প্রিয়তমা পর্ব-২৬ ২৭

0
2174

#উপন্যাস
#প্রিয়তমা
২৬+২৭
(২৬তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
আজ লামিয়ার মা,, শায়লা আর ফারিহা মিলে নোয়াখালীর উদ্দেশ্য ভোর ছয়টার বাসে উঠেছে। লামিয়া যায়নি। এটা নিয়ে বাসায় মায়ের সাথে হুলস্থূল কান্ড হয়েছে। ওর খালামণি আর পলি ও ফোন করে অনেক রাগারাগি করেছে নানারকম ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছে। শেষমেশ ওদেরকে কোনমতে বুঝালো যে ও বিয়ের আগের দিন লাবিবের সাথে যাবে। চাইলে এখন স্কুল থেকে এতদিনের ছুটি নেয়া সম্ভব না।
আর সবচেয়ে বড় কথা ওখানে মানুষের কাছে হাজারো জবাবদিহি করতে হবে। গ্রামের মানুষের একটা স্বভাব কারো একটু দোষ পেলে সেটাকে তিল থেকে তাল বানিয়ে প্রচার করে।
সেইবার লামিয়া যখন ওর বাবার মৃত্যুর পর গ্রামে গিয়েছে বাবার মৃত্যুর কি শোক পালন করবে মানুষের কটু কথা শুনতে শুনতে আরো হাঁফিয়ে উঠেছে ও।
একজন বলে আহারে মেয়েটা কত ভালো অথচ সংসারটায় ভেঙে গেলো।
আরেক জন বললো এতো ভালো যখন তখন স্বামি ঘর থেকে কেনো বের করে দিবে। নিশ্চয় কোন ঘাপলা আছে।
আরেকজন বলে,, কেনো বের করছে কারো সাথে কথা টথা বলছো নিশ্চয়।
কেউ বলে হয়তো চরিত্রে দোষ আছে।
আরেকজন বলে আহারে বাচ্ছাটার কি হবে এই রকম হাজারো কথা শুনতে হয়েছে। এরপর থেকে আর গ্রামে যায়নি মনে মনে ভেবেছে আর যাবেনা। কিন্তু না যেয়ে ও উপায় নেই।
আনাস যখন পিয়াসের বিয়ের ব্যাপারে ওর মাকে জানালো। তখন উনি বললো,,, তোর যেটা ভালো মনে হয় কর। হয়তো লামিয়াকে পেয়ে ও যেতে পারিস আল্লাহ সহায় থাকলে ।
লামিয়া আর লাবিব বারোটার দিকে এসে পৌঁছালো। পুরো বাড়ী ডেকোরেট করা হয়েছে। হইহুল্লোড়ে সারা বাড়ী মুখরিত হয়ে আছে। লামিয়া বাড়ীর ভিতরে যেয়ে সবার সাথে দেখা করে ফ্রেশ হতে গেলো। আদিবা তো কয়দিন পরে মামি আর নানুকে পেয়ে খুশিতে আটখানা। হাসতে হাসতে একবার নানির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তো আবার মামির কাছে আবার খালামণির কাছে।
লামিয়া ওয়াশরুম থেকে বেরুতে ওর খালামণি বললো,,, লামিয়া তোর মেয়ে তো খুব দুষ্টু হয়েছে দেখছিস,, কিভাবে আমাকে ভেংচি কাটছে।
লামিয়া হেসে দিলো।
দুপুরে খেয়ে লামিয়া ঘুম দিলো। এসব হৈ হট্টগোল ওর একদম ভালো লাগেনা। ওদের কে বুঝাবে যে এসব গান বাজনা বিয়েতে ঠিক না!!!!
আনাস বিকাল চারটায় পিয়াসদের বাড়ি এসে পৌঁছালো। পিয়াস বাইরে এসে ওকে বাড়ীর ভিতর নিয়ে গেলো। পিয়াসের মায়ের সাথে কুশল বিনিময় করে আনাস ড্রয়িংরুমে বসে রইলো। লামিয়ার বাড়ীর কাউকে দেখতে পাচ্ছেনা। তবে কি ওরা কেউ আসেনি??? এত কষ্ট করে অনেক বড় আশা নিয়ে এসেছে সব কি বিফলে যাবে ?
পিয়াসকে জিজ্ঞেস ও করতে পারছেনা। আনাস সিদ্ধান্ত নিলো রাতে পিয়াসকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলবে। আজ তিনবছর ধরে একটা চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে বয়ে বেড়াতে বেড়াতে আজ ও হাঁফিয়ে উঠেছে। এ কথা গুলো আজ পর্যন্ত ও কাউকে বলতে পারেনি। না ওর পরিবারের কাউকে না কাছের কোন বন্ধুকে। এমন একটা ব্যাপার না কাউকে খুলে বলা যায়। তবে পিয়াসকে বলা যেতে পারে যেহেতু ও ঘরের মানুষ ও একটু হলেও বুঝবে।
পিয়াস এসে বললো,,,, কিরে বসে রইলি যে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয় আম্মু টেবিলে খাবার দিয়েছে চল চল।
আনাস খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়েছে পুরো একদিনের জার্নিতে শরীরে বেহাল দশা হয়ে গেছে।
লামিয়া ঘুম থেকে উঠে ওর মা খালামণির সাথে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে যখন শুনলো আনাস এসেছে বিয়েতে।
তোমরা যখন জানতে অন্য কেউ আসবে তখন আমাকে কেনো আসতে বলেছিলে?
