টিট ফর ট্যাট পর্ব-১৬

0
2968

#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_১৬

— বের হন তাড়াতাড়ি। ছেলে মানুষ হয়ে এতো সময় লাগে গোসল দিতে? আপনি কি আজ ওয়াশরুমেই থাকবেন? সবাই মাঠে গেলো!

ওয়াশরুমের দরজায় মৃদু থাপ্পড়ের জোয়ার তুলেছি। নীরব প্রায় এক ঘন্টা হলো গোসলে গেছে। বেরোনোর কোনো নামই নেই। আমি ভীষণ বিস্মিত। একটা ছেলের গোসল করতে এতো সময় লাগে?

— ঈদের দিন আজকে ভুলে গেছো?

ঝুম ঝুম পানির ধ্বনির সাথে নীরবের কন্ঠ ভেসে এলো কানে। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম

— হ্যা আপনি বরং সংসার গড়েন ওখানে। সবাই নামাজ পরে শেষ করলো।

কথাটা বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওয়াশরুমের দরজার দিকে। ওরে স্বামী এখন তো একটু বের হ! আমি গোসল করবো কখন? আমার অসহায় ভাবনা। এমন করে ঠাঁই দাড়িয়ে থাকার পর প্রায় পাঁচ মিনিট পর নীরবের মর্জি হলো। দরজা খুলে বেরিয়েই স্নিগ্ধ বদনে হৃদয় দুলিয়ে দেওয়া একটা হাসি দিলো। আমার ছোট্ট ভীতু হৃদপিণ্ড তার হাসির ঝুঁকি খুব কষ্টে সামলিয়ে উঠলো। ধুকপুক ধুকপুক সুরে সে মাতাল হলো। আমি তড়িঘড়ি করে চোখ নামিয়ে নিলাম। তার স্নিগ্ধ জলে ভেজা ঠোঁট দেখে কি আমার ঈর্ষা হওয়া উচিত?

— এখন তো তুমিই সরছো না। আমার সময় নষ্ট হচ্ছে সরো।

নীরবের কথায় আমার অবিচ্ছেদ্য বাচ্চমো ভাবনায় ছেদ পরলো। চটজলদি সরে এলাম তার সম্মুখ হতে। সে আমায় পেরিয়ে সোজা বিছানায় গেলো। উন্মুক্ত বুকে সাদা গেঞ্জি চাপিয়ে যেই না চোখ ফেলল পাঞ্জাবিতে তখনই তার চোখে অবিশ্বাস্য চকচক করে উঠলো। আমি মুখ বাকিয়ে অন্য দিকে নিলাম। সে তড়িৎ বেগে সাদা পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে বলল

— নীলিমা? আমার পাঞ্জাবি সাদা কেন? কফি কালারটা কোথায়?

আমি স্বামীর বিচলিত ভাবের বিপরীতে সম্পূরণ গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে বললাম

— সকালে ভিজে রেখেছি। ধুয়ে দেবো এখন।

আমায় কথায় যেন সে আফসোসে কেঁদেই দেবে। অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে বলল

— এমন কেন করলা বউ। আলগা সেবাটা না করলেও পারতা। তুমি জানো? কফি কালার আমায় কত বেশি মানায়? আম্মু কিনে দিয়েছিল রোজার ঈদে।

— তো? আপনার সাদাটাই পরে মাঠে যেতে হবে। এতো রূপ নিয়ে ঘোরাঘুরি করা যাবে না। কাল একটা ছাই রংয়ের শার্ট পরেই বুড়ি মানুষের নজরে আটকে গেছিলেন। আজ আরো রংধনু পরে যান। সবাই গিলে খাবেনি।

প্রচন্ড মেজাজ নিয়ে বললাম কথাগুলো। বুঝিনাা, এতো তো ধবধবে নয় সে তবুও সবার নজরে আটকে যায়। তার চেয়ে আমিই বেশি ফর্সা। অথচ আফসোস! কেউ আমার বিয়ে আনলো না।

— ওহ তুমি ইচ্ছে করেই পানিতে ভিজাইছো? নীলিমা? এতো হিংসুটে কেন তুমি? চৌদ্দ দিনেই তুমি আমার জীবন ত্যানা ত্যানা করে দিলা। ভবিষ্যতে কি করবা কে জানে?

