প্রিয়তমা পর্ব-৩০শেষ পর্ব

0
2337

#উপন্যাস
#প্রিয়তমা (শেষ পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
আনাস চলে যাওয়ার পর থেকে লামিয়ার সবকিছু কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। মনে মনে বলছে,,এই সাতদিনে একটা বদঅভ্যাস আমার তৈরি হয়ে গেছে আর তা হলো উনার হাতে খাওয়াটা। আর উনি নামক ছোঁয়াছে রোগটা আবারো আক্রমণ করে ফেলেছে যার থেকে বেরোনোর কোন উপায় নেই।
সন্ধ্যার দিকে লামিয়া শুয়ে ছিলো। জোবায়েদা দরজায় নক করে বললো,,, আসবো মা??
-আম্মু!! আসো।
-কেমন লাগছে এখন তোর??
-আলহামদুলিল্লাহ আগের থেকে কিছুটা ভালো।
-ওহ। কিছু খাবি??
-না কিছু্ খাবোনা। আম্মু তুমি কি আমাকে কিছু বলতে এসেছো?
-না মানে হ্যা।
-তো বলো?
– তুই রেগে যাস কি না তাই বলতে ভয় হচ্ছে।
-কি বলতে চাও বলো আমি রাগ করবোনা।
-আদিবার ব্যাপারে কিছু ভেবেছিস??
– আদিবার ব্যাপারে কি ভাববো??
-না,, মানে তুই কি শশুড়বাড়ি ফিরে যেতে চাস?? আনাসের সাথে সংসারটা তুই করতে চাস কি না?
-আম্মু আমি এখন ওই ব্যাপারটা নিয়ে কিছু ভাবছিনা। আমাকে একটু সময় দাও?
-হুম তোর যা খুশুি। তবে একটু ভালো করে ভাবিস। তোদের সামনে এখনো জীবনের অনেকটা সময় পড়ে আছে তোর বা আনাসের জীবনটা হয়তো একদিন গুছিয়ে যাবে। এই ঘটনা হয়তো তোরা একবছর,, দুই বছর বা পাঁচবছর মনে রাখবি এরপর তোরা ঠিকই তোদের জীবনটা গড়ে তুলবি নতুন করে।
কিন্তু আদিবা!!! ওকি পাবে? কিচ্ছু পাবেনা। মা বাবার ভালোবাসার জায়গাটা ওর সারাজীবনের মতো অপূর্ণই থেকে যাবে। এটা ওর জীবনে অনেক বড় আফসোস হয়ে থাকবে। একজন সন্তানের জন্য মা বাবা দুজনের প্রয়োজন ।
একদিন আদিবা বড় হবে তখন ও যদি তোদের প্রশ্ন করে কেন তোরা আলাদা হয়েছিস?
কেন তোরা ওকে মা বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছিস??
তখন কি জবাব দিবি তোরা দুজনে??
-আম্মু তুমি কি চাচ্ছো আমরা শুধু আদিবার কথা ভেবেই আবার একসাথে থাকবো?
-না আমি তা চাইনা। আদিবার কথা ভেবে তোরা একসাথে থাকলে সেখানে শান্তি আসবেনা।
আমি চাইনা কোন দায়বদ্ধতা থেকে তোরা আবারো একসাথে থাকবি। আমি চাই তোরা একে অপরকে বুঝতে শিখবি। একজনের প্রতি আরেকজনের বিশ্বাস টা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা কর। মানুষের জীবনে আরো বড় বড় বিপদ আসে মানুষ সেগুলোকে মোকাবেলা করে জীবনের কঠিন পথ পাড়ি দেয় তাহলে তোরা কেন থমকে যাবি ?
