প্রিয়তমা পর্ব-২৮ ২৯

0
2115

#উপন্যাস
#প্রিয়তমা (২৮ ২৯ তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
জোবেয়েদা দরজা খুলে দিতেই লামিয়া সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকে।
কিরে আজ এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি যে??
সামনের সোফাতে আনাস আদিবাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। আজ তিন বছর পর ও লামিয়াকে দেখছে। হয়তো সে বোরকাবৃত কিন্তু তারপর ও ওকে এক পলক দেখার লোভ সংবরন করতে পারলোনা। একবার লামিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে নিলো। লামিয়ার চোখে চোখ রাখার সাহস যে ওর নেই । কেননা ওই চোখে আজ আর আনাস ভালোবাসা খুঁজে পায়নি পেয়েছে অন্য কিছু। যার দরুন ওইদিকে দ্বিতীয় বার তাকানোর সাহস পায়নি।
লামিয়ার দৃষ্টি সামনের দিকে যেতেই ও কয়েক সেকেন্ড ওই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। পরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,,, এতো তাড়াতাড়ি না এলে যে তোমাদের এসব নাটক দেখতে পেতাম না তাই।
-কি বলছিস তুই?? কিসের নাটক করছি আমরা?? আসলে তুই যা ভাবছিস ব্যাপারটা তা না।
লামিয়া আর কোন কথা না বলে নিঃশব্দে নিজের রুমে গিয়ে ভিতর থেকে দরজা আটকে দিলো।
জোবায়েদা মনে মনে বললো,,, এই সেরেছে রে আজ আর আমাদের রক্ষা নাই।
লামিয়া ভিতরে চলে যেতেই ওই দিকে তাকিয়ে একটা করুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনাস দাঁড়িয়ে বললো,,, মা আজ আমি আসি।
-আরে কি বলছো?? আমাদের সাথে দুপুরে খেয়ে তারপর যেও। লাবিব ও চলে আসবে কিছুক্ষণ পরে।
-না মা আমার মনে হয় এখানে আমার আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে।
-আরে কিচ্ছু হবেনা।
-না আমি পরে আবার আসবো। শাশুড়ির থেকে বিদায় নিয়ে মেয়েকে আরো কিছুক্ষণ বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে আনাস বেরিয়ে গেলো। আদিবা তো কিছুতেই ওর কোল থেকে নামবেনা। অনেক জোর করে ওকে সরাতে হয়েছে। আনাস চলে যেতেই ও আরো জোরে জোরে বাবা যাবো,,, বাবা যাবো বলে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে ওকে কোনভাবে থামানো যাচ্ছেনা।
লামিয়া দরজা আটকে শুয়েছিলো। ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন আর এ ব্যাপারে ও কোন কথা বলবেনা। আর এভাবে কারো সামনে পরিবারের লোকের সাথে কোন সিনক্রিয়েট করার মানে হয়না। সবার যার যার মতো যা খুশি করুক।
অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটা কাঁদছে। লামিয়া দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে মেয়েকে কোলে নিয়ে আবার রুমের দিকে চলে গেলো।
জোবায়েদা লামিয়ার মতিগতি লক্ষ্য করে শায়লাকে বললো, কি ব্যাপার বউমা এত চুপচাপ কেন ও?? আমি তে ওর মতিগতি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা এত শান্ত থাকার তো কথা না কিন্তু আজ কি হলো?? তুমি কি কিছু বুঝতে পারছো??
-শায়লা চিন্তিত মুখে বললো মা আমিও তো কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা।
সারাটিদিন পরিবারের সবাই এই ভয়ে ছিলো আনাসের বাসায় আসার ব্যাপারে লামিয়া কি বলে?? কিন্তু না ওই ব্যাপার লামিয়া আর একটা কথাও বলেনি। তবে ওর গম্ভীর মুখটা কারো নজর এড়ায় নি।
আনাসের কাছ থেকে আদিবার দুষ্টুমির গল্প শুনে রাশেদা চৌধুরী ওকে দেখার জন্য উৎসুক হয়ে উঠলো। আর উৎসুক হবে নাই বা কেন আনাস তো আসার পর থেকে বলে চলেছে আদিবা এটা করেছে আদিবা ওটা করেছে আর সবচেয়ে বড় কথা হলো মেয়েটা ওকে বাবা বলে ডেকেছে সেই সব শুনেই তো উনার এত উৎসাহ।
বাবা তুই আমাকে ওর নিয়ে যাবি??? ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে???
-না মা এখন না আরো কয়দিন যাক। আমি আগে লামিয়ার ভাবগতি একটু বুঝি তারপর না হয় যাবে নয়তো আমিই আদিবাকে তোমার কাছে নিয়ে আসবো।
-আচ্ছা তোর যা খুশি।
-ওহ ভুলে গেছি তোমাদের দেখানোর জন্য আমি ওর ছবি তুলে এনেছি এই বলে পকেট থেকে ফোন বের করে মায়ের সামনে ধরলো।
রাশেদা ফোন হাতে নিয়ে বললো,,, মাশাআল্লাহ!! কার মতো হয়েছে রে? ?তোর মত না লামিয়ার মতো কিছুই তো বুঝতে পারছিনা। তোদের কারো সাথে তো ওর মিল দেখতে পাচ্ছিনা।
-মা ও ওর মতো হয়েছে। আমাদের কারো মতো নয়।
আমাসের কানে বারবার আদিবার বলা বাবা ডাকটা বাড়ি দিয়ে যাচ্ছে। এ যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি!!!
