পার্থক্য পর্ব-১২

0
1145

পার্থক্য

১২ পর্ব।

#রিফাত_হোসেন।

২০.
টেবিলের উপর ফোনটা রেখে ভাবনার জগতে চলে যায় রিফাত৷ সে এক অদ্ভুত জগৎ। সেখানে শুধু কাছে পেতে চায়। মন দিয়ে ভালবাসতে চায়। সেই জগতের বাসিন্দারা শুধু ভালবাসতে জানে। কখনও কাউকে ঠকানোর চিন্তা তাদের কল্পনাতে ও আসেনা। রিফাত মনে মনে ভাবছে যদি আমি আর তারিন সেই জগতে গিয়ে কিছুক্ষন সময় থাকতে পারতাম । তাহলে হয়ত তারিন কে বোঝাতে পারতাম আমি উনাকে কতটা ভালবাসি। উনি আমার কতটা জুরে আছে।
তারিনের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্তের কথা ভাবতেই রিফাতের ঠোঁটের কোণে অসম্ভব রকম রোমান্টিক হাসি ফুটে উঠে। সেই স্তব্ধ অন্ধকার রাতে দেখা হয়েছিলো। যার মুখে ছিলো সাংঘাতিক রকমের ভয়। আর ছেলেদের প্রতি অবিশ্বাস এবং ঘৃণা। তবুও মেয়েটার প্রতি এক অদ্ভুত ভাললাগা কাজ করেছিলো। চাঁদের আবছায়া আলো তারিনের মুখে এসে পড়েছিলো। নীরব পথ ধরে দু’জন হাঁটছিলাম। তখন খুব ইচ্ছে করেছিল একটা বার তারিনের হাত স্পর্শ করতে। কিন্তু সেই অধিকার নেই বলে তার চেষ্টাও করিনি।

২১.
দুলাভাই কী বলল?

তারিন ফোনটা রেখে তিশার দিকে রাগি মুড নিয়ে তাকিয়ে রইলো।

– ‘এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?’
– ‘ইচ্ছে করছে তোকে খুন করে ফেলতে।’
– ‘আমি কী এমন করেছি যার জন্য আমাকে খুন করবি।’
– ‘তুই উনাকে দুলাভাই কেন বললি?’

তারিন তিশার দিকে রাগি মুড নিয়ে তাকিয়ে থাকায় তিশা কিছুটা আমতা আমতা করে বলল – ‘ইয়ে মানে।’

তিশা কিছুটা ভয় পেয়েছে ৷ তাই তারিন আর রেগে না থেকে সাথে সাথে হেসে দিলো। দু’জনে কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে ঘুমিয়ে পরলো।

২২.
সকালে ঘুম থেকে তিশা বাড়িতে যাবে তখন তারিন বলল – ‘,এখন যাওয়া যাবে না।’

তিশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘কেন?’
– ‘সারাদিন আমার সাথে থাকবি।’
– ‘কেন?’
– ‘আমার একা একা ভাল্লাগেনা।’
– ‘আমি এখন যাই আবার পরে আসবো।’
– ‘ঠিক আছে, তবে সকালের খাবার আমাদের সাথে খেয়ে তারপর যাবি।’

তারিনের জেদের কাছে তিশা সবসময় হেরে যায়। তাই আর না করতে পারলো না – ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তবে খেয়েই আমি চলে যাবো। আবার মা কে বলে পরে আসবো।’
– ‘হু ঠিক আছে। চল ফ্রেশ হয়ে নেই।’

তিশা আর তারিন বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে খাবার ঘরে গিয়ে দেখে আমেনা বেগম বসে আছে। তারিন জিজ্ঞেস করলো – ‘বাবা কোথায় মা।’
– ‘তিনি একটু বাহিরে গেছে।’
– ‘আমাকে যে এখানে নিয়ে এসেছে। বিকেলে সে আসবে তোমাদের সাথে দেখা করতে।