তোদের জীবনের ভালো সময়গুলোকে মনে কর আর খারাপ সময়গুলোকেও। কোন সময়টা তোদের জীবনকে বেশি প্রভাবিত করেছে । কিসের অভাব ছিলো তোদের সম্পর্কের মাঝে ভেবে তারপর সিদ্ধান্ত নিস।
আমরা কেউ তোকে জোর করবোনা। জীবনটা তোর তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার ও তোর আছে।
তবে ভাগ্যকে বদলানোর ক্ষমতা তোর,,, আনাসের বা আমাদের কারো নেই এটা আগে থেকেই উপরওয়ালা লিখে রেখেছে।
এটা মনে করিসনা আমরা তোকে বোঝা মনে করে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি তাহলে তুই ভুল ভাবছিস। বাবা মায়ের কাছে সন্তান কখনো বোঝা হয়না। কিন্তু সন্তানের একটা সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে দেয়া মা বাবার উপর আল্লাহর দেয়া অর্পিত দায়িত্ব। তোর বাবা তো চলে গেছে সব ছেড়ে এখন আমাকেই সেই কাজটা করতে হবে। না হলে আল্লাহর কাছে আমাকেই জবাবদিহি করতে হবে।
মারে,, মানুষের জীবনটা কোন হেলা খেলার জিনিস না এটা আজ না বুঝলে এক সময় হয়তো বুঝবি। কিন্ত তখন কিচ্ছু করতে পারবিনা।
এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিস না যাতে পরে আফসোস করতে হয়।
জোবায়েদা রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
মায়ের বলা কথাগুলো লামিয়ার মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। আনাসের সাথে কাটানো ভালো খারাপ সময়গুলো লামিয়া ভাগ করে নিচ্ছে। যে পাল্লাটা ভারী হবে লামিয়া ওইদিকেই যাবে আর কোনো বাড়াবাড়ি নয়। হয় এপার নয় ওপার। এভাবে নিজেদের কষ্ট দেয়ার কোন মানেই নেই।
আনাসের অনেক ইচ্ছে করছে একবার লামিয়াকে ফোন করে ওর খবর নিতে কিন্তু লামিয়ার নিষেধের জন্য তা পারছেনা যদি আবার রেগে টেগে যায়। তাই মাকে দিয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে ফোন দিয়েছে আনাস। অন্তত ওর খবরটা তো পাওয়া যাবে।
রাতে আনাস ভাবলো ওর কাছে কি আরেকটা সুযোগ চাইবো??
সে কি আমায় সুযোগ ভালোবাসা আর বিশ্বাসের প্রমাণ দেখানোর জন্য ??
নাকি আগের মতো ফিরিয়ে দেবে আর আশাভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়ে আমাকে জীবন কাটাতে হবে?
পরের দিনটা লামিয়ার তেমন একটা ভালো যায়নি। এই কয়দিন ঘুম থেকে উঠে আনাসকে পাশের বেডে দেখতে পেত আর আজ সেই মানুষটা নেই। সত্যি আমরা মানুষেরা অাজব প্রানী!! যেই মানুষটা কাছে থাকলে তার মূল্য বুঝিনা কিন্তু সেই মানুষটা দূরে গেলেই তার শূন্যতাটা আমাদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।
তবে লামিয়া এটা বুঝতে পারছে তার ভেতরের অভিযোগ আর অভিমানের পাহাড়টা গলে মনের এক কোনে একটু একটু মানুষটার জন্য ভালোবাসা গুলো আবারো বাসা বাঁধতে শুরু করেছে
বিকালে লামিয়া ঘুম থেকে উঠে চারদিকে চোখ বুলালো,, ওর কেন জানি মনে হচ্ছে আনাস এসেছে। চারদিকে ওর চোখজোড়া শুধু আনাসকেই খুঁজছে। কোথাও না দেখে আশাহতের মতো জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। শায়লা তখন রুমে আদিবার জামাকাপড় গুছাচ্ছিলো। তাই অনেক কষ্টে কান্না আটকালো। আজব আমার কান্না আসছে কেন?? তার কি আসার কথা ছিলো?