-জোবায়েদা বললো,,,, আমরা কি জানতাম নাকি যে আনাস আসবে।
-তোমরা না জানলে ও খালামণি তো জানতো। সে তো আমাকে বলতে পারতো তাহলে আমি আসতাম না।
-ওর খালামণি বললো,,বিশ্বাস কর মা আমি জানতাম না। পিয়াস আমাকে কিচ্ছু বলেনি।
-তোমরা কেউ আসলে আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবেনা।
-লাবিব বললো,,, এরকম রাগ করছিস কেন। ভাইয়া এসেছে এসেছে। তুই তোর মত থাকলেই তো হবে।
-আমি থাকবোনা। আমার টিকেট করে দাও আমি আজ এক্ষুনি চলে যাবো। এ বাড়ীতে আমি আর একমুহূর্ত থাকবোনা।
-এরকম রাগ দেখাচ্ছিস কেন তোদের সম্পর্ক টা তো এখনো আছে। আর যা হয়েছে তাতে তো ভাইয়ার কোনো দোষ ছিলনা উনিও তো পরিস্থিতির স্বীকার।
-হুম সব দোষ আমার ছিল কারো কোন দোষ ছিলনা। আর কোন সম্পর্কের কথা বলছিস যে সম্পর্কের কোন অস্তিত্ব নেই সেই সম্পর্ক???
তোমরা কেউ আমাকে কখনো বুঝতে চেষ্টা করোনি।
-ফারিহা বললো,,, লামিয়া এরকম আচরণ করার কোন মানে হয়না। তুই তোর মতো থাকবি।
-বললাম না আমি থাকবোনা। আমার মেয়েকে এনে দাও আমি এক্ষুনি চলে যাবো। আর যাবো মানে যাবো কেউ আমাকে জোর করোনা এ বলে উঠে রেডি হতে গেলো।
-লামিয়ার খালামণি বললো,,,, মা আমার তুই রাগ করিসনা। আমি ভুল করেছি কিন্তু তুই এভাবে চলে গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। আমার কথাটা রাখ বিয়ের পরদিন তুই চলে যাস আমি তোকে আটকাবোনা। কিন্তু আজ তুই এভাবে চলে গেলে আমি খুব কষ্ট পাবো।
-সবসময় এই একটা জিনিসই পারো তোমরা দুইবোন। ওকে আমি থাকবো কিন্তু আমি বিয়ের পরদিনই চলে যাবো তোমাদের বউভাতে ও আমি থাকতে পারবোনা।
-আচ্ছা তা দেখা যাবে। এখন তো একটু শান্ত হ।
-আমার মেয়েকে ভুলেও উনার সামনে নিবেন না। আর কেউ উনাকে ওর বা আমার ব্যাপারে কিছু বলবেন না। নাহলে কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যাবে বলে দিলাম।
– পলি বললো,,,হুম আপনি যা বলবেন তাই হবে আপুনি। এখন গিয়ে আপনি মাথায় একটু পানি দিয়ে মাথাটা ঠান্ডা করুন কিছুক্ষণ পর হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে।
-তোদের অনুষ্ঠান তোরা কর। আমাকে এসবের মধ্যে একদম ডাকবিনা।
-তুই আগের মতই রয়ে গেলি। পরিবর্তনের মাঝে হলো অনেকটা কঠিন হয়ে গেছিস।
-আমি আগের মতই আছি এখন তোরা সবাই এখান থেকে যাবি আমার মাথাব্যাথা করছে।
সবাই চলে যেতেই লামিয়া পিছন থেকে শায়লাকে ডেকে বললো,,, ভাবি আদিবাকে একটু আমার কাছে দিয়ে যেয়ো।
নাকের মধ্যে শুড়শুড়ি লাগাতে আনাসের ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো দুটি ছোট ছোট হাত ওর সারামুখে ছুঁয়ে দিচ্ছে। আনাসকে তাকাতে দেখেই বাচ্ছাটা হি হি হি করে হেসে উঠলো। আনাস ও হেসে দিলো। আনাসকে হাসতে দেখেই ও আরো শব্দ করে হেসে দিলো। ভারী দুষ্টু মেয়েতো দেখো হাসছে কেমন করে!!!
আনাস ওকে কোলে নিয়ে নাকের সাথে নিজেরনাক ঘষে দিলো। আদিবা আবারো শব্দহেসে উঠলো। কি সুন্দর করে হাসে!! আনাসের মজা লাগছে বাচ্ছাটাকে এভাবে হাসাতে।
কার বাচ্ছা কে জানি?? কি সুন্দর হাসি,,, ভাঙা ভাঙা গলায় কথা বলা আমার মত অপরিচিত মানুষের কাছে এসে ও কেমন কোলে চড়ে বসেছে। আনাসের মনে হলো ও এ বাচ্ছাটাকে কোথাও দেখেছে!! কিন্তু কোথায় মনে পড়ছেনা!!
