টিট ফর ট্যাট পর্ব-১৩

0
3023

#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_১৩

জেরিন প্রচন্ড অবাক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে দেখছে হৃদকে। হৃদ ফোনের ছবিগুলো তড়িঘড়ি করে ডিলিট করতে ব্যাস্ত। আমি মনে এক চিলতে আনন্দ আর চোখে ভীষণ আশ্রয় ভাব ফুটিয়ে তুলেছি। দেখছি হৃদের কাজ। জেরিন ফুলেফেঁপে উঠছে রাগে। তার পদ্মআঁখি ভয়ঙ্কর রূপ নিলো। আকস্মিক সে থাবা দিলো হৃদের হাতে। মুহূর্তেই হৃদ হাত উঁচু করে নিলো। নাগালের বাইরে চলে গেলো জেরিনের। জেরিন হঠাৎ চেচিয়ে বলে উঠলো

— হৃদ ভাইয়া তুমি কিন্তু ঠিক করছো না।

জেরিনের কথায় হৃদ আপন কর্ম সম্পাদন করে রয়ে সয়ে মাথা তুলল। উত্তপ্ত মেজাজ নিয়ে বলল

— আমি আমার মাকে খুব ভালোবাসি এটা তোর অজানা না। মা যদি এসব শোনে অসুস্থ হয়ে যাবে। আমার আর নীলিমার সমস্যা আমি বুঝবো তোর নাক গলাতে হবে না।

— একশো বার নাক গলাবো আমি। নীরবের প্রেমিকা হিসেবে আমার অধিকার আছে।

কথাটা জেরিন বলতে না বলতেই আচমকা হৃদ থাপ্পড় বসিয়ে দিলো জেরিনের গালে। আমি চমকে উঠলাম। তাদের দ্বন্দ্বের হেতু খুঁজে পেলাম না আকাশ পাতাল এক করেও। আকস্মিক থাপ্পড়ে বোধ হয় ঘাবড়ে গেছে মেয়েটা। সে টলমল চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে হৃদের দিকে। হৃদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো

— আম্মু তোকে আদর করে। তোকে এখানে এনেছে। বিয়ে খেয়ে চুপচাপ চলে যাবি। দ্বিতীয় বার আমার ভাইয়ের জীবনে প্রবেশ করার সাহস করবি না। বাচ্চা নষ্ট করার পর ভুল বুঝলি? নষ্ট মেয়ে।

কথাটা তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে বলে উঠলো হৃদ। আমি চরম অবাক হলাম। তাহলে এই কান্ড? ফেলে দেয় অবলীলায় আর ধোঁকা খেলে কুড়িয়ে নেয়! বাহ!

— কথায় বলে না, ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়। নীরবকে ঠকিয়ে বেশি দূর যেতে পারলেন না। সেই ছেলেটা আপনাকে পাটকেল মেরেছে। ঠকালে নিজেও ঠকতে হয়।

শেষ কথাটা হৃদের দিকে দৃষ্টি দিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলাম। হৃদ নত করলো দৃষ্টি। জেরিন যেন আমার কথায় আগ্নী রূপ নিলো। হঠাৎ তেড়ে এলো আমার দিকে। হাতের আঙ্গুল উঁচিয়ে শাসিয়ে বলল

— ইউ সেটআপ! বড় বড় কথা আসছে মুখে তাই না। তোমাকে আমি দেখে নেবো। নীরবকেও আমি আমার করে নেবো।

— আমিও দেখার অপেক্ষায় রইলাম। দেখি আপনি কি করে নীরবকে আপনার করেন।

পাল্টা জেদ নিয়ে বললাম। জেরিন মানতে পারলো না আমার কথা। সে আরো দ্বিগুণ রেগে বলল

— ও যদি আমার না হয় তোমারও হতে দেবো না আমি।

কথাটা বলে সে তেজ নিয়ে হৃদের থেকে নিজের ফোন কেঁড়ে নিলো। আবারও আমার দিকে শক্ত একটা চাহনি ফেলে গটগট করে চলে গেলো সে। আমি তাকিয়ে রইলাম তার যাওয়ার পানে।

— নীলিমা?