লামিয়াকে এভাবে দেখে শায়লা বললো,,, কি খুঁজছো আপু? আর এমন বিষন্ন লাগছে কেন তোমাকে?
-কই কি খুঁজছি??
-আমি তো দেখলাম তুমি কেমন চোরের মত এদিক সেদিক চোখ ঘুরাচ্ছো।
-আসলে,,, বলছিলাম কি,,,উ,, উনি আসেনি?
-উনি কে?
-লামিয়া একটু রেগে বললো বুঝেও না বুঝার নাটক করছো কেনো?
-আজব!! তুমি বুঝিয়ে বললেই তো বুঝি।
-আদিবার বাবার কথা বলছি।
-বাব্বাহ!! যেই মানুষকে আপনার সহ্য হয়না আজ তার খোঁজ নিচ্ছেন ব্যাপার কি ননদিনী?? আবার দেখি আপনার চোখে পানিও । কেয়া বাত হে!! মুজে তো কুচ গড়বড় লাগতাহে!!!
-লামিয়া ধরা পড়া গলায় বললো,,,কিসের ব্যাপার কি? এমনি জানতে চাইছি। আর হিন্দী বলছো কেনো বাংলা ভাষায় কি কথার অভাব পড়ছে??
তোমাদের সাথে কথা বলাও মুশকিল। তোমরা একটা কথা পেলে ওটাকে এদিক সেদিক ঘুরিয়ে তাল পাকিয়ে দাও। যত্তসব!!!
-রাগছো কেন আমি তো দুষ্টুমি করেছি। টেনশন করোনা তোমার উনি এসেছে তুমি ঘুমাচ্ছো দেখে জাগাতে নিষেধ করেছে। আদিবা জ্বালাচ্ছে দেখে ওকে নিয়ে একটু বাহিরে গেছে হাটতে।
-লামিয়া মনে মনে অনেক খুশি হলো। কিন্তু সেই খুশিকে শায়লার কাছ থেকে আড়াল করে মুখে বললো,, ওহ
-আপু একটা কথা বলি?
-হুম বলো।
-তোমার উনাকে তুমি সত্যি অনেক ভালোবাসো কিন্তু অভিমানে বলতে পারোনা তাইনা?
-লামিয়া কিছুক্ষণ ভেবে মুচকি হেসে বললো,,,হুম হয়তো
-হয়তো নাগো ননদিনী এটাই সত্যি!
এমন সময় আনাস দরজায় নক করলো। শায়লা তাড়াহুড়ো করে ওড়না ভালোভাবে পেঁচিয়ে বললো,, নাও তোমার উনি এসে গেছে বলে দ্রুত পায়ে রুম ছাড়লো।
লামিয়া হাত দিয়ে চোখের কোনে আসা পানিটা মুছে নিলো।
আনাস সালাম দিয়ে রুমে ডুকলো। লামিয়া সালামের জবাব দিয়ে নিজেও সালাম দিলো। এক অন্যরকম লজ্জা এসে ভর করলো ওর চেহারায় সেই প্রথম দিনের মত। নিচের দিকে তাকিয়ে লামিয়া নিজেকে নিজে ধমকালো,, কি করছিস কি লামিয়া?
তাকে কি এই প্রথম দেখছিস যে এত লজ্জা পাবি??
আনাস এসে বললো,, বসতে পারি??
-হুম
-কেমন আছো এখন?
-আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
-আমিও আলহামদুলিল্লাহ। মাথার ব্যাথাটা কি একটু কমেছে?
-জী।
কতক্ষণ চুপ থেকে আনাস বললো,,, আসলে আসতে চাইনি কিন্তু কি বলোতো মানুষের মন এমন এক জিনিস যেইটা না করতে চায় মন তাই করতে বাধ্য করে। মনের সাথে যুদ্ধ করে না থাকতে পেরে চলে এলাম। রাগ করোনি তো আবার?