ওহ হ্যা মনে পড়েছে সেদিন মার্কেটে দেখেছি ওকে। সেদিন ও তো এভাবে এসে আমাকে পিছন থেকে টানছিলো।
কিন্তু ও এখানে কেন?? কার সাথে আসলো???হবে হয়তো পিয়াসদের কোন আত্মীয়।
লাবিব আদিবা বলে ডাকতে ডাকতে পিয়াসের রুমে ডুকলো। আদিবাকে আনাসের কোলে দেখে লাবিব একটু থমকে দাঁড়িয়ে গেলো।
লাবিব মনে মনে বললো,,,,সর্বনাশ!!! মেয়েটা এসেছে এসেছে তো একেবারে জায়গামতো এসেই উঠেছে।
আনাস লাবিবকে দেখে লজ্জিত হয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। এদের কারো চোখে চোখ রেখে কথা বলার ক্ষমতা ওর নেই। তারপর আদিবাকে কোলে নিয়ে খাট থেকে নেমেই লাবিবকে সালাম দিলো।
লাবিব সালামের জবাব দিয়ে নিজেও সালাম দিলো। তারপর কুশল বিনিময় করে সৌজন্যবোধ রক্ষা করলো। যত যাই হোক পুরো ব্যাপারটাতে লামিয়ার যেমন দোষ নেই তেমনি আনাসও নির্দোষ। ওরকম পরিস্থিতিতে কোন মানুষ স্বাভাবিক থাকেনা। ভুল বুঝতেই পারে তবে উনার উচিত ছিল সত্য মিথ্যা যাচাই করা দোষ থাকলে এতটুকু। কিন্তু তাই বলেতো উনার সাথে খারাপ আচরণ করা যায়না। সম্পর্ক তো এখনো নষ্ট হয়নি। উনি এখনো লামিয়ার হাজবেন্ড আছে।
আদিবা মামাকে দেখতে পেয়ে মাম,,,মা বলে লাবিবের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
লাবিব বললো ও এখানে এলো কখন?? আর ওদিকে আমরা ওকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। আদিবার গাল টেনে বললো,,, বুড়ি,, অনেক দুষ্টু হয়ে গেছিস কিন্তু তুই। আদিবা সাথে সাথে লাবিবের গালও টেনে দিলো।
আচ্ছা ভাইয়া থাকেন পরে কথা হবে আমি ওকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে আসি।
বাব্বাহ ভারী দুষ্টু মেয়ে সবাই যাই করবে তাই করবে। আনাস ওদিকে তাকিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলো। এটা কার বাচ্ছা হতে পারে লাবিব ভাইয়াকে মামা বলে ডাকলো। ফারিহা আপুর না না উনার মেয়েতো আরো বড়। পিয়াসের বোনেরও তো একটাই ছেলে। তাহলে কার???
লামিয়া কি আবার বিয়ে কর,,,, না না এটা হতে পারেনা ছি,, ছি,, কি ভাবছি আমি। ও ওরকম মেয়ে নয়। আর ওর সাথে এখনো আমার সম্পর্ক টা জোড়া লেগে আছে। হবে হয়তো উনাদের অন্য কোন আত্মীয়ের। কিন্তু আমি এত কেন ভাবছি!! এই বাচ্ছাটাকে কেমন আপন আপন মানুষের মত লাগছে আমার। মনে হচ্ছে ওর সাথে আমার কোন টান আছে। হয়তো লামিয়ার সাথে আমার স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকলে হয়তো আজ আমার ও এরকম একটা বাচ্ছা থাকতো বলে আনাস একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মানুষের জীবন কেন এত কঠিন হয়ে যায়!!!
একদিন যার সামনে নিঃসংকোচে সব কথা বলা যেতো আজ তার সামনে দাড়ানোর সাহস আমার নাই!!!!
লাবিব এসে যখন সবাইকে আদিবার আনাসের কাছে যাওয়ার কথা বললো লাবিবের মত সবাই ও বিষ্মিত হয়ে গেলো। ওর খালামণি বললো,,, রক্ত রক্তকেই টানে বুঝলি!! নয়তো বাড়ীতে এতো এতো মানুষ থাকতে ও আনাসের কাছে কেন যাবে??? রক্তের টান এমনই আমরা আনাসের কাছ থেকে ওকে সরিয়ে রাখতে চাইছি আর ও ঠিক ওর কাছেই গিয়ে উঠলো।
-জোবায়েদা বললো,,, যা হয়েছে হয়েছে সবাই এখানে ভুলে যা কথাটা। ওর কানে কথাটা গেলে এক্ষুণি চলে যাবে। খবরদার কেউ বলবিনা। আমি চাইনা এখানে কোনো ঝামেলা হোক।
উপরে হলুদের অনুষ্ঠান চলছে লামিয়া দরজা আটকে আদিবাকে ঘুম পাড়িয়ে নামাজ শেষ করে আদিবার ছোট্ট দুটি হাতে মেহেদী পরিয়ে দিলো। আনাস আসার খবর শুনার পর থেকে ও একবারো রুমের বাহিরে বের হয়নি। খাবারটা ও রুমে এনে খেয়েছে।
হলুদের অনুষ্ঠান শেষে পিয়াস রুমে আসতেই আনাস বললো,,, পিয়াস আমার তোর সাথে কিছু জরুরী কথা আছে।
-কি কথা??
-লামিয়ার ব্যাপারে
-দেখ আনাস!! আমি তোকে শুধু এখানে আমার বন্ধু হিসাবে ইনভাইট করেছে। ওইসব কিছু আমি এখন শুনতে চাইনা।
-কিন্তু আমার তোকে বলতেই হবে প্লীজ। আমি আর এসব বয়ে বেড়াতে পারছিনা।
-বাদ দেনা আমার এসব শুনতে ইচ্ছে করছেনা।
-আমি জানি তুই এড়িয়ে যাচ্ছিস। আমার উপর তোর অনেক রাগ ও কিন্তু বলতে পারছিস না। ভাই আমার তুই আমার কথাটা তো শুন। তারপর যা ইচ্ছে বলিস!!
-কি বলবি বল?
