টক ঝাল মিষ্টি – পর্ব ২

0
1097

#টক_ঝাল_মিষ্টি (পর্ব ২) নুসরাত জাহান লিজা “সর্বনাশ! আপনি লাবণ্য?” “এটা তো কমনসেন্স থাকলেই বোঝার কথা!” “আপনি সবসময় এমন বাঁকা করে কথা বলেন কেন?” “কারণ আপনার মতো বাঁকা একটা মানুষ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তাই!” বাকিরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল, এতক্ষণ পরে তনু বলল, “তোরা আগে থেকেই পরিচিত?” “আরে, তোরে বললাম না রাতে, বাসের ফালতু, বিরক্তিকর একটা ছেলের কথা, এইটাই সেই পিস!” “আপনি সেদিন ম্যানার নিয়ে জ্ঞান দিলেন না? কত্ত বড় বড় কথা যেন ম্যানারের ড্রাম ধরে গিলে হজম করেছেন৷ অথচ আপনার নিজের মুখের ভাষার ঠিক নেই। আগে নিজের চরকায়, স্যরি, ম্যানারের ঝুলিতে একটু তেল ঢালেন, তারপর জ্ঞান বিতান খুলে বসবেন। নিজের মাথায় মগজ নেই, আসছে আরেকজনকে জ্ঞান দিতে!” অনিকেতের গলা চড়ে গেল। লাবণ্য ছেড়ে দেওয়ার মতো মেয়ে নয়, সে গলা দ্বিগুণ চড়িয়ে বলল, “আপনি যে অসুস্থ সেটা কী আপনি জানেন? শুধু অসুস্থ না, ভয়াবহ অসুস্থ। জ্বর এলে যেমন তিনবেলা প্যারাসিটামল খাওয়া লাগে, আপনার জন্য চিকিৎসা হতো আপনার বাবা-মা যদি সকাল, দুপুর, রাত তিনবেলা না না, তিনবেলায় কাজ হবে না, সাথে ডোজ বাড়িয়ে সন্ধ্যা যোগ করে মোট চার বেলা যদি থাপড়াতেন। তাহলে হয়তো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো চিন্তা করতে পারতেন। আপনার মতো ফালতু লোকের জন্য থাপ্পড় একটা অতি কার্যকরী এবং উপাদেয় ওষুধ!” “ফালতু লোকের বউ হওয়ার জন্য তো নাচতে নাচতে সেজেগুজে চলে এসেছেন।” “সেটাই আমার দুর্ভাগ্য। যদি জানতাম আপনি সেই লোক, তাহলে জীবনেও আসতাম না৷ চৌদ্দবার করে চোখ ধুতে হবে বাসায় গিয়ে।” “আর আমি আপনার সাথে কথা কেন বললাম সেই দুঃখে মুখ সেলাই করে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে।” “ওফ! আপনি বরং তাই করুন। ভীষণ উপকার হয়। আপনার আশেপাশের মানুষ বেঁচে যায় তাতে।” কথাটা বলেই হনহনিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল লাবণ্য। মাথা দপদপ করছে৷ বাবা-মা কী দেখে এই ছেলের এত এত প্রশংসা করেছেন, সে ভেবে পাচ্ছে না। একটা মানুষ এমন ছ্যাচড়া কী করে হতে পারে! *** “কাহিনী কী হলো কিছুই বুঝলাম না, দোস্ত?” “বলছি, আগে মাথা ঠান্ডা করতে দে।” আশেপাশে কেউ চোখ ঘুরিয়ে সরাসরি দেখছিল, কেউ আড়চোখে দেখছিল। অনিকেত বন্ধু মুহিতকে সাথে নিয়ে নিজেদের টেবিলে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো। এরপর গতকালের ঘটনা বন্ধুকে খুলে বলল। সব শুনে মুহিত বলল, “ওই মেয়ের জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তুই চড় খেতি