-না।
– আচ্ছা মাঝে মাঝে ফোন দিবো বিরক্ত হবেনা তো?
-লামিয়া সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।
– ভালো থেকো। আজ আমি আসি।
-নাস্তা না করেই চলে যাবেন?
-আমি এসেছি অনেকক্ষণ হলো তুমি ঘুমে ছিলে। আসার পরেই মা নাস্তা দিয়েছে।
-ওহ। কাল আবার আসবেন তো? কথাটা বলেই লামিয়া জ্বিভ কাটলো। মনে মনে নিজেকে একটা বকা দিলো,, ছিহ লামিয়া!!! তুই এতো বেহায়া হলি কবে?
– আনাস লামিয়াকে এক পলক দেখেই বললো যদি কারো অনুমতি পাই তো!!
লামিয়া হেসে দিলো।
কয়দিন পরে রাশেদা চৌধুরী এসেও লামিয়াকে যথেষ্ট বুঝালো। দেখো মা আমি জানিনা তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে না হয়েছে। আনাস আজ অবদি আমাকে কিচ্ছু বলেনি। তোমাদের দুজনের কারো মাঝে আমি সেই ধরনের কোন কিছু দেখতে পাইনি। কারণ আজ অবদি তোমরা কেউ কাউকে অসন্মান করে কথা পর্যন্ত বলোনি যেটা আমি লক্ষ্য করেছি তারপরও কেন এতবড় সিদ্ধান্ত নিলে বুঝতে পারিনি।
যাই হোক আমি কিছু জানিনা বা জানতে ও চাইনা কিন্তু আমার মনে হয় তোমাদের আর একবার এ ব্যাপারে চিন্তা করা দরকার।
-জী মা আমি ভেবে দেখি।
দেড় মাস লাগলো লামিয়ার পুরোপুরি সুস্থ হতে। এর মাঝে কোন বিকাল যায়নি যেদিন আনাস লামিয়াকে দেখতে আসেনি। এমনকি লামিয়ার ডাক্তার দেখানো থেকে সব আনাস নিজেই করেছে।
আজ লামিয়া আবারো ফিরে যাচ্ছে সেই ঠিকানায় যেখান থেকে একদিন স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়ে চলে এসেছে। আজ আবারো একরাশ স্বপ্ন নিয়ে ফিরে যাচ্ছে সেই ঠিকানায়। সত্যি উপরওয়ালা চাইলে কি না সম্ভব!!
তবে লামিয়া কোন দায়বদ্ধতা থেকে নয় তার উনার ভালোবাসার টানে ফিরে যাচ্ছে। এই দেড় মাস লামিয়া অনেক ভেবে চিন্তে হিসাব মিলিয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আজ আনাসদের বাড়ি থেকে আনাসের বাবা মা সহ ওর বড়বোন, সৌদি থেকে ভাই ভাবি এসেছে উনারা আর আনাস এসেছে লামিয়া আর ওর মেয়েকে সসম্মানে ওদের বাড়ি নিয়ে যেতে। লামিয়া সবার মেহমানদারী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আনাসের দিকে একবারো তাকায়নি। আজকাল আবার ওর আনাসের দিকে তাকাতে লজ্জা লাগে কেন নিজেও জানে না। তাই ইচ্ছে করেই তাকায় নি।
আনাস আদিবা,, রাহী আর ওর ভাইয়ের আর বোনের ছেলেদের নিয়ে সোফাতে খেলছে মাঝে মাঝে আড়চোখে লামিয়াকে দেখছে। লামিয়া আজ সাদা আর বেগুনি কালারের কম্বিনেশনের একটা হাফ সিল্কের শাড়ী পড়েছে। আনাস আসার পর থেকে মুগ্ধ হয়ে বারবার ওদিকেই তাকাচ্ছে। লামিয়া বুঝতে পেরে হালকা চোখ রাঙানি দিলো,, কি হচ্ছে কি? লাজ লজ্জার কি মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি?