আমেনা বেগম খুশি হয়ে বললেন – ‘সত্যি ‘
– ‘হ্যাঁ,
– ‘আচ্ছা তাহলে তোরা এবার খেয়ে নে।’

তারিন আর তিশা খেতে শুরু করলো। খাওয়ার মাঝে সবাই টুকটাক কথা বললেন। খাওয়া শেষ করে তিশা চলে গেল।

তারিন ঘরে এসে বসে রইলো। কিছুই ভাল্লাগছে না ওর। কিছুক্ষন টিভি দেখলো। তবুও ভাল লাগছে না। সব কিছু থেকে মন উঠে গেছে।
কিন্তু এভাবে চুপ করে বসে থাকতে তারিনের মোটেও ইচ্ছে করছে না । তাই রিফাতের‍ নম্বরে ফোন দেওয়ার জন্য মোবাইল হাতে নিলো।

২৩.
রিফাত ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল। অনেক আগে থেকেই একটা অভ্যাস তৈরি হয়েছে। ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বের হওয়া। সবাই এখনও ঘুমিয়ে আছে। তাই কাউকে আর না ডেকে ক্যামেরা হাতে নিয়ে উপর থেকে নিচে নামলো । নিচে এসে দেখে আরিফ সাহেব সোফায় বসে বসে চা খাচ্ছে। রিফাত কে দেখেতে পেয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল – ‘ আসসালামু-আলাইকুম রিফাত সাহেব।’
– ‘ওয়ালাইকুম-সালাম।’
– ‘এত সকালে ক্যামেরা হাতে কোথায় যাচ্ছেন?’
– ‘আসলে একটু হাঁটতে বের হচ্ছি।’
– ‘এক কাপ চা খান। একটু পর আমিও যাবো বাহিরে।’
– ‘একটু পরে গেলে আর সুন্দর সকাল টা পাবো না। সকালে প্রকৃতি আরও উজ্জ্বল দেখা যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে বৌ কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ভেজা চুলের ঘ্রান নেওয়ার মধ্যে যেমন ফিলিংস থাকে। তেমনি শীতের সকালে কুয়াশার আড়ালে হালকা সূর্যের তাপ শরীরে মেখে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেও অস্থির ফিলিংস আসে।

আরিফ সাহেব একটু মজা করার জন্য বললেন – ‘আপনার তো বৌ নেই, তাহলে এত কিছু কীভাবে যানেন?’
– ‘এগুলো আমার ফিউচার প্লান। তাই আগে থেকে সকালে হাঁটার অভ্যাস করে নিচ্ছি। বিখ্যাত এক বিজ্ঞানী অনেক পরীক্ষা করে জানতে পেরেছে আগে থেকে ফিউচার প্লান নিয়ে ভেবে রাখার মধ্যেও একটা রোমান্টিকতা থাকে।’

রিফাতের কথা শুনে আরিফ সাহেব হেসে উঠলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো – ‘তা সেই বিজ্ঞানীর নাম কী?’
– “বিজ্ঞানী আব্দুর রহমান”
– ‘ওনি আবার কে?’

রিফাত একটু হাসি দিয়ে বলল – ‘এই বিজ্ঞানী হলো আমার দাদা।’

রিফাতের কথা শুনে আরিফ সাহেব আবারও হেসে উঠলেন। আবার জিজ্ঞেস করলো – ‘তা এই বিজ্ঞানী কোন বইয়ের মধ্যে এই কথাটা লিখেছেন।’
– ‘এই বিজ্ঞানী কোন বইতে লেখেননি। তিনি আমার দাদির উপর এটা প্রয়োগ করেছিলেন। দাদি আমাকে যখন গল্প শোনাতো। তখন এটা বলেছিলো । দাদা প্রতিদিন সকালে দাদির ভেজা চুলের ঘ্রান নিতো। তারপর হাঁটতে বের হতো। সেই থেকে আমিও হাঁটতে বের হই। আর বিয়ের পর বাকিটুকু বৌ এর উপর প্রয়োগ করবো।’

