বাচ্ছা।প্রথম দেখায় যে কারো মন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। অন্য বাচ্চাদের তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধিমতি, একদম শুদ্ধভাবে স্পষ্ট কথা বলে। শুধু চিন্তার ব্যাপার একটাই যুগের সাথে তাল মেলাতে চায়না। নিজের আলাদা জগতে থাকতেই সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ার পরও নুরজাহানের আগ্রহ আরবি নিয়ে। ইসলামের নানাদিক সম্পর্কে তার জানা চাই ই চাই। সায়েম তার মেয়ের এসব গুন দেখে খুবই খুশি। শুধু আমার মনটা কেমন জানি করে! আমি জানি এসব ভালো, কিন্তু আমাদের কারো এমন গুন নেই তাহলে নুরজাহান পেল কি করে? ভাবতে ভাবতে নিষ্পাপ নিজের কাজে মন দেয়। মাঝরাতে নূরজাহানের চিৎকার শুনে নিষ্পাপ আর সায়েম নূরজাহানের ঘরে ছুটে আসে। নূরজাহান প্রচন্ড হাপাচ্ছে। নিষ্পাপ তাকে পানি খাইয়ে বুকে টেনে নেয়। সায়েমের দিকে ভয়মাখা চাহনীতে তাকিয়ে বলল, — সায়েম এসব কি হচ্ছে বলো তো! — ভয় পেয়োনা। দুঃস্বপ্ন দেখে একটু ভয় পেয়ে গেছে। তুমি ওকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। ওর কাছেই থাকো বরঙ। সায়েম এগিয়ে এসে নূরজাহানের কপালে চুমু দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলে। নিষ্পাপ মেয়ের চোখে ভয় আর অবাকতা দেখছে।নূরজাহানকে পাশে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ” কি দেখেছো সোনা? মাম্মাকে বলো। নুরজাহান কাপা কাপা কন্ঠে বলে, — একটা মহিলা অনেক উপর থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে। জানো মাম্মা উনার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। কাদছিল খুব। মনে হচ্ছিল আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছিল। হঠাৎ নিচের কুয়াশায় উনি হারিয়ে গেলেন। এসব শুনে নিষ্পাপ মেয়েকে আরো আঁকড়ে ধরেন। এই ঘটনা তার নতুন শোনা নয়। গত ৩ বছর ধরে উনি এই বর্ণনাই শুনে আসছেন। মাঝে মাঝেই নুরজাহান মাঝরাতে চিৎকার করে উঠে আর এই ঘটনাই বলে। কত সাইকোলিজিস্ট দেখালেন। সবার একটাই কথা, ” এটা তার কল্পনায় বানানো চিত্র। হয়তো কোনো মুভি দেখে সে নিজের মাথায় এই চিত্র গেথে নেয়। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে!” ঠিক হওয়ার তো নামই নেই। দিনদিন তা বেড়েই যাচ্ছে, এইটুকু বাচ্চাকে কেন এত প্রেসার দিচ্ছো আল্লাহ! কেন ওকে সবার মত সাদামাটা বানালে না। তাহলে ওর এত কষ্ট আমাকে দেখতে হতনা। ভেবেই নিষ্পাপের চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ল। নূরজাহান চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “কাদছো কেন মাম্মা? তুমিও কি উনার মত কষ্ট পাচ্ছো। কষ্ট পেয়োনা। তোমার নুরজাহান আছেনা আমি সবার কষ্ট দূর করে দিব দেখো।” নিজের মেয়ের এমন মিষ্টি কথায় নিষ্পাপের মুখে হাসি ফুটে ওঠল। তার কপালে চুমু দিয়ে বলল, “সোনা মেয়ে আমার! ঘুমো এখন” নুরজাহানকে স্কুলে যাওয়ার জন্য মালিহাকে রেডি করতে বলে নিষ্পাপ সায়েমকে চা দিতে গেল। চা টা রেখে সায়েমের টাই বেধে দিতে দিতে বলল, — সাবধানে যেও। নুরজাহান স্কুলে ঢুকে গেলে তবেই তুমি অফিসে যাবা অকে। — জো হুকুম মহারাণী। কিন্তু তোমার কি মনে হয়না তুমি নুরজাহানকে নিয়ে একটু বেশি চিন্তা করছো। — মা হও তবে বুঝবে কেন এত বেশি ভাবি। — এত