আনাস একটা মুচকি হাসি দিয়ে অন্য দিকে ফিরে তাকালো।
সন্ধ্যার আগেই ওরা বেরিয়ে গেলো ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে।
বাসার সামনে গাড়ি আসতেই লামিয়ার কেমন যেন এক খারাপ লাগা কাজ করতে শুরু করলো। সেদিন এ বাড়ি ছেড়ে ও শূন্য হাতে বেরিয়ে গেছে কখনো ভাবতে পারেনি আবারো সেই বাড়িটাই আসার সৌভাগ্য ওর হবে। মহান রবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নিচু করলো লামিয়া।
রাতের খাবার লামিয়াদের বাসা থেকে দিয়ে দিয়েছে তাই রান্নার ঝামেলাটা আর করতে হয়নি। কিছুক্ষণ গল্প করে যে যার রুমে রেস্ট নিচ্ছে। আনাস আসার পরে সেই যে বেরিয়ে গেছে এখনো ফিরেনি। লামিয়ার কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছে এই রুমটা জুড়ে একদিন ওর অধিকার ছিলো আর আজ কেমন পর পর লাগছে। মনে হচ্ছে ও এই রুমের অতিথি। তবে সবকিছু আগের মতই আছে। লামিয়ার জামাকাপড় গুলো আলমারিতে সেই ভাবে রাখা আছে যেভাবে লামিয়া রেখে গেছে। আদিবাকে ঘুম পাড়িয়ে লামিয়া রুমটাকে গুছালো তারপর বারান্দায় গিয়ে বসলো। মাকে ফোন দিয়ে কথা বললো।
রাশেদা চৌধুরীর ডাকে লামিয়া রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসলো। মা ডাকছিলেন??
-হুম আমার বোনটা কি ঘুমিয়ে গেছে?
-জী মা।
ওই সময় লামিয়ার বড় জা আর ননদও ওর শাশুড়ির রুমে আসলো। সবার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করার পরে ড্রয়িংরুম থেকে আনাসের বাবা ডেকে বললো,, কি ব্যাপার আমরা কি আজ উপোস করছি খাবার কি কেউ দিবেনা নাকি?
রাশেদা চৌধুরী হেসে বললেন আমরা কথা বলছি ওদের সহ্য হচ্ছেনা। আগে ওদের খাবার দিই গল্প পরে করবো বলে উনি বেরুতে নিলে লামিয়াও পিছু পিছু
গেলো। মায়ের সাথে হাত লাগিয়ে টেবিলে খাবার সাজালো। আনাসও ততক্ষণে এসে গেছে।
সবাই একসাথে খাবার টেবিলে বসেও গল্প জুড়ে দিলো। সবার খাওয়া শেষে যার যার রুমে চলে গেলো। লামিয়া শাশুড়ির সাথে আবারো সব কাজ গুছিয়ে নিলো। কাজের মেয়েটা না থাকার কারণে এখন নিজেদের কাজ নিজেদেরই করতে হচ্ছে।
লামিয়া রুমে যাওয়ার আগেই আদিবার কান্না শুনতে পেলো। কি ব্যাপার মেয়েটার তো এখন উঠার কথা না ভাবতে ভাবতে লামিয়া রুমের দিকে গেলো। গিয়ে দেখলো আনাস আদিবার পিঠে হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
লামিয়া বললো,,, কি হয়েছে আদিবা কাঁদছে কেনো?
-আরে বলোনা ঘুমের মাঝে ওকে একটু জড়িয়ে ধরেছি ওমনি কেঁদে উঠলো।
– ও এমনই। আসলে আমি ছাড়া ঘুমের মধ্যে কেউ ধরতে পারেনা কেমনে জানি ও বুঝে যায়।
-আনাস বিড়বিড় করে বললো,, হুম হয়েছে তো মায়ের মতো।
-লামিয়া আদিবাকে কোলে নিতে নিতে বললো,,, কি বললেন?