– ‘সত্যি আপনি একটা জিনিস মাইরি। আপনার সাথে যত কথা বলি ততই ভাল লাগে।’
– ‘তাহলে আমি যাই।’
– ‘আপনি একা যাবেন কেন? আমিও তো বিয়ে করবো। আমার ও তো বৌ হবে। তাই আমাকেও আগে থেকে অভ্যাস করতে হবে।’
– ‘হা হা, আচ্ছা চালুন তাহলে।
দু’জনে মিলে নদীর পাড়ের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো।

কিছুদূর যাওয়ার পর রিফাত দেখতে পেলো উল্টো দিক থেকে তিশা হেঁটে আসছে। রিফাত আরিফ সাহেব কে জিজ্ঞেস করলো – ‘আরিফ ভাই আপনার ওনি ওদিকে কোথায় গেছিলেন। ওনার বাড়ি তো আপনার বাড়ির পাশে।’
– ‘আরে কালকে তো তারিনদের বাড়িতে ছিলো। সেখান থেকেই ফিরছে।’
– ‘ওহ্, তাই তো।

তিশা ওদের সামনে এসে আরিফ সাহেব কে বলল – ‘তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমাকে বললাম পুকুর পাড়ে যেতে। একটু পর বাবা এখান দিয়ে হাটে যাবে। যদি তোমাকে আর আমাকে এখানে দেখে ফেলে।’
– ‘দেখলে দেখুক, তাতে আমার কী।’
– ‘ বাড়িতে গিয়ে আমাকে মেরে ফেলবে।’
– ‘ইহ্, বললেই হলো নাকি। আমার বৌ কে মারবে এত সাহস আছে ওনার।’
– ‘আচ্ছা বাদ দেও। তা রিফাত ভাইয়া আপনি এই সকালবেলা ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঘুরছেন কেন?’
– ‘সকালের সৌন্দর্যগুলো স্মৃতি হিসেবে রাখার জন্য ছবি তুলতে এলাম।’
– ‘ইচ্ছে করলে এখানেই থেকে যেতে পারেন।’

রিফাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘মানে?’
– ‘আমাদের কাছে লুকিয়ে লাভ নেই। আমরা খুব ভাল করেই জানি আপনি আবার বান্ধবীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন।

তিশার কথা শুনে রিফাত লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকাতে লাগলো।

তিশা বলল – ‘তারিন আপনাকে কিছুটা হলেও পছন্দ করে তবে এখনও সেটা ভালবাসায় রূপ নেয় নি।
– ‘হ্যাঁ, তিশা ঠিক কথা বলেছে। কিন্তু আমি জানি, রিফাত সাহেব চেষ্টা করলে তারিনের ভালবাসা অর্জন করতে পারবে।’

রিফাত বলল – ‘তার জন্য ওনার সাথে আমার বেশি করে সময় কাটাতে হবে।’
– ‘সেটা নিয়ে আপনি ভাববেন না। আমি এবং আরিফ সব সময় আপনার পাশে আছি।’
– ‘ অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদের।’
– ‘ ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা সব সময় চাই তারিন যেন ভাল থাকে। আর এটাও জানি আপনি তারিন কে ভাল রাখতে পারবেন।’
– ‘কিন্তু তাকে সেটা বোঝাবে কে?’
– ‘এতে তারিনের কোন দোষ নেই। ও আশিক ভাইয়া কে খুব ভালবাসতো। তাই এখন আশিক ভাইয়া কে ও ভুলতে পারছে না। আশিক ভাইয়া ওকে যতই কষ্ট দিক। তবুও তারিনের হৃদয়ে তার নামটা রয়ে গেছে। সেখান থেকে এত সহজে তার নামটা মুছে ফেলতে পারছে না তারিন। তাই নতুন করে কাউকে বিশ্বাস করতে খুব ভয় পাচ্ছে। ওর মনে আপনার জন্য কিছুটা জায়গা তৈরি হলেও তা প্রকাশ করতে পারছে না। তবে চিন্তা করবেন না, ধৈর্য দরুন। একদিন ও ঠিক আপনাকে ভালবাসবে।
– ‘হুম’