রাগ করো কেন? নুরজাহান তো আমারো মেয়ে। এই কথাটা শুনে নিষ্পাপের অন্তর আত্মা কেপে উঠল। সে যেন ভাবনার জগতে হারিয়ে গেল। সায়েম তাকে এভাবে ঠায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে গা নাড়া দিয়ে বলল, — কি ভাবছো এত? — না কিছুনা। — যাও দেখে এসো নুরজাহান রেডি হয়েছে কিনা? স্কুলের টাইম হয়ে যাচ্ছে যে। — তুমি বের হও আমি এক্ষুনি ওকে নিয়ে আসছি। নুরজাহানকে নিয়ে মালিহা ড্রয়িং রুমে এসে দাড়াতেই নিষ্পাপ তার মেয়েটিকে এক নজর দেখে নিলেন। আজ তার মেয়ে হিজাব পড়েছে। — নুরজাহান এটা তুমি কেন পড়েছো? — কেন মাম্মা? সুন্দর লাগছেনা আমায়? — হুম খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু মাম্মা তোমার স্কুলে তো এসব নিষেধ। খুলে ফেলো মাম্মা। — না মাম্মা পড়িনা প্লীজ। — জেদ করোনা সোনা।তুমি না মাম্মার গুড গার্ল। সায়েম পিছন থেকে এসে বলল, ” আমার মামনিটাকে তো খুব সুন্দর লাগছে!” — থ্যাংক ইউ পাপা। কিন্তু মাম্মা এটা খুলে ফেলতে বলছে, তুমি মাম্মাকে বুঝাওনা। — নিষ্পাপ খুলতে বলছো কেন? — ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে এসব এ্যালাউ না তুমি জানোনা। — তাতে কি হয়েছে? একদিন পড়লে কিচ্ছু হবেনা। আমি ম্যামের সাথে কথা বলে নেব। আচ্ছা আমরা বেরিয়ে পড়ি। — হুম সাবধানে যেও। টাটা মাম্মা — আল্লাহ হাফেজ মাম্মা। বলে নুরজাহান সায়েমের সাথে বেরিয়ে গেল। নিষ্পাপ তাদের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলাম। বুকের ভিতরে মনে হচ্ছে কে হাতুরি দিয়ে আঘাত করছে। মনের ভেতরটা কু ডাকছে। আল্লাহ তুমি আমার মেয়েটাকে হেফাজত করো। . সব কাজ শেষ করে সবেমাত্র রেকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন নিষ্পাপ। এমনিসময় কলিংবেলটা বেজে উঠল। ঘড়ির দিকে তাকালেন, এখনো নূরজাহানের ফেরার সময় হয়নি। তবে কে এলো? মালিহাকে ডেকে দরজা খুলতে বলে চোখজোড়া বুজলেন কিচ্ছুক্ষনের জন্য। মেয়েলী কন্ঠে কেউ একজন বলল, “বুবু কেমন আছ?” চোখ খুলে দেখেন উপরের ফ্ল্যাটের ভাবী এসেছে। উনার সম্পর্ক টা অনেকটা বোনের মত। কথাবার্তায় খুব আপন মনে হয়, নিয়মিত অবাধ যাতায়াত একে অপরের বাসায়। — আরেহ বোন, দেশের বাড়ী থেকে এলে কখন? — কাল রাতেই এলাম বুবু। পথে বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাই ফিরতে রাত হল। — বসো বোন। চা খাবে? — না বুবু, কিছু খাবোনা। নূর সোনামণি কই? — স্কুলে গেছে। তোমার বাচ্চারা কোথায়? — তারাও গেল। নূরকে অনেক মিস করছি বুবু, তাই দেরী না করে চলে এলাম দেখতে। — একটু বেশিই আদর করো ওকে। — করতে তো হবেই। এত মিষ্টি একটা মেয়েকে আদর না করে থাকা যায় বলো! বুবু কাল রাতে নূর চিৎকার শুনলাম মনে হলো। — তুমি কি করে শুনলে? — কাল রাতে যখন ফিরলাম তোমাদের দরজার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখনি শুনলাম। অতরাতে তোমাকে আর বিরক্ত করতে চাইনি, তাই নক করিনি। — আর বলোনা বোন। মেয়েটার সাথে যা হচ্ছে, মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠে।অনেক সাইকোলজিস্ট দেখালাম, সবাই বলে এটা ওর কল্পনামাত্র। ভয়ের কিছু নেই। তারপরও আমার খুব চিন্তা হয়। শত হলেও মায়ের মন। — তুমি কোন হুজুরের শরণাপন্ন হও নাই? — এসবে আমার বিশ্বাস একটু কম তাই ট্রাই করিনাই। — কি যে বল! একবার ট্রাই করে দেখো ঠকবানা। বুঝোই তো পার্বত্যাঞ্চলে থাকো, এখানে আবার খারাপ জিনিসের প্রকোপ একটু বেশি। আমার পরিচিত এক বড় আলেম আছেন, উনি খুব সহজে আসল সমস্যা ধরতে পারেন। তুমি চাইলে ঠিকানা দিতে পারি। একবার চেষ্টা করলে তো ক্ষতি নেই। — তুমি যখন বলছো একবার গিয়েই দেখি। তুমি ঠিকানাটা লিখে দাও।আরো কিছু কথা বলে মহিলা চলে গেল। মাঝরাত হয়ে গেলেও নিষ্পাপের চোখে ঘুম নেই। ও বিশ্বাস করেনা, নূরজাহানের মাঝে খারাপ কিছু আছে। আবার অবিশ্বাস ও করতে পারছেনা। একপ্রকার দোটানা কাজ করছে। একবার গিয়ে দেখলে তো সমস্যা নেই। সায়েমকে কি বলব? ও কি রাজি হবে? আচ্ছা সকালে ওকে ম্যানেজ করে নূরজাহানকে নিয়ে হুজুরের কাছে যাব।সকালে সায়েম আর নূরজাহানকে নিয়ে রওনা দিলাম। সায়েম জিজ্ঞেস করল, — তুমি তো এসব বিশ্বাস করোনা, তাহলে আজ যাচ্ছো কেন? আমি খানিকটা চুপ করে থেকে বললাম, — কখনো কখনো পরিস্থিতি বিশ্বাসের গন্ডি পেরোতে বাধ্য করে। এসো, আমরা পৌছে গেছি। অনেক বড় দরবার হুজুরের।ভীড় ও লেগে আছে খানিকটা। ভীড় ঠেলে কোনোরকমে হুজুরের কাছে গেলাম। হুজুর অনেক সুন্দর দেখতে, বসে বসে অবিরত তাসবীহ গুনছেন। মাঝে মাঝে মোনাজাত করে লম্বা দাড়িতে হাত বুলাচ্ছেন।উনি আমাদেরকে ইশারায় বসতে বললেন। সুন্দরকন্ঠে বললেন, “কি কারণে এসেছো এইখানে?” আমি উনাকে সবটা খুলে বললাম। উনি বললেন, — নূরজাহান, এদিকে এসো মা। নূরজাহান সাবলীলভাবে উনার কোলে গিয়ে বসলেন। হুজুর খানিকক্ষণ ওর সাথে গল্প করলেন তারপর বললেন, — নূরজাহান তোমাদের একমাত্র মেয়ে? সায়েম কিছু বলার আগেই আমিই বললাম, হ্যাঁ ও আমাদেরই মেয়ে। একটাই মেয়ে আমাদের। — নূরজাহান তুমি স্বপ্নে কাকে দেখো? — একটা সুন্দর মহিলাকে। খুব আপন মনে হয় উনাকে। জানো উনার না অনেক কষ্ট। কেউ উনার কষ্ট বুঝেনা। হুজুরকে খানিকটা চিন্তিত দেখাল। উনি বললেন, — তোমরা আজ যাও মা। খুব তাড়াতাড়ি আমি তোমাদের সাথে যোগাযোগ করব। ততদিন অব্ধি ওর দিকে নজর রেখো।আল্লাহ তোমাদের ভালো করুক। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে এলাম। মাথার মধ্যে নানারকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। চিন্তাগুলো কে ঝেড়ে সংসারে মন দিলাম আবার। নিজেকে স্বাভাবিক করলাম কারণ, আমার মন বলছে আমার মেয়ে স্বাভাবিক।এটা শিশুবয়সের কল্পনাবলি মাত্র। নানাকাজে হুজুরের কথা ভুলেই গেছিলাম। নূরজাহানের সব কিছু স্বাভাবিক হিসেবে নিতে চেষ্টা করছিলাম বলে আর ভাবার প্রয়োজন পড়েনি। নূরজাহানের রুমে দুধের গ্লাস নিয়ে ঢুকলাম। — সোনা, কি করো তুমি? — লিখছি মাম্মা। — কি লিখছো, দেখাও তো। দেখলাম তার খাতার পৃষ্ঠা ভর্তি মুশায়রা লেখা। চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, — এটা কার নাম মাম্মা? — জানিনা তো। মাথায় ঘুরঘুর করছে তাই লিখে ফেললাম।নামটা সুন্দর না মাম্মা? — হুম সুন্দর। তুমি দুধটা খেয়ে নাও মাম্মা। বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। নামটা কার? নূরজাহানের মাথায় এই নামটাই বা ঘুরঘুর করছে কেন!