আনাসের আজকাল লামিয়াদের বাসায় আসা যাওয়া বেড়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই বলতে গেলে ও এ বাসায় আসে আদিবাকে দেখার জন্য। আনাস আসে এসে আদিবার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে চলে যায়। অবস্থা এমন যে আদিবাকে না দেখে এখন ওর একদিন ও কাটানো দায় হয়ে গেছে। তবে আর তার সাথে লামিয়ার রাগটা পামি করে তার মনে জায়গা করে নেওয়ার একটু চেষ্টা ও চলছে।
আনাস এ বাসায় আসছে এতদিন ধরে লামিয়া কখনো বাসায় থাকে আবার কখনো থাকেনা। বাসায় যখন থাকে আনাস যাওয়া অবদি রুমের দরজা লক করে রাখে। যেন দরজা খুলে রাখলেই আনাস রুমে এসে ঢুকবে। আনাস ওর এই আচরণটা দেখে মাঝে মাঝে মনে মনে হাসে। কিন্তু লামিয়া কখনো আনাসের ব্যাপারে বাসা আর একটা কথাও বলেনি।
আনাস মনে মনে ভাবে,,, এই মেয়ে কে মানানো এতো সহজ নয়। খুব ভালো করে বুঝতে পারছি লামিয়ার মনের বরফের পাহাড়টা গলাতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হবে। তবে আনাস ও এতো সহজে হাল ছাড়বেনা নিজের চেষ্টা চালিয়ে যাবে যতক্ষণ না সে লাইনে আসে।
এদিকে রাশেদা নাতনি কে দেখার জন্য আনাসের কানের কাছে বসে সারাক্ষণ জ্বালিয়ে মারছে।
আজ লামিয়ার স্কুলে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আছে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে আনাস যখন কথাটা শুনেছে তখনি সুযোগ পেয়ে শাশুড়িকে বললো,,, মা যদি অনুমতি দেন একটা কথা বলবো???
-কি কথা বলো??
-আসলে আমার মা আদিবাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে আছে। আমি যদি আজ একটু আমার বাসায় নিয়ে যায়…
-কি বলছো তুমি ওর মা জানতে পারলে আমাদের খবর করে ছাড়বে। এমনিতে তুমি আসো এটাতে ওর অনেক রাগ মুখে কিছু বলেনা কিন্তু ওকে দেখলেই বুঝা যায়। এখন আবার তুমি ওকে নিয়ে গেলে…
-মা আমি লামিয়া আসার আগেই ওকে নিয়ে আসবো। প্লিজ না করবেন না।
-কি বলবো এখন তো আমারি চিন্তা হচ্ছে।
-মা দু তিনঘন্টারই তে ব্যাপার।
-আচ্ছা যাও তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। তারপর আদিবাকে নিয়ে শায়লাকে ডেকে বললো,,, বৎমা আদিবাকে একটু রেডি করে দাওতো??
-কেন মা?
-আনাস ওকে নিয়ে যাবে।
-মা আপনি কি..
-কি করবো ছেলটা এমনভাবে বলেছে না করার ও উপায় নেই। তবে লামিয়া আসার আগে চলে আসবে বলেছে।
-আমি কিচ্ছু জানিনা মা। আপনাকে সব সামলাতে হবে।
-হুম যাও ওকে রেডি করে দাও আর ওর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ওর সাথে দিয়ে দিও।
আনাস আদিবাকে নেওয়ার সময় জোবায়েদা বারবার করে বলে দিলেন তাড়াতাড়ি যেনো ফিরে আসে।
একমাত্র নাতনীকে দেখতে পেয়ে রাশেদা চৌধুরী আনন্দে কেঁদে দিলো। একমাত্র বললাম এই কারণে এ পরিবারে আদিবা একমাত্র মেয়ে রাশেদা চৌধুরীর বড় মেয়ের ঘরে তিন ছেলে আর বড় ছেলের ও একটাই ছেলে আর ছোট মেয়ের এখনো কোন বাচ্ছা হয়নি।
আদিবা ও এ বাড়িতে সবার সাথে মিশে গেলো। কতগুলো অপরিচিত মানুষ যাদের ও জন্মের পর থেকে কখনো দেখেনি তাদের সাথেই কেমন মিশে গিয়েছে যেন এরা ওর অনেক আগের চেনা পরিচিত মানুষ।
লামিয়ার শরীর বেশি ভালো লাগছেনা বোধহয় প্রেশার বেড়ে গেছে। তাই অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে বলে বাসায় চলে এসেছে। লামিয়াকে বাসায় দেখে শায়লা আর ওর লামিয়ার মা ঘাবড়ে গেলো।
লামিয়া বাসায় এসে যখন দেখলো আদিবা বাসায় নেই তখন ওর মাকে ডেকে বললো,,, আম্মু আদিবা কোথায়??
-জোবায়েদা খানিকটা ইতস্তত করে বললো,,, আদিবা একটু বাহিরে গেছে।
-বাহিরে গেছে মানে?? কোথায় গেছে,,, কার সাথে গেছে??
-জোবায়েদা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
-কি ব্যাপার তোমরা কেউ কথা বলছোনা কেন?? আমার মেয়ে কোথায়??
-শায়লা ভয়ে ভয়ে বললো,,, ভাইয়ার সাথে গেছে।
-ভাইয়া!!! কোন ভাইয়া??
-আনাস ভাইয়া। উনি বলেছে তাড়াতাড়ি দিয়ে যাবে।
-কোথায় নিয়েছে??
-উনাদের বাসায়।
-উনার এতবড় সাহস কি করে হয় আমার মেয়েকে উনার বাসায় নিয়ে যাওয়ার??
-জোবায়েদা বললো,,, ও আমার কাছে বলে নিয়ে গেছে।
-বাহ!! আমার মেয়েকে আমার অনুমতি ছাড়া এখন যেখানে সেখানে পাঠিয়ে দিচ্ছো!!
-যেখানে সেখানে কোথায় ও ওর দাদুর বাসায় গেছে এতো দোষের কি আছে??