হৃদের কন্ঠ। আমি অবিচলিত ভাবে তাকালাম। হৃদ ক্ষণিক গোভীর চোখে দেখলো আমাকে। অতঃপর অত্যন্ত মোলায়েম কন্ঠে বলল

— আই মিস ইউ নীলিমা।

আমার ভালো লাগলো না তার এ কথা। আগের মতো জেদটাও তেড়ে এলো। এলো শুধু বিরক্ত। মনে ঝাঁক ঝাঁক বিরক্ত। আমি হৃদের দিকে তাকিয়ে বললাম

— আমি আমার স্বামী নিয়ে ভালো থাকতে চাই হৃদ। আমায় সুখে থাকার সুযোগ দাও। আমি টিট ফর ট্যাট গেইমের গুটি চেলেছি। প্লেয়ার হয়েছি। অর্ধেক খেলেছি। আর আমি জানি সফলও আমি। তোমার বুকে আগুন জ্বালিয়েছি।

— ঠিকই বলেছো তুমি। আমি হারিয়ে বুঝেছি। এখন খুব কষ্ট হয় আমার নীলিমা। সুযোগ থাকলে আমি…

— স্টপ ইয়ার। বাকি টুকু শুনতে চাই না। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। তুমি আমায় ছেরেছিলে বলেই আজ আমি একজন উত্তম জীবন সঙ্গী পেয়েছি। ধন্যবাদ তোমাকে।

কথাগুলো নির্লিপ্ত সুরে বলে হেলতে দুলতে চলে যাচ্ছি নিজ রুমে। ভালো লাগে না আর প্রতিশোধের কথা ভাবতে। সে তো পুড়ছে। খুব পুড়ছে। আমার দেওয়া শেষ উপহার ছিল একটা টি শার্ট। সেই শার্টটাই সে আজ দু’দিন হলো শরীরে দিয়ে আছে। আমি খেয়াল করেছি সে দু’দিন হলো রুমে বন্দি। বেরোয় না। বেরুলেও সময় নিয়ে আগের মতো বসে আড্ডা দেয় না মা, ভাইয়ের সাথে। আমার আর কিছু দেখার ইচ্ছে নেই। খুব করে একটাই ইচ্ছে এখন। নীরবকে নিয়ে সুন্দর একটা সংসার তৈরি করবো। যেখানে থাকবে শুধু ভালোবাসা, ভালোবাসা আর ভালোবাসা।

.
নীরব বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি মানুষটাকে। বলে দেবো সব। চাই না লুকোচুরি। পরে আরো ঝামেলা হবে এসব নিয়ে। ভাবতে ভাবতে বিছানার এক কোন থেকে উঠে দাড়ালাম। টলতে টলতে সোজা চলে গেলাম পড়ার টেবিলে। হাতে কলম আর টেবিলে খাতা নিয়ে বসে পরলাম। লিখতে শুরু করলাম লুকোনো কথা

প্রিয় স্বামী,

ভীষণ ভীষণ ভরসা করি আমি আপনাকে ডাক্তার। আপনার হাতটা আমি ছাড়তে চাই না কখনো। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত আমি আপনাকে পাশে চাই। আমায় কবরে নামানোর আগ পর্যন্ত পারলে আমি আপনার হাতটা ধরে রাখবো।