হয়তো কোথাও শুনেছে। এমনি ভাবনার সময় কলিংবেল বেজে উঠল। গিয়ে দরজা খুলে দেখি সেই হুজুরটা দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি মাথা কাপড় টেনে সালাম দিলাম। তারপর ভেতরে এনে বসালাম। উনি মুচকি হেসে বললেন, “কেমন আছ, মা?” — জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি বাসায় আসলেন ভাবতেই ভালোলাগছে। আপনি বসুন আমি আপনার জন্য কিছু নাস্তাপানির ব্যবস্থা করি। — ব্যস্ত হয়োনা মা। আমি কেবল কিছু জানতে এবং বলতে এইখানে এসেছি। তুমি আমার কিছু কথা উত্তর দাও। আমি বিনীতস্বরে বললাম,” অবশ্যই।” — নূরজাহান প্রকৃতপক্ষে কার মেয়ে? এই প্রশ্ন শুনে আমি হতহিব্বল হয়ে গেলাম। — হুজুর আমি তো সেইদিনও বলেছি ও আমার মেয়ে।তাও আপনি এসব কেন জিজ্ঞেস করছেন। আমরা ছাড়া কে বা ওরা মা-বাবা হবে! — তুমি সত্যি বলছোনা মা। — এটাই সত্যি হুজুর। নূরজাহান আমার মেয়ে, ওকে আমি এতদিন আদর-যত্নে লালনপালন করে বড় করেছি। — পেটে ধরেছো কি? এইধরনের প্রশ্ন শুনে নিষ্পাপ চুপসে যায়। বুকের ভিতরে উথালপাথাল ঝড় বয়ছে। নিজেকে কোনোরকম সামলে বলল, — ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন।আপনি এখন আসতে পারেন। — আর কতদিন সত্য থেকে পালিয়ে বেড়াবে? একদিন তো তার মুখোমুখি তোমাকে হতেই হবে। সেইদিন তোমার ন্যায় অসহায় কেউ থাকবেনা।এখনো সময় আছে।নিষ্পাপ রাগান্বিত কন্ঠে বলল, — আপনি এখন আসতে পারেন হুজুর। আর কখনোই এই বাড়ীমুখো হবেননা। আপনার হাদিয়া আমি আপনাকে পাঠিয়ে দিব। হুজুর চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। কি ভেবে পিছু ফিরে বললেন, “একদিন তোমার আমাকে প্রয়োজন পড়বে। সেইদিন আমি তোমাকে তাড়িয়ে দেবনা। আমার দরবার তোমার জন্য সবসময় খোলা থাকবে। তখন আশা করি সত্য নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হবে। ভাল থেকো।” এরপর হুজুর এক মূহুর্ত ও দাড়ালেননা। হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। নিষ্পাপ কান্না করতে করতে লুটিয়ে পড়ে নিচে।এইদিনটা ও দেখতে হল তাকে। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। হঠাৎ কেউ যেন তার পিঠে হাত রাখল।চমকে উঠে পিছনে ফিরল নিষ্পাপ। . নূরজাহান তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। নিষ্পাপ তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে বলল, — মাম্মা কিছু বলবা? — মাম্মা আমি তোমার নিজের মেয়ে না? নিষ্পাপ নূরজাহানকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত চুমু খেয়ে বলল,” না সোনা, তুমি আমার নিজের মেয়ে! অই দাদুটা মিথ্যে বলছে মাম্মা।” নূরজাহান মুচকি হেসে বলল, — তুমি কাদছো কেন তাহলে? যদি দাদুই মিথ্যে বলে থাকে। সত্যি করে বলোনা মাম্মা আমি কার মেয়ে? আমার নিজের মাম্মা কে? নিষ্পাপ মাথায় রাগ চড়ে গেল, নূরজাহানকে এক চড় দিয়ে বলল, — কতবার বারণ করেছি, মুখে মুখে তর্ক করবানা। যাও নিজের রুমে যাও। এসব টপিক নিয়ে আর একটা কথ বললেই কিন্তু মাইর দিব। যাও এখান থেকে। নূরজাহান কাদলোনা ফ্যালফ্যাল করে নিষ্পাপের দিকে তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। নিষ্পাপ শান্ত হয়ে গেল। যে মেয়েটার গায়ে আজ অবধি হাত তুলেনি, আজ অন্য একটা কারণে ও হাত তুলে ফেলল। নূরজাহান নিশ্চয়ই খুব অভিমান করেছে।