-বাব্বাহ!!! তোমরা ভিতরে ভিতরে দেখছি আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে দেয়ার পায়তারা করছো।
তোমাদের কিছু বলছিনা দেখে তোমরা যা খুশি তা করে যাবে। এত কি উনার এ বাসায়?? আমি কিছু বলছিনা দেখে নির্লজ্জের মতো প্রতিদিন ড্যাংড্যাং করে কেন আসবে।
– লামিয়া এটা কি ধরনের কথার ছিরি!!! তোর কাছ থেকে তো আমি এরকম ব্যবহার আশা করিনি। আর ও এ বাসায় আসে ওর মেয়েকে দেখতে এতে দোষের কি আছে।
-মেয়ে কে দেখতে!!! আদিবা আমার মেয়ে আর কারো নয়।
-একরোখার মত কথা বলবিনা। যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে কথা বলছিস। একটা কথা ভুলে যাসনা তুই যেমন আদিবার জন্মদাত্রী মা তেমনি আনাস ওর জন্মদাতা পিতা। ওর উপর তোর যতটা অধিকার আছে আনাসেরও ঠিক ততোটাই আছে। ও একটা ভুল করেছে কিন্তু তুই কি করছিস??
-অধিকার!!! কোন অধিকারের কথা বলছো মা। হুট করে ফিরে এসে মেয়ে বলে দাবি করলেই অধিকার ফলে যায় না মা।
আমাকে চুপচাপ দেখে তোমরা মনে করছো আমি উনার এই আসা যাওয়াকে খুশি মনে মেনে নিয়েছি??
উনাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিবে আমার মেয়েকে নিয়ে যেনো টানাহেঁচড়া না করে।
-ও তো তোর কাছ থেকে আদিবাকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছেনা শুধু একটু ভালোবাসা দিতে চাই নিজের ভুলগুলো শুধরাতে চাই এতটুকুই তো।
-কিচ্ছু চাইনা আমি ওই মানুষটার কাছ থেকে কিচ্ছুনা,,, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি মা আর পারবোনা। উনাকে ভালো করে আজ বলে দিবে সেকেন্ড টাইম যেনো উনি এ বাসায় না আসে।
-আমি পারবোনা। তোর বলার হলে আজ ও আসলে তুই বলে দিস। ভালো লাগেনা আমার আর এসব যন্ত্রণা বলে উনি বেরিয়ে গেলো।
শায়লা বললো,,, একটু শান্ত হয়ে আমার কথাটা শুনবে??
-ভাবি তুমি এর মাঝে কিছু বলোনা। আমি চাইনা এখন তোমার সাথে ও রাগারাগি করতে। তোমরা সবাই আমার সামনে থেকে যাও আর শুনো আদিবাকে নিয়ে আসলে আমাকে ডাক দিও তোমরা যখন কিছু বলবেনা তখন আমাকেই বলতে হবে।
শায়লা মাথা নেড়ে চলে গেলো। লামিয়ার এইরকম রুদ্ররূপ শায়লা এই প্রথম দেখেছে তাই ভয়ে আর কথা বলার সাহস হয়নি।
সবাই বেরিয়ে যেতেই লামিয়া দরজা আটকে কাঁদতে থাকে। কেন এরা কেউ আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেনা।
অনেকক্ষন পর চোখ মুছে বললো,,, দেখাচ্ছি আজ মেয়ের প্রতি দরদ!!! অধিকার খাটাতে আসছে উনার অধিকার উনাকে আজ ভালো করে বুঝিয়ে দিবো!!!!
আজ এর একটা দফা রফা করতেই হবে!!
আদিবা ঘুমে থাকায় রাশেদা চৌধুরী আনাসকে বের হতে দেয়নি। আদিবা ঘুম থেকে উঠতেই ওকে রেডি করে দিলো যাওয়ার জন্য। উনার ইচ্ছে করছে নাতনীটাকে নিজের কাছে রেখে দিতে কিন্তু তার কোন উপায় নেই।
আনাস রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে আরেক সংকটে। রাস্তার বিশাল জ্যাম লেগে আছে কখন ছাড়ে তার কোন ঠিক নাই।
আনাস গাড়িতে বসে দুশ্চিন্তায় অস্থির। কি জানি কি হয় আজ?? তবে এটা ঠিক যে আজ কঠিন আকারের এক যুদ্ধ হয়ে যাবে।
বাসা থেকে ও দেরিতে বের হলাম আর এখন রাস্তায় পড়েছি জ্যামে আটকা। বিপদ যখন আসে তখন সব দিক থেকে একসাথেই আসে। অসহ্য!!! ঢাকা শহরের এই জ্যামের জন্য আমার মতো কত নিরীহ মানুষকে যে বিপদে পড়তে হয়। আল্লাহ আজ রক্ষা করো!!!
আমার মাকে এতকরে বললাম উনি ও ছাড়েনা এতক্ষণ । যা কথা শুনার এখন আমাকেই শুনতে হবে। উনি তো জানেনা উনার বউমা এখন কতটা দজ্জাল আর কঠিন মনের হয়ে গেছে। কাউকে কথা বলতে উনি এখন বিবেচনা করেনা আর আমি তো তার চরম শত্রু ।
আজ এতদিন তার মুখটা অবদি দেখলাম না। একেই বলে কপাল!!! জানিনা অভিমানিনীর অভিমান কবে ভাঙবে???
আনাস অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেল চেপে যাচ্ছে ওপাশ থেকে খোলার কোন নাম নেই। কি ব্যাপার সবাই কি করছে?? ঘুমাচ্ছে নাকি??? এই সন্ধ্যায় কিসের ঘুম???
প্রায় দশ মিনিট পরে ভেতর থেকে আস্তে করে দরজা খুলে গেলো। আনাস অবাক হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দরজায় হা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো……
চলবে………..

#উপন্যাস
#প্রিয়তমা (২৯তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
লামিয়া আনাসের কোল থেকে আদিবাকে একরকম টেনে নিয়ে গেলো। তারপর রুমে নিয়ে এলোপাথাড়ি কয়েকটা থাপ্পড় দিলো আদিবাকে। কেন গিয়েছিস বল কেন গিয়েছিস??