-আনাস প্রথম থেকে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা পিয়াসকে খুলে বললো।
-পিয়াস সব শুনে বললো,,, তুই আমাকে আগে কেন সব জানাসনি?? আর তুই একবারো এটা কেন চিন্তা করলিনা যে এখন প্রযুক্তির যুগ মানুষ চাইলে যা খুশি তাই করতে পারে প্রযুক্তির অপব্যবহার করে।
-সে কথা বলে আমাকে আর কষ্ট দিসনা। তখন আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু এখন আমার ওর সাথে কথা বলাটা বড্ড জরুরী।
-তুই চাইলেও লামিয়া হয়তো তোর সাথে কথা বলবেনা। আগের লামিয়া আর এখনকার লামিয়ার মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। খালু মারা যাওয়ার পর থেকে তো ও আরো কঠিন হয়ে গেছে।
-কে,,, কে মারা গেছে???
-লামিয়ার বাবা।
-কি বলছিস?? কবে???
-আজ থেকে নয়মাস আগে। আর লামিয়া ওর বাবার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করে। ওর ধারনা ওর জন্য চিন্তা করতে করতে খালু মারা গেছে।
-কি বলছিস এসব?? এসব কিছুর জন্য আমিই দায়ী বলে আনাস দুহাতে মুখ ডেকে ফেললো।
-আরো একটা কথা তুই জানিস না???
-কি কথা???
-তুই যখন লামিয়া কে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিস সেদিন লামিয়া অন্তর্স্বত্ত্বা ছিল। তোর অনাগত সন্তান তার গর্ভে ছিলো।
-তুই কি বলছিস কি??? অন্তর্স্বত্ত্বা মা,,, মানে???
-হুম আর আদিবাই তোর সন্তান।
-আ,,আদিবা আ,,আমার সন্তান। আমার সন্তান আদিবা। সেই জন্যইগো ওকে আমার এতো আপন লাগছিলো। ও সত্যি আমার সন্তান??
-হুম আদিবা তোরই সন্তান।
-কি করলাম আমি??? কি করলাম??? ও কেনো আমাকে এসব খুলে বলেনি???
-হয়তো তুই সুযোগ দিসনি বলার।
আদিবার জন্মের সময় লামিয়ার জীবন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ফিরেছিলো। ডাক্তার তো বলছে মা আর বেবি সবার জীবন সংকটাপন্ন। সবাই তো আশা ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আল্লাহর রহমত ছিল বিধায় ফিরে এসেছিলো।
-আনাস পিয়াসকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছিরে অনেক বড় অপরাপ!!! যার কোনো ক্ষমাই নেই। না পারলাম ওর স্বামি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে আর না পারলাম সন্তানের বাবা হওয়ার যোগ্যতা। অপরাধের বোঝাটা যে অনেকটা বেড়ে গেছে। আছে কি এর কোন ক্ষমা?
পিয়াস তুই একবার আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দে প্লিজ। প্রয়োজনে ওর পা ধরে ক্ষমা চাইবো।
-লাভ নাইরে। তুই এখানে আসছিস শুনে বিকালে যে কান্ডটাই করলো আমার মনে হয় না ও তোর সাথে কথা বলবে।
-প্লিজ তুই একটু চেষ্টা করনা!!
-আমার মনে হয় তোর খালামনি আর লাবিবের সাথে একবার কথা বলা দরকার। তুই বস আমি ওদেরকে ডেকে আনছি।
-কি বলছিস তুই আমি উনাদের সাথে কোন মুখে কথা বলবো।
-যে মুখ দিয়ে বলার বলবি। এই মুহূর্তে উনাদের সাথে কথা বলাটাই আগে দরকার।
-কিন্তু উনারা কি আমার সাথে…
-খালামণিকে আমি ভালো করে চিনি উনি ঠিকক তোর ব্যাপারটা বুঝবে। তুই বস আমি আসছি।
পিয়াসের রুমে চারজন মানুষ বসে আছে কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই চুপচাপ হয়ে আছে
জোবায়েদা চিন্তায় পড়ে গেলো এই মুহুর্তে কি বলবে?? কি বলা উচিত ছেলেটাকে???
আনাস জোবায়েদার হাত চেপে ধরে বললো মা,,, অন্তত আপনি আমাকে একটু বুঝতে চেষ্টা করুন।
-বাবা আমাদের কারো তোমার উপর কোন রাগ নেই। তুমিও তো পরিস্থিতির স্বীকার। কিন্তু মেয়েটা কষ্ট সহ্য করতে করতে এখন পাথরে পরিণত হয়েছে। আমার মনে হয়না ও রাজি হবে তোমার সাথে কথা বলতে।
-মা একবার আপনি চেষ্টা করুন না। আপনার কথা ও ফেলতে পারবেনা।
-আচ্ছা আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো জানিনা রাজি হবে কিনা।
লামিয়া পানি খেতে ডাইনিংয়ে আসছিলো রুমে পানি ছিলোনা। পিয়াসের রুমের পাশ দিয়ে যেতে মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে পড়লো। এতো রাতে মা এই রুমে কি করছে??? কিছুটা খটকা লাগায় লামিয়া ওখানে দাঁড়িয়ে সব শুনলো।
মায়ের বের হওয়ার আওয়াজ বুঝতে পেরে লামিয়া দৌঁড়ে এসে রুমে ডুকে দরজা আটকে দিলো। তার মানে আমার অগোছরে এসব হচ্ছে!!!
মা তুমি যত চেষ্টাই করোনা কেন আমি ওই মানুষটার সাথে কথা বলবোনা। যখন আমার ওই মানুষটার সাহচর্যের দরকার ছিলো তখন যখন তাকে পাইনি আজো দরকার নেই। আমি বাকিটা জীবন এভাবেই পার করতে পারবো। দরকার নেই কারো সহানুভূতির আমার!!! কোন দরকার নেই!!