মালিহাকে দিয়ে আইসক্রীম আর চকলেট আনিয়ে অইগুলো নিয়ে মাম্মা বলে ডাকতে ডাকতে নূরজাহানের রুমে ঢুকল। কিন্তু রুমের কোথাও নূরজাহান নেই। ও তো রুমের দিকেই এলো, এখন তাহলে রুমে নেই কেন? সারা বাসা খুজেও নূরজাহানকে কেউ কোথাও পেলনা। সায়েম বাসায় ফিরতেই নিষ্পাপ তাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাদতে শুরু করল। হুজুরের ব্যাপারটা সে চেপে গেল। সে চায়না সায়েম এসব ব্যাপারে জানুক। সায়েম এক মূহুর্ত দেরী না করে নূরজাহানকে খুজতে বাহিরে বেরিয়ে গেল। সারারাত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেও কোথাও পেলনা।অবশেষে থানায় জিডি করে বাসায় নতমুখে ফিরে আসল। আসতেই নিষ্পাপ সায়েমকে পাগলের মত জিজ্ঞেস করতে লাগল। সায়েমকে নীরবে কাদতে লাগল। নিষ্পাপ বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে আর বিলাপ করছে, “নূরজাহানকে এনে দাও আমাকে। আমি আর কখনোই বকবনা। প্লীজ সায়েম আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে এনে দাও।” পুরো ২দিন কেটে যাওয়ার পরও কেউ নূরজাহানের সন্ধান পেলনা। নিষ্পাপ অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, কিচ্ছুটি মুখে তুলছেনা। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। হঠাৎ তার হুজুরসাহেবের কথা মনে পড়ল। পাগলের মত ভরসন্ধ্যায় বেরিয়ে গেল।সায়েম তা দেখতে পেয়ে নিষ্পাপের পিছু পিছু ছুটল। মাঝরাস্তায় নিষ্পাপকে ধরে ফেলল,জিজ্ঞেস করতে লাগল,”কি হয়েছে তোমার?তুমি এভাবে ছুটে কোথায় যাচ্ছ?” নিষ্পাপ ফোপাতে ফোপাতে বলল, “হুজুর সাহেবই পারবে নূরজাহানের খোজ দিতে।আমাকে তার কাছে যেতে দাও।” — আমরা কাল সকালে যাব নিষ্পাপ। চলো বাসায় চল। নিষ্পাপ সায়েম বাহুডোর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, — আমি আর এক মূহুর্ত ও দেরী করতে পারবনা। কেন বুঝতে পারছোনা আমাদের মেয়ে উধাও হয়ে গেছে। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারব সায়েম। — আচ্ছা চল, আমিও যাব তোমার সাথে। হুজুরের দরবারে এসে পৌছালো দুজন। নিষ্পাপ সায়েমকে রেখে দৌড়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। দেখল হুজুর নামাযের মোনাজাত শেষ করে সবে উঠেছেন। নিষ্পাপ হাতজোড়ে কেদে কেদে বলল, — হুজুর আমার মেয়েটা হারিয়ে গেছে। তাকে খুজে বের দিন। আমাকে ক্ষমা করুন সেইদিনের ব্যবহারের জন্য। সায়েম এসে এটা দেখে অবাক হয়ে গেল এবং বলল, — তুমি কবে হুজুরের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছো? — সেদিন হুজুর আমাদের বাসায় গিয়েছিলেন নূরজাহানের আসল পরিচয় জানার জন্য। আমি ওকে হারানোর ভয়ে উনাকে তাড়িয়ে দিয়েছি। — আসল পরিচয় মানে কি? হুজুর সায়েমকে শান্ত হতে বলে বলল, ” নূরজাহানের অন্য একটি পরিচয় আছে, যেটা তোমরা কেউ জানোনা। তবে সবচেয়ে বড় সত্যি এটাই নূরজাহান তোমাদের মেয়ে নয়।” সায়েম বলল, — কি বলছেন কি? নূরজাহান কে আমি সেই ছোট থেকেই নিজের হাতে বড় করেছি আজ বলছেন সে আমাদের মেয়ে নয়। — তুমি তোমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করো। সায়েম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিষ্পাপের দিকে তাকাল। নিষ্পাপ কাদতে কাদতে বলল, উনি সত্যি বলছেন নূরজাহান আমাদের মেয়ে নয়। সেইদিন হসপিটালে আমাদের ৩য় বারের মত মৃত বাচ্চা হয়েছিল। সেইদিন ঠিক একি সময় পাশের বেডে একটা মেয়ে বেবি হয়েছিল। আমার আমাদের বেবির কথা শুনে যখন কাদছিলাম, তখন দেখলাম অই মহিলার কাজের বুয়া বাচ্চা কোলে নিয়ে বসেছিল এবং বাচ্চার কান্না থামাতে চেষ্টা করছিল। কিছুতেই পারছিলনা। আমি ওকে ডেকে বাচ্চাটাকে কোলে নিতেই ও শান্ত হয়ে গেল। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, — বেবির আম্মু কোথায়? — ভাবী ভাইয়াকে আনতে গেছে। আমার কাছে রেখে গেছে, খুব তাড়াতাড়ি ফিরবেন বলেছেন। কিন্তু ২দিন পার হওয়ার পরও ওর আম্মু আসেনি। তাই আমি অই মেয়েটাকে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে নিজের কোল পূরণ করার জন্য বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে এসেছি। আর তুমি ঢাকা থেকে ফেরার পর বলেছি ও আমাদেরই মেয়ে। সায়েমের চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু পড়ল। হুজুর শান্ত গলায় বলল, “জানো ও কে?” নিষ্পাপ চোখের পানি মুছে বলল, — কি তার পরিচয়? — ও জ্বীনকন্যা। জ্বীন মুস্তফা আর মনুষ্যকন্যা মুশায়রার মেয়ে। সায়েম অবাক হয়ে বলল, — কি বলছেন আপনি এসব? — এটাই সত্যি। তোমরা কি ওর মাঝে আলাদা কিছু লক্ষ করোনি? নিষ্পাপ আর সায়েম দুইজন দুইজনের দিকএ তাকাল। ওদের সব মনে পড়ে গেল। নিষ্পাপ অবাক হয়ে বলল, “আপনি কি করে জানেন?” — আমার যে জ্বীনজগতের সাথে যোগাযোগ আছেরে মা। পুরো জ্বীনজগত অধীর হয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। কবে তাদের জ্বীনকন্যা আসবে? তাদেরকে রক্ষা করবে কষ্টের হাত থেকে। — নূরজাহানের বাবা-মা কোথায়? — আমি যতটুকু জানি তারা খুন হয়েছে মুশায়রার মায়ের হাতে। শুনে নিষ্পাপের অন্তরাত্মা কেপে উঠল। সে বিনীতস্বরে বলল, ওর যখন মা-বাবা জীবিত নেই, তবে আমাদের কাছে থাকতে কিসের বাধা হুজুর? — ও এই পৃথিবীতে পাচ-দশটা মেয়ের মত জীবন কাটাতে আসেনি। ওর যে সামনে কঠিন লড়াই। তাই ও তোমাদের কাছে আর ফিরতে পারবেনা। নিষ্পাপ চিৎকার করে বলল, “হুজুর আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবনা। ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। আমি হাতজোড় করে ভিক্ষে চাইছি আমার মেয়েকে।” . এমনসময় নূরজাহান পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এসে নিষ্পাপকে লক্ষ করে বলল, “মাম্মা, তুমি ফিরে যাও!” নিষ্পাপ নূরজাহানের কাছে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, “মাম্মা তুমি এইখানে কি করে এলে? চল আমাদের সাথে ফিরে চলো।” — তা সম্ভব না মাম্মা। আমি আমার আসল পরিচয় আর কর্তব্য সম্পর্কে জেনে গেছি। — মাম্মা অইসব মিথ্যে । তোমাকে মিথ্যে বলা হয়েছে। মাম্মার সাথে চল সোনা। মাম্মা যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। — মাম্মা, তুমি চলে যাও। আমি তোমাদের কাছে ফিরতে পারবনা। নিষ্পাপ লালচোখে হুজুরের দিকে তাকাল। — আপনি আমার মেয়েটাকে তুলে এনে কি বুঝিয়েছেন? কেন এভাবে আমার সুখের সংসারটা তছনছ করছেন? — মাম্মা উনি আমাকে তুলে আনেনি।আমি স্বেচ্ছায় এখানে সত্যিটা জানার জন্য।