আদিবা চিৎকার করে কাঁদছে
আদিবার কান্না শুনে জোবায়েদা আর শায়লা দৌড়ে এলো।
শায়লা বললো,,,, আপু কি করছো কি?? এইটুকু একটা বাচ্ছাকে এইভাবে কেউ মারে??
-খবরদার!!! কেউ রুমে আসবেনা।
-জোবায়েদা বললো,,, কি করছিস?? ও ছোট বাচ্ছা!! ও কি বুঝে? ওকে যে যেদিকে টানবে ও তো সেদিকেই যাবে। তোদের রাগারাগি ওর উপর কেন ঝাড়বি??এইভাবে বাচ্ছাটাকে মারবি তুই?? মায়া দয়া কি উঠে গেছে তোর???দে ওকে এদিকে দে??
-মা তোমরা কেউ এদিকে আসবেনা। তোমাদের কারো কথা আমার সহ্য হচ্ছেনা। তোমরা এখান থেকে যাও । তোমাদের কে বিশ্বাস করে আমার বাচ্ছাকে তোমাদের কাছে রেখে যাওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে। আজকের পর আমার কোন ব্যাপারে তোমরা কথা বলবেনা।
আনাস এতক্ষণ ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো। আনাস এতোক্ষন পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করলো। আদিবার কান্না এখনো থামছেনা। মেয়েটা চিৎকার দিয়ে দিয়ে কাঁদছে। লামিয়া কাউকে ওকে ধরতেও দিচ্ছেনা নিজেও কোলে নিচ্ছেনা খাটের মাঝখানে বসিয়ে রেখেছে। তাই বাধ্য হয়ে আনাস সমস্ত দ্বিধা সংকোচ দূরে ফেলে ওই রুমের দিকে গেলো। আদিবাকে কোলে নিতে হাত বাড়াতেই লামিয়া বললো,,,, খবরদার!! আমার মেয়েকে আপনি ধরবেন না।
-লামিয়া কি করছো কি তুমি?? এতো ছোট একটা মেয়েকে এইভাবে কেন মারছো?? আমি নিয়ে গেছি দেখেইতো ও গেছে। তুমি যা বলার আমাকেই বলতে ওকে কেন মারছো? রাগটা তো তোমার আমার উপর তো ওটা আমাকেই দেখাও।
-এই আপনি আমার মেয়েকে কেন বাহিরে নিয়ে যাবেন?? কে আপনি???
কিসের অধিকার খাটাচ্ছেন??
আপনার সাহস কি করে হয় আমার মেয়ের কাছে আসার?? আর আপনি আমার রুমে কেন এসেছেন??
– আমি আদিবার কেউ না??
-না আপনি ওর কেউ না। কেন এসেছেন ফিরে আপনি?? কাটা গায়ে লবনের ছিটে দিতে?? নাকি আমার গায়ে অপবাদ দেয়ার আরো কিছু পেয়েছেন??
– লামিয়া আস্তে কথা বলো সবাই শুনছে।
-সবাই শুনছে তো কি হয়েছে। আজ তিন বছর তো আমি মানুষের কথা শুনে আসছি তো আপনার ও তো শুনার দরকার আছে একটু কি বলেন?? অন্যায় না করেও সব কথা আমি কেন শুনবো???
জোবায়েদা দৌড়ে এসে বললো,, লামিয়া কি শুরু করছিস এটা??? চুপ কর মা!! এভাবে মাথা গরম করিস না!!!
তারপর আনাসকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,, বাবা তুমি এখন এখান থেকে চলে যাও।
– কোথাও যাবেনা উনি। কথা যখন উঠেছে তখন তো বলতেই হবে।
আম্মু এখান থেকে যাও তোমরা এর মাঝে কথা বলোনা।
জোবায়েদা চলে গেলো।
-লামিয়া তুমি আমার কথাটা তো শুনবে?
-আপনার কোন কথার শুনার ইচ্ছে বা ধৈর্য্য আমার নাই।
-প্লিজ??
-কেন শুনবো আপনার কথা?? সেদিন আপনি আমার কথা শুনেছেন?? তাহলে আজ আমি আপনার কথা কেন শুনবো??
-আমি একটা ভুল করেছি দেখে তুমি ও আরেকটা ভুল করবে??
-ভুল… কোনটাকে ভুল বলছেন আপনি?? অপরিচিত একটা লোকের কথার উপর বিশ্বাস করে বিয়ে করা বউকে বের করে দেয়া এটা ভুল নয়???
আমি আপনাকে বারবার বলেছি আমার কথাটা শুনতে আপনি শুনেন নি। কারণ সেদিন আপনার কাছে ওই অপরিচিত লোকটায় সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল আমি না!!!
-লামিয়া আমি তো ভুল স্বীকার করছি এর জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা ও চাইছি। আর কি করতে হবে বলো??
-আপনি ভুল স্বীকার করলে আমার জীবনটা আগের মত হয়ে যাবে?? আমি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবো?? কিচ্ছু হবেনা আগের মত।
-তুমি চাইলে সব সম্ভব।
-কিচ্ছু সম্ভব না।
আপনার জন্য,,,, শুধুমাত্র আপনার জন্য আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি সেই বাবা যে ছিল আমার জীবনটাকে সঠিক পথে গড়ে নেয়ার অনুপ্রেরণা পারবেন আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে??
আপনার জন্য আজ তিনবছর ধরে আমি মানুষের বাজে কথা শুনতে শুনতে হাঁফিয়ে গেছি পারবেন,,, সেই তিন বছর আমার জীবনে ফিরিয়ে আনতে??
মানুষের কাছে হাজারো জবাবদিহি করতে হয়েছে আমাকে আমার পরিবারকে।
,,,আপনার করা সেই একটা ভুলের জন্য আমি নিজের বাড়ি ছেড়েছি এইযে এখানে এসে উঠেছি না এখানেও মানুষ আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কেন আমার স্বামি আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে কি জবাব দিবো আমি??
এগুলোর কোন সমাধান আছে আপনার কাছে??