সকাল থেকে লামিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা না আদিবা আছে না লামিয়া। পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখা হয়েছে কোথাও ওদের দেখা নেই। এদিকে ওর ফোনটাও বন্ধ। শায়লা রুমে এসে দেখলো লামিয়ার লাগেজটা ও নেই। তার মানে যে ভয়টা ছিল শেষ পর্যন্ত তাই হলো………..
চলবে………

#উপন্যাস
#প্রিয়তমা (২৭তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
আনাস যখন শুনলো লামিয়া বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে তখন থেকে ওর কষ্টটা আরো বেড়ে গেলো। দরজা আটকে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে অনেকক্ষণ যাবত। এতটা কষ্ট ওর কখনো হয়নি যতটা লামিয়াকে কষ্ট দিয়ে আজ নিজে পাচ্ছে। ও কখনো চোখের পানি ফেলতোনা কিন্তু লামিয়াকে ভুল বুঝে আজ তিনবছর যাবত এই চোখের পানি ওর নিত্যসঙ্গী। লামিয়া কি করে পারলো এভাবে পালিয়ে যেতে??
এতটা কঠিন না হলে কি হতোনা?
এতটা পরিবর্তন কেন হয়েছো????
ওরকম একটা ছোট বাচ্ছাকে নিয়ে কি করে বেরিয়ে গেলো একা একা। আনাস নিজেও চলে যাওয়ার জন্য সব গুছিয়ে নিলো। কি করবে আর এখানে থেকে? যার জন্য আসা সেই যখন আমার কাছ থেকে পালিয়ে গেলো তখন আমি আর কি করবো এখানে।
অনেকক্ষণ ধরে দরজা নক হচ্ছে। আনাস চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে দরজা খুললো জোবায়েদা এসে বললো,,, বাবা তুমি আবার কোথায় যাচ্ছো?
-আমি চলে যাচ্ছি মা। ওর সাথে আমার কথা বলতেই হবে।
-বাবা তুমি এতো পেরেশান হয়োনা। আসলে অনেক জিদ্দি হয়ে গেছে এখন মেয়েটা। হয়তো কাল রাতে আমাদের কথা শুনে ফেলেছে এজন্য সবাই উঠার আগে বাড়ি ছেড়েছে। আর এ মুহূর্তে তুমি ওর পিছু পিছু গেলে ও তুলকালাম বাধিয়ে ফেলবে। রাগের মাথায় কি বলতে কি বলে ফেলে তার ঠিক নাই। তুমি থাকো এখানে পরিস্থিতি ঠান্ডা হোক। আমি বাসায় গিয়ে ওকে একটু ভালো করে বুঝাবো। তুমি চিন্তা করোনা আমরা সবাই আছিতো।
-মা লামিয়াকে কি ফোনে পেয়েছেন??
-না এখনো পাইনি। তবে সবাই চেষ্টা করছে। আর বিয়ে বাড়ীতে আমরা এতো পেরেশানি দেখালে সবাই খারাপ ভাবতে পারে তাই সবকিছু আগের মত স্বাভাবিক থাকাই ভালো।
ফারিহা বাহিরে দাঁড়িয়ে বললো,,, আম্মু একটু এদিকে আসবে??
-হুম আসছি বলে জোবায়েদা বেরিয়ে এলো।
কিরে কি হয়েছে?
-লামিয়া ফোন করেছে। তোমার সাথে কথা বলবে।
-হুম দে
-এখানে না আগে রুমে আসো
রুমে গিয়ে জোবায়েদা ফোন ধরেই,,,
লামিয়া এটার মানে কি?? কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিস কেন??
-আম্মু আমি এখনো সেই ছোট্ট লামিয়া নেই।
-হুম আমার মেয়েতো এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। কারো কোন কথার দাম তার কাছে নাই।
– ওপাশ থেকে লামিয়া বললো,,,, আম্মু উল্টোপাল্টা কথা বলবেনা। আজ পর্যন্ত এমন কখনো হয়নি যে আমি তোমাদের কোনো কথার অমান্য হয়েছে। যখন যাই বলতে বাধ্য মেয়ের মত মেনে নিতাম কখনো এই নিয়ে কিছু বলতামনা। কিন্তু আজ যখন আমি বারবার করে নিষেধ করা সত্ত্বেও তোমরা আমার আর আদিবার ব্যাপারে উনাকে বলে দিয়েছো তখন তোমাদের কথা অমান্য না করে আমার উপায় ছিলোনা। আমি কোনো সার্কাসের ঘোড়া না যে যখন যেদিকে আমাকে ঘুরাবে আমি সেদিকেই ঘুরবো। এটা একদম ভালো করোনি আম্মু ।
তোমরা শুধু তার দিকটায় দেখেছো তার কষ্টগুলোতে ব্যথিত হচ্ছো। এই তিনবছরে আমার কষ্টগুলো তোমাদের কাউকে স্পর্শ করতে পারেনি। খুব ভালো করেছো,, খুব ভালো করছো এই না হলে তোমরা আমার মা,, বোন,, ভাই। যারা আমার আপনজন তারাই আজ আমার সাথে এমন করলো!!!