হঠাৎ করে তিশা “বাবা” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। রিফাত পিছনে তাকিয়ে দেখে একটা মধ্যবয়স্ক লোক বাজারের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

আরিফ সাহেব বলল – ‘কাকা আপনি এখানে।’
– ‘হ্যাঁ, আমি। কিন্তু তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে কী করছো?’

তিশা আমতা আমতা করে বলল – ‘তারিন দের বাড়ি থেকে ফিরার সময় ওনাদের সাথে দেখা হয়। তাই একটু কথা বলছিলাম।’
– ‘গ্রামে অনেক মানুষের কাছে শুনেছি তোমাদের মাঝে কিছু একটা আছে। কিন্তু আমি অন্যের কথা বিশ্বাস করি না। আজ তোমাদের একসাথে নিজের চোখে দেখে মনে হচ্ছে গ্রামের মানুষরা ঠিক কথা বলেছে। সত্যি করে বল তোমাদের মাঝে কী সম্পর্ক?

একসাথে কথাগুলো বলল তিশার বাবা। আরিফ সাহেব এতক্ষন চুপ করে ছিলো। কিন্তু আর চুপ করে না থেকে বলল – ‘কাকা গ্রামের মানুষেরা আপনাকে কী বলেছেন তা আমি জানিনা। এবং জানতে ও চাই না। কিন্তু আপনি যে প্রশ্ন করলেন, তার উত্তর হলো আমি আর তিশা একে অপরকে ভালবাসি। আর এটাই আমাদের মাঝে সম্পর্ক।

আরিফ সাহেব ও তিশা দু’জনেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
মধ্যবয়স্ক লোকটা বলল – ‘ঠিক আছে। তোমরা এখন বাড়িতে যাও। পরে এই বিষয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে আলোচনা হবে।

এ’কথা বলে তিনি বাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
ওনারা দু’জনেই মধ্যবয়স্ক লোকটার হেঁটে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

তিশা বলল – ‘আমার খুব ভয় করছে। যদি তারা আমাদের সম্পর্ক মেনে না নেয়।’
– ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমি আছি তোমার সাথে।’

রিফাত লোকটার শেষ কথার মানে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু অনেক চেষ্টা করে’ও কোন মানে খুঁজে পেলো না।
রিফাত ভাবছে শেষের কথাটা কী ওনি রাগ থেকে বলল নাকি ওনি তিশা আর আরিফ সাহেবের সম্পর্ক মেনে নিয়েছেন। কেমন এক অদ্ভুত রহস্য নিয়ে শেষের কথাটা বলে চলে গেল।

আরিফ সাহেবের কথায় রিফাতের ভাবনার ছেদ পরলো।
– ‘আপনি আবার কী ভাবছেন?’
– ‘না, কিছুনা। চলুন আজকে আর হাঁটতে হবে না।’
– ‘আচ্ছা চলুন।’

তিনজনে মিলে আবার বাড়ির পথে হাঁটা দিলো। কারোর মুখে কোন কথা নেই। বাড়িতে এসে দেখে ফ্রেন্ডরা সবাই উঠে পড়েছে। চার্জ থেকে ফোনটা খুলে হাতে নিতেই বড়সড় একটা টাস্কি খেলো রিফাত। ম্যাসেজ বক্সে ঢুকে তো আরও অবাক হয়ে গেলো। কয়েকটা ম্যাসেজ পরতেই রিফাতের মাথা চক্কর দিতে শুরু করলো। অতঃপর ধপাস করে বিছানায় বসে পরলো।

চলবে…………….?

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। লিখার পর চেক দেওয়ার সময় পাইনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here