গোমড়া মুখে কথাগুলো বলতে বলতে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে পরে নিলো নীরব। আমার একটুও লাগলো না তার কথা। স্বামী যদি সুন্দর হয় তাহলে তাদের সব কথা গায়ে মাথতে নেই। বরং উল্টো চিন্তা করতে হয় কিভাবে তার রূপ অন্যের চোখে মলিন করতে হয়। নীরব ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে তার ঝাকড়া চুল গুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। আমি অনিমেষ তাকিয়ে আছি। বেচারার কি মন খারাপ করে দিলাম? ভাবতেই আমার মনটায় জুড়ে বসলো একরাস অশান্তি। আচমকা চলে গেলাম ওয়াড্রপের নিকট। তাদের গ্রামের এই এক তলা বাড়িটার দক্ষিণের ঘর আমার আর নীরবের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। মৃদু মন্দ হাওয়ায় আমার মনটা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এটা হয়তো একটু বেশিই হয়ে গেছে। ঝটপট একটা নীল পাঞ্জাবি নিয়ে এগিয়ে গেলাম নীরবের নিকট। নীরব মাত্রই আতরের ছোট শিশি খুলেছে। আমি খপ করে নিয়ে নিলাম তার হাত থেকে। তার সম্মুখ দাড়িয়ে ঝটপট খুলতে লাগলাম পাঞ্জাবির বোতাম। নীরব আমার কান্ডে বিরক্ত। অনিচ্ছায় বাঁধা দিতে দিতে বলল

— কি করছো। সরো।

— না। আপনি নীল পাঞ্জাবি পরে যাবেন।

— পরতে হবে না। তোমার আবার হিংসায় বুক ফেটে যাবে।

— যাবে না। যদি আমার ডাক্তার কারো দিকে না তাকায়।

আমার কথায় নীরব পরিপূর্ণ শান্ত ভাবে ডুবে গেলো। মুচকি হেসে বলল

— বিশ্বাস নেই?

আমি তার পাঞ্জাবিটা টেনে খুলে দিলাম। বিছানা থেকে নীল পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে তার মাথার উপর দিতে দিতে বললাম

— খুব বেশি নেই। ছেলেরা পিছলা যায় অতি তাড়াতাড়ি। এদের মায়াদয়া খুব কম বউয়ের উপর।

আমার কথায় নীরব বুঝি মজার পুকুর পেলো। ঝাপিয়ে পড়ে সশব্দে হেসে দিলো। আমি মুখটা বাকিয়ে মিনিট খানেক তাকিয়ে দেখলাম তাকে। মাশা আল্লাহ! ‘নীলে নীলময় নীলিমার নীরব।’ কথাটা সাজিয়ে হেসে উঠলাম আপন মনে। তার পাঞ্জাবির কলারটা নিভাঁজ করে দিয়ে বললাম

— সালামি দিবেন না?

নীরব হাতা গুটাতে ব্যাস্ত ছিল। আমার কথায় মুখটা উঁচু করে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। মুখে বলল

— সালামি কাকে বলে?

— ঢং করেন? জানেন না সালামি কাকে বলে? এতো কোন কথা নেই। এই যে হাত পাতলাম আমার টাকা চাই।

কথাটা বলেই হাত বাড়িয়ে দিলাম নীরবের দিকে। সে কুঁচকানো ভ্রু যেন সোজা করার কথা ভুলেই গেলো। আমায় উপেক্ষা করে আয়নায় নিজের চুল নিয়ে ব্যাস্ততা দেখিয়ে বলল

— সালামি নেয় ছোটরা। তুমি কি ছোট?

আমার এবার ভীষণ রাগ হলো। তাকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে সোজা আয়নার সম্মুখে দাড়ালাম। তার দিকে কড়া দৃষ্টি দিয়ে বললাম

— সালামি দিবেন কিনা বলেন।

নীরব হেসে উঠলো। মজা বাড়িয়ে সে আমার অগ্রসর করা দেওয়া হাতে টুপ করে চুমু দিয়ে বলল

— দিলাম। এর চেয়ে ইউনিক আর সুন্দর সালামি হতেই পারে না।

কথাটা বলে সে বিছানা থেকে টুপি তুলে নিলো হাতে। মাথায় অতি সন্তর্পণে দিতে দিতে বলল

— আসছি।

আমি মুখ গোমড়া করে বললাম

— আসার সময় দোয়া নিয়ে আসবেন।

আমার কথায় নীরব মৃদু অবাকে পা থামিয়ে দিলো। কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলো

— কি দোয়া?

— আমি যেন পরকালে আপনার হই। শুধুই আমি। কোনো হুর আপনার আশেপাশে যেন না থাকে। মোনাজাতে বলবেন ” হে আল্লাহ আমি আমার নীলিমাকেই চাই। আমার কোনো হুর না শুধুই আমার নীলিমাকে চাই। একটা জান্নাত আমাকে আর আমার নীলিমাকে দিয়ে দিয়েন।”

শুকনো মুখে অভিমানী কন্ঠে বললাম। হাতের আঙ্গুল আমার শাড়ির আঁচলে পেঁচাতে ব্যাস্ত আমিকে হঠাৎ নীরব জরিয়ে ধরলো। ভালোলাগায় মন আবেগে ভেসে গিয়ে অশ্রু ছেড়ে দিলো। আমি চুপটি করে মুখ লুকিয়ে রাখলাম নীরবের বুকে। সত্যি বলতে আমার বুকটা ফেটে যায় যখন ভাবি মৃত্যুর পর আমার এই তীব্র ভালোবাসার মানুষটাকে হুরেরা নিয়ে নেবে। আমি মানতে পারি না সহ্য হয় না। আমার মাথা বুকে চেপে ধরে নীরবকে বলতে শোনা গেলো