মাম্মা আমার যে অনেক দায়িত্ব,যে আমার আসল পাপা-মাম্মাকে খুন করেছে তাকে শাস্তি দিতে হবে। এই কাজটা আমাকে তোমাদের থেকে বিছিন্ন থেকেই করতে হবে। — নূরজাহান এসব কি বলছো? নিষ্পাপ উঠে সায়েমের কাছে এলো। তাকে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল, “তুমি চুপ করে আছো কেন? ওকে কিছু বলবানা, বুঝাবানা। প্লীজ সায়েম কিছু তো বলো।” সায়েম ধীরপায়ে নূরজাহানের গালে হাত রেখে চুমু খেয়ে বলল, “নিষ্পাপ যা আমাদের নয়, তা আমরা কখনোই জোর করে ধরে রাখতে পারবনা। একদিন না একদিন তো সে আমাদের ছেড়ে যাবেই। ওকে তুমি আটকিয়ো না, তাকে তার কাজটা ঠিকমত করতে দাও। তাতেই সবার মঙল।” নূরজাহান সায়েম জড়িয়ে ধরে পায়ে হাত রেখে সালাম দিয়ে বলল, — পাপা আমার জন্য দোয়া করো যাতে তোমার মামণি তার কাজে সফল হয়। মাম্মাকে বুঝিয়ে নিয়ে যাও। আমি একদিন ঠিকিই তোমাদের কাছে ফিরব। ততদিন তুমি মাম্মাকে দেখে রেখো। — দোয়া করি মামণি। নিষ্পাপ জোরকন্ঠে চেচিয়ে bolol — সায়েম তুমি এটা করতে পারলা? একবারো আমার কথা ভাবলানা। ও চলে গেলে আমি কি নিয়ে বাচবো। আমি তোমার পায়ে পড়ছি ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। — নিষ্পাপ ও আমাদের নিজের মেয়ে নয়।তাই ওকে আটকানোর সাধ্য নেই আমাদের। চলো আমরা ফিরে যাই। ও জ্বীনকন্যা, মানুষের মায়ার ডোরে ওকে বেধে রাখা যাবেনা। হুজুর আপনি ওকে দেখে রাখবেন। আমরা কালই এই এলাকা ছেড়ে চলে যাব। হয়তো ওর সাথে আর কখনোই দেখা হবেনা, আপনি ওকে একটু আগলে আগলে রাখবেন। ওর জন্য সবসময় দোয়া রইল। সায়েম নিষ্পাপকে টেনে নিয়ে গেল। নিষ্পাপ কাদতে কাদতে বলল, সায়েম নূরজাহানকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবনা। প্লীজ এমনটা করোনা। নিষ্পাপের আর্তনাদ নূরজাহানের কাছে আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে গেল। নূরজাহান চোখের পানি মুছে হুজুর কে বলল, — আপনি আমাকে বলুন এখন আমাকে কি করতে হবে? কি করলে আমি আমার মাম্মা-পাপার হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারব! আমি কি কখনোই আমার আসল মাম্মা-পাপাকে খুজে পাবনা। — শান্ত হও দাদু। এখনি এত ভেঙে পড়োনা।তোমার মনটাকে শক্ত করো। সব জানতে পারবে তুমি।এসো আমার সাথে। হুজুরের পিছু পিছু নূরজাহান একটা বড় ঘরে ঢুকল। ঘরে রাশিরাশি ইসলামিক বই আর কুরআন ।চারিদিকের দেয়ালে আল্লাহর কালাম লেখা। হুজুর তাকে বসতে বললেন ইশারায়। নূরজাহান মেঝেতে বসে পড়ল এবং হুজুরকে জিজ্ঞেস করল, — আমরা এখানে আসলাম কেন? — এটা নামাযঘর দাদু। এই ঘরে আমি একজন ডাকব যে তোমাকে সব সঠিক তথ্য দিতে পারবে তোমার মা-বাবার সম্পর্কে এবং তার পরর্বতীতে তোমাকে কি করতে হবে তা বলে দিবে। — কাকে ডাকবা দাদু? — জ্বীনসর্দার। সম্পর্কে সেও তোমার দাদু হয়। এখন চুপটি করে বসো। হুজুর ঘরের আলো নিভিয়ে দুটো মোম জ্বালালেন। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর মনে হল ঘরটা কেপে উঠল।একটা দমকা বাতাস জানালা দিয়ে ঘরে ডুকল। একটা গম্ভীর মিহি কন্ঠে কেউ বলে উঠল, — আমাকে স্মরণ করার কারণ কি হুজুর? — আপনার থেকে অনেককিছু জানার ছিল সর্দার। এই মেয়েটির দিকে লক্ষ করুন, এই আপনাদের মুস্তফার সন্তান। আমাদের বংশের ভবিষ্যৎ, সে এসেছে আপনাদেরকে অন্যায়ের হাত থেকে রক্ষা করতে। অদৃশ্য মিহি কন্ঠটি পুলকিত হয়ে বলল, — সে এসেছে? তার জন্য এতদিন আমরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। — জ্বী সর্দার। এখন আপনি তাকে সবকিছু খুলে বলুন যাতে সে তার কাজগুলো সুনিপুনভাবে করতে পারে। নূরজাহান উদ্দেশ্য করে অদৃশ্য কন্ঠটি বলে উঠল, — শোনো দাদু, তোমার নানাভাই ছিল একজন নিষ্ঠ আলেম। তোমার নানুকে নিয়ে তার জীবন খুব