-না কিছুনা। ওকে ঘুম পাড়িয়ে একটু বারান্দায় এসো বলে আনাস বারান্দার দিকে চলে গেলো।
লামিয়া আদিবাকে ঘুম পাড়িয়ে কতক্ষণ ঝিম মেরে বিছানায় বসে রইলো। আনাসের সাথে কথা বলতে ওর কেমন কেমন জানি লাগছে। লজ্জায় নাকি অপরাধবোধের জন্য বুঝতে পারছেনা।
কিছুক্ষণ পর ধীর পায়ে নিঃশব্দে আনাসের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দুজনে অনেকদিন পরে এইভাবে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। অনুভূতিটা অন্যরকম।
আনাস লামিয়ার উপস্থিতি বুঝতে পেরে বললো,,, আদিবা ঘুমিয়েছে?
-হুম
তারপর কিছুক্ষণ দুজনে চুপ। নিরবতা ভেঙে আনাস বললো,,, কি হলো চুপ করে আছো যে?
-কি বলবো?
-কিছু বলার নেই?
-আপনিও তো চুপ করে আছেন।
-হুম তাইতো। ভালো আছো তুমি?
-আনাসের এইরকম প্রশ্নে লামিয়া হেসে দেয়।
-উফ!!! এমন করে হেসোনা কোথাও গিয়ে লাগছে!!
-আচ্ছা
-কি আচ্ছা?
-কিছুনা।
-একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
-হুম।
-সত্যি করে বলোতো,,, তুমি নিজে থেকে এসেছো নাকি কোনো দায়বদ্ধতা থেকে ?
– কোনো দায়বদ্ধতা থেকে নয় আমি নিজের ইচ্ছেতেই এসেছি।
-সত্যি?
-মিথ্যা কেন বলবো?? আপনি ভালো করে জানেন আমি মিথ্যা বলিনা।
-হুম।
-মনে হচ্ছে আমার উপর এখনো রেগে আছো?
-আপনার উপর আমার কোনদিন ও রাগ ছিলোনা। কাছের মানুষের উপর রাগ করা যায়না। যদি কিছু থাকে সেটা হলো,,, অভিযোগ আর অভিমান
-কিন্তু আমার মনে হয় তুমি এখনো রেগে আছো।
-আপনার এমনটা কেন মনে হলো?
-না এইযে নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলছো ভুল করেও তো আমার দিকে একবারো তাকাওনি।
-আসলে,,, অপরাধবোধের কারণে আপনার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছিনা।
-অপরাধবোধ!! কিসের?
-আসলে সেদিন আমি আপনার সাথে যা করেছি…
-আনাস লামিয়ার মুখে হাত রেখে বললো,, সেদিন তুমি যা করেছো বা বলেছো কিচ্ছু ভুল বলোনি। আমিও তো তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি। কিন্তু আমরা পিছনের কথা মনে করে আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যতটাকে নষ্ট করতে চাইনা। যা হয়েছে তার থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে চাই।
-তারপরও আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিবেন আমার এতোটা কঠিন আচরণ করাও ঠিক হয়নি বলে আনাসের হাত চেপে ধরলো।
-এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে!! এগুলা কি হ্যা!! বলেছিনা যা গেছে তা গেছে ওগুলো আর মনে করতে চাইনা।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আনাস বললো,,, আরেকটা কথা জানতে চাই সঠিক উত্তর দেবে?
-কি কথা বলুন।
-এখনো কি ভালোবাসো?
-কাকে?
-না বুঝার অভিনয় করছো কেনো? বলোনা?
-কেন আপনি বুঝেন না?
-না নতুন করে শুনতে চাই।
-হুম
-হুম কি?
-ভালোবাসি!!
-আবার বলো?
-ভালোবাসি!!
-আবার বলো?