শিউর। মেয়েটা তো তোকে তেমন কিছুই বলেনি।” “তোর মনে হচ্ছে আমার দোষ? তোর মতো বন্ধু থাকলে শত্রুর আর কোনো দরকার হয় না! মেয়েটা আমাকে ছ্যাচড়া, এটেনশন সিকার কত বাজে কথা বলল, আমি ছেড়ে দিতাম এমনি এমনি?” “তাও ভালো যে আমাকে কিছু একটা ভাবিস। আমি অনেস্টলি বলছি, মেয়েটার সহ্যশক্তির তারিফ করতেই হয়। শুরুটা কিন্তু তুই করেছিস। যেকোনো মেয়েরই রেগে যাবার কথা।” অনিকেতকে মুখ খুলতে দেখে থামিয়ে দিয়ে মুহিত আবার বলতে শুরু করল, “শোন, তোকে কয়টা কথা বলি। এই যে তোর এমন লাল্টু মার্কা হ্যান্ডসাম চেহারা নিয়েও কোনো একটা রিলেশনশিপ বেশিদিন টানতে পারিস না। কেন পারিস না ভেবেছিস কখনো?” “ভাবার কী আছে? কারো সাথে এডজাস্টমেন্ট হয়নি, তাই টেকেনি, সিম্পল। আমি আমার মতো, পুতুপুতু প্রেমালাপ আমার পোষায় না, আসেই না। আমি রাতে প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ দেখি, তখন সেটা বাদ দিয়ে যদি তারা ফোনে কথা বলতে চায় সেটা তো আমার পক্ষে সম্ভব না। লেজ ধরে শপিং করতে হবে, তাদের ব্যাগ টানাও সম্ভব না। এটা জাস্ট দুইটা বললাম, আরও কত কী আছে তোরে না বললে বুঝবি না।” “তাইলে রিনির সাথে ব্রেকআপ করেছিলি কেন? সে তো খুব শান্ত একটা মেয়ে ছিল, তোর জন্য রান্নাও করে নিয়ে আসত।” “ও ঠিক আমার টাইপের না। অতিরিক্ত ইমোশনাল, একটু কিছু বললেই কান্নাকাটি করে বন্যা বইয়ে দিত।” অনিকেতের তাৎক্ষণিক উত্তর। “তোর সমস্যা আসলে কী জানিস অনি? তুই কেমন সঙ্গী চাস এটা তুই জানিস না। কনফিউজড থাকিস। শোন, সব মেয়েই ভালোবাসার মানুষের চোখে নিজের জন্য মুগ্ধতা দেখতে চায়, প্যাম্পারড হতে পছন্দ করে, প্রায়োরিটি পেতে চায়৷ যখন তোর মতো কাঠখোট্টাভাবে কেউ গার্লফ্রেন্ডকে ট্রিট করে, তখন তারা হোঁচট খায়। প্রেম করার সময় প্রেমিক হতে হয়, তুই তো কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স হয়ে যাস। কখন, কোথায়, কী বলতে হয় এটা তুই কেন বুঝিস না?” মুহিত চেষ্টা করছে অনিকেতকে কিছুটা হলেও ওর দুর্বলতা বুঝাতে। অনিকেত মুহিতের সাথে একমত হতে পারে না। মাথা নেড়ে বলল, “মুহিত, দেখ আমি দুই, তিনবার ট্রাই করেছি রিলেশনশিপে থিতু হতে। কিন্তু কারোর সাথেই ম্যাচ করেনি। ওরা নিজেরাই এসেছে, আবার নিজেরাই চলে গেছে। আমি ওদের আমার লাইফে আসার বা যাবার কোনোটাতেই বাধা দেইনি। একসময় মনে হলো এসব আমার জন্য নয়৷ কারো মন রাখার জন্য আমি তাদের মতো হতে পারব না। কেউ যদি আমার সাথে এডজাস্ট করে নেয় তবে অন্য কথা।” “বাহ্! তুই নিজেকে বদলাতে পারবি না, অথচ আশা করবি ওই প্রান্তের মানুষটা তোর সাথে মানিয়ে নেবে? তুই এখনো বোকার স্বর্গে আছিস৷ রেসপেক্টটা দুদিক থেকেই সমান হতে