— আচ্ছা আমি এই দোয়াটাই করবো। আরো বলবো, আমার নীলিমার আগে যেন আমাকে মৃত্যু ডাক দেয়। নীলিমার আগে যেন আমি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই।

নীরবের এই কঠিন কথাটা হজম করতে পারলাম না আমি। আচমকা এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম তাকে। দু’জনের মাঝে দু’হাত ফারাক এলো। নীরব ছিটকে দূরে গিয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। মেজাজ আমার তুঙ্গে উঠে গেলো। এলোমেলো হয়ে গেলাম আমি। মানে কি? ঈদের দিন কি তার এমন উদ্ভট কথা না বললে হয় না। আমি ঝাঁজালো কন্ঠে বললাম

— যান আপনি মাঠে। আপনি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যান। ঈদের দিনও আপনার এমন কথা বলতে হবে?

নীরব আমার আচরণে সেকেন্ড কয়েক থ হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎই হো হো করে হেঁসে দিলো। রাগ আমার বেড়ে যেন দ্বিগুণ।

— রাগ করে না বাবু…. এই তো নাও সালামি দিচ্ছি। রাগ করে না। সরি এমন কথা আর বলবো না।

কথাগুলো বলতে বলতে নীরব প্যন্টের পকেট থেকে পুরো ওয়ালেট আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। আমার ইতিমধ্যে চোখে অশ্রু চলে এসেছে কড়া অভিমানে। মুখ ভার করে বললাম

— লাগবে না আমার।

নীরব ঠোটে সেই একই হাসি ঝুলিয়ে জোর করে হাতে ধরিয়ে দিলো ওয়ালেট। আমার কানের পিঠে গুঁজে রাখা একগুচ্ছ ছোট চুল যত্ন করে ছাড়িয়ে এলোমেলো করে দিয়ে বলল

— তুমি যখন কাজ করো তখন এই ছোট গুলো ভীষণ ডিস্টার্ব করে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি ভীষণ মিষ্টি লাগে তখন তোমায়।

কি মুহূর্তে কি কথা? আমি আমার চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী হা করে তাকালাম নীরবের দিকে। সে আজ উচ্চ স্বরে উগ্র মেজাজ না দেখিয়ে চমৎকার একটা হাসি দেখালো। আমার অবাক প্রহর মধ্যপর্বে। সে এমন সময় হুট করে আমার চিবুকের তিলটায় চুমু দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটলো। যেতে যেতে বলল

— তোমার চোখ আর চিবুকের তিলটা আমার নেশা ধরায় নীলিমা।

আমি এতোক্ষণ পর মুখ টুপ করে বন্ধ করে নিলাম। হেসে ফেললাম আপন মনে। এ বেচারাও লজ্জা পায়? হাসতে হাসতে হাতের ওয়ালেটা খুলে চোখ ফেলতেই আমি বোকা বনে গেলাম। এমনও চালাক মানুষ হয়? মুহূর্তেই আমার হাসি বিলীন হয়ে মুখে নেমে এলো ভাবশূন্যতা। বিশ্বাস করুন পুরো ওয়ালেট জুরে একাটা পাঁচ টাকার কয়েন ব্যাতিত কিছুই নেই। জামাই আমায় এভাবে ঠকাবে ভেবেই আমার মাথায় আইসপ্যাক দিয়ে সটান শুয়ে থাকার বাসনা হলো। কি করা উচিত আমার এই পাঁচ টাকা? দৌড়ে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। কতদূর গেছে নীরব? লম্বা গলির মতো উঠান পেরিয়ে বাইরে আসতেই দেখি উনি হেলে দুলে যাচ্ছে। হঠাৎ পেছন ফিরে তাকালো। তাকিয়েই একটা হাসি দিলো। দুষ্টু হাসি। আমার গলা উঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করলো

” আপনি দিন দিন অসভ্যর সাথে চরম কিপ্টা হচ্ছেন ডাক্তার! ”

সাথে এটাও বলতে ইচ্ছে হলো

” ওমন হাসি ঝুলিয়ে রাস্তা দিয়ে চলবেন না প্লিজ! আপনার সুন্দর ঠোঁটর হাসিতে মেয়েরা আরো বেশি করে তাকিয়ে থাকবে আপনার দিকে। আমার তখন প্রচুর হাশফাশ লাগবে, বুকের মধ্যে অবাধ্য হিংসাত্মক ঝড় উঠবে। ”

চলবে…….

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। জানি না কেমন আকাইম্মা হলে আজকের দিনেও গল্প লেখা যায় 🥱 যাই হোক ঈদ মোবারক।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here