তবে একটা কথা ভালো করে শুনে রাখো,,,, আমি ঢাকা ফিরে যাচ্ছি আদিবাকে নিয়ে। খবরদার!! তাকে যদি আমার পিছনে পাঠিয়েছো বা বাসার ঠিকানা দিয়েছো তবে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে তোমাদের বাসা ছেড়ে দুচোখ যেদিকে যায় চলে যাবো বলে দিলাম।
-তুই আমার কথাটা তো একবার শুনবি। এভাবে কাউকে না বলে একা একা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া তোর একদম ঠিক হয়নি
– বলে আসলে কি তোমরা আমাকে আসতে দিতে??? আমি খুব ভালো করে জানতাম কি করতে তোমরা?? আর শুনো,,, তোমাদের কারো কোন কথা শুনার ইচ্ছে এখন আমার নেই। একটা কথা ভুলে যেওনা। তোমার মেয়ে এখন আগের মত সহজ সরল নেই। আজ তিনবছর একাকীত্বের সাথে যুদ্ধ করতে করতে সে এখন একা একা চলার অভ্যাস গড়ে নিয়েছে। আমাকে নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবেনা। রাখছি আমি বলে লামিয়া লাইন কেটে ফোন বন্ধ করে দিলো।
জোবায়েদা কান থেকে ফোন নামিয়ে বললো,,, এই মেয়েকে নিয়ে আর পারিনা। মনে হচ্ছে ও একাই কষ্ট করেছে আমরা কেউ কষ্ট পাইনি?? যত্তসব!!!
-ফারিহা বললো,,, আম্মু এখন কি করবে??
-কি আর করবি বিয়েতে এসেছিস আনন্দ ফুর্তি কর!!!
-এরকম বলছো কেন??
-এই তুই যাতো আমার সামনে থেকে। দুই বোন হয়েছিস দুই রকম। যাকে নিয়ে আমার চিন্তা করার কথা ছিলনা আজ তাকে নিয়েও আমাকে এত পেরেশানি হতে হচ্ছে। তোদের বাপ তো মরে গিয়ে বেঁচেছে আর আমাকে রেখ গেছে তোদের এসব যন্ত্রণা সহ্য করতে। আর পারিনা আমি এসব নিতে বলে উনি কেঁদে দিলো।
বিয়ের এই দুদিন আনাসের অনেক কষ্টে কেটেছে। কি জন্য এসেছে আর কি হয়ে গেলো!!!!
বিয়ের পরদিন আনাস সকালেই বেরিয়ে গেছে। দুপুরের পর লাবিবরা বেরিয়েছে। জোবায়েদার অনেক ইচ্ছে ছিলো বোনের কাছে কয়দিন থাকবে কিন্তু লামিয়ার কথা ভেবে আর থাকলোনা। কে জানে বাসায় কি করছে একা একা???
আনাস বাসায় ফিরে যখন সব জানালো তখন ওর বাবা মা দুজনে হতভম্ব হয়ে বসে থাকলো।
রাশেদা বললেন,,,, এতকিছু হয়ে গেলো আর ওরা আমাদের এতটুকু জানোনোর প্রয়োজন বোধ করেনি। আমার একটা নাতনি হয়েছে এটা ওনারা লুকালো কি করে???
এতদিন আনাসের বাবা এসব ব্যাপারে কিছু বলেনি। কিন্তু আজ আর চুপ করে থাকতে পারলোনা বললো,,, উনারা তোমাদের জানাবে কি করে??
তোমার ছেলে জানানোর মত কোন পথ খোলা রেখেছে??? দিনের পর দিন মেয়েটা কষ্ট করে গেছে কাউকে বলতে পারেনি। তোমার ছেলে তাকে বাড়িতে আনবেনা,, কিন্তু কেন আনবেনা,, কি জন্য আনবেনা কিছু বলেছে আমাদের?? তার মনে হলো সে বউ রাখবেনা তাই তাড়িয়ে দিয়েছে এখন তার আবার মনে হলো সে তাকে নিয়ে আসবে।
কেন মেয়েটার কি কোন ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই???
মেয়েটার যখন আমাদের সবাইকে ওর পাশে রাখার দরকার ছিল তখন পায়নি এখন কেন সে আসবে???
-আব্বু তুমি আমার কাটা গায়ে লবনের ছিটা দিচ্ছো??
-কাটা গায়ে লবনের ছিটে দিচ্ছিনা। যা সত্যি তাই বলছি। আমার মনে হয় এ শাস্তিটা তোর প্রাপ্য।
-রাশেদা বললেন,,, আহ!!! কি শুরু করেছোটা কি?? দেখতেছো ছেলেটা কষ্ট পাচ্ছে তার উপর তুমি এসব বলে যাচ্ছো। কোথায় একটা সমাধানের পথ বের করবে তা না উনি বক্তৃতা দিতে শুরু করছে।
-আমি এসবের মধ্যে নেই। তোমার ছেলে যখন দোষ করেছে তখন তাকেই বলো তার বউকে ফিরিয়ে আনতে। আমাকে এসবের মাঝে টানাটানি করবেনা।
-আচ্ছা তুমি কি ওর বাবা নাকি পর কেউ?? কোথায় মেয়েটাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে তা না।
-আমি যেতে পারবোনা। তোমার যেতে হলে তুমি যাও।
-হুম আমিই যাবো। ছেলে তো আমারি আমার ছেলের কষ্ট আমার সহ্য হয়না। আমি যাবো আমার নাতনি আর বউমাকে ফিরিয়ে আনতে তোমাকে যেতে হবেনা।
-না মা তোমাদের কাউকে যেতে হবেনা। আমিই যাবো ভুল যখন আমি করেছি তখন তা আমিই সমাধান করবো।
-তুই তোর বাবার কথায় কষ্ট পেয়েছিস??