না আমি কাউকে কিচ্ছু বলতে পারিনা মাথা নিচু করে চলে যাওয়া ছাড়া।
আপনি পুরুষ মানুষ না আপনাকে কারো কথা শুনতে হয়েছে না কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছে।
যে মিথ্যা অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে আমি আজ তিনবছর এই সমাজ আর সমাজের মানুষগুলোর সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছি সেগুলোর কি হবে??
একটা মেয়ে যখন মা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে তখন তার পাশে তার হাজবেন্ডের থাকাটা সবচেয়ে জরুরী আমি সেই সময় আপনাকে পাইনি একেকটা দিন আমার কত কষ্টে কেটেছে তা আমি জানি!!
তখন তো আপনাকে পাইনি তাহলে আজ কেন???
হাসপাতালে আমরা মা মেয়ে জীবন মৃত্যুর সাথে লড়েছি কোথায় ছিলেন তখন আপনি??
এমন কোন দিন যায়নি যেদিন আমার চোখ থেকে পানি ঝরেনি সেই দিনগুলো কিভাবে কাটিয়েছি তা আমি জানি। জানেন আজ আর আমার চোখ দিয়ে পানি আসেনা শত কষ্ট পেলেও। আমার ইচ্ছে করে চিৎকার করে কাঁদি কিন্তু আমি কাঁদতে পারিনা। আমার বুক ফেটে যেতো যন্ত্রনায় কাউকে বুঝাতে পারিনি। সারাক্ষণ আপনার বলা ওই কথাগুলো আমার মাথায় ঘুরপাক করতো তখন যন্ত্রনায় মাথা ফেটে যেতো।
আজ আমি একটু একটু করে নিজেকে গড়ে তুলেছি মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছি।আমি চাইনা আবারো কোনো মিথ্যে অপবাদের কারণে আমার জীবনটা আবারো এলোমেলো হয়ে যাক তা হলে যে আমি আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবোনা।
-আনাস দুহাত মুখে দিয়ে বসে পড়লো কি জবাব দিবে এই প্রশ্নগুলোর?? তার কাছে তো এর কোন জবাব নেই। ছোট্ট একটা ভুলের কারণে এইভাবে যে সব শেষ হয়ে যাবে তা কি ও কোনদিন ও ভেবেছিলো। সেদিনের একটু ভুল বুঝাবুঝি ওদের সম্পর্ক টাই তিক্ত করে দিয়েছে। যে লামিয়া ওর সামনে আসলে কথা বলতে পারতোনা লজ্জায় আজ সেই এত রুক্ষভাষী হয়ে গেছে। কাঠিন্যতা ওর চোখমুখ জুড়ে ছড়িয়ে আছে।
আদিবা কাঁদতে কাঁদতে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো আনাস ওকে কোলে তুলে নেওয়ার আগেই লামিয়া আদিবাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে নিলো। আপনি আমার মেয়েকে ধরবেন না!!
-লামিয়া ও আমারো মেয়ে।
-আপনার মেয়ে??? কোথায় ছিলেন আপনি এতদিন?? আপনাকে হাত জোড় করে বলছি আপনি আর আমার মেয়ের সাথে যোগাযোগ করবেন না।
হ্যা এটা ঠিক আপনি ওর জন্মদাতা,, কিন্তু এর বাহিরে ওর উপর আপনার কোন অধিকার নেই। মেয়েকে দেখতে চেয়েছেন আমি কিচ্ছু বলিনি কিন্তু তাই বলে প্রতিদিন কিসের দেখা?? আপনি আর আমাদের মাঝে আসবেন না। একটু শান্তিতে থাকতে দিন আমাদের।
-লামিয়া প্লিজ একবার শুধু আদিবার কথা চিন্তা করে আমাকে ক্ষমা করা যায়না। দেখো একজন সন্তানের মায়ের সাথে বাবার ও দরকার আছে।
-লাগবেনা!! আমার মেয়ের জন্য আমি একাই যথেষ্ট। কারো সহানুভূতির দরকার নেই আমার। সেদিন আপনি অন্য লোকের কথায় আমায় বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন আবারো যে সেই ভুল করবেন না তার কি গ্যারান্টি???
আজ আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন,,, কাল হয়তো অন্য কারো কথায় বিশ্বাস করে বলবেন যে এ বাচ্ছাটাও আপনার না..
-লামিয়া!!! আনাস এবার একটু জোরে বলে উঠলো। কথা ঠিক করে বলো?? কি বলছো তুমি মাথা ঠিক আছে??
-কেনো লাগছে কথাটা না!!! ভুল তো কিছু বলিনি। সেদিন আমার ও কষ্ট হয়েছে। যার সাথে এতদিন সংসার করার পর ও যার বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি যার কাছ থেকে কোন অন্যায় না করে খারাপ মেয়ের অপবাদ শুনতে হয়েছে সেদিন আমার কেমন লেগেছে বুঝতে পারছেন। আমার কথা আপনার অসহ্য লাগে আমার মুখের দিকে তাকাতে আপনার ঘৃনা লাগছে যখন এই কথাগুলো বলছিলেন না মনে হয়েছে আমি মরে যায়। কিন্তু ওই যে আত্মহত্যা মহাপাপ তাই পারেনি। আর সেদিন তো আমি একা ছিলাম না আমার ভিতরে আরেকটা প্রাণ ছিলো শুধু ওর কথা ভেবে সেদিন আমি ভালো থাকার চেষ্টা করেছি। আজো ওর মুখের তাকিয়েই নিজেকে ভাল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আমি সয়ে গেছি এখন আমি একা একা চলতে পারি। আজকের পর আপনি এ বাসায় আসবেন না!!
আমাকে আমার মত বাঁচতে দিন। কেন আসছেন পুরোনো ক্ষতটা নাড়া দিতে। ভালো থাকুন আপনি আপনার মত সুখী হোন।
আর কোন অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে আমি হাটতে পারবোনা। হাঁফিয়ে গেছি আমি সত্যি হাঁফিয়ে গেছি!!!