হয়। একটু ভেবে দেখিস।” মুহিত অনিকেতকে খুব পছন্দ করে, কিন্তু অনিকেতের বোকামিতে বারবারই হতাশ হয়। কবে যে বুঝবে ছেলেটা! *** “তোর সমস্যা কী, অনি?” “তোমরা একটা বদমেজাজি মেয়ে এনে আমার সাথে জুড়ে দিলে সমস্যা নেই কিন্তু আমি সেখানে আপত্তি করলেই দোষ?” মায়ের কথার তিক্ত উত্তর দিল অনিকেত। “অন্যকে দোষ দেওয়ার অভ্যাস পাল্টা অনি, খুব বাজে অভ্যাস এটা। লাবণ্যকে আমি অনেক আগে থেকে চিনি৷ তোর মামার বন্ধু জামান ভাইয়ের মেয়ে। যথেষ্ট ভদ্র মেয়ে।” কড়া গলায় বললেন অনিকেতের মা রাহেলা। “কত ভদ্র সে আমি জানি! ও যদি ভদ্র হয় তবে ভদ্রতার সংজ্ঞা বদলাতে হবে। মা, শোনো, তুমি আমাকে যার সাথে ইচ্ছে তার সাথে বিয়ে দাও, আমি করে ফেলব। কিন্তু ওই মেয়ে বাদ দাও প্লিজ।” আদুরে গলায় বলার চেষ্টা করল অনিকেত। কিন্তু খুব একটা ফায়দা হলো না। রাহেলা বললেন, “ছেলেরা এরকম ঢং করলে মানায় না বাবা৷ এই ঢংকে পাত্তাও দিতে ইচ্ছে করে না। অন্য কিছু চেষ্টা করে দেখতে পারিস৷” “মা, তুমি এমন কেন? এখানে আমার জীবন মরণের প্রশ্ন৷ তোমার ছেলের জীবনের প্রতি তোমার একটুও মায়া নেই? ওই মেয়ের সাথে সংসার করতে গেলে কবে না জানি গলা টিপে মারে।” মাকে মানানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখে অনিকেত। “এটাই তোর শেষ কথা?” অনিকেত সম্মতিসূচক মাথা নাড়লে রাহেলা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “আমার কথা কেন ভাববি তুই? দরকার নেই ভাবার। একজন তো সেই কবেই আমাকে ছেড়ে ওপারে চলে গেছে, আমিও কয়দিন পরে সেখানে চলে যাব। আমার কথা শোনার তো কেউ নাই৷ যার যা ইচ্ছে করুক, আমার কথার তো কোনো মূল্য নেই।” মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করলেন তিনি। “মা, এসব কী বলছো তুমি? বিয়ে করলেই যদি খুশি থাকো তাহলে করছি বিয়ে, তাও এসব উদ্ভট কথা বলো না। আরেকটা কথা, তোমাকেও এসব ঢং মানায় না মা।” রাহেলা হেসে ফেললেন, কেন যে ছেলেটা এখনো এমন ছেলেমানুষ! হাত দিয়ে অনিকেতের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলেন। এত সুন্দর ছেলেটা, তাকিয়ে থাকতে থাকতে নজর না লেগে যায়! যখন অনিকেতের নয় বছর বয়স তখন তার স্বামী একটা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান। রাহেলা তখন অকূল পাথারে পড়েন, বড় ভাই শফিকের সহায়তায় একটা স্কুলে চাকরি জুটিয়ে ছেলেকে আঁকড়ে ধরেন। সেই ছোট্ট অনিকেত এখন কত্ত বড় হয়ে গেছে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু বড্ড এলোমেলো। জীবনটা গুছিয়ে দিতে পারলেই তার শান্তি। “তোর জন্য আমি সবচাইতে ভালো মেয়েটাই দেখেছি অনি। দেখবি, অনেক অনেক সুখী হবি।” অনিকেতের মুখে