-না মা বাবার কথায় কষ্ট পাবো কেন??? বাবা তো ভুল কিছু বলেনি। আর লামিয়া অনেক পাল্টে গেছে মা। ও আর আগের লামিয়া নেই জানিনা কি করে এ বরফ গলাবো বলেই আনাস উঠে চলে গেলো।
জোবায়েদা বাসায় আসার পর থেকে লক্ষ্য করেছে লামিয়া আগের মতো চুপচাপ হয়ে গেছে নিজের মত চলাফেরা করে স্কুল যায় আসে। সেদিনের ব্যাপারটা নিয়ে কাউকে কিচ্ছু বলেনি।
জোবায়েদা তো ভয়ে ছিলো না জানি বাসায় আসার পর কি বলে বসে। কিন্তু লামিয়াকে স্বাভাবিক দেখে উনার প্রাণ ফিরে এসেছে মনে হয়।
শায়লা বললো,,, মা কি ব্যাপার আপনার মেয়ে এতো শান্ত কেন???
-বুঝতে পারছিনা বউমা এতো স্বাভাবিক তাতো আমারও প্রশ্ন??
-মা আপনি কি একবার ওর সাথে কথা বলে দেখবেন???
-কোন ব্যাপারে??
-আনাস ভাইয়ের ব্যাপারে।
-না এখনি না আরো কয়দিন যাক আগে ওর মতিগতি বুঝি।
শাশুড়ির সাথে কথা শেষ করে আদিবাকে ঘুম পাড়িয়ে শায়লা কিচেনে গেলো দুপুরের রান্না করতে। কিছুক্ষণ পরে কলিংবেলের শব্দে শায়লা কিচেন ছেড়ে বেরিয়ে এলো কি ব্যাপার এই অসময়ে আবার কে এলো?? এসব ভাবতে ভাবতে শায়লার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভিতর থেকে দেখার চেষ্টা করলো বাহিরে কে আছে। আনাসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেয়ে শায়লা একরকম দৌড়ে শাশুড়ির রুমের দিকে গেলো।
শায়লা সেদিন পিয়াসের বিয়েতে কথার ফাঁকে একবার একটু দেখেছে তাই জন্য চিনতে পেরেছে।
জোবায়েদা শায়লার কাছে কথাটা শুনে মাথার কাপড় ঠিক করে শায়লাকে নাস্তা রেডি করতে বলে দরজার দিকে গেলো।
দরজা খুলেই আনাসকে দেখে বলে উঠলেন,,, আরে বাবা তুমি???
-আনাস সালাম দিয়ে বললো,, কেন মা আসতে পারিনা নাকি??
-আরে না না আসবেনা কেন তোমার যখন খুশি তখনি আসবে। এসো ভিতরে এসো।
আনাস ভিতরে এসে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বললো,,, আদিবা বাসায় নেই মা???
-আছে ও একটু আগেই ঘুমিয়েছে। তুমি বসো।
আনাস সোফায় বসতে বসতে বললো,,, আসলে আদিবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাই নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে চলে এলাম। আপনি রাগ করেন নি তো।
-আরে রাগ করবো কেন?? তোমার মেয়েকে তুমি দেখতে আসবে এতে আমার রাগ করার কি আছে??
যাও আদিবা ওই রুমে ঘুমিয়ে আছে বলে উনি ইশারায় লামিয়ার রুম দেখিয়ে দিলো।
আনাস বুঝতে পারলো এটা লামিয়ার রুম তাই যেতে একটু ইতস্তত বোধ করছে।
জোবায়েদা তা বুঝতে পেরে বললো,,, আরে তুমি যার জন্য যেতে চাচ্ছোনা সে এখন বাসায় নেই তাই নির্ভয়ে যেতে পারো।
আনাস শাশুড়ির কথায় আশ্বস্ত হয়ে সামনে এগুলো। জোবায়েদা শায়লার সাথে নাস্তা বানাতে কিচেনের দিকে গেলো। জামাইটা অনেকদিন পর এ বাড়িতে পা রাখলো।
আনাস দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো,,, খাটের মাঝখানে একটা ছোট্ট পরী ঘুমিয়ে আছে। আনাস মনে মনে বললো,,, এই ছোট্ট পরীটাই আমার একটা অংশ।
আনাস আস্তে আস্তে খাটের দিকে এগুলো। বাব্বাহ!!! ঘুমানোর কি স্টাইল!!
দুইহাত গালের নিচে দিয়ে এক কাত হয়ে হয়ে ঘুমিয়ে আছে। কি নিঃষ্পাপ চেহারা। সারা মুখ জুড়ে মায়া ছড়িয়ে আছে।
আনাস বললো,,, কি করে পারলাম তোদের থেকে দূরে সরে থাকতে?আনাস আবেগ লুকাতে না পেরে ঘুমন্ত আদিবাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলো।
কেন সেদিন তোর মাকে একটু বুঝার চেষ্টা করলাম না? সেদিন আমার একটা ভুলের জন্য আনাদের তিনজনকে আজ বিচ্ছিন্ন জীবন কাটাতে হচ্ছে। আজ আমি চাইলেও তোকে একটু কোলে নিতে পারবোনা,, জড়িয়ে ধরতে পারবোনা,, আদর করতে পারবোনা নিজের অপরাধ বোধের জন্য। আজ তোর মায়ের সামনে আমি দাঁড়াতে পারিনা নিঃসংকোচে। তার কাছে আজ আমি একজন কঠিন মাফের অপরাধী যে আজ আমার কথাও শুনতে চাইনা। তুই কি পারবিনা তোর মা আর বাবার মাঝের দেয়ালটা ভেঙে দিতে??