-আনাস কান্না চেপে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,,, ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি আর আসবোনা;তোমাদের উপর অধিকার খাটাতে। শুনেছি বান্দা যত বড়ই ভুল করুক আল্লাহ ক্ষমা করে দেই। কিন্তু এতবড় ভুল করেছি যে তোমার কাছে ক্ষমা পাওয়ারও যোগ্য নয়। আজকের পর তুমি যা চাইবে তাই হবে। যদি বলো সম্পর্কটা শেষ করে দিতে তাই হবে।বুঝতে পারিনি একটা ভুল যে এভাবে সব শেষ করে দিবো। বড্ড বিরক্ত করেছি তোমায় এই কয়দিনে পারলে ক্ষমা করে দিও।
হয়তো তোমার ধারণা তুমি একাই কষ্ট পেয়েছো। কিন্তু তোমাকে ভুল বুঝে আমি তার থেকেও বেশি কষ্ট পেয়েছি। তুমি তো আদিবাকে পেয়ে একটু হলেও নিজের কষ্ট ভুলতে পেরেছো কিন্তু আমি একাকীত্ব জীবন নিয়ে অনেক কষ্টে কাটিয়েছি। তোমাকে বাড়ি থেকে বের করেছি বলে আমার বাবা মা আমাকে ভুল বুঝেছে পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ আমার সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে। দেশে ফিরে তোমাকে অনেক খুঁজছি অবশেষে আল্লাহ আমার প্রতি সহায় ছিলো তাই তোমাকে পাইয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই সহজ সরল লামিয়ার বিপরীতে এক কঠিন মনের লামিয়াকে পেয়েছি আমি। যার কাছে আমার আবেগ ভালোবাসার এখন আর কোন মূল্য নেই সে বড় স্বার্থপর হয়ে গেছে। আজ এতগুলো কঠিন কথা শুনতে হয়েছে আমাকে শুধুমাত্র একটা ভুলের কারণে।
ভালো থেকো।
শেষবারের মতো মেয়েটাকে একটু জড়িয়ে ধরতে দিবে???
লামিয়া আদিবাকে নিয়ে বারান্দার দিকে চলে গেলো। আনাস অনেকক্ষন বসে থেকে আশাহতের মতো হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলো।
জোবায়েদা এতোক্ষন অনেক কষ্টে নিজেকে চেপে রেখেছিলো। আনাস বেরিয়ে যেতেই রুমে এসে লামিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,,, হয়েছে তো তোর শান্তি??? ছেলেটাকে এতোগুলো কথা না শুনালে কি হতোনা??? বড্ড কথা বলা শিখে গেছিস। মনে রাখিস আজকের তোর এই ব্যবহারের জন্য একদিন নিজের কপাল নিজে চাপড়াবি। তখন এদিক ও পাবিনা সেদিক ও পাবিনা।
লাবিব ঢাকার বাহিরে গিয়েছে একটা কাজে। আসার পর এসব শুনে সেও অনেকক্ষণ লামিয়াকে বকাবকি করেছে। ফারিহা ও এসেছে সেও অনেক কথা শুনিয়েছে। সবার সব কথা নিরবে শুনে গেছে লামিয়া কোনো প্রতিউত্তর না করে। এ মুহুর্তে কারো কথার জবাব দিতে ইচ্ছে করছেনা। মাথাটা প্রচন্ড ঘুরাচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রেশারটা বেড়ে গেছে। কোনো মতে আদিবাকে খাইয়ে লামিয়া না খেয়েই শুয়ে পড়লো।
আনাসকে এমন উদভাস্তের মতো বাসায় ঢুকতে দেখে রাশেদার ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো। ছেলেটা তো খুশি মনে বাসা থেকে গেলো। কি হলো এখন আবার??
আনাসকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ও বলে উঠলো,,,, মা আমি এখন ঘুমাবো কেউ আমাকে সকালের আগে ডাকবেনা বলেই দরজাটা আটকে দিলো।
সকালে লামিয়া ঘুম থেকে উঠার পর থেকে খেয়াল করলো বাসার সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত কেউ ওর সাথে কোন কথা বলছেনা। সবার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে ও এ বাসায় অপরিচিত কেউ। লামিয়ার আজ স্কুলে যেতে মন কিছুতেই সায় দিচ্ছেনা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। কিন্তু না যেয়েও উপায় নেই। প্রাইভেট স্কুল চাইলেই ছুটি নেয়া সম্ভব না। মেয়েকে কোনরকমে খাইয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো স্কুলের উদ্দেশ্যে। বাসা থেকে স্কুল দশ মিনিটের রাস্তা তাই লামিয়া প্রতিদিন হেটেই যায়।
লামিয়া রাস্তা দিয়ে আনমনে হাটছিলো আর কালকের কথাগুলো ভাবছিলো আমি কি ঠিক করলাম??
এতো কঠিন কেন হয়ে গেলাম আমি???
উনি তো মেয়েটার উপর অধিকার খাটাতেই পারে আমি বাঁধা দিলাম কেনো?? ভাবছে আর হাটছে তখনি সামনে থেকে একটা মিনিবাস এসে লামিয়া ধাক্বা মারলো। লামিয়া ছিটকে রাস্তার একপাশে পড়ে গেলো……..
চলবে………….

লেখা – শারমিন মিশু
হাসপাতাল থেকে ফোন আসার পরে লাবিব পাগলের মতো ছুটে এসেছে। মনে মনে বলছে,,, আল্লাহ আমার বোনটাকে সুস্থ রেখো।
ফারিহা,, শায়লা ওর মাকে নিয়ে রওনা দিয়েছে। জোবায়েদা সেই থেকে কান্নাকাটি করে যাচ্ছে আর বলছে,,, আল্লাহ আনার মেয়েটাকে সুস্থ রেখো। হয়তো রাগের মাথায় একটু বকাবকি করেছি কিন্তু মেয়েটার অকল্যান কখনো চাইনি। তাহলে কেনো এত কষ্ট দিচ্ছো আমার মেয়েটাকে?? তুমি সবকিছু ভালোর জন্যই করো কিন্তু এ কোন ভালো করছো জানিনা?