শুনুন ডাক্তার, আপনি যখন জেরিন মেয়েটার দিকে তাকান তখন মনে হয় আমি পৃথিবী ছেড়ে ভিন্ন গ্রহে চলে যাই। যেখানে শুধু জ্বালাপোড়া। খাক হয়ে যায় আমার অন্তর। আপনার দিকে সেদিন দুইটা মেয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। আমার মনে হলো ওদের চোখ তুলে এনে তেলে ভাজি। আনার ডাক্তারের দিকে নজর দেওয়ার সাহস হয় কি করে? আমার ভালো লাগে না ডাক্তার সাহেব। আমি হয়তো আপনার পার্মানেন্ট রোগী হয়ে গেছি। নীরবময় অসুখে আমার অন্তর আবিষ্ট।

আমি গুছিয়ে লিখতে পারছি না। আপনি কি আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন ডাক্তার? আমি এখন আপনাকে একটা ভয়ংকর কথা শোনাবো। মানিয়ে নিবেন তো আপনার বেগমকে? আমার সাহস হয়নি আগে বলার। ভীষণ ভয় লাগছিল। কিন্তু আপনি যদি অতি সহজে আপনার অতীত আমায় বিশ্বাস করে বলতে পারেন। তাহলে অবশ্যই আমারও পারতে হবে৷ আমার স্বামী আমার সবকিছুতে থাকবে।

এই নীলিমার একটা কলঙ্ক পরেছে মনে। ঠিক আপনার মতোই দগ্ধ হয়েছিল এই নীলিমা প্রেমাগুনে। আজ আড়াই মাস হবে তার সাথে বিচ্ছেদ হয়েছে আমার। কিন্তু বিশ্বাস করেন ডাক্তার প্রথমে ভেঙে গুড়িয়ে গেলেও আমি আজ শক্ত, সুস্থ সতেজ মনে আপনাকে চিঠি লিখছি। তা সম্ভবও হয়েছে শুধুমাত্র আপনি জন্য। আপনার যত্নে, আপনার আদরে, শাসনে আর দায়িত্ববোধে আমি পারিনি পাগল না হয়ে থাকতে। আচ্ছা ডাক্তার, দ্বিতীয় বার কি ভালোবাসা যায়? প্রেমে পরা যায়? হয়তো ভালোবাসা যায় বুঝলেন? আমি আপনাকে কঠিন রকমের ভালোবেসে ফেলেছি।

মনে যা আসলো লিখলাম। জানি না কি এলোমেলো কথা লিখেছি। তবে একটা কথা লিখতে গিয়েও লিখিনি। মন সায় দেয়নি কিছুতেই। হৃদের নাম উল্লেখ করতে পারিনি। সাহসে কুলোয় নি। থাক না কিছু অজানা! যদি এতে নীরবের আর আমার ভালো হয়।

চিঠিটা সুন্দর করে ভাঁজে মুড়ালাম। বসা থেকে উঠে আলমারির কাছে চলে গেলাম। অতি সতর্কতার সঙ্গে আলমারির পাল্লা খুলে নীরবের এপ্রোনটা বের করলাম। এপ্রোনের পকেটে চিঠি রাখলে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। চিঠিটা যথাস্থানে রাখতে রাখতে ভাবলাম কাল বাসায় চলে যাবো। নীরবের ঘুম ভাঙার পূর্বেই। কাল তার ক্লিনিকে কোনো কাজ নেই। একেবারে অবসর। ঘুম থেকে নিশ্চয়ই দেরিতে উঠবে। তবে অবশ্যই জেরিন কে বিদায় করে। ওর আশেপাশে আমি আমার ডাক্তারকে যেতে দেবো না। বেখেয়ালি মনে অগ্রিম কার্যক্রম ঠিক করে চলে এলাম বিছানায়। আলমারি থেকে নীরবের দেওয়া সাদা ওড়নাটাও এনেছি। মাথায় সুন্দর করে ঘোমটা দিয়ে শুয়ে পরলাম স্বামীর পাশে। একদম তার গায়ের সাথে গা লাগিয়ে। নীরব শিখিয়ে দিয়েছে, স্বামী স্ত্রীর শোয়ার মাঝে ফাঁক রাখতে নেই। শয়তান ডিসটার্ব করে।

চলবে…..

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here