শাশুড়ির ডাকে আনাস চোখ মুছে উঠে বসলো।
বাবা নাস্তা করতে আসো।
-না মা আমি কিছু খাবোনা। আদিবাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাই চলে এলাম। আমি এক্ষুণি চলে যাবো।
-এ কেমন কথা??? আমার বাসা থেকে তুমি না খেয়ে যাবে এটা তো আমি মানবোনা।
আর মেয়েকে কোলে না নিয়েই চলে যাবে???
-আনাস ছল ছল চোখে শাশুড়ির দিকে তাকালো। এতক্ষণ যেন ও এ কথাটার অপেক্ষার করছিলো।
-আরে এভাবে তাকানোর কি আছে ও তো তোমার মেয়ে।
ওদের কথার মাঝখানে আদিবা উঠে গেলো। আনাসের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিলো। আনাস ওকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরলো আদিবা যে ওরই রক্ত। আর আদিবা ও বাবার বুকে চুপটি করে শুয়ে রইলো। যেন এটাই এখন ওর সবচেয়ে শান্তির জায়গা।
-জোবায়েদা ওদের বাবা মেয়ের মিলনদৃশ্য দেখে চোখের কোনে আসা পানিটা হাত দিয়ে মুছে নিলো। কখনো দেখেনি মেয়েটা বাবাকে চিনেও না অথচ কেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বাবার বুকের সাথে। সম্পর্কের টান এমনই হয়।
আল্লাহ যেনো ওদের মাঝের সব সমস্যা দূর করে এই বাচ্ছাটার উচিলায় ওদের আবার সম্পর্কের বাঁধনে বেঁধে ফেলে এটাই আল্লাহর কাছে চাওয়া।
তারপর হেসে হেসে বললো,,দেখছো কি ভদ্র মেয়ে!!! প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে কি কান্নাকাটি করে ওকে সামলাতেই আমাদের বউ শাশুড়ির অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। আর আজ বাবাকে দেখেই ঘুম থেকে উঠেই হাসে এখন আবার কত ভদ্র সভ্য হয়ে আছে। মনে হয় যেন এত ভালো মানুষ আর নেই।
নানুর কথা শুনে আদিবা বাবার বুক থেকে মুখ তুলে হি হি করে হেসে দিয়ে আবারো বাবার মুখে মুখ লুকালো।
-কি দুষ্টু মেয়েরে!!!
আনাস ও সাথে সাথে হেসে দেয়।
-জোবায়েদা আদিবাকে বললো,,, নানু তুমি কার কোলে গিয়েছে।
-বাবা।
-ও তোমার কি হয়??
-বাবা
আনাস আর জোবায়েদা আদিবার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। এইটুকু মেয়ে কি করে এটা বলতে পারলো??
ওকে তো কেউ শিখিয়ে দেয়নি তাহলে???
আনাসকে তো ও এর আগে দুুএকবার দেখেছে তাতেই বাবা চিনে ফেললো। আনাস মেয়ের কথাই আনন্দে কেঁদে দিলো। এই প্রথম বাবা ডাক শুনলো সন্তানের মুখে। সন্তানের মুখে বাবা ডাক শুনার যে এতো আনন্দ জানা ছিলোনা। আর আমি দুই বছর ওর কাছ থেকে দূরে ছিলাম!!
এখন তো ওকে ছেড়ে আমি থাকতেই পারবোনা।
কি করে ওকে ছেড়ে যাবো? ইচ্ছে করছে সাথে করে নিয়ে যাই কিন্তু ওর যে দজ্জাল মা এমনিতেই আমাকে সহ্য করতে পারেনা এখন তার মেয়েকে নিয়ে গেলে আমার বারোটা বাজিয়ে দেবে।
শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,,, মা আমি যদি মাঝে মাঝে আদিবাকে দেখতে আসি আপনাদের কোন সমস্যা হবে নাতো??
-আরে তোমার মেয়েকে তুমি দেখতে আসবে আমাদের এতে আমাদের সমস্যা থাকবে কেন। নিজের বাড়ি মনে করেই চলে আসবে। এখন চলো নাস্তা করবে কথা পরেও বলা যাবে।
আনাস ড্রয়িংরুমে সোফায় রাখা ব্যাগ গুলো শাশুড়ির দিকে এগিয়ে দিলো। মা আমি এখানে আমি আদিবার জন্য কিছু জামা কাপড় আর খেলনা এনেছি।
-এগুলো আবার কেন এনেছো।
-মা আমার মেয়ের জন্য আমি এই সামান্য কিছু ও আনতে পারবেনা।
-না বাবা কথা তা নয় আসলে লামিয়া জানতে পারলে…
-মা আপনারা কিছু একটা বলে বুঝিয়ে নেবেন আমার কথা না বললেই তো হবে।
তারপর কিছুটা সংকোচ নিয়ে বললো,,, লামিয়া কখন ফিরবে?? আসলে ওর ভয় হচ্ছে লামিয়া যদি এসে পড়ে আর ওকে যদি বাসায় দেখে কি রিয়্যাক্ট করে সেই জন্য্
-ও তো দুইটার দিকে আসে তুমি চিন্তা করোনা এখনো দেরি আছে।
কিন্তু কথায় আছেনা,,, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয় হলো ও তাই।
কলিংবেলটা বিকট আওয়াজে বেজে উঠলো আর তার সাথে আনাসের বুকের ভিতর ও ভয়ে ধ্বক করে উঠলো………
চলবে………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here