আদিবাকে জড়িয়ে ধরে বললো এই বাচ্ছাটার কাছ থেকে তার আশ্রয়স্থলটা কেড়ে নিওনা।
রাশেদা চৌধুরী সেই থেকে আনাসের রুমের দরজায় নক করে যাচ্ছে কিন্তু খোলার কোন নাম নেই। এবার উনার চিন্তাটা দুঃশ্চিতায় পরিণত হয়েছে। আনাসের বাবাকে ডেকে বলছে,,, ওগো ছেলেটা দরজা খুলছেনা কাল রাতে যে রুমে ডুকেছে আর বেরুয়নি। ওর ফোনটা ও বন্ধ করে রাখছে। আমার চিন্তা হচ্ছে তুমি কিছু একটা করো।
আনাসের বাবা বললো,,, ও তো কাল লামিয়াদের বাসা থেকে আসার পর থেকে এমন করছে তাইনা??
-হুম।
-এক কাজ করো লামিয়ার মায়ের কাছে ফোন দাও। জিজ্ঞেস করো ওখানে কোনো ঝামেলা হয়েছে কিনা?
এরপর যা করার করবো।
-তুমি তো ঠিক বলছো। এ কথাটা আমার মাথায় কেনো আসেনি বলে উনি লামিয়ার মায়ের ফোনে কল দিলো।
লাবিবরা সবাই হসপিটালে আছে লামিয়াকে ও টি তে নেয়া হয়েছে। কি অবস্থা ডাক্তাররা কেউ কিছু বলছেনা। তাই সবাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বসে আছে।
এই নিয়ে উনিশবার কল দিচ্ছে রাশেদা কিন্তু ওপাশ থেকে কোন রেসপন্স নেই।
আনাসের বাবা প্রশ্ন চোখে তাকালো।
রাশেদা বললো,, কেউই তো ধরছেনা। বুঝতে পারছিনা কি হয়েছে।
লামিয়ার নাম্বার ও বন্ধ বলছে আমার কাছে তো ওদের বাড়ি আর কারো নাম্বার নেই।
অপেরেশন রুম থেকে ডাক্তার বেরিয়ে জানালো,,,
উনার কপালের উপরের দিকে মাথার কাছে ফেটে গেছে আর ডান হাতের কব্জিতে ভেঙ্গে গেছে। শরীরের অন্যান্য জায়গায় অল্প অল্প কেটে গেছে। তবে যে ভয়টা ছিলো ওইরকম মারাত্মক কিছু হয়নি। উনার ওপর হয়তো কারো দোয়া আছে নয়তো এরকম এক্সিডেন্টে বেঁচে থাকার কথা নয়। তবে আপনারা আল্লাহকে ডাকুন রুগির জ্ঞান না ফিরা পর্যন্ত এখনো কিছু বলতে পারছিনা। মাথার আঘাতার জন্য ভয় আছে।
এদিকে তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে যাওয়ায় জোবায়েদা ফোনটা ও নিতে পারেনি। উনি লাবিবকে ডেকে বললো,,, বাবা আনাসকে একটু খবরটা দে। যত যাই হোক ওকে জানানোটা খুব দরকার।
লাবিব মাথা নেড়ে আনাসের ফোনে কল দিলো। ওপাশ থেকে নাম্বারটা বন্ধ জানাচ্ছে। লাবিব আনাসের বাবার ফোনে কল দিলো আবার।
আকরাম চৌধুরী অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো। তখনি উনার ফোনটা বেজে উঠায় রাশেদা চৌধুরী ধরলো।
ওপাশ থেকে লাবিব সালাম দিয়ে বললো,,, আন্টি আমি লাবিব।
-ও লাবিব!! আচ্ছা বাবা কি হয়েছে বলোতো?? তোমাদের বাড়িতে কি হয়েছে?? আনাস কাল রাত থেকে রুম থেকে বের হয়নি। আমি তোমার মায়ের ফোনে কলের পর কল দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু উনি ধরছেনা।
-আন্টি আমরা সবাই হসপিটালে আর আম্মুর ফোন তো বাসায়।
-হসপিটালে!! হসপিটালে কেনো??
-আন্টি লামিয়া এক্সিডেন্ট করেছে!!
-এক্সসিডেন্ট!!! কখন??
-সকালেই স্কুলে যাওয়ার সময়।
-তোমরা আমাদের আরো আগে জানাও নি কেন?
-আসলে আন্টি,,
-আচ্ছা আমরা এক্ষুনি আসছি বলে উনি ফোন কেটে দিলো।
আকরাম চৌধুরী স্ত্রীর দিকে বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে বললেন কি হয়েছে??
-বউমা এক্সিডেন্ট করেছে???
-এক্সিডেন্ট!! কখন??
-সকালে বলে উনি আবারো আনাসের দরজায় নক করলো
বাবা দরজাটা খোল লামিয়া এক্সিডেন্ট করেছে।
লামিয়া এক্সিডেন্ট করেছে কথাটা শুনার পরে আনাস হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। কি শুনলো লামিয়া এক্সিডেন্ট করেছে??
আসলে কাল রাত থেকে কান্নাকাটি করে চেহারার অবস্থা খারাফ করে ফেলেছিল। এ অবস্থায় মা বাবার সামনে পড়তে চায়নি বলে এতক্ষণ রুম থেকে বের হয়নি।
এ মুহুর্তে দরজা খুলে বললো,, কি বলছো মা?? কে একসিডেন্ট করেছে??
-লামিয়া
-তোমাদের কে বললো???