অনিশ্চয়তার ছাপ দেখে মনে মনে শুভাশিস আওড়ালেন রাহেলা। *** লাবণ্য বসার ঘরে শফিক আঙ্কেলের মুখোমুখি বসে আছে। বাবা-মা ওকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে তার দ্বারস্থ হয়েছেন। “শুনলাম, তুই নাকি বিয়েটা করতে চাচ্ছিস না?” সরাসরি প্রশ্নে কিছুটা ইতস্ততবোধ করল লাবণ্য, বলল, “আঙ্কেল, আসলে তোমার ভাগ্নের সাথে মনে হয় আমার যায় না। ছেলেরা যে এমন ঝগড়াটে হয় তাকে না দেখলে আমি বুঝতেই পারতাম না।” শফিক আঙ্কেল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “শোন মা, অনিকেত তো আমার ভাগ্নে। ওকে আমি হাড়েমজ্জায় চিনি। সুন্দর গাধা কাকে বলে জানিস?” “যারা দেখতে সুন্দর, কিন্তু মাথায় কিচ্ছু নেই।” “ঠিক বলেছিস। অনি হলো সুন্দর গাধা ক্যাটাগরির প্রথম শ্রেণির বাসিন্দা। মাকাল ফল টাইপ। দেখতে মারাত্মক সুন্দর, কিন্তু ওর ঘিলু বরাবরই একটু কম৷ বুঝলি?” লাবণ্য অনিকেতের এই নতুন বিশেষণে খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল। “খুব সুন্দর বললে তো আঙ্কেল, সুন্দর গাধা।” “এটা যেমন সত্যি তেমন আরেকটা সত্যি কথা বলি তোকে, অনির মাথায় বুদ্ধি কম বলেই হোক, অথবা যে কারণেই হোক ওর মধ্যে তুই কোনো ভাণ পাবি না। মুখে কোনো মুখোশ নেই। হম্বিতম্বি করলেও, মনটা ভীষণ সুন্দর।” এবার লাবণ্যর হাসি কিছুটা ম্লান হলো, সেটা বুঝতে পেরে শফিক আঙ্কেল আবার বললেন, “তুইও ভীষণ ভালো মানুষ। দুটো গুড সোল একসাথে হলে কী দারুণ একটা ব্যাপার হয় বলতো! প্লাসে প্লাসে অলওয়েজ প্লাস হয় কিন্তু।” “কিন্তু উনার সাথে তো আমার কিছুই মেলে না।” “এদিক দিয়েও দেখ না, মাইনাসে মাইনাসেও কিন্তু প্লাসই হয়। তোরা সব দিক দিয়েই পারফেক্ট ম্যাচ কিন্তু।” এতক্ষণ হেসে বললেও এবার সহসাই যেন অনেকটা গম্ভীর হলেন আঙ্কেল। ঠান্ডা গলায় বললেন, “দেখ মা, রাজি হয়ে যা, খুব একটা খারাপ হবে না তোদের জোড়াটা।” লাবণ্য এবার হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “আমি রাজি হতে পারি। কিন্তু আঙ্কেল, তোমার ভাগ্নে যদি আমার সাথে বেয়াদবি করে বা অসম্মান করে, আমি কিন্তু তাকে ছেড়ে কথা বলব না এই বলে দিলাম।” “তেমন হবার কথা না৷ তবে যদি হয় আমি নিজে তোর দলে থাকব৷ তুই চিন্তা করিস না মা।” শফিক আঙ্কেলের বুক থেকে একটা বিশাল বোঝা নেমে গেল৷ এত সহজে রাজি করাতে পারবেন ভাবেননি। যাক, পাত্র-পাত্রী দুজনই যখন রাজি তখন আর দেরি করার মানে হয় না৷ দুটোর একটারও মুড বিগড়ে গেলেই সব ভন্ডুল হয়ে যাবে। কোনো ঝুঁকি না নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই দুটোর গাঁটছড়া বেঁধে দিতে হবে! ………. (ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here