-কি শুরু করেছেন কি?
-তুমি যতবার কথাটা বলো ততোবার বুকের এখানটায় গিয়ে লাগে বলে বুকের বাম পাশে হাত দিয়ে দেখালো
-ঢং!!
– ঢং না সত্যি ম্যাডাম জী!! চলো আগে একটা কাজ করি?
-কি কাজ?
-ভয় পেয়োনা এখনি কিছু করছিনা।
-আপনার তো দেখি আগের মতো মুখে কোন লাগাম নেই।
-আনাস শব্দ করে হেসে উঠলো।
চলো অযু করে আমরা মহান রবের দরবারে আমাদের আবার একসাথ করে দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতায় আর আমাদের অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে দু’রাকাঅাত শোকরানা নামাজ আদায় করি। তারপর তুমি আমাকে কোরআন পড়ে শুনাবে। কতদিন তোমার সেই সুরেলা কন্ঠের তেলাওয়াত শুনিনি।
আজকের পর থেকে আমরা আবার কোরআনের তা’লিম নেয়ার চেষ্টা করবো। একদিন তুমি আমাকে শুনাবে আর একদিন আমি এভাবে পালা করে একদিন আমরা পুরো কোরআন শরীফের তাফসীর সহ শিখে নিবো।
-আল্লাহ কবুল করুক।
দুজনে নামাজ আদায় করার পর লামিয়া আনাসের কাঁধে মাথা রেখে সূরা নূরের কিছু আয়াত তাফসীরসহ পড়ে শুনালো আর আনাস তা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চুপ করে শুনলো।
পড়া শেষ হতেই আনাস লামিয়ার হাত ধরে বললো,,,, প্রিয়তমা ঠিক এইভাবে তোমাকে নিয়ে তোমার হাত ধরে আমি চীর যৌবনের দেশ জান্নাতে যেতে চায় তুমি কি আমার সঙ্গী হবে?
-ইনশাআল্লাহ!!! আমি আপনার সাথে জীবনের বাকী দিনগুলো থেকে জান্নাতে যাওয়া পর্যন্ত সাথে থাকবো। জান্নাতেও শুধুই আপনার প্রিয়তমা হয়েই থাকতে চাই।
আর এভাবেই সমস্ত রাগ,, অভিমান,, অনুযোগ,, অভিযোগ কে পিছনে ফেলে দুজন মানুষ এগিয়ে চললো জান্নাতী ভালোবাসার সন্ধ্যানে।
—–‌‌‌‌‌সমাপ্ত—–
#আমার কথাঃ-
——————-আলহামদুলিল্লাহ অবশেষে শেষ হলো প্রিয়তমা গল্প। গল্পটা আগেই সাজানো ছিলো তাই কারো কোনো কথায় নয় একমাত্র নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়েই লিখে গেছি। জানিনা কতটুকু ভালো হয়েছে??
তবে আপনারা আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন বলেই আমিও লেখার আগ্রহ পেয়েছি,,, অনুপ্রেরণা পেয়েছি।
আমি যথাসম্ভব বড় করে লিখেছি। তারপরও অনেকেই বলেছেন পর্ব গুলো নাকি ছোট হচ্ছে,,, তাড়াতাড়ি শেষ করতেও বলেছেন। আমারও এতো দিন ধরে একটা গল্প লেখার ইচ্ছে ছিলোনা কিন্তু কি করবো বলেন তো সময় স্বল্পতার জন্য তা সম্ভব হয়নি। তারপর ও আপনারা অপেক্ষা করেছেন,, পড়েছেন আমি সত্যিই অভিভূত। কেননা পাঠকের সাড়া না পেলে কোন লেখক এগুতে পারেনা। আপনার আমার পাশে ছিলেন এটাই বড় পাওয়া। সবাই ভালো থাকবেন।
আমার ভালোবাসা নিবেন
আর
আমার জন্য দোয়া করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here