-লাবিব ফোন করেছিলো।
-আনাস আর কোন কথা না বলে রুমে ডুকে শার্টটা কোনমতে গায়ে দিয়ে মোবাইল আর ওয়ালেট টা হাতে নিয়ে বললো,, মা আমি হসপিটালে যাচ্ছি। আমি গাড়ি নিয়ে যাবো তোমরা পরে চলে এসো ট্যাক্সি নিয়ে বলে আনাস বেরিয়ে পড়লো। ওর মাথা কাজ করছেনা। কি থেকে কি হয়ে গেলো???
আনাস কিভাবে গাড়ি চালিয়ে এসেছে ও নিজেও জানেনা। হসপিটালের করিডোরে ওরা সবাই বসে আছে।
আনাস গিয়ে লাবিবকে বললো,,, ভাইয়া কি হয়েছে??? কি করে হলো এটা??
-জানিনা। প্রায় দেড় ঘন্টা আগে লামিয়ার ফোন থেকে এক ব্যক্তি ফোন করে জানালো এ মোবাইলটা যার সে নাকি একসিডেন্ট করেছে রাস্তায় পড়ে আছে। পরে আমি উনাদের হসপিটালের ঠিকানা দিয়ে বললাম আপনারা ওখানে নিয়ে যান আমি আসছি।
-ডাক্তার কি বললো???
-কপালের উপরে মাথার দিকটা ফেটে গেছে,, ডান হাতের কব্জিতে ভেঙে গেছে শরীরের আরো কয়েক জায়গায় কেটে গেছে। তবে বড় ধরনের কিছু হয়নি বলে উনারা ধারনা করছেন। টেস্ট করে দেখা হবে।
-লামিয়ার জ্ঞান ফিরেছে??
-এখনো জ্ঞান ফিরেনি। ভয়ের জায়গাটা ওখানে। মাথায় আঘাত পাওয়ার কারনটা বেশি বিপজ্জনক। ডাক্তার বললো জ্ঞান না ফিরা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছেনা।
-আনাস ওখানেই বসে পড়লো। কি হলো?? এমনটা কি হওয়ার ছিলো??
আল্লাহ অপরাধ তো আমি করেছি কিন্তু ওকে কেন কষ্ট দিচ্ছো??
আল্লাহ তুমি ছাড়া কেউ নেই আমার। আমার মেয়েটাকে তুমি মা হারা করোনা। তুমিই মানুষকে মৃত্যুর পর ও জীবিত করতে পারো তাহলে আজ কেন পারবেনা আমার কাছের মানুষটাকে জাগিয়ে তুলতে??
আদিবা বাবাকে দেখে শায়লার কোল থেকে নেমে এলো । আনাস মেয়েকে কোলে তুলে নিলো।
আল্লাহ আমার মেয়েটা এখনো মায়ের মায়া মমতা বুঝতে পারেনি এইটুকু বয়সে তুমি ওর কাছ থেকে পরম মমতার মানুষটিকে কেড়ে নিওনা।
জানি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো এক চুল নাড়ানোর ক্ষমতা নেই কিন্তু তুমি চাইলে কি না সম্ভব।
কাঁধের উপর কারো হাতের স্পর্শে আনাস মাথা তুলে তাকালো। মাকে পাশে পেয়ে আনাস একটু শব্দ করে কেঁদে উঠলো।
মা সবসময় ওর সাথেই কেন এমন হয়?? আমি তো ওর খারাপ কিছু কখনো চাইনি তাহলে ও কেন শাস্তি পাচ্ছে?
-তোকে ধৈর্য্য ধরতে হবে বাবা। তুই ভেঙে পড়লে আদিবাকে কে সামলাবে?
আল্লাহর উপর থেকে ধৈর্য্য হারাতে নেই।
আনাসের বাবা লাবিবের সাথে কথা বলছিলো।
ডাক্তার ও টি থেকে বেরিয়ে আসলো।
ডাক্তারকে বেরুতে দেখে ওরা সবাই এগিয়ে গেলো।
লাবিব বললো,,,,ডাক্তার কি অবস্থা এখন??
-উনাকে এখন বেডে দেয়া হবে। জ্ঞান না ফিরা অবদি কিছু বলতে পারছি না। আল্লাহকে ডাকুন আমাদের হাতে কিছুই নেই এ বলে ডাক্তার চলে গেলো।
লামিয়াকে বেডে দেয়া হয়েছে। তবে কাউকে ওখানে যেতে ডাক্তার নিষেধ করেছে। আদিবা ঘুমিয়ে পড়েছে আনাস ওকে মায়ের কোলে দিয়ে লামিয়ার বেডের দিকে গেলো। ভালোবাসার মানুষটাকে কাছ থেকে একবার না দেখলে যে ওর শান্তি হবেনা। ধীর পায়ে গিয়ে বেডের পাশের টুলটায় বসলো আনাস। কত নিষ্পাপ হয়ে ঘুমিয়ে আছে ও। মনে হচ্ছে ওর কোন পিছুটান নেই। এইযে এতগুলো মানুষ ওর চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে ওর কোন খেয়াল আছে??
আনাস লামিয়ার বাম হাতটা চেপে ধরলো,,, এতবড় শাস্তিটা আমাকে দিওনা তুমি নাহলে বেঁচে থেকেও যে আমি মরে যাবো।
আমার ভুলের শাস্তি আমাকে দিওনা তুমি যদি আমার সাথে না থাকতে চাও আমি তাও মেনে নিবো কিন্তু তোমার চলে যাওয়া আমি মানতে পারবোনা।
সন্ধ্যার পরে লাবিব শায়লা আর ওর মাকে আদিবাকে নিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। এতগুলো মানুষ এখানে থেকেই বা কি করবে তাই। কিন্তু জোবায়েদা মেয়েকে মৃত্যুর মুখে রেখে কোনভাবে বাসায় যাবেনা। ফারিহা অনেক বুঝিয়ে বললো,,, আম্মু আমরা তো আছি এখানে। তুমি বাসায় যাও লামিয়?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here