ভালোই চলছিল। সেইসময় আমাদের ভালো জ্বীন আর বদজ্বীনের সাথে যুদ্ধ চলছিল। আমরা তাদের হাত থেকে মানুষ আর জ্বীনজাতিকে রক্ষা করার জন্য বদজ্বীন সর্দারকে হত্যা করি। এতে তাদের দল দূর্বল হয়ে পড়ে, একে অপরের থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়। বদজ্বীন সর্দারের স্ত্রী উপায়ান্তর না দেখে ঘটনাক্রমে তোমার নানুর শরীরে আশ্রয় নেয়। আস্তে আস্তে তোমার নানুর আত্মাকে নিঃশেষ করে তার শরীর পুরোপুরি দখল করে নেয়। নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকে তার খারাপ শক্তি জাগ্রত করে জ্বীনজগতে ফিরে আসার। আলেম সাহেব তা বুঝতে পেরে তাকে বের করে দেন। ততদিনে সে অনেক ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছিল তাই তাকে ধবংস করার জন্য আমি আর উনি ঠিক করি মুস্তফা আর মুশায়রার বিয়ে দেওয়ার। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল তাদের সন্তান দ্বারাই অই মহিলাকে হত্যা করার। সেই মহিলা এসব জানতে পেরে নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগল তুমি যাতে জন্ম নিতে না পারো। তোমার বাবা অনেক ক্ষমতাধর হওয়া সত্ত্বেও তুমি আর তোমাকে মাকে রক্ষা করতে পারলনা। কেননা, তাদের মিলনের ফলে তার সব শক্তি তোমার মাঝে স্থানান্তর হয়েছিল। নূরজাহান অবাক হয়ে সব শুনছিল;তার জন্ম নেওয়ার পিছনে এত রহস্য ছিল।জ্বীনসর্দার একটু থেমে আবার বলা শুরু করলেন, “তোমার বাবাকে ওই মহিলা বন্ধি করার পরই তোমার মায়ের প্রসবব্যথা উঠে, এর পরেরদিনই তোমার জন্ম হয়। তোমার মা মুস্তফাকে বাচানোর জন্য মিথ্যে গর্ভবতীর অভিনয় করে সেখানে যায়। অই মহিলা ভয় দেখিয়ে তোমার মাকে পাহাড় থেকে ফেলে দেয়। তারপর থেকে শুরু হয় জ্বীনজগতে অই বদমহিলার রাজত্ব। অকথ্য নির্যাতন চলছে এখনো অবধি ভালো জ্বীনগুলোর উপর। আমরা জানতাম তুমি আসবে অই মহিলাকে শেষ করতে, তাই এত অপেক্ষা তোমার জন্য।” নূরজাহান বিস্মিত হয়ে বলল, “আমি কি করে তাকে শেষ করব? — তুমিই পারবে।এর আগে তোমাকে ১৮বছর বয়সে উপনীত হতে হবে। তাতে তুমি তোমার বাবার দেওয়া শক্তি ফিরে পাবে। তবেই তুমি তাকে শেষ করতে পারবে। — কিন্তু আমি তো এখনো ছোট, ১৮ বছর হতে অনেক দেরী। — তুমি খুব শীঘ্রই ১৮ বছর বয়সে উপনীত হবে। তবে আর জন্য তোমাকে নিজের মাকে খুজে বের করতে হবে। — আমার মা কি বেচে আছে দাদু? কোথায় পাবো তাকে? — হুম তোমার মা জ্বীনরুপে বেচে আছে, তাকে তোমায় ই খুজে বের করতে হবে।তবেই তুমি তোমার শক্তি ফিরে পাবে। হয়ে উঠবে ১৮ বছরের তরুনী। তবে মনে রেখো তুমি এইসময়ে কোনো মানুষের সাথে বৈবাহিক কিংবা প্রণয় সম্পর্কে জড়াতে পারবেনা। তাহলে তুমি জ্বীনকন্যা থাকবেনা, সব শক্তি হারাবে। হয়ে পড়বে এক সাধারণ বালিকা। নূরজাহান জোরগলায় বলল, সব মানতে রাজি আমি।আপনি শুধু বলুন আমার মাম্মাকে কোথায় পাব? কি করে চিহ্নিত করব? — দেখো তোমার বা হাতে একটা জন্মদাগ আছে, এমন একটা দাগ তোমার মায়ের হাতেও আছে। তোমরা যখন মুখোমুখী হবে, দুটো দাগ থেকে আলো বিচ্চুরিত হবে। তখনই তুমি নিশ্চিত হবে ওইটা তোমার মা। তুমি যখন মায়ের সাথে মিলিত হবে অই বদজ্বীনি জেনে যাবে তোমার আসল পরিচয়। তোমাকে বাধা দিতে থাকবে প্রতি পদে, চাইবে তোমাকে হত্